এমনি তো কিছুকাল যায় । কিন্তু এই তিনটে বিদেশী যুবক কোনো নিয়মের মধ্যেই ধরা দেয় না । যেখানে যখন ওঠা , বসা , মুখ ফেরানো , উপুড় হওয়া , চিৎ হওয়া , মাথা নাড়া , ডিগবাজি খাওয়া উচিত , ইহারা তাহার কিছুই করে না বরং সকৌতুকে নিরীক্ষণ করে এবং হাসে । এই – সমস্ত যথাবিহিত অশেষ ক্রিয়াকলাপের মধ্যে যে – একটি দিগ্গজ গাম্ভীর্য আছে ইহারা তদ্দ্বারা অভিভূত হয় না ।
একদিক টেক্কা সাহেব গোলাম আসিয়া রাজপুত্র, কোটালের পুত্র এবং সদাগরের পুত্রকে হাঁড়ির মতো গলা করিয়া অবিচলিত গম্ভীরমুখে জিজ্ঞাসা করিল , “ তোমরা বিধানমতে চলিতেছ না কেন । ” তিন বন্ধু উত্তর করিল , “ আমাদের ইচ্ছা । ” হাঁড়ির মতো গলা করিয়া তাসরাজ্যের তিন অধিনায়ক স্বপ্নাভিভূতের মতো বলিল , ইচ্ছা? সে বেটা কে ? ইচ্ছা কী সেদিন বুঝিল না, কিন্তু ক্রমে ক্রমে বুঝিল । প্রতিদিন দেখিতে লাগিল, এমন করিয়া না চলিয়া অমন করিয়া চলাও সম্ভব , যেমন এদিক আছে তেমনি ও দিকও আছে — বিদেশ হইতে তিনটে জীবন্ত দৃষ্টান্ত আসিয়া জানাইয়া দিল, বিধানের মধ্যেই মানবের সমস্ত স্বাধীনতার সীমা নহে । এমনি করিয়া তাহারা ইচ্ছানামক একটা রাজশক্তির প্রভাব অস্পষ্টভাবে অনুভব করিতে লাগিল । ঐ সেটি যেমনি অনুভব করা অমনি তাসরাজ্যের আগাগোড়া অল্প অল্প করিয়া আন্দোলিত হইতে আরম্ভ হইল — গতনিদ্র প্রকাণ্ড অজগরসর্পের অনেকগুলা কুণ্ডলীর মধ্যে জাগরণ যেমন অত্যন্ত মন্দগতিতে সঞ্চলন করিতে থাকে সেইরূপ ।
নির্বিকারমূর্তি বিবি এতদিন কাহারো দিকে দৃষ্টিপাত করে নাই , নির্বাক্ নিরুদ্বিগ্নভাবে আপনার কাজ করিয়া গেছে । এখন একদিন বসন্তের অপরাহ্নে ইহাদের মধ্যে একজন চকিতের মতো ঘনকৃষ্ণ পক্ষ্ম ঊর্ধ্বে উৎক্ষিপ্ত করিয়া রাজপুত্রের দিকে মুগ্ধনেত্রের কটাক্ষপাত করিল । রাজপুত্র চমকিয়া উঠিয়া কহিল , এ কী সর্বনাশ! আমি জানিতাম , ইহারা এক-একটা মূর্তিবৎ তাহা তো নহে , দেখিতেছি এ যে নারী ।
কোটালের পুত্র ও সদাগরের পুত্রকে নিভৃতে ডাকিয়া লইয়া রাজকুমার কহিল , “ ভাই , ইহার মধ্যে বড়ো মাধুর্য আছে । তাহার সেই নবভাবোদ্দীপ্ত কৃষ্ণনেত্রের প্রথম কটাক্ষপাতে আমার মনে হইল, যেন আমি এক নূতনসৃষ্ট জগতের প্রথম উষার প্রথম উদয় দেখিতে পাইলাম । এতদিন যে ধৈর্য ধরিয়া অবস্থান করিতেছি আজ তাহা সার্থক হইল । ” দুই বন্ধু পরম কৌতূহলের সহিত সহাস্যে কহিল , “ সত্য নাকি, সাঙাত । ” সেই হতভাগিনী হরতনের বিবিটি আজ হইতে প্রতিদিন নিয়ম ভুলিতে লাগিল । তাহার যখন যেখানে হাজির হওয়া বিধান , মুহুর্মুহু তাহার ব্যতিক্রম হইতে আরম্ভ হইল । মনে করো , যখন তাহাকে গোলামের পার্শ্বে শ্রেণীবদ্ধ হইয়া দাঁডাইতে হইবে তখন সে হঠাৎ রাজপুত্রের পার্শ্বে আসিয়া দাঁড়ায়; গোলাম অবিচলিত ভাবে সুগম্ভীর কন্ঠে বলে , “ বিবি , তোমার ভুল হইল । ” শুনিয়া হরতনের বিবির স্বভাবত রক্তকপোল অধিকতর রক্তবর্ণ হইয়া উঠে , তাহার নির্নিমেষ প্রশান্ত দৃষ্টি নত হইয়া যায় । রাজপুত্র উত্তর
দেয় , “ কিছু ভুল নাই , আজ হইতে আমিই গোলাম । ”নবপ্রস্ফুটিত রমণীহৃদয় হইতে এ কী অভূতপূর্ব শোভা , এ কী অভাবনীয় লাবণ্য বিস্ফুরিত হইতে লাগিল । তাহার গতিতে এ কী সুমধুর চাঞ্চল্য , তাহার দৃষ্টিপাতে এ কী হৃদয়ের হিল্লোল , তাহার সমস্ত অস্তিত্ব হইতে এ কী একটি সুগন্ধি আরতি-উচ্ছ্বাস উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিতেছে ।এই নব অপরাধিনীর ভ্রমসংশোধনে সাতিশয় মনোযোগ করিতে গিয়া আজকাল সকলেরই ভ্রম হইতে লাগিল । টেক্কা আপনার চিরন্তন মর্যাদারক্ষার কথা বিস্মৃত হইল , সাহেবে গোলামে আর প্রভেদ থাকে না , দহলা-নহলাগুলা পর্যন্ত কেমন হইয়া গেল ।এই পুরাতন দ্বীপে বসন্তের কোকিল অনেকবার ডাকিয়াছে, কিন্তু সেইবার যেমন ডাকিল এমন আর-কখনো ডাকে নাই । সমুদ্র চিরদিন একতান কলধ্বনিতে গান করিয়া আসিতেছে; কিন্তু এতদিন সে সনাতন বিধানের অলঙ্ঘ্য মহিমা একসুরে ঘোষণা করিয়া আসিয়াছে — আজ সহসা দক্ষিণবায়ুচঞ্চল বিশ্বব্যাপী দুরন্ত যৌবনতরঙ্গরাশির মতো আলোতে ছায়াতে ভঙ্গীতে ভাষাতে আপনার অগাধ আকুলতা ব্যক্ত করিতে চেষ্টা করিতে লাগিল ।
৭
এই কি সেই টেক্কা , সেই সাহেব , সেই গোলাম । কোথায় গেল সেই পরিতুষ্ট পরিপুষ্ট সুগোল মুখচ্ছবি । কেহ বা আকাশের দিকে চায় , কেহ বা সমুদ্রের ধারে বসিয়া থাকে , কাহারো বা রাত্রে নিদ্রা হয় না , কাহারো বা আহারে মন নাই । মুখে কাহারো ঈর্ষা , কাহারো অনুরাগ , কাহারো ব্যাকুলতা , কাহারো সংশয়। কোথাও হাসি , কোথাও রোদন , কোথাও সংগীত । সকলেরই নিজের নিজের প্রতি এবং অন্যের প্রতি দৃষ্টি পড়িয়াছে । সকলেই আপনার সহিত অন্যের তুলনা করিতেছে । টেক্কা ভাবিতেছে , ‘ সাহেব ছোকরাটাকে দেখিতে নেহাত মন্দ না হউক কিন্তু উহার শ্রী নাই — আমার চাল-চলনের মধ্যে এমন একটা মাহাত্ম্য আছে যে , কোনো কোনো ব্যক্তিবিশেষের দৃষ্টি আমার দিকে আকৃষ্ট না হইয়া থাকিতে পারে না । ‘ সাহেব ভাবিতেছে , ‘ টেক্কা সর্বদা ভারি টক্টক্ করিয়া ঘাড় বাঁকাইয়া বেড়াইতেছে; মনে করিতেছে , উহাকে দেখিয়া বিবিগুলা বুক ফাটিয়া মারা গেল । ‘ – বলিয়া ঈষৎ বক্র হাসিয়া দর্পণে মুখ দেখিতেছে । দেশে যতগুলি বিবি ছিলেন সকলেই প্রাণপণে সাজসজ্জা করেন আর পরস্পরকে লক্ষ্য করিয়া বলেন , ‘
আ মরিয়া যাই । গর্বিণীর এত সাজের ধুম কিসের জন্য গো, বাপু । উহার রকম-সকম দেখিয়া লজ্জা করে! ‘ বলিয়া দ্বিগুণ প্রযত্নে হাবভাব বিস্তার করিতে থাকেন । আবার কোথাও দুই সখায়, কোথাও দুই সখীতে গলা ধরিয়া নিভৃতে বসিয়া গোপন কথাবার্তা হইতে থাকে । কখনো হাসে , কখনো কাঁদে , কখনো রাগ করে , কখনো মান-অভিমান চলে , কখনো সাধাসাধি হয় । যুবকগুলা পথের ধারে বনের ছায়ায় তরুমূলে পৃষ্ঠ রাখিয়া, শুষ্কপত্ররাশির উপর পা ছড়াইয়া অলসভাবে বসিয়া থাকে । বালা সুনীল বসন পরিয়া সেই ছায়াপথ দিয়া আপনমনে চলিতে চলিতে সেইখানে আসিয়া মুখ নত করিয়া চোখ ফিরাইয়া লয় — যেন কাহাকেও দেখিতে পায় নাই , যেন কাহাকেও দেখা দিতে আসে নাই, এমনি ভাব করিয়া চলিয়া যায় । তাই দেখিয়া কোনো কোনো খেপা যুবক দুঃসাহসে ভর করিয়া তাড়াতাড়ি কাছে অগ্রসর হয় , কিন্তু মনের মতো একটাও কথা জোগায় না , অপ্রতিভ হইয়া দাঁড়াইয়া পড়ে , অনুকূল অবসর চলিয়া যায় এবং রমণীও অতীত মুহূর্তের মতো ক্রমে ক্রমে দূরে বিলীন হইয়া যায় । গল্পটির তৃতীয় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন