বিল্লাল কে দেখে বোঝা যায় না যে ওর বয়স পনেরতে পড়েছে। দেহের গড়নে বয়স একদম ঠাওর করা যায় না, মনে হয় বড়জোর দশ বছর হবে। ছিপছিপে গড়নের খুব দুরন্ত এক কিশোর সে। কাঁধে পানের ডালা নিয়ে ঘুরে বেড়ায় সমস্থ হাতিরঝীল এলাকা জুড়ে। রামপুরা ব্রিজ থেকে কাওরান বাজার পর্যন্ত। সব সময় মুখে একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে খদ্দের কে জিজ্ঞেস করে মামা একটা পান দিমু? ওর মায়া ভরা মুখ দেখে যে কোনদিন পান খায়নি সেও পান কিনে খেতে চাইবে। এমনই এক মায়াজালে আমিও ফেঁসে গেলাম।
সময় পেলেই আমি মাঝে মাঝেই হাতিরঝীল যাই। মহানগর প্রোজেক্ট এর সামনে লেকের উপর দিয়ে যে ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণাধীন ওখানে বসে আমি মোবাইলে গেমস খেলছিলাম। এমন সময় বিল্লাল এসে বলল,
-মামা পান দিমু?
-আমারে দেখে কি তোর পানখোর মনে হয়?
-মামা কি যে বলেন! একটা পান বানাইয়া দেই খাইয়া দেহেন! অনেক মজা পাইবেন।
-তোর পানে কি ম্যাজিক আছে নাকি রে?
-ম্যাজিক আছে কি না কইতে পারুম না তয় যে একবার খায় সে আবারও খাইতে চায়।
-বলিস কি! তুই তো তাইলে মহাজাদুকর! সবাইরে পান খাইয়ে বশীকরণ করিস।
-মামা দেই একটা পান?
-না আমি এসব খাইনা। দাঁত লাল হয়ে যায়। সামনে দেখ কেউ খায় কিনা!
-যে আচ্ছা।
বিল্লাল মন খারাপ করে চলে যাচ্ছে। ওর মায়া ভরা মুখটা আমাকে ভীষণ ভাবে নারা দিলো ভাবলাম পান না খাই তাতে ওকে তো সাহায্য করতে পারি? আমি তাকে ডাক দিতেই যে দৌড়ে ফিরে এলো। আমি পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে একটা একশত টাকার একটা নোট ওর দিকে বারিয়ে বললাম
-এই নে এইটা তোর বকশিস।
-ক্যান মামা বকশিস দেন ক্যান?
-তোর কথায় আমি খুশি হয়েছি তাই!
-মামা আমি ভিক্ষুক নই। পান বেইচা খাই বলে আমারও একটা সম্মান আছে। আপনার টাকা আমি নিমু না। আপনি এইটা কোন ফকিররে দিয়েন।
-কি নাম তোর? -বিল্লাল হোসেন।
-বাহ সুন্দর নাম!
-হ সুন্দর নাম বইলাই সবাই আমারে বিলাই বিলাই কয়া ডাকে!
-হা হা হা… তুই তো বেশ মজা করতে পারিস!
-পান খাইবেন?
-হুম, খাবো তো কোন জর্দা দিতে পারবি না।
-ভাঁজি মসলা দিয়া দেই?
-আচ্ছা দে।
বিল্লাল পান বানাতে ব্যাস্ত, আমি নিজের বোকামি ঢাকতে বিল্লালের কাছ থেকে পান কিনতে রাজি হলাম, কেননা বিল্লালের আত্মসম্মান বোধ দেখে আমার টনক নড়ে গেছে। এতো অল্প বয়সে ওর মানুসিকতা দেখে সত্যি আমি মুগ্ধ।
-মামা এই লন!
-দে, তোর বয়স কতো বিল্লাল
-পনের চলছে।
-বলিস কি! দেখে তো মনে হয় দশ এর বেশি হবে না?
-হ মামা কেউ বিশ্বাস করে না।কি করমু কোন এইডা কি আমার দোষ? জন্মের পর মা মারা গেছে, হুনচি দাদী আমারে ভাতের মার খাওয়াইয়া বড় করছে।
-বলিস কি! তোর তো তাহলে অনেক দুঃখ! কোথায় থাকিস?
-এইতো সামনেই মধুবাগ বস্তিতে।
-কে কে থাকিস?
-দাদীর লগে থাকি।
-তোর বাবা কোথায়?
-বাবা বিয়ে করে আমাগো ফেলাইয়া কই যে থাকে সেইডা আমরা জানি না। মাঝে মদ্দে আহে!
-পড়ালেখা করেছিস!
-হ মামা করছিলাম তিন ক্যালাস। তারপর দাদী ঢাকা নিয়ে আইছে।
-পান বিক্রি করছিস কতদিন ধরে?
-এইতো এক বছর হইতাছে। আগে ছিলাম কমলাপুর বস্তিতে দাদীর লগে একটা বাসায় কাজ করতাম, দাদীর বয়স হইয়া গেচে তাই এহন কাজ করতে পারে না। আমি যা কামাই করি তা দিয়ে চইলা যায় দুজনের।
-বলিস কি? সারাদিন ধরেই কি পান বিক্রি করিস?
-না মামা সারাদিন কি আর বেচাবিক্রি হয়! বিকালে আহি আর রাত দশটায় বাসায় যাই। সকালে কাওরান বাজার থেকে মাল কিন্না আনি। দাদীর সাথে সব গুছাইয়া বিকালে বাইর হই।
-কেমন হয় প্রতিদিন ইনকাম?
-হয় ২৫০-৩৫০টাকার মতো।
-পড়ালেখা করতে ইচ্ছা করে না?
-খুব করে! পোলা মাইয়ারা যখন ব্যাগ কাঁধে স্কুলে যায় দেইখা আমার বুকের মদ্দে মচর দিয়া অডে। যদি মা বাইচা থাকতো তাইলে আমিও হ্যাঁগোর মতো স্কুলে যাইতাম!
বিল্লালের চোখে পানি ছলছল করছে! আমি ওকে আর দেরি করালাম না। পানের দাম সহ ওর বকশিসটা অনেকটা জোর করেই ওর পকেটে ঢুকিয়ে দিলাম। আমার ভিজিটিং কার্ডটা ওকে দিয়ে বললাম যদি কখনও তোর মন চায় আমাকে কল দিস। যদি পড়ালেখা করতে সত্যি ইচ্ছা করে তাহলে তোর জন্য আমার দোয়ার খোলা আছে। তোর দাদীকে আমার সালাম দিস। বিল্লাল হাসি মাখা সেই মিষ্টি মুখটা নিয়ে আমাকে ফেলে মধুবাগের দিকে রওনা দিলো। আমি চেয়ে আছি ওর চলে যাবার দিকে…………………