একটি ঐতিহাসিক গল্প

তৌহিদুর রহমান টিপু সুলতানের মৃত্যুর পরের ঘটনা। ভারতবর্ষ থেকে স্বাধীনতার শেষ সূর্যরশ্মী তখন  ডুবে যেতে বসেছে। শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে দক্ষিণ ভারতের সামান্য অংশে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার জন্য চলছে মুসলিম কমিউনিটিতে তীব্র বিষ-বেদনা। সুতীব্র দহনে দগ্ধ হচ্ছে মুসলিম সমাজ। দক্ষিণ ভারতের সামান্য এক চিলতে ভূখণ্ডে মরণপণ লড়ছে মুসলমানরা। একদিকে অহিংস আন্দোলনের আড়ালে চলছে মুসলিম নিধন। অন্যদিকে ইংরেজ অপশক্তি কুটকৌশলে মুসলমানদের রক্ত নিয়ে খেলছে ছিনিমিনি। যেন আগ্নেয়গিরির উত্তপ্ত লাভার স্রোত বয়ে চলেছে মুসলমানদের উপর দিয়ে। একদিকে ইংরেজ রাজশক্তি অন্যদিকে তাদের সুবিধাভোগী এ দেশীয় মুসলিম বিদ্বেষী শক্তি। অসহায় নারী-শিশুর আর্তনাদে ভারি হয়ে উঠেছে ভারতবর্ষের আকাশ-বাতাস। রক্তের বন্যা ছুটে চলেছে বিভিন্ন জনপদে। লাশের মিছিল তখন বিভিন্ন মুসলিম জনপদে। নিরস্ত্র মুসলমানদের নির্দয়ভাবে হত্যা করছে দেশীয় ও ভিন দেশীয় মিলিত শক্তি। রক্তের ঢেউ বয়ে চলেছে নীলামপুরমের আঁকাবাঁকা পাহাড়ী নদী দিয়ে। ট্রেনে বোঝাই করে এনে লাশের পর লাশ ফেলা হচ্ছে বালেশরম ও নীলামপুরমের মতো নদীগুলোতে। লাশের পচা গন্ধে বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে।
হাজার হাজার শকুন উড়ছে মুসলিম জনপদে। লক্ষ লক্ষ নারী, শিশু, বৃদ্ধ বেরিয়ে পড়েছে পথে সামান্য একটু আশ্রয়ের সন্ধানে। তাদের সামনে চলার সব পথ যেন রুদ্ধ। এরই মাঝে বিশাখাপত্তমে মস্তক খাড়া করে উঠে দাঁড়ালো কিছু মুসলিম যুবক। তারা তাদের জাতিকে অন্তত জানে বেঁচে থাকতে সাহায্য করতে চায়। পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে চায় নিরাপদ আশ্রয়ে। তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিশাখাপত্তমের গভর্নর তানজির জায়েদ। সুলতানকে বাঁচাতে গিয়ে যিনি কিছুদিন আগে মারাত্মকভাবে আহত হয়ে পড়েছিল লড়াইয়ের ময়দানে লাশের স্তূপে। শত্রুরা ভেবেছিল সে মরে গেছে। সত্যিই মরার দশাই হয়েছিল তানজির জায়েদের। অবশেষে শত্রুরা চলে গেলে অজ্ঞান অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে আনা হয়েছে তার খাস কামরায়। সেখানে তার চিকিৎসা চলছে খুব সংগোপনে। ২. তানজিরের জ্ঞান যখন ফিরে এলো তখন সে চোখ মেলে দেখল, তাঁর বাড়ির ভেতরের একটি রুমে আসহায়ভাবে পড়ে আছে সে। হাত পা তার অসাড়! কিছুই সে নড়াতে পারছে না। তাহমিনা, বাড়ির কাজের লোক ও ডাক্তার সাহেব তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সে একটু ভালো করে চোখ মেলে দেখল বেশ রাত হয়ে গেছে। তার কামরায় একটি টেমি জ্বলছে। যারা দাঁড়িয়ে ছিল তাদের দিকে সামান্য ক্ষণ তাকাবার পর তানজিরের চোখ গিয়ে পড়ল তাহমিনার মুখের উপর। তন্দ্রাচ্ছন্নের মতো নীরব নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল তাহমিনা। তৃষ্ণায় তানজিরের কলিজা চৌচির হয়ে যাচ্ছে। সে ক্ষীণ কণ্ঠে পানি চাইল। পানির গ্লাস ভরে সাঈদ জলদি করে পানি আনলো। মইনুল তানজিরকে ধরে তুলে বসালো।
তানজির উঠে অল্প একটু পানি পান করার পর আবার মাথা রাখলো বালিশে। ডাক্তার সাহেব তার ব্যাগ থেকে একটি বড়ি বের করে হাতের তালুতে রেখে তানজিরকে উদ্দেশ্য করে বললো, এই ট্যাবলেটটা খাওয়ার পরে হয়তো কিছুটা ভালো লাগতে পারে। তারপর আরো একটা ছোট ট্যাবলেট তাহমিনার হাতে দিয়ে ডাক্তার সাহেব ব্যাগটি সরিয়ে রাখলো। একটু পানি সমেত তাহমিনাকে সেটা খাইয়ে দিতে বললো। তাহমিনা কিছু সময় বাদে ট্যাবলেটটা তানজিরকে খাইয়ে দিল। একটা একটা করে ওষুধ গিলে নিলো তানজির এসব কথার কোনো জওয়াব না দিয়ে। ডাক্তারের দিকে কৃতজ্ঞার দৃষ্টিতে সে তাকাতে লাগলো। তাহমিনা এখন অনেকটা আশান্বিত হয়ে তাকাতে লাগলো স্বামীর মুখের দিকে, যে এতক্ষণ প্রায় দুঃখ-বেদনা ও হতাশার আকাশ মাথায় নিয়ে ভাবছিল আকাশ পাতাল। ডাক্তার তাহমিনার দিকে দৃষ্টি দিয়ে বললো, প্রতি দিন তিন বারে একটা করে ওষুধ পানির সহকারে খাওয়াতে হবে। ফজরের নামাজ বাদে আমি আরও একবার এসে দেখে যাবো। ডাক্তার সাহেব তানজিরকে সান্ত্বনার সুরে বললো, আহত স্থানটা আমি আধা ঘণ্টা ধরে দেখেছি। জখম গভীর, তবে জীবন সংহারক নয়। ব্যথার ও ঘুমের ওষুধ দিয়েছি। আশা করি এর মধ্যে রোগীর ঘুম এসে যাবে। গুলি বেরিয়ে যাবার কারণে পায়ের যখম তেমন গুরুতর নয় বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। মাথার আঘাতটাও অতটা মারাত্মক নয়।
সময়মতো রক্ত বন্ধ হলে রোগীর অবস্থা এতটা কঠিত হতো না। অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণের কারণে রোগীর এই অবস্থা হয়েছে। ডাক্তারকে উদ্দেশ্য করে তানজির জায়েদ বললো, ডাক্তার সাহেব, আপনার জন্য সময় যথেষ্ট মূল্যবান। এখন বিশাখাপত্তমের প্রতিটি মুসলিম পরিবারে অসংখ্য আহত মানুষ অসহায়ভাবে কাতরাচ্ছে। আপনার উচিত প্রতিটি ঘরে প্রতিটি পরিবারে খোঁজ নেওয়া। ডাক্তার সাহেব তাঁর ব্যাগটি হাতে তুলে নিতে নিতে বললো, সারা রাজ্যে ছড়িয়ে পড়েছে যে, সুলতান শহীদ হয়েছেন। কয়েক মিনিট নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থেকে এরপর ডাক্তার আর কিছু না বলে বেরিয়ে চলে গেলো। ডাক্তার চলে গেলে প্রথমে মহিমা হাত ইশারা করে তানজিরের দিকে এগিয়ে গেলো। পরে অন্যেরা সবাই তার পিছনে পিছনে গেলো। তানজির জায়েদ তাহমিনার দিকে তাকিয়ে অলক্ষে হাত বাড়িয়ে দিলো। একটু এগিয়ে গিয়ে তাহমিনা মাথাটি রাখলো তানজিরের বুকের উপর। তানজির জায়েদ চোখ বুজে নীরবে তাহমিনার লম্বা চুলের মধ্যে আঙুল চালনা করতে লাগলো। চোখ না খুলেই বললো, তাহমিনা, মনে হচ্ছে আমি মৃত্যুর দরজায় করাঘাত করে ফিরে এসেছি। আমি চাপা পড়েছিলাম অনেক লাশের নিচে। সেখান থেকেই আমি তোমার কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছিলাম। এখন সব ঘটনা আমার কাছে একটা স্বপ্ন মনে হচ্ছে। আজ থেকে দেড়শো বছর আগে মুর্শিদাবাদের উপর দিয়ে এই ধরনের একটা টর্নেডো বয়ে গিয়েছিলো। তখন আমাদের পূর্ব পুরুষরা মহীশূরের আকাশে দেখেছিলেন নতুন আলোর ঝিলিক। হয়তো সেজন্য তারা এসেছিলেন এই বিশাখাপত্তমে।
কিন্তু এখন বিশাখাপত্তমে নেমে এসেছে যে মহাদুর্যোগ, তাতে এখানে এখন পূর্ণিমার চাঁদের আলো খোঁজার চেষ্টা করা বৃথা। এখন এখান থেকে স্বাধীনতার নিশান হাতে যারা বেরিয়ে যাবে ভয়াবহ অন্ধকার ছাড়া তাদের সামনে আর কিছুই হয়তো থাকবে না। তাহমিনা, তুমি যে নিকসকালো অন্ধকার দেখে এখানে চলে এসেছিলে সেখানে আর হয়তো কখনো স্বাধীনতার সূর্য উঁকি দিবে না। তবে মুসলমানরা জীবন দিয়ে হলেও স্বাধীনতার জন্য প্রাণ-পণে লড়ে যাবে। এখানকার অন্য জাতির মানুষ তাদের ভাগ্য নিয়ে আজ সন্তুষ্ট থাকতে পারে। কিন্তু আমি পারি না। আমরা পারি না। মদীনা থেকে শুরু করে আজ অবধি মুসলমানরা মানুষের স্বাধীনতার জন্যে লড়াই করে চলেছে। তারা হেরে যেতে পারে কিন্তু তারা কখনো নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে না। বিশাখাপত্তমের গৌরব শান্তির নিশান আজ আবার অন্ধকারে তলিয়ে যেতে বসেছে। তাহমিনা, তোমার অনুরাগ, প্রেরণা আর সাহচর্য আমার জীবনের প্রতিটি ক্ষণ ছিলো আনন্দে ভরপুর। কিন্তু আমি যদি আগে জানতাম, আমার জাতির ভাগ্য মীর সাদিকের মতো শয়তান-গাদ্দারের হাতে বন্দী হয়ে আছে, তাহলে আমি কখনো তোমাকে জীবনসাথী করতাম না। তোমাকে নিয়ে যখন আমি স্বপ্ন দেখেছি তখন বিশাখাপত্তমের আকাশে ছিলো সোনালি আলোর ঝলকানি। তখন আমি চেয়েছিলাম সারা দুনিয়ার অনুরাগ আর ভালোবাসা তোমার পায়ের কাছে নিয়ে এসে আমি জড় করবো। কিন্তু তুমি দেখতে পাচ্ছো আজ আমার আকাশ এক লুণ্ঠিত জাতি, তাদের এ দেশীয় দোসর ও মীর সাদিকের মতো গাদ্দারদের দখলে।
এখন আমার কাছে এক সাগর অশ্রুধারা ছাড়া আর কিছুই নেই। লাশের স্তূপের নিচে যখন পড়েছিলাম তখন আমি অনেক বার মনে মনে বলেছি, এই পরাজিত জাতির আর্তচিৎকার শোনার আগে যদি আমি শহীদ হয়ে যেতাম। আমার রক্তধারা লাশের স্তূপ গড়িয়ে যখন নিচের দিকে ধাবিত হচ্ছিল তখন একটা কথায় ভাবছিলাম যদি মরবার আগে আমি তোমাকে কোনো নিরাপদ জায়গায় রেখে যেতে পারতাম! মনে মনে এমন এক নিরাপদ স্থান আমি তালাশ করে ফিরছিলাম মীর সাদিকের মতো হীন গাদ্দার ও দেশদ্রোহিদের কোনো লোভের আগুন যেখানে নেই। তানজিরের কথা শুনতে শুনতে তাহমিনার বুকের ভেতর চোপ রাখা মর্মবেদনা করুণ কান্নায় রূপান্তরিত হয়ে আর্তনাদ রূপে বেরিয়ে এলো। তানজিরের বুক থেকে তাহমিনা যখন মাথা তুললো তখন তার দু’গণ্ড অশ্রুর বন্যায় ভেসে যেতে দেখা গেল। তাহমিনা তানজিরের দিকে তাকিয়ে বেদনাবিধূর স্বরে বললো, তুমি জান আমার জন্মভূমি ইতালি নয়, বিশাখাপত্তম। আমার নিজের ব্যাপারে আমার কোনো অভিযোগ নেই এবং কখনো ছিলোও না।  আনন্দঘন সুখের যে দিনগুলো আমি তোমার সাথে কাটিয়েছি তা আমার জীবনের সব থেকে মূল্যবান সম্পদ। তা ছিল আমার কাছে মহামূল্যমানের। মণি-মুক্তা, হিরা-জহরত, সোনা-রূপার সাথে তুলনা করে তাকে আমি মূল্যহীন করে তুলতে চাই না। তাই তোমার সাথে আগামী দিনের গহীন অন্ধকারতম পথের দিকে চলতে আমার কখনো পা কাঁপবে না। আমাদের জন্য যদি বিশাখাপত্তমের মাটি সংকীর্ণ হয়ে যায়, তাহলে তোমার সাথে শহীদ হতে আমি তৈরি আছি। আর যদি মহান আল্লাহর দয়ায় কোনোভাবে বেঁচে যাই তাহলে বিশাখাপত্তমের এই সুখস্মৃতি সেখানেও আমাকে দান করবে অপার আনন্দ।
আমি প্রথম কাবেরীর নদীর তীরে কোনো এক পাহাড়র ওপর দাঁড়িয়ে তোমার সাথে দেখেছিলাম বিশাখাপত্তমের এই অপরূপ সৌন্দর্য্য। তোমার সাথে যে আনন্দময় দিনগুলো আমি কাটিয়েছি চার দেওয়ালের মাঝে, তা আমার পরবর্তী জীবনের সময়কে ভরিয়ে রাখবে অসম্ভব মায়া-মমতায়। না তাহমিনা! আমি ছেড়ে যাবো না বিশাখাপত্তম। মহান সুলতান টিপুর শরীরের রক্ত যে মাটির ওপর ঝরে পড়েছে, আমি বঞ্চিত হতে চাই না সেই মাটিতে দাফন হবার সৌভাগ্য থেকে। যদি আল্লাহ আমার হায়াত দারাজ করেন তবে মরবার আগে বিশাখাপত্তমের অবশিষ্ট কাজ সমাপ্ত করে যেতে চাই। এখানে বহু কাজ আমার পড়ে রয়েছে। বিশাখাপত্তমের শহীদানের রূহের কসম, যে গাদ্দারেরা বিশাখাপত্তমের জনগণের মান-সম্মান ও স্বাধীনতাকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে আমি তাদেও কাউকে ছাড়বো না। আমি মনে করি এই শকুনের দল ফিরিঙ্গি লুটেরাদের সাথে মিলে আমাদের দেহের রক্ত আর গোশত খুবলে খেতে পারবে না। আমাদের জাতির একজন বেঁচে থাকতেও এটা আমরা হতে দেবো না। তানজির আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো, এমন সময় কে যেনো দরজায় শব্দ করলো। তানজির চুপ করে গেলো। তাহমিনা  জিজ্ঞেস করলো, কে ওখানে? দরজা খোলা ছিলো। ভিতরে উঁকি মেরে সাঈদ বললো, জি, দুধ এনেছি। নিয়ে এসো। তাহমিনা  বললো। তানজিরকে লক্ষ্য করে সাঈদ বললো, আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ খবর আছে জনাব। তানজির বললো, কি খবর জলদি করে বলো। সাঈদ দুধের কাপ তাহমিনার হাতে দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। হাত ধরে তুললো তাহমিনা, তানজির জায়েদকে এবং দুধের কাপটা তার মুখের সামনে তুলে ধরলো।
মাত্র দু’এক চুমুক দুধ পান করে তানজির জায়েদ আবার বিছানায় শুয়ে পড়লো। এ অবস্থা দেখে সাঈদ দুধের কাপ নিয়ে চলে যেতে উদ্যত হলো, কিন্তু তানজির জায়েদ তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, সাঈদ, কি জরুরি খবর আছে বলে যাও। সাঈদ বললো, না মানে আপনার শরীরের যা অবস্থা! এখন না হয় থাক এসব কথা। তানজির বললো, আমার শরীর নিয়ে ভাবতে হবে না, ভাবো দেশ নিয়ে, জাতি নিয়ে। সেকথা তো বলতে এসেছিলাম। বললো সাঈদ। তানজির কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বললো, তা না বলে ফিরে যাচ্ছো কেন? একটু মুখ কাচুমাচু করে সাঈদ বললো, বিশাখাপত্তমের দক্ষিণ অংশের তিনটি গ্রামে ফিরিঙ্গি দলের দালালরা হামলা চালিয়ে কিছু মন্দির ও ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। আর এর সব দায় চাপিয়েছে মুসলমানদের ওপর। এই অজুহাতে ফিরিঙ্গি ফৌজ ও তাদের এ দেশীয় দালালরা মিলে সারা শহরে মুসলমানদের ওপর হামলে পড়েছে। আগুন লাগিয়ে দিয়েছে মুসলমানদের বাড়ি-ঘরে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। অতর্কিত আক্রমণে সাধারণ মুসলমানরা দিশেহারা হয়ে পড়েছে। রক্তের বন্যা বয়ে যাচ্ছে শহর জুড়ে। লাশের পর লাশ ভাসতে দেখা গেছে বালেস্বর, নীলামপুরম ও কাবেরী নদীতে। গাড়িতে করে লাশ নিয়ে ফেলা হচ্ছে নদীতে। তারপর… সাঈদকে থামিয়ে দিয়ে তানজির জায়েদ বললো, সাঈদ, ওপর তলার কামরা থেকে আমাদের সব বন্দুক, ছোট তোপ ও বারুদ নিয়ে এসে আমার সামনে রাখো। অকেজো বন্দুক ঠিক করার ব্যবস্থা করো। তাহমিনা বললো, তার আগে তোমাকে এর চাইতে কোনো নিরাপদ জায়গায় রেখে এলেই কি ভালো হতো না? শহরে তো তোমার অনেক বন্ধু আছে? তানজির জায়েদ বললো, বিশাখাপত্তমের একজন মুসলমানের গৃহই নিরাপদ নয় আজ আমার জন্য। সাঈদ দ্রুত ছয়টি বন্দুক, তিনটি ছোট কামান ও বারুদের দশটি প্যাকেট এনে তানজির জায়েদের সামনে রেখে বললো, জনাব! হুকুম হলে বন্দুকগুলোতে কার্তুজ ভরে দেই।
তা না হলে গুণ্ডারা এসে পড়লে সময় পাওয়া যাবে না। হ্যাঁ, জলদি করো। বললো তানজির। সাঈদ মেঝেতে বসে এক এক করে বন্দুকগুলোতে কার্তুজ ভরে তানজির জায়েদের মাথার পাশে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে রাখতে লাগলো এবং ছোট কামানগুলোয় বারুদ ভরে পায়ের দিকে রেখে দিলো। উঠে দাঁড়িয়ে সাঈদ বললো, মইনুল বাইরের দরজায় পাহারা দিচ্ছে। তার কাছে কোনো বন্দুক ছিলো না, আমার বন্দুকটা আমি তাকে দিয়ে এসেছি। যদি অনুমতি হয় তাহলে এখান থেকে একটা বন্দুক আমি নিতে পারি। তানজির জায়েদ বললো, না। আমার পক্ষ থেকে তুমি সকলকে হুকুম দিয়ে দাও, ফিরিঙ্গি ও তাদের দালালরা যদি কেউ বাড়িতে প্রবেশ করার চেষ্টা করে, তাহলে কেউ যেনো বাধা না দেয়। তোমাদের জীবন বিপন্ন করে আমার জীবন বাঁচাতে হয়তো তোমরা পারবে না। কেউ ভিতরে ঢুকতে চাইলে তোমরা শুধু আমাকে সংবাদটা পৌঁছে দিও।  তারপর আমি…। তানজির জায়েদ আরো কিছু বলতে গিয়েও পারলো না। থেমে গেলো। সাঈদ কিছুক্ষণ দ্বিধান্বিত হয়ে তানজির জায়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো, জনাব, আমার একটা অনুরোধ। বলো। তানজির জায়েদ বললো। সাঈদ বললো, আমার একটা অনুরোধ, দুশমন এসে গেলে আপনি দয়া করে সদর দরজা বন্ধ করে দেবেন না। তাহলে আমরা কেউ আর ভেতরে ঢুকতে পারবো না। আমার দেহে প্রাণ থাকা অবধি আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই। লড়ে যেতে চাই জীবন পণ। আমি জান্নাতে যেতে চাই। তা হয় না, সাঈদ! তুমি এখন নিরাপদ স্থানে চলে যাও! তানজির জায়েদ অত্যন্ত তীক্ষè কণ্ঠে বললো। অশ্রু ভেজা চোখে সাঈদ তানজির জায়েদের দিকে তাকিয়ে দরজার দিকে চললো মাথা নিচু করে। তানজির জায়েদ বললো, একটু দাঁড়াও সাঈদ। সাঈদ পিছন ফিরে থমকে দাঁড়ালো।
তাহমিনাকে লক্ষ্য করে তানজির জায়েদ বললো, তাহমিনা, আম্মাজানের যে ঝুলা আমাদের কাছে দিয়েছিলো, তা কোথায় রেখেছো? তা উপর তলার সিন্দুকে পড়ে রয়েছে। বললো তাহমিনা। জলদি করে নিয়ে এসো। বললো তানজির। দ্রুত কামরা থেকে বেরিয়ে গেলো তাহমিনা। অল্পক্ষণ পর মখমলের একটা ঝুলা নিয়ে ফিরে এলো তাহমিনা। শুয়ে থেকেই ঝুলাটি তানজির জায়েদ তাহামিনার হাত থেকে নিলো। সেটা খুলে তা থেকে কিছু সোনার গহনা বের করে সাঈদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো, তুমি জীবনে আমার কথা অমান্য করোনি। আশা করি আজও করবে না। এটা রাখো, বিপদে কাজে লাগবে। না নিলে আমি রাগ করবো। কষ্ট পাবো। তাহমিনা একটু এগিয়ে এসে গহনাগুলো তানজিরের হাত থেকে নিয়ে সাঈদের হাতে দিলো। আরও কিছু গহনা বের করে তানজির জায়েদ, সাঈদ আলীর দিকে হাত এগিয়ে দিয়ে বললো, এগুলোও নিয়ে যাও সাঈদ! মইনুল, রেজ্জাক ও সখীনাকে দু’টি করে দিয়ে দিও। তাদেরকে বুঝিয়ে বলো, যেনো কিছুদিন এগুলো লুকিযে রাখে। এগুলো অনেক দামি। সাঈদ আলী গহনাগুলো হাতে নিয়ে কয়েক মুহূর্ত নিবিষ্ট মনে তানজিরের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো, জনাব, মনে হচ্ছে আপনি আমাদেরকে রেখে কোথাও যেতে চাচ্ছেন। কিন্তু আপনার শরীর তো ভালো নয়? এ অবস্থায়? না সাঈদ তোমাদেরকে ছেড়ে আমি যাবো না কোথাও। তানজির জায়েদ জবাব দিলো। এসব মূল্যবান গহনা তাহলে কেন আমাদের দিচ্ছেন? সাঈদ বললো।
খোদার কসম! এখন এখান থেকে একটু যাও। আমাকে একটু একা থাকতে দাও। তানজির জায়েদ তিক্ত কণ্ঠে বললো। সাঈদ এ তিক্ততার কারণ বুঝলো না। সে একবার তানজির জায়েদের দিকে, একবার তাহমিনার দিকে তাকিয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও কামরা থেকে বেরিয়ে গেলো। সাঈদের দু’গণ্ড বেয়ে ঝরতে লাগলো অশ্রু। কি করবে সে যেন ভেবে কুল-কিনারা করতে পারছে না। ৩. সারা দক্ষিণ ভারতের সমস্ত মুসলিম জনপদ ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হয়েছে। মুসলমানদের মসজিদ, মাদরাসাসহ সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, খানকা ইত্যাদি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। বৃদ্ধ, শিশু, নারী কাউকেই রেহাই দেয়া হয়নি। হত্যা আর লুণ্ঠন চালানো হয়েছে সর্বত্র। নারীদের চরমভাবে লাঞ্ছিত করা হয়েছে। শস্য ক্ষেত জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, যে মুসলমানরা বিগত ছয়শো বছর ধরে নিজেদের জীবন বিপন্ন করে তার প্রতিবেশীদের জান-মালের হেফাজত করে এসেছে, জাত-পাত প্রথা উচ্ছেদ করে একই পাত্রে, এক সাথে বসে খাবার খাওয়ার রেওয়াজ চালু করে পশু সংস্কৃতি বিলোপ করে মানুষকে দিয়েছে সত্যিকারের মানুষের মর্যাদা সেই তারাই আজ ফিরিঙ্গিদের সাথে হাত মিলিয়ে মুসলমানদের জীবন সংহারের উন্মত্ত খেলায় মেতে উঠেছে। চারদিক থেকে ঘিরে ফেলা হয়েছে বিশাখাপত্তমের গভর্নর ভবন। হাজার হাজার দাঙ্গাবাজ শিবাজীভক্ত তার সাথে অত্যাধুনিক কামানসহ কয়েক হাজার ফিরিঙ্গি সৈন্য। চারদিক থেকে মুহুর্মুহু নারা লাগানো হচ্ছে, হিন্দু ইংরেজ ভাই ভাই মুসলিম তোদের রক্ষা নাই। বিশাখাপত্তমের এই ভবন শুধু মাত্র একটা গভর্নর ভবন নয়, এর সাথে আছে অস্ত্রাগার, আছে টাকশাল, আছে দশ লক্ষাধিক বইয়ের একটি সমৃদ্ধ পাঠাগার, আছে পৃথিবী বিখ্যাত মিউজিয়াম। কিন্তু হায়! এর রক্ষকরা আজ কেউ আর দুনিয়াতে বেঁচে নেই।
মীর সাদিকের মতো কিছু গাদ্দারের সহযোগিতায় তাদের অনেকেই হয়েছে গুপ্ত হত্যার শিকার  আর অধিকাংশ সুলতানের সাথে যুদ্ধের ময়দানে নিজেদের জীবন তুলে দিয়েছে মহান মালিকের হাতে। এখন এই বিশাখাপত্তমের বিশাল গভর্নর ভবন একদম খাঁ খাঁ করছে। শুধু মাত্র আহত গভর্নর তানজির জায়েদ, তার চিরজনমের সাথী তাহমিনা আর দু’একজন কাজের লোক ছাড়া এখন কেউ নেই এই বিশাল গভর্নর ভবনে। শিবাজী ভক্তরা হৈ হল্লা করে আস্ফালন করছে চারদিকে। ইংরেজ সৈন্যরা অজনা শঙ্কায় আক্রমণ করতে সাহস পাচ্ছে না। শিবাজী ভক্তরা কূটকৌশলে আগুন লাগিয়ে দিল গভর্নর ভবনের এক প্রান্তে। সাঈদ দ্রুত ভেতরে ফিরে এসে সে খবর পৌঁছে দিল তানজির জায়েদের কাছে। অবস্থা বেগতিক দেখে মইনুল ও সখীনা সদর দরজা আগেই বন্ধ করে দিয়েছে। তারাও চলে এসেছে অন্দর মহলে। তানজির জায়েদ তাদেরকে লক্ষ্য করে বললো, আমাকে ধরাধরি করে চিলে কোঠায় নিয়ে চলো। সদর দরজা সহজে শত্রুরা ভাঙতে পারবে না। এক এক করে বন্দুক, কামান ও কার্তুজ নিয়ে গিয়ে জমা করো চিলে কোঠায়। তার কথামতো সবকিছু করা হলো।
তাহমিনা ও সাঈদের ঘাড়ে ভর দিয়ে তানজির জায়েদ পৌঁছে গেলো চিলে কোঠায়। ক্রমেই ধোঁয়ার কুণ্ডলি চারদিক আচ্ছন্ন করে ফেলছে। কিছুই দেখা যাচ্ছে না কোন দিকে। তানজির জায়েদ সবার হাতে একটা করে বন্দুক তুলে দিলো। তাহমিনাকে তার পাশে বসে কামানে বারুদ ভরে দিতে বললো। তাহমিনা তাই করতে লাগলো। তানজির জায়েদ ধোঁয়ার কুণ্ডলির বাইরে মুহুর্মুহু কামানের গোলা নিক্ষেপ করতে লাগলো। সাঈদ ও মইনুল বন্দুকে কার্তুজ ভরে শত্রুদের দিকে মারতে লাগলো। সখীনা নির্বিকার দাঁড়িয়ে ছিলো। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো চতুর্দিক থেকে আগুন। নিমেষে গ্রাস করে ফেললো সমস্ত গভর্নর ভবন। চারদিকে শুধু আগুন আর আগুন। সহসা তাহমিনা জড়িয়ে ধরলো তানজিরকে। তার শরীরের একাংশে আগুনের উত্তাপ লাগতে শুরু করেছে। হঠাৎ অদৃশ্য থেকে একটা বন্দুকের ছররা এসে লাগলো তানজিরের চোখে। পড়ে গেলো তার হাত থেকে কামান। সেও দু’হাতে আকড়ে ধরলো তাহমিনাকে। এক নিমেষে আগুনের লেলিহান শিখা গ্রাস করে নিলো সব কিছু। তানজির তাহমিনাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো, মিনা, আমরা আরেক জগতে চলে যাচ্ছি! বলো, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ…! তাহমিনা অস্ফুটো স্বরে বললো, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।
 লেখক : কবি, সাহিত্যিক
সত্যই সমুজ্জ্বল

সত্যই সমুজ্জ্বল

wi-fi বিড়ম্বনা !

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *