একটি গরুর আত্মকাহিনি

গরু বিষয়ে একটি বাংলা রচনা সাধারণত শুরু হয় এভাবে: গরু গৃহপালিত চতুষ্পদ প্রাণী। গরুর চারটি পা, দুটি শিং, দুটি কান, দুটি চোখ আর একটি লম্বা লেজ আছে। লেজের অগ্রভাগে এক গোছা চুল। লেজ দ্বারা গরু মশা-মাছি তাড়ায়।
গরু খুব শান্ত ও নিরীহ প্রাণী। গাভি বছরে একটি বাছুর প্রসব করে আর বাছুরকে অত্যন্ত ভালোবাসে। গরু ঘাস, লতাপাতা, খড়, কলাই, ডাল, খৈল, ভাতের মাড়, গমের ভুসি, চালের কুড়া ইত্যাদি খাইয়া থাকে।
গরুর দুধ আদর্শ খাদ্য। ইহার মাংস খাদ্য হিসাবে খুবই পুষ্টিকর ও সুস্বাদু। জীবিত ও মৃত উভয় অবস্থাতেই গরু আমাদের অনেক উপকার করে। তাই ইহাদের প্রতি আমাদের সবার যত্নশীল হওয়া উচিত।
এ রকম একটা রচনা শিক্ষকের হাতে এলে তিনি রচনা লেখককে এই বলে ধমক দেন—গুরুচণ্ডালী দোষ আছে তোমার লেখায়, অর্থাৎ উড্ডীয়মান পক্ষী ধপাস করিয়া তুলা খেতে পড়িয়া গেল। অথবা লাল কালির দাগ দিয়ে মন্তব্য করেন—একই রচনায় সাধু ও চলিত ভাষার মিশ্রণ দূষণীয়। কথাগুলো সত্য হলেও এতে আমাদের কিছুই যায় আসে না। তবে গরুর রচনায় ছাত্ররা যা লেখে না তা-ই বলার জন্য আমি বর্তমান আত্মকাহিনি রচনা করেছি।
স্বর্ণকমলপুর জেলার ছোট্ট গ্রাম শিয়ালুতে আমার জন্ম। আমার মা-বাবার পালনকর্তাদের পরিবারটা ছিল ছোট। স্বামী-স্ত্রী, একটা ছেলে আর একটা মেয়ে। জন্মের পর থেকেই তাদের সঙ্গে বেড়ে উঠেছি। তাদের খেলার সঙ্গীও ছিলাম। এখন ওরা বড় হয়েছে, আমিও।
আমার পালনকর্তা আবদুল কুদ্দুস একজন গরিব মানুষ। নিজের জমি নেই বলে অন্যের জমি বর্গা নিয়ে চাষ করে। ফসলের ভাগ যা পায় তা দিয়ে সংসার চলে না। তার বউ গ্রামের সম্পন্ন এক জোতদারের বাড়িতে কাজ করে, কিছু টাকা-পয়সা পায়, মাঝেমধ্যে ভাত-তরকারি নিয়ে আসে ছেলেমেয়ের জন্য।
শিয়ালুতে একটা নদীবন্দর আছে। দেশের উত্তর আর দক্ষিণ অঞ্চলে যেতে বন্দর থেকে গাড়িগুলো ফেরিতে পার হয়। বন্দরে বড় বড় লঞ্চ আসে। জাহাজ আসে না, তবে একসময় আসত, সে অনেক দিন আগের কথা।
গ্রামের কাজকর্ম না পেলে আমার পরিবারের কর্তা আবদুল কুদ্দুস বন্দরে চলে যায়। কুলিগিরি করে দু-চার টাকা পায়। কুলিগিরি না পেলে ফালি শসা কিংবা আমড়া বিক্রি করে।
বন্দরে যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও যাওয়া হয়নি কখনো। কে নিয়ে যাবে, কেন-ই বা নেবে? তবে বন্দরের কাছাকাছি বড় সড়কে যাওয়া হয়। আমার পালনকর্তার ছেলে আবদুস শহীদ ঘাস খাওয়াতে আমাকে ওখানে নিয়ে যায়। সড়কের নিচেই লম্বা খাদ। কচুরিপানা আর নানা জাতের জলজ আগাছায় ভরা। পানা সরালেই টলটলে পানি। তেষ্টা পেলে ঢুক ঢুক করে খেয়ে নিই। বড় সড়ক দিয়ে হাজার হাজার গাড়ি যাওয়া-আসা করে। দেখতে খুব ভালো লাগে, তবে ওগুলোর শব্দে মাঝেমধ্যে কান ঝালাপালা হয়ে যায়।
বড় সড়কের দুই পাশে অনেক গাছ ছায়া দিচ্ছে সারা দিন। অনেক ফলের গাছও আছে। বাচ্চা ছেলেদের উৎপাতে গাছের ফল বড় হতে পারে না। কাঁচা ফল পেড়ে খায় ঢিল ছুড়ে।
ক্লান্ত হয়ে পড়লে শহীদ আমাকে খুঁটার সঙ্গে বেঁধে রেখে গাছতলায় ঘুম লাগায়। মাঝেমধ্যে লম্বা ঘুম দেয় সে। বেলা পড়ে গেলে আমাকে নিয়ে ঘরে ফেরে। তার মা খুব বকে। বলে, ‘কাম-কাইজ ফালাইয়া তুই সারা দিন কী করলি?’ শহীদে কিছু বলে না। ভাত-টাত খেয়ে মায়ের সবজি খেতে কাজ করে। তার বোন রহিমাও কাজ করে তার সঙ্গে। শহীদ একবার শহরে গিয়ে পুরোনো একটা বাংলা সিনেমা দেখেছিল। সেখানে একজন রহিমা খালাকে পেয়েছিল। সেই থেকে রহিমাকে সে রহিমা খালা বলে খেপাত। এ নিয়ে ভাইবোনের মধ্যে ঝগড়া লেগে যেত। তাদের মা মারধর করে তাদের ঝগড়া থামাত।
সেই সময় গ্রামে খরা হলো খুব। ফসলের জমি ফেটে একেবারে চৌচির। ফসল ফলল না। কাজকর্মের অভাবও হলো খুব। কুদ্দুস মিয়ার বউয়ের একলার কামাইয়ে সংসার চলে না। খাবারে টান পড়ে। শহীদ আর রহিমা কান্নাকাটি করে। সহ্য করতে না পেরে তাদের বাপ-মাও কাঁদে। টান পড়ে আমার খৈল-পানিতে। শুধু ঘাস-পাতা খেয়ে শরীর টিকতে চায় না। একসময় ঘাস পাতারও অভাব দেখা দেয়। সবকিছু দেখে-শুনে আমার চোখে পানি আসে।
একদিন কুদ্দুস মিয়ার এক বন্ধু আসে। নাম আবদুল করিম পরামানিক। ঢাকায় থাকে। তার গলা জড়িয়ে ধরে আবদুল কুদ্দুস খুব কাঁদে, কাঁদে আবদুল করিমও। কুদ্দুস মিয়া বলে, ‘করিমরে অখন আমি কী করুম, পুলাপানেরে কী খাওয়ামু, কী পিন্দামু।’ শুনে করিম বলে, ‘কান্দিস না তুই। তরে আমি ঢাকা লইয়া যামু। আশুলিয়ার যে গার্মেন্টসে আমি কাম করি সেখানে তরে কাম জুটাইয়া দিমু। আমাগো মালিক খুব ভালো…।’
তখন থেকে আবদুল কুদ্দুস গার্মেন্টসে কাজ করে। তাদের সংসারটা একটুখানি খাড়া হয়েছে। কুদ্দুস মাঝেমধ্যে বাড়িতে আসে। ছেলেমেয়ে আর বউয়ের জন্য এটা-ওটা কিনে আনে। বয়স একটুখানি বেশি হয়ে গেলেও শহীদ আর রহিমা স্কুলে ভর্তি হয়।
তখনই শুরু হয় গণ্ডগোল। বড় সড়কের পাশে যখন ঘাস খেতে যাই—গাড়ি ঘোড়া চলতে দেখি না। মাঝেমধ্যে আগুনে পুড়তে দেখি গাড়ি। মানুষই পোড়ায়। এত সাধের আর এত দামের গাড়ি তারা কেন পোড়ায়? গাড়িগুলো তো তাদের নিজেদেরই—কোনো জন্তু জানোয়ারের নয়, অর্থাৎ আমাদের নয়। দলে দলে মানুষ রাস্তার পাশের গাছ কেটে রাস্তার ওপর ফেলে দেয়। গাড়ি চলতে পারে না। পুলিশ এসে গাছ সরায়। তাদের নিজেদের চলাচলের রাস্তা কেন বন্ধ করে তারা? রাস্তা তো জন্তু জানোয়ারের জন্য বানানো হয়নি, অর্থাৎ আমাদের জন্য বানানো হয়নি। তরতাজা গাছগুলোই বা তারা কাটে কী করে? গাছ তো তারা নিজেদের প্রয়োজনেই লাগায়। তাদের কি একটুও মায়া হয় না? মানুষই তো আবিষ্কার করেছে গাছেরও প্রাণ আছে। গাছ তো তাদেরই ছায়া দেয়, অক্সিজেন দেয়, আসবাবের কাঠ দেয়, জ্বালানি দেয়, ফল দেয়, ফুল দেয় এমনকি ঔষধি গাছ প্রাণ বাঁচানোর উপাদান দেয়। একটা গাছ বড় হতে কত দীর্ঘসময় লাগে। কাটা তো যায় চোখের পলকে!
আবদুল কুদ্দুস একদিন বাড়ি ফিরে আসে। মুখে তার হাসি নেই, সঙ্গে জিনিসের পোটলা নেই। বউ-পোলাপানকে সামনে পেয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে সে। যে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে সে কাজ করত সেটা নাকি কারা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। শুনে আমি অবাক হয়ে যাই। কোটি কোটি টাকা খরচ করে মানুষ ওগুলো বানায়, হাজার হাজার শ্রমিক খাটে, কাপড় তৈরি হয়, সেই কাপড় বিদেশের বাজারে বিক্রি করে ঘরে কাঁড়ি-কাঁড়ি টাকা আসে। তাহলে সেই টাকা আনার কারখানা মানুষ পোড়াবে কেন?
টাকার অভাব হয় কুদ্দুস মিয়ার। ধারের চেষ্টা করে। কোথাও পায় না। মাথা তার খারাপ হয়ে যায়। শুধু কাঁদে আর কাঁদে। একদিন তার বউ তাকে বলে, ‘গরুডা বেইচা দ্যান। হেই ট্যাকা দিয়া দোকান করেন একটা বাড়ির সামনে, তাতে হাতে ট্যাকা আসপো কয়ডা।’ এ কথা শুনে শহীদ আর রহিমা খুব কান্নাকাটি করে। বলে, ‘আমরা গরু বেচপার দিমু না। সে আমাগো বন্ধু। তারে লইয়া আমরা খেলি।’ ছেলেমেয়ের ওই কথা শুনে তাদের মা কেঁদে জারজার হয়। কাঁদে তাদের বাবাও, কিন্তু সবার ক্রন্দন বৃথা যায়।
কুদ্দুস মিয়া আমাকে একদিন শিয়ালুর হাটে নিয়ে যায়। গরুর ব্যাপারী কিনে নেয় আমাকে। আমার বুকটা ফেটে যায়। কত দিন ছিলাম ওই পরিবারের সঙ্গে। তারা আমাকে লালনপালন করেছে, খাইয়েছে, স্নেহাদর দিয়েছে, তাদের পেটেই খালি হই নাই, আর কিছুতে তাদের সঙ্গে আমারও কোনো পার্থক্য ছিল না।
গফুর মিয়ার বাড়িতে অনেক গরু। শিগগিরই এক ট্রাক গরু সে চট্টগ্রাম পাঠাবে। কিন্তু হরতাল-অবরোধের কারণে পাঠাতে পারছে না। হরতাল কী, অবরোধ কী জানা নেই আমার; শুধু এইটুকু বুঝতে পারছিলাম জীবন তার স্বাভাবিক গতি হারিয়েছে, বিঘ্নবাধা সৃষ্টি হয়েছে সর্বত্র। কেন আমি জানি না। গরু বলেই হয়তো জানি না, জানোয়ার বলে হয়তো জানি না, মানুষ হলে জানতাম।
গফুর মিয়া আমাদের বসিয়ে-বসিয়ে খাওয়ায়। গাঁট থেকে বাড়তি পয়সা খরচ হতে থাকে তার। একদিন ট্রাক ড্রাইভার গফুর মিয়াকে খুব সাহস দেয়। বলে, ‘এক ট্রাক মাল রেডি করেন। সকালে গাড়ি ছাড়ুম, রাইতে-রাইতে চট্টগ্রাম পৌঁছিয়া যামু।’ বিরক্ত গফুর মিয়া রাজি হয়। ১৫টা গরু নিয়ে ট্রাক চট্টগ্রাম রওনা হয়।
সকাল থেকে ট্রাকটা চলছে তো চলছেই। সন্ধ্যার দিকে সীতাকুণ্ড পৌঁছালে ড্রাইভার হেলপারকে বলে, ‘আর চিন্তা নাই, ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে বহদ্দারহাটে যাওন যাইব। যানজটফট কিচ্ছু নাই।’ এ কথায় আমরাও স্বস্তি পাই। রাস্তার দুইপাশের দোকানপাটের বাতি দেখি। লোকজনের চলাচল তেমন একটা নেই। হুশ হুশ করে গাড়ি চলে যাচ্ছে একটা-দুটো। আমাদের ট্রাকটা চলছিল ধীর গতিতে।
হঠাৎ রাস্তার বাঁ পাশ থেকে চুপিসারে দুজন যুবক এগিয়ে আসে। তাদের হাতে ছোট ছোট দুটো জিনিস। ওগুলো কী ঠাহর করার আগেই যুবকদ্বয় জিনিসগুলো আমাদের দিকে ছুড়ে মারে। চোখের পলক পড়তে না পড়তেই স্পষ্ট দেখি, পুরো ট্রাকে আগুন ধরে গেল। সামনের দিকটাতে অগ্নিশিখা ঊর্ধ্বাকাশে ছুটে চলার সঙ্গে সঙ্গে গরুগুলো হাম্বা হাম্বা করে চিৎকার করে উঠল, জবেহ হয়ে যাওয়ার পূর্বক্ষণ তারা যেভাবে চিৎকার করে।
দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে গাড়ি থেকে লাফ দিয়েছিলাম। আমার সঙ্গে লাফ দিয়েছিল আরও কয়েকটা গরু। তীব্র তাপে পুড়ে যাচ্ছিল আমার গা।
কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান হারাই। জ্ঞান ফেরার পর দেখি পুড়ে মরা ১০-১২টা গরু টেনে-টেনে খাদে ফেলছে লোকজন। উঠে দাঁড়ানোর শক্তি আমার ছিল না। পায়ের তীব্র ব্যথা থেকে অনুমান করেছিলাম, নিশ্চয়ই আস্ত নেই ওগুলো।
আমার পাশে দাঁড়িয়ে আহাজারি করছিল গরুর ব্যাপারী আবদুল গফুর, ‘এই অবাগা জন্তু গুলানের অফরাধ কী? তাগো কেন পুড়াইয়া মারল?’
আমার মনেও ওই একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল। আমাদের কেন মারল ওরা? কদিন পরে তো কষাইখানার ছুরির নিচে এমনিতেই প্রাণ যেত আমাদের।
এ রকম যখন ভাবছিলাম তখন একজন লোক এগিয়ে এল আমাদের দিকে। বলল, ‘দেখ, দেখ এই গরুটা বেঁচে আছে। উঠাও ওকে, পশু হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।’ তখন আরেক ধন্ধে পড়তে হলো আমাকে। এই লোকটা আমাকে বাঁচাতে চাইছে কেন? এদের দুই জাতভাই-ই তো আমাদের ওপর পেট্রলবোমা ছুড়েছে। তাহলে এই মারা ও বাঁচানোর মধ্যে নিশ্চয়ই একটা কিছু আছে, হয়তো তার নাম পলিটিকস বা রাজনীতি! ঠিক জানি না আমি। গরুর পক্ষে তো আর সবকিছু জানা সম্ভব নয়!
এই ঘটনার পর বাচ্চা ছেলেদের গরুর রচনায় কোনো পরিবর্তন আসবে কি? ওখানে কি লেখা হবে, হরতাল–অবরোধের সময় মানুষের মতো গরুদেরও পুড়ে মারা হয়; কিন্তু কাজটা করা মোটেও উচিত নয়, কেননা গরু আমাদের অনেক উপকার করিয়া থাকে। হয়তো রচনাটা গুরুচণ্ডালী দোষে দুষ্ট হবে। চলতি ভাষার সঙ্গে সাধু ভাষা ঢুকিয়ে দেবে অসতর্ক ছাত্র; কিন্তু তাতে আমরা কিছুই মনে করব না…।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!