একজন বাবু এবং হাসু আপার গল্প— রমজান আলী মামুন

ক্লাস ফোরের রুবিনার হোম টিচার হতে গিয়েই বাবুর সাথে পরিচয়। আজ সাত মাস যাবত এ বাড়িতে আসা-যাওয়া করছি। কিন্তু ঘুণাক্ষরেও জানতে পারিনি যে বাবু আসলে রুবিনার ভাই নয়।

রুবিনাকে পড়াতে গেলেই পড়ার ঘরের আশে-পাশে সে উঁকি মারবেই। করুণ অথচ মায়াবী মুখখানা দেখলেই কাছে ডেকে আদর করতে ইচ্ছে করে।

কতইবা বয়স হবে বাবুর। বড় জোর চার কি পাঁচ। এ বয়স তো হল্লা করে সময় কাটাবার। কিন্তু বাবুটা সব সময় এতো গম্ভীর থাকে কেনো? কি এতো দুঃখ তার? এ রকম প্রশ্ন প্রায়শই আমার মনের ভেতর উঁকি দিতো। কিন্তু কোনদিন তা জানবার সময় ও সুযোগ হয়নি।

প্রতিদিনের মতো আজও সন্ধ্যা বেলা রুবিনাকে পড়াতে যাই। কলিং বেল টিপতেই দরজা খুলে স্বয়ং বাবু আমার সামনে খাড়া। ইতস্তত ভাব। কী ব্যাপার তোমার আপু কোথায়? একটু হতচকিত হয়ে গেল বাবু। তারপর সলজ্জ দৃষ্টিতে বললঃ স্যার, রুবিনা আপার না খুব জ্বর। জেঠি মা বলেছেন আপা আজ পড়তে পারবে না।

অনেকদিন পর বাবু আমার সাথে কথা বলল। মিষ্টি এই ছেলেটার সাথে আরো কিছুক্ষণ কথা বলার অভিপ্রায়ে মাথায় আমার দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেলো। বললাম- আপা না পারুক। তুমি তো পারবে। পড়বে কিছুক্ষণ আমার সাথে? লক্ষ্মী ছেলের মতো মাথা দুলিয়ে বাবু সম্মতি দিলো।

পড়ার ঘরে গিয়ে বাবুকে নিয়ে বসলাম। জিজ্ঞেস করিঃ বাবু তুমি কোন ক্লাসে পড়? আমার প্রশ্ন শুনে বাবু লজ্জা পেয়ে যায়। মৃদু স্বরে বলেঃ স্যার, আমি আজও স্কুলে ভর্তি হইনি তো। তার কথা কেড়ে নিয়ে বলিঃ ভর্তি হওনি কেনো? বাবু আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলে ওঠেঃ আমার আজও পাঁচ বছর হয়নি তো-তাই। বাপি আমাকে শুধু ঘরেই পড়ায়।

বাবুকে পড়াতে গিয়ে দেখি স্কুলে ভর্তি হবার মতো যথেষ্ট যোগ্যতা সে ইতিমধ্যে অর্জন করে ফেলেছে। স্বরবর্ণ-ব্যঞ্জনবর্ণের প্রতিটি অক্ষর। অইঈউ থেকে ত পর্যন্ত তার ঠোঁটস্থ। ১ থেকে ৫ এর নামতা আর টুকটাক অংকও শিখেছে।

রুবিনার জন্যে মাঝে মধ্যে চকলেট-মিমি নিয়ে যাই। আজ পকেটে ছিলো একটা মিমি। ওটা বাবুকে দিয়ে বলিঃ তোমার পাঁচ বছর হয়নি তো কী হয়েছে। পাঁচ বছর না হলে বুঝি স্কুলে ভর্তি হওয়া যায় না। অবশ্যই যায়। তোমার বাপিকে বলে জানুয়ারিতে তুমি শিশু শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে যাও।

বাবু তার করুণ অথচ মায়াবী মুখখানা আলতো তুলে আমাকে হঠাৎ এক প্রশ্ন করে বসেঃ ভর্তি হলে, আমি কার সাথে স্কুলে যাবো- স্যার? কেনো তোমার আম্মু আছে না, তার সাথেই যাবে। আমার কথা শুনে অস্পষ্ট স্বরে বাবু বলেঃ কিন্তু আমার যে মা নেই- স্যার? নেই মানে, তোমার মা কোথায় গেছেন? বাবু বলে ওঠেঃ সবাই বলে মা মেঘের ঘোড়ায় চড়ে সাত আসমানের বুক ছিঁড়ে বেহশ্তে চলে গেছেন। কিন্তু স্যার আমি জানিঃ আমার মা মারা গেছেন। রুবিনা আপু আমাকে বলেছেনঃ সবাইকে একদিন আল্লাহ্র হুকুমে চলে যেতে হয়।

এতোদিন এ বাড়িতে টিউশনি করছি; অথচ কি আশ্চর্য কস্মিনকালেও জানতে পারিনি এখানে একজন মাতৃহারা দুঃখী শিশু বসবাস করে। কী জবাব দেবো বাবুর প্রশ্নের? খেই হারিয়ে ফেলি। বাবুর মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে কখন যে রুবিনাদের ঘর ছেড়ে মেইনরোডে এসে পড়ি খেয়াল নেই। খেয়াল হলো দুরন্ত যানবাহনের তীব্র হর্ণের আওয়াজ আর হেড লাইটের চোখ জ্বালা করা উদ্ভাসিত আলোর বিচ্ছুরণে।

কী হয়েছিল বাবুর মায়ের? বাবুর মা কি কোন কঠিন রোগে মারা গেছেন? প্রশ্নটা মনের ভেতর ঝিকিয়ে উঠতেই হঠাৎ বড় আপার কথা মনে পড়ে যায়। কী প্রাণ উচ্ছল জীবন ছিল হাসু আপার। শাদা এপ্রোন পরা অবস্থায় চাকুরিস্থল থেকে ফিরেই রাজ্যের গল্প জুড়ে দিতো সবার সাথে।

হাসু আপা কাজ করতেন পৌর দাতব্য চিকিৎসালয়ে। সেবিকা বলেই রোগী নিয়ে কাজ কারবার তার। কিন্তু সে আপাই যে একদিন রোগী হয়ে এই চিকিৎসালয় ত্যাগ করবে কে জানতো এসব। পেটে ব্যথা হলেই ডাক্তার আপাকে বলে ব্যথা উপশমের ওষুধ খেয়ে নিতেন। ব্যাস এটুকুই। কিন্তু ভেতরে ভেতরে যে তার পেটে টিউমার বাসা বেঁধেছে কে জানতো। আপাও না। পেটের ব্যথা ক্রমান্বয়ে বেড়ে গেলে আবার ডাক্তার আপার দ্বারস্থ হলেন। এবার ভালো করে দেখে শুনে ডাক্তার আপা বললেনঃ হাসু আর অবহেলা নয়। আমি লিখে দিচ্ছি তুমি শরীরটা একবার চেকআপ করে নাও।

ততদিনে আপার ভাত উঠে গেছে। খাবার-দাবারেও আর রুচি নেই। চেকআপ করালে পেটে টিউমার ধরা পড়ে। ডাক্তার আপা বললেনঃ অপারেশন করাতে হবে। শীঘ্রই মেডিকেলে ভর্তি হয়ে যাও। আপাকে মেডিকেলে ভর্তি করানো হলো। এক মাসের মধ্যে অপারেশন করার কথা। কিন্তু বিশ-পঁচিশ দিন পেরিয়ে গেলেও ডাক্তারদের মধ্যে অপারেশন করার কোন লক্ষণ দেখছি না।

রোজার মাস তার উপরে ডিসেম্বরের প্রচন্ড শীত। আমরা শুধু পালাক্রমে মেডিকেলে আসা-যাওয়া করছি। আর আল্লাহ্র কাছে শুধু প্রার্থনা করছি- হাসু আপাকে তিনি যেনো তার তিন সন্তানের উসিলায় ভালো করে দেন।

একদিন হাসপাতালের করিডোরে পায়চারি করছি। শীররটাও ভালো যাচ্ছে না। এর আগের দিন সাহরীর পর এক ফোটা ঘুমুতে পারিনি। প্রায়শই এরকম হয়। পরিশ্রান্ত দেহে নানা চিন্তা বাসা বেঁধেছে। এবার হাসি-খুশি ঈদ করতে পারবো তো? কতর্ব্যরত ডাক্তার আমাকে ইশারায় তার রুমে ডেকে নিয়ে গেলেন। বললেনঃ রোগী তোমার কী হয়?

বুকটা আমার অজানা আশঙ্কায় ধক্ করে উঠলো। নিজেকে সংযত করে বলিঃ রোগী আমার আপা। ডাক্তার বললেনঃ তোমার আপাকে আজকে আমরা রিলিজ করে দেবো। ওষুধ-পত্র-ইনজেকশন যেভাবে লিখে দেয়া হবে ঠিক সেভাবে চলবে।

আমি আর্তনাদ করে বললামঃ ডাক্তার, আমার আপার অপারেশন হবে না? ডাক্তার আমার কথা শুনে চকিত মুখ তুলে বললেনঃ তোমার আপার-টিউমার ক্যান্সার হয়েছে। এ অবস্থায় অপারেশন করা যায় না।

ক্যান্সার? আপার টিউমার ক্যান্সার হয়েছে! এ কথা শুনে আমার হাত-পা অবশ হয়ে গেলো। সারা আকাশ যেনো আমার মাথায় ভেঙ্গে পড়লো। অনেকক্ষণ ধরে আমি কোন কথা বলতে পারলাম না। দাদা কী হলো, ডাক্তার কী বলেছেন? ছোট ভগ্নিপতির কথায় সম্বিত ফিরে পাই। তাকে বললাম টেক্সীর ব্যবস্থা করো। আপাকে বাসায় নিয়ে যেতে হবে।

বাসায় নিয়ে আসার এক সপ্তাহ পর একদিন; ভোরে মোয়াজ্জিন মসজিদে তখনো আজান দেয়নি। হঠাৎ মা এবং ছোট বোনের কান্নার আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে যায়। হতচকিত হয়ে আপার রুমে ছুটে যেতেই ছোট বোন এগিয়ে এসে মাতম করে বললঃ ছোট ভাই, বড় আপা আর নেই-রে। হাসু আপার অকাল প্রয়াণ। এই একটি মাত্র মৃত্যুই আমাকে অনেক কিছুই জানান দিয়ে যায়। শোককে শক্তিতে পরিণত করতে শেখায়। ছোট্ট বাবুকেও কি- তাই?

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!