একজন দুঃখী মানুষের গল্প —- জারাহ জেবিন

চা বাগানের কোয়ার্টারগুলোর মধ্যে রন্জুদের বাসাই ছিল সবচেয়ে সুন্দর। বাবা-মা, ভাইবোন, কাকু-ফুফু, চাকর-বাকর, গরু-ছাগল, দেশি-বিদেশি আসবাব, সামনে ফুলের বাগান—সব মিলিয়ে ঈর্ষা করার মতো সুখের সংসার।
তবে এই সুখের মাঝেই ছিল এক ‘কাঁটা’—রন্জুর কাকিমার পাগলামির রোগ। মাঝেমধ্যে তিনি বেহুশ হয়ে বাসা থেকে বের হয়ে উদ্ভট কাণ্ড করে বসতেন।

এমন সময় পাশের বাসায় বেড়াতে এলেন ছোট খালা পান্না। নামের মতোই রূপ—তৎকালীন শাবানা-ববিতাকেও হার মানাতে পারেন। সবকিছুতে আনন্দ খুঁজে পাওয়া, হাহাহিহি করে হাসা—এই ছিল তার স্বভাব।

খালা আসার দুই-একদিনের মধ্যেই কাকিমার ‘ঘুমন্ত রোগ’ জেগে উঠল। তিনি পাশের বাসায় গিয়ে খাটের নিচে লুকিয়ে পড়লেন। রন্জুর আব্বা ও কাকু অনেক টানাটানি করেও তাকে বের করতে পারলেন না। অবশেষে বাসার আন্টি বললেন,
— “তিনি যখন বের হচ্ছেন না, আমরা বুঝিয়ে বাসায় দিয়ে আসব।”

সারা বিকাল-সন্ধ্যা কেটে গেল, কাকিমা খাটের নিচেই রইলেন। রাত হলে সাবধানে মাথা বের করে চারপাশ দেখে বের হলেন, কিন্তু ফ্লোরে বসে মাথাটা তোষকের নিচে লুকালেন।

ছোট খালা হেসে জিজ্ঞেস করলেন,
— “ভাবি, মাথা লুকাচ্ছেন কেন?”
কাকিমা বললেন,
— “দেখছ না, তুফান আইছে, আসমানে কালো মেঘ। তোমরার গাছের আম আমার মাথায় পড়তনি?”
বলতে বলতে খালার কালো খোলা চুলের দিকে ইশারা করলেন। খালা তৎক্ষণাৎ খোঁপা বেঁধে নিলেন। আন্টি তখন কাকিমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
— “তুফান থেমে গেছে ভাবি, চলেন বাসায় যাই।”
কিন্তু কাকিমার ফেরার ইচ্ছা ছিল না।

তিনি বসে বসে আন্টি ও খালাকে নানা বক্তব্য শুনিয়ে আন্টিকে ‘বোকা’ প্রমাণের চেষ্টা চালালেন। তার মূল বক্তব্য—এই সুন্দরী মেয়েটিকে বাসায় জায়গা দিয়ে আন্টি নিজের সর্বনাশ ডেকেছেন, এতে তার মেয়েকে আর বিয়ে দেওয়া যাবে না।
খালা যত খিলখিল করে হাসেন, কাকিমার রাগ তত বাড়ে। হাসি-কান্নার এই দুই রূপ যেন সমান্তরাল রেললাইন।

রাগ বাড়তে বাড়তে কাকিমা চিৎকার করে উঠলেন,
— “বয়সকালে আমি কি তোর চেয়ে কম ছিলাম লো পান্না? এই দেখ!”
বলেই ড্রেসিং টেবিলের পাউডার, স্নো, লিপস্টিক, কাজল, আলতা—যা ছিল সব মুখে মেখে সুন্দরী হওয়ার চেষ্টা শুরু করলেন। দৃশ্যটা এত হাস্যকর হয়ে উঠল যে আন্টিও ঠোঁট চেপে আঁচলে মুখ লুকালেন।

হট্টগোলের খবর পেয়ে রন্জুর আব্বারা আবার এলেন কাকিমাকে নিতে। তাদের আওয়াজ পেয়ে কাকিমা পেছনের দরজা দিয়ে দৌড়ে চা বাগানে ঢুকে পড়লেন। থেমে না থেকে মাঠ পেরিয়ে বাঁশঝাড়ের কাছে ছোট ছড়ায় গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন।
তখন মধ্যরাত—এক পাশে ঝোপে ঢাকা টিলা, অন্য পাশে ঘন বাঁশবন। রন্জুর আব্বা কোনোরকমে তাকে ধরে আনলেন।

এমন ঘটনা নাকি প্রায়ই ঘটত—সকাল, দুপুর, রাত—যে কোনো সময় কাকিমাকে ধরে আনতে হতো।

গ্রামের লোকজন বলত, কাকিমা নাকি সত্যিকারের পাগল নন; দেবরের প্রতি আসক্ত। তাই দেবরের বিয়ের প্রসঙ্গ উঠলেই পাগলামির ভান করে বিষয়টা গোপন করার চেষ্টা করতেন। রন্জুর আব্বা হয়তো জানতেন, কিন্তু মুখে কিছু বলতেন না—পাঁচ ছেলে-মেয়ের সংসারে বড় ঝামেলা হয়ে যেত।

শেষ পর্যন্ত ছোট খালার প্রতি কাকিমার সব সন্দেহ সত্যি প্রমাণ করে, একদিন খালা রন্জুর কাকুকে বিয়ে করে অস্ট্রেলিয়া চলে গেলেন।
কাকিমা এরপর আর পাগল হয়েছিলেন কিনা জানা নেই, তবে রন্জুর আব্বা যে কী বিপদজনক পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে সেই সময়টা পার করেছেন, তা আন্দাজ করা কঠিন নয়।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!