১
প্রতিটি দিনই নতুন মনে হয় মাঝে মাঝে, যদিও আমার বিষাদ লাগে। অজানা কারণে বুকের ভেতর চিন চিন ব্যথা করে তবু বেশী ঝামেলার কথা ভাবতে ভাল লাগে না। কিন্তু কিছু ঝামেলা মাথায় নিতেই হয়। জানি এভাবে জীবন যায় না। আজ যখন দুপুরে বের হই তখন চরম বৃষ্টি। এরকম বৃষ্টি দেখলে ছাতা নিয়ে হাটতে বেশ লাগে। কিন্তু রাস্তায় যে কত শত মানুষ। বৃষ্টি, রোজা তার উপর সবার ঈদের পোষাক কেনার ব্যপার আছে। অতএব গাড়ি , রিক্সা সব থেমে আছে। সব ঠেলে ঠুলে হাটতে লাগলাম।ছাতায় ছাতায় ধাক্কা লাগছিল। ভাবছিলাম সেও ভালো। তবু বৃষ্টি পড়ুক।
২
আজ বেশ কতদিন একাধারে বৃষ্টি আমাদের এই এলাকায় । একে আমাদের গ্রামে বলে কাইতন । কাইতনের সময় গ্রাম গুলোতে সারাদিন ঘরে বসে থাকা , সবাই মিলে ঘরে বসে গল্প করা , বুড়োবুড়ি পান খাওয়া এমনটাই দেখেছি । সময়টা মন্দ কাটে না সবার ।
এই ভেজা মেঘের দিনে কত কথা যে মনে পড়ে ।
আমি ছিলাম একদম হ্যাংলা পাতলা । আম্মার সাথে বাড়িতে গেছি ।
এই বৃষটির দিনে ঘর থেকে বেরুলেই বৃষ্টির পানি আর কাদা । আমি বের হলেই ধুম করে আছাড় খাই ।
বার বারই একই ঘটনা ঘটতো । এমন লজ্জা পেতাম ।
বিয়ের পরে শ্বশুড়বাড়ি (গ্রামের বাড়ি ) গেছি । উঠানে ঢুকেই একদম পা পিছলে আছাড় খেলাম । এরপর যতবারই বৃষ্টির দিনে বের হই পা টিপে টিপে হাঁটি ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বর্ষার কবি । বর্ষা নিয়ে তার কত যে কবিতা ।
আষাঢ়সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল, গেল রে দিন বয়ে
বাঁধন-হারা বৃষ্টিধারা ঝরছে রয়ে রয়ে।
একলা বসে ঘরের কোণে কী ভাবি যে আপন-মনে–
সজল হাওয়া যূথীর বনে কী কথা যায় কয়ে।।
অথবা
আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদল দিনে জানি নে,
জানি নে কিছুতেই কেন যে মন লাগে না ।।
আসলেও তো কিছুতেই মন লাগে না । ইচ্ছে করে জানালায় বসে বৃষ্টি দেখি ।
আকাশ কাঁপিয়ে নামুক বৃষ্টি ।
সমাজ সংসার মিছে সব,
মিছে এ জীবনের কলরব।
কেবল আঁখি দিয়ে
আঁখির সুধা পিয়ে হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভব– .
এই বৃষ্টির দিনে এই সমাজ সংসার সবই বৃথা মনে হয় । হৃদয়কে অনুভব করা হৃদয় দিয়ে – আহা আর কি আছে এই পৃথিবীতে ।
ব্যাকুল বেগে আজি বহে বায়,
বিজুলি থেকে থেকে চমকায় ।
যে কথা এ জীবনে রহিয়া গেল মনে
সে কথা আজি যেন বলা যায়–
এমন ঘনঘোর বরিষায় ॥
আহা কত কথা যে এই জীবনে বলা হয় নি । কেউ জানলো না । রয়ে গেলো ভেতরেই ।
সেই কথাগুলো আজ বলবো , তোমার দুখে দুখী হবো । সবই তো মিছে । সত্যি শুধু আমি আর তুমি ।আর এই বরষা , এই বৃষ্টি এই মেঘলা দিন ।
৩
বৃষ্টি হলেই আমার বুকের ভেতর চিন চিন করে ওঠে । ভালো লাগা কিংবা না লাগা বোধ – এর ব্যাখ্যা পাওয়া মুশকিল । ইচ্ছে করে জানালার পাশে বসে রিমঝিম বৃষ্টি দেখি ।
এখন অন্ধকার হালকা । স্ট্রীট লাইটের পাশে দু একজন মানুষ আনমনে দাঁড়ায় । এই বৃষ্টিতে ছাতা ছাড়া লোকটা দাঁড়িয়ে
করছে টা কি ?
আমাদের এখানের সবগুলো গাছ এই বর্ষায় কালচে সবুজ রঙ ধারণ করেছে ।
একটা গাছের নাম জানি না । তার নিজেকে মেলে ধরার ব্যপারটা অদ্ভুত । সে
দুটো ধাপে নিজেকে সাজিয়েছে । প্রথম ধাপে গোল পাতা তার অর্ধেকটা শরীর জুড়ে ।
দ্বিতীয় ধাপে অনেকটা নেমে গিয়ে আবার একটা লেয়ার পাতার ।
এরপর একদম নীচের দিকে আর কোন পাতা নেই । ডাল ও নেই । তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকার মতো ।
আশ্চর্য এই গাছটার নাম জানি না কেন ?
এখানের সবগুলো গাছ পালায় একধরনের নতুন প্রান পাবার সারা ।
হুমায়ুন আহমেদই বলেছিলেন গাছেরা প্রতি বর্ষায় নতুন জীবন পায় । বার বার যৌবন পায় । মানুষ একবারই পায় । মানুষের সেই সৌভাগ্য নেই ।
আচ্ছা বিজ্ঞান কি সেই অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারবে ?
একসময় মৃত্যু থাকবে না , জরা থাকবে না । মানুষ সব কিছুকেই জয় করবে ।
কিন্তু এত বেশী বেঁচে থাকাও একঘেয়ে ব্যপার । মৃত্যুর মুখোমুখি কি হতে চায় ?
অথচ বেশী অনেক বেশী কেউ মনে হয় না বেঁচে থাকতে চাইবে ।
পৃথিবী অনেক আনন্দের । কিন্তু বিষাদ মাখা পৃথিবী থেকে মানুষ পালাতে চায় ।
আমি আর একবার ধুলো মাখা পৃথিবীতে ফিরতে চাই
আর একবার একটা কুয়াশা মাখা ভোর হতে চাই ।
আর একবার তোর হাতে হাত ধরে হেঁটে হেঁটে
পার করবো উনিশটা বসন্ত ।
তবু তুই আমাকে বলিস না
সখী থেকে যাস নে কেন রে ?
—-লিখেছেন সুফিয়া বেগম