ছেলের বউটা খুব অত্যাচার করে মনার মার উপর। কত আশা নিয়ে ছেলেটাকে বিয়ে করিয়েছিলেন। স্বামী যতদিন বেচেছিলো সবই ঠিক ছিলো। স্বামী মারা যাওয়ার পর কখন যে সব বদলে গেলো টেরই পায়নি মনার মা। যেই সংসারে সে ছিলো কর্ত্রি সেই সংসারে আজ সে বোঝা। তারচেয়ে বড় কথা প্রতিদিন এমন অপমান ভালো লাগে না তার। ঠিক সেই সময়টাতেই ঢাকায় তাদের নিকট আত্মীয়ের বাসায় কাজের লোক দরকার হলো। কিছুটা অভিমান, কষ্ট নিয়েই মনার মা বললো সে যেতে চায়। পরের দিনই চলে এলো সে ঢাকায় ।
যেই বাড়িতে সে এলো সেখানে তার মূল দায়িত্ব ছিলো রান্না করা, বাচ্চা গুলোকে দেখা আর তদারকি করা। বড় ছেলেটা ক্লাস ৫ এ পড়ে… থাকে হোস্টেলে বাসায় থাকার মধ্যে ছোট ছেলেটাই। সারাজীবন অসম্ভব কর্মঠ জীবন যাপন করেছে তাই তার বসে থাকা ব্যাপারটা কখনোই ভালো লাগে না। বাসায় যে আরেকজন লোক ছিল তার কাজ কর্ম তার ভালো লাগতো না। ফাকির হিসেবটাই তার মাঝে নেই। তাই গৃহকর্তীকে অনুরোধ করে অন্যলোককে বিদায় করে নিজের হাতে দ্বায়িত্ব তুলে নিল সংসারের। পুরা বাড়ির দেখভাল দারওয়ানের কাজ দেখা রান্না বান্না সহ সব নিজের কাধে তুলে নিয়ে যেনো মনার মা এতো দিনে একটু শান্তি পেলো। শুধু মাত্র আত্মীয়তার খাতিরে না যোগ্যতায়, দক্ষতায় মনার মা সময়ের সাথে সাথে বাসাটির নিজেদের একজন হয়ে উঠলো। বাইরের যে কেউই মনে করত সে বাসার মুরুব্বি। শুধু তাই নয় মনা মা কখন যেনো দারওয়ান মিন্টুরও মা হয়ে গেল টেরই পায়নি কেউ। মনার মা হয়ে উঠলো মিন্টুর মা।
মনার মার ছেলে আসাদ যখন টের পেল তার মা বেশ ভালো অবস্থায় আছে ঢাকায়, খোজ খবর নেওয়া শুরু হলো। ছেলের বউ ছেলেকে বললো মা কাজ করে সেই টাকা যদি ছেলেকে না দেয় তবে কাকে দেবে। ছেলে আসাদ নিজে তেমন কিছুই করতো না মার কামাই শুরু হওয়ার পরে যাও বা টুকটাক কাজ করতো সেটাও ছেড়ে দিলো সে। তার রোজগারের উপায় হয়ে দাঁড়ালো মার প্রতিমাসের বেতন। এইভাবেই দিন কেটে যায়। চলে গেলো ৫ টি বছর। বড় ছেলেটি, আকাশ হোস্টেলে থাকলেও বাড়িতে আসলে সে মনার মার খুব নেওটা ছিলো। মনার মার সাথে তার সম্পর্ক ছিলো খুবই ভালো। সম্পর্কে মামা লাগায় কোনদিন তাকে সে নাম ধরে বলেনি গ্রামীন সংস্কারের কারনে। সারা জীবন ডাক ছিল আব্বা। আর ছেলেটাও তাকে আহলাদ করে বুড়ি বলে ডাকত। মনার মা হয়ত ছেলের ভালোবাসা এই দুইটি ছেলের মাঝেই ফিরে পেয়েছিলো।
বয়েস হচ্ছিলো মনার মার। বয়েসের সাথে সাথে বিভিন্ন অসুখ বাসা বাধছিল তার দেহে। হঠাৎ করেই একবার প্রচন্ড পায়ে ব্যাথা শুরু হলে এক্সরে করে দেখা গেলো পায়ে অনেক আগে কিছু ঢুকেছিল সেটার কারনেই ব্যাথা হচ্ছে তার। অপারেশন লাগবেই এবং হাসপাতালেও থাকা লাগবে দুইদিন। আসাদকে ফোন করে বলা হলো যাতে আসে মার সাথে থাকতে। আসাদ সরাসরি জানালো তার হাতে সময় নেই সে যেতে পারবে না। আকাশ তখন মাত্রই কলেজে ভর্তি হয়েছে। সব শুনে সে বললো সেই থাকবে মনার মার সাথে হাসপাতালে। দুইদিন পরে মনার মাকে নিয়ে ঘরে আসার পর সব কেমন যেনো বদলে গ্যালো। মনার মা কেমন যেনো মনমরা হয়ে থাকতো। টাকা দিয়ে যাচ্ছিলো ছেলেকে নিয়মিত কিন্তু কই যেনো একটা শুন্যতা তৈরি হলো তার মধ্যে। ছেলের ব্যাপারে খুব একটা কথা বলতো না কারো সাথেই আর। একদিন অনুরোধ করলো যাতে তার ছেলেকে একটা চাকরি দেখে দেওয়া হয়। যেহেতু পরিবারটির নিজস্ব রিয়েল এস্টেট ব্যাবসা ছিলো তারা তাই আসাদকে একটি সাইটে দারোয়ান হিসেবে নিয়োগ দিয়ে দিলো। আর মনার মাকে বুদ্ধি দিলো গ্রামে নিজের টাকায় একটা ঘর করতে লাগলে তারা সহায়তাও করবে। দিন বেশ ভালোই কেটে যাচ্ছিলো। ঝামেলা বাধলো যখন আসাদ প্রজেক্ট থেকে জিনিস চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়লো। কিছুটা ঝামেলা হলেও ব্যাপারটা চাপা দিয়ে দেওয়া হলো মনার মার কথা চিন্তা করে।
আসাদের ভিতর কি কাজ করছিলো জানা যায় নি। সে কিছুদিন পর চাকরীটা ছেড়ে দিলো। এর মাঝে সে তার স্ত্রীকে ঢাকায় নিয়ে এসেছে। হঠাৎ একদিন আসাদ এসে জানালো তার মা যেহেতু বৃদ্ধা হচ্ছে তাই সে তাকে নিয়ে যেতে চায়। শুনে সবাই খুশি হলেও আকাশরা দুই ভাই একদমই খুশি ছিলো না। মনার মা চলে যাবে তাদের সাথে আর থাকবে এই ব্যাপারটাই তারা দুই ভাই মেনে নিতে পারছিলো না। তারপরেও মনার মার কষ্ট করতে হবে না এই চিন্তা করে দুই ভাই ব্যাপারটা মেনে নিলো। চলে গেলো মনার মা। পিছনে রেখে গেলো অনেক গুলো বছরের স্মৃতি।
যেই আকাশকে মনার মা পেয়েছিলো বাচ্চা বয়েসে তাকে সে তারুন্যের দ্বার প্রান্তে রেখে যায়। আকাশ পড়া লেখা করার জন্যে দেশের বাইরে গেলেও মনার মার কথা কখনোই ভোলেনি। চেষ্টা করতো খোজ খবর রাখতে। কিন্তু জীবনের ব্যস্ততায় একটা সময় আর খবর রাখা হয়ে উঠেনি। আকাশ যখন দেশে এলো সে বহু কষ্টে আসাদের ঢাকার ঠিকানা বের করে গেলো দেখা করতে মনার মার সাথে। গিয়ে সে জানতে পারলো, মনার মা মেসে কাজ করতে গিয়েছে। সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, কেনো আসাদ না তার মাকে এনেছে আর কাজ করতে দেবে না? তখন উন্মোচিত হলো আরেক ঘটনা। আসাদের ইচ্ছা কখনোই এমন ছিলো না। মেসে কাজ করলে পয়সা বেশি এই তথ্য জানার পরে সে তার মাকে আকাশদের বাসা থেকে এনে মেসের কাজে লাগিয়ে দেয় পয়সা বেশি পাবার আশায়। এই শুনে আকাশ রাগে, ক্ষোভে দুঃখে অনেকক্ষন চুপ থেকে মেসের ঠিকানা জেনে চলে যায় সেখানে। মেসে গিয়ে আকাশ দূর দেখে মনার মা চেহারাটা আরো জীর্ন শির্ন হয়ে গেছে। বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠে আকাশের। গলার কাছে কি যেনো দলা পাকিয়ে আসে মনার মাকে এই অবস্থায় দেখে। কিছুটা অভিমানও ভর করে বুড়ী কেনো চলে এসেছিলো তাদের বাসা থেকে ভেবে। পিছন থেকে আকাশ মনার মার কাছে গিয়ে ডাক দেয়, “বুড়ী”। মনার মা ভুত দেখার মত চমকে পিছনে ফিরে তাকিয়ে আকাশকে দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পরে। আকাশ সেখানে বসে অনেক বার বোঝানোর চেষ্টা করে কিন্তু মনার মাকে তার সাথে ফিরতে রাজী করতে পারলো না। ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল করেও লাভ হলো না। মনার মা আকাশকে বললো, আব্বা আপনে চলে যান। আমার দোহাই লাগে। এই কথা শুনে আকাশ সেখান থেকে চলে এলো। পিছনে ফিরলে সে দেখতে পেত একজন মমতাময়ী মা অশ্রুসজল চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। যে নিজের জীবনে সব সহ্য করে বৃদ্ধাবস্থায় সন্তানের উন্নতির জন্যে মেস বাড়িতে কাজ করছে।