এইসিমেট্রিক

এক

আজ ভোরে ঘুম ভাঙল ঠিকা বুয়ার সঙ্গে মায়ের বাহাসে। প্রতিদিনই তার দেরি হয়, একই ব্যাখ্যা প্রতিদিনই, তবু মা সেটা জানতে চায়! দীর্ঘদিন ধরে স্কুলের হেডমিস্ট্রেসগিরির বাইপ্রোডাক্ট হলো বেশকিছু বদগুণ, যার মধ্যে অন্যতম এই জেরা করার স্বভাব। মাথার নীচ থেকে বালিশটা টেনে মুখের ওপর ফেলি। আওয়াজ একটু কমে এল যেন।

আসলে কি মায়ের অর্জন শুধু ওইটুকুই? নাহ্, ভাল কিছুও আছে। এই যে আমি, একটু পরে অফিসে যাব, তার পারিপাট্যের প্রস্তুতি মা নিজ দায়িত্বে করে রাখছেন। আমার বাইরে বেরুবার পোশাক তার কাছে স্কুল ইউনিফর্মের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিন সকালে মাড়-কড়কড়ে, নিখুঁতভাবে ইস্ত্রি করা জামাকাপড় খাটের পাশে চেয়ারে রেডি। আমাদের মা-মেয়ের দুটো সিঙ্গেল খাটের মাঝে ছোট একটা টেবিল আর চেয়ার। চেয়ারটায় সকালবেলার জামাকাপড়েরাই কেবল বসে। আর কে বসবে, বাসায় আমরা দুটো প্রাণী! ভাবীর বাচ্চা হবার আগে থেকে কিছু সমস্যা হচ্ছিল, সে চলে গেছে বাপের বাড়ি। বেশিরভাগ দিন ভাইয়া অফিস সেরেই সেখানে চলে যায়।

নাশতার টেবিলে আমরা, আমার হাতে চায়ের কাপ, মায়ের হাতে পত্রিকা। একগাল হাসি নিয়ে বুয়া হাজির।
– আফা আজকা শাড়ি পিনবেন?
– হুঁ
– বালা অইছে সুতির শাড়ি, মাড় দিয়া কড়কড়া। ছিল্ক অইলে ওসুবিদা…

– বাবুর মা তুমি যাও এখান থেকে। কাজের দেরি হচ্ছে।
মোটা ফ্রেমের চশমার ওপর দিয়ে মায়ের চোখ দেখা আরামদায়ক কোন দৃশ্য না। বুয়া নিঃশব্দে শিংমাছের মতো পিছলে বেরিয়ে গেল। তবে এই শাড়ির গল্প কলোনির অন্তত চারটা বাসায় আজই রিলে করে ছাড়বে, তাতে সন্দেহ নেই।

আমাদের বাসাটা দোতলায়। সরকারি কলোনির সারিবাঁধা খুপরির একটা, আয়তন হিসেবে অফিসিয়াল ভাষায় যাকে বলে ডি-টাইপ। একসময় এটা বাবার নামে ছিল, চাকরিতে থাকা অবস্থায় বাবা মারা গেলে খুব কঠিন একটা সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম আমরা, তখন প্রায় অলৌকিকভাবে ভাইয়াও একই ডিপার্টমেন্টে চাকরি পেয়ে যায়, তাই সে-বাসাতেই আমরা রয়ে গেছি।
এখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে আমরাই সবচেয়ে পুরনো। কাছাকাছি আরেকটা পরিবার আছে আমাদের সমসাময়িক; সে-বাসার মেয়ে মিলি আমার বান্ধবী। ওর বাবা অবসরে গেছেন কিছুদিন আগে, ওদের পরিবার কলোনি ছেড়ে চলে যাচ্ছে দু-একদিনের মধ্যেই। চাচার পেশাগত সুনাম তেমন নেই; তাতে তেমন কিছু এসে যায় নি ওদের। মিলির বিয়ে হয়েছে ঘটা করে, ওর ভাই পড়াশোনা শেষ করে ভাল চাকরি করছে। অসৎ চাকুরের সন্তান গোল্লায় যায়- এমনটা বোধহয় বাংলা সিনেমা ছাড়া আর কোথাও দেখা যায় না আজকাল। ভাড়া বাসা খোঁজার ঝামেলাতেও যেতে হচ্ছে না মিলির বাবা-মাকে; শহরের নতুন অংশে অনেক যত্নে তৈরি হয়েছে তাদের নিজেদের বাড়ি- সেখানেই উঠবেন।

মিলিদের বাসার সামনে ট্রাক দাঁড়িয়ে, ভোরবেলা থেকে মালপত্র উঠছে। অফিসে যাবার পথে সেখানে একটু দাঁড়াই। খবরের কাগজ আর পাটের দড়িতে মোড়ানো আসবাব কিংবা তার ভগ্নাংশ; কাচের অংশ খুলে আলাদা করে নেয়া। মিলির ড্রেসিং টেবিলটা চিনতে পারি। বইয়ের মলাটের মতো তিনভাঁজের বড় আয়না, তার নীচে অনেকগুলো খোপকাটা ড্রয়ার। আমাদের স্কুল-কলেজের নবীনবরণ, বিদায় সংবর্ধনা- এমন সব অনুষ্ঠানে যাবার আগে শাড়ি নিয়ে ওদের বাসায় চলে যেতাম, একসঙ্গে রেডি হতাম। চাচী আমাদের সাজিয়ে দিতেন নিজের সংগ্রহের যাবতীয় প্রসাধনীর ঝাঁপি খুলে, শাড়ি পরিয়ে দিতেন দক্ষ হাতে। বড় আয়নাটার সামনে আমাকে দাঁড় করিয়ে প্রতিবার বলতেন, ‘তোমার মা যে কেমন করে ওই স্টিলের আলমারির একফালা আয়নাটা দেখে ডেইলি ডেইলি শাড়ি পরে, আমি বাবা বুঝি না’…

আমাদের অনেক কিছুই মিলির বাবা-মা বোঝেন নি অথবা ভুল বুঝেছেন। তাদের ছেলের দুর্বলতা টের পান নি, দোষ দিয়েছেন আমার বাবা-মাকে। তারা নাকি নিজের মেয়েকে মিলির সঙ্গে বন্ধুত্বের ছুতোয় লেলিয়ে দিয়েছেন মাসুদের পিছনে! সেই মাসুদ- মিলির ভীষণ মেধাবী ভাই- কলোনির সবাই যাকে একনামে চেনে ভাল ছাত্র হিসেবে। মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকের পর যার ছবি খবরের কাগজে দেখা গেছে। ছোটবেলা থেকেই তাকে দেখছি, ভাল ছাত্র- এর বাইরে কখনোই আলাদা করে কিছু মনে হয় নি।

আমরা যখন কলেজে অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে মাত্র ঢুকেছি, তখন একবার এক ছুটিতে মাসুদভাই ঢাকা থেকে এসেছে। ফুটবল-ক্রিকেটের বিশ্বকাপের মৌসুমে তাদের ভার্সিটি নাকি এমনিতেই বন্ধ হয়ে যায়, ছেলেরা সব ক্লাসে তালা ঝুলিয়ে দেয় বলে! মিলি আর আমি প্রতিদিন একসঙ্গে কলেজে যেতাম। সেদিন মিলি বারান্দা থেকে হাত নেড়ে ‘বাই’ বলে দিল, কলেজে যাবে না, কোথায় নাকি দাওয়াত আছে। মোড়ে গিয়ে একা রিকশায় উঠেছি; আমাকে চমকে দিয়ে কোত্থেকে লাফিয়ে উঠল মাসুদভাই।
– একটু লিফট নিচ্ছি, অসুবিধা আছে?
– আসলে কলোনির কেউ দেখতে পেলে… না মানে মা যদি টের পায় তাহলে…
– ব্যাপার না, হুড তুলে দিচ্ছি! এই যে ড্রাইভার ভাই, একটু উল্টোদিকে ঘোরো তো, ওয়ার সিমেট্রি যাব। তমা তুমি কি ভয় পাচ্ছ, এমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছ যে! কেউ জেনে ফেলবে ভাবছ? আরে চিন্তা কোরো না, মিলিকে দুপুরে কপার চিমনিতে খাওয়াব বলেছি, নেক্সট তিনচার ঘণ্টা সে আর বাসা থেকে বের হচ্ছে না, আমি শিওর!
– আ-আমি তো কলেজে…
– তোমাদের আজ এমন কিছু হাতিঘোড়া পড়ানো হবে না কলেজে, দুতিনঘণ্টা আমার জন্য অনায়াসেই তুমি স্পেয়ার করতে পার, অফ কোর্স যদি সেটা করতে চাও তবেই… একি তুমি কাঁপছ কেন তমা? আরে কী মুশকিল, পড়ে যাবে তো! ঠিক আছে, ডানহাতে রিকশার হুডটা গ্রিপ কর, বাঁহাতের দায়িত্ব আমার। উফ, কী ঠাণ্ডা হাত, তুমি বোধহয় এনিমিক তমা! আচ্ছা দেখি হিমোগ্লোবিনের ঘাটতি হলে কী দরকার হয়?
– আয়রন বোধহয়…
– উঁহু, আরো কিছু! বললে ক্ষেপে যাবে না তো আবার? তোমার চাই, আচ্ছা কানে-কানে বলি- উষ্ণতা! হাহাহা, বলতে না বলতেই কাজ হয়ে গেছে। তোমার হাতের তালু ঘামছে, তমা!
– হাতটা মুছব মাসুদভাই
– মুছতে হবে না, দেখি কত ঘামতে পার…
মাসুদভাইয়ের হাতটা একটু শিথিল হলো, তবু একদম পুরোপুরি ছাড়ে নি সে, আমিও কেন যেন নিজের হাতটা টেনে নিতে পারি নি। কিছুক্ষণের নীরবতা কাটিয়ে গভীর স্বরে সে বলেছিল- তমা শোনো, তোমার নামটা খুব ছোট, ডাকতে না ডাকতেই ফুরিয়ে যায়, একটু বড় করে নিলে বেশ হবে! আচ্ছা বলতো এই নামটা কেমন- প্রিয়তমা?

দুই

আমার অফিস শহরের আরেক প্রান্তে, পুরনো অংশে। আমাদের বন্দর নগরীর স্থানীয় পত্রিকা, বেশ নামকরা, প্রভাবশালীও বটে। পত্রিকা অফিসের একতলায় অ্যাকাউন্টসের আমরা কয়েকজন বসি। রাতের কর্মীরাও দুএকজন মাঝে-মধ্যে এসে আড্ডা দিয়ে যায়; কেউ বোধহয় একদম পুরোপুরি নিশাচর হতে পারে না!

বিজ্ঞাপন-প্রজ্ঞাপনের লেনদেনের হিসাবের বাইরেও আমার কাজ পড়ে দোতলার ফিচার রুমের শেষ মাথায়, আনিকার চেম্বারে। বেশ সিনেমাটিক ফ্যাক্ট এটা- আমাদের পত্রিকার মালিক নিঃসন্তান ও ধনী; তার প্রিয় ভাতিজি আনিকা এখানকার অধীশ্বরী। মায়ের হেডমাস্টারির স্কুলে একসঙ্গে পড়ার সময় আমরা পরস্পরকে তুমি করে বলতাম। খুব সচেতনভাবেই এখন আর ওকে সরাসরি সম্বোধন করি না। শত হলেও সে আমার বস, তার কারণেই চাকরিটা পাওয়া। আনিকাও অন্য কারো সামনে পূর্বপরিচিতির কোন নমুনা দেখায় না। বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের ডিগ্রিটা ওকে অনেক প্র্যাকটিকাল জ্ঞানও দিয়েছে- মানতেই হবে।

আনিকার জন্য আলাদা করে কিছু কাজ করে দিতে হয় আমার। মেয়েদের লেখালেখির জন্য সপ্তাহে একটা পাতা বরাদ্দ ছিল পত্রিকায়, সেটা বাড়িয়ে দুপাতা করা হয়েছে কিছুদিন আগে, কিন্তু সেভাবে লেখা আসছে না। পাঠিকাদের হয়ে আমাকেই টুকটাক লিখে দিতে হয় কতরকম নামে! বাসের মহিলা-সিটে পুরুষ যাত্রী, পাত্রী দেখা, ইভটিজিং নিয়ে চিন্তিত ভঙ্গীর চিঠি। পেতলের বাসন ঝকঝকে রাখার উপায়, ইনডোর প্ল্যান্টের যত্নের টিপস। দেশিবিদেশি পত্রিকার অভাব নেই, হাত বাড়ালেই মেটেরিয়াল। আনিকা সেখানে ফ্ল্যাগ সেঁটে রাখে, লেখা কবে যাবে তার তারিখসহ। প্রতিবার কাজের কথা সেরে উঠে আসার সময়, যেন হঠাৎ করেই খুব জরুরি কোন কথা মনে পড়েছে, এমনভাবে বলে ওঠে- ‘আচ্ছা তমা বড়আপা কেমন আছেন রে? রিটায়ারমেন্ট বেনিফিটগুলো পেতে সমস্যা হচ্ছিল, সলভ হলো?… ইয়ে তমা, তোর শরীর এখন কেমন, না মানে বলছিলাম এখন কি শুধু ওরাল ইনটেইক অফ মেডিসিন, নাকি থেরাপিও লাগে? …’

আজ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী, দুপুরে প্যাকেট লাঞ্চ ম্যানেজমেন্টের খরচে। নিত্যদিনের চেনা চেহারার বাইরে বেশ একটা উৎসবের আমেজ সারা অফিসজুড়ে, ছবি তোলা হচ্ছে বিশেষ সাপ্লিমেন্টের জন্য। মহিলা কর্মীরা আনিকার প্ল্যানমাফিক সবাই শাড়ি পরে এসেছে। পুরুষরাও অন্যদিনের চেয়ে একটু যেন গোছানো। আনিকা ঠিক কেন ডেকেছে, বোঝা যাচ্ছে না। ওর সামনের চেয়ারে হেলান দিয়ে টেবিলে পা ঠেকিয়ে ফূর্তিবাজের ভঙ্গিতে বসে আছেন মাঝবয়সী একজন। কয়েকগাছি চুল লম্বা করে ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে ঢেকে রাখা টাকে ফ্লুরোসেন্ট আলো লেপে আছে। আলাপে মনে হচ্ছে আনিকার ফুপাতো ভাই। কেমন করে যেন কথা বলছেন, ইংরেজির মতো অ্যাকসেন্টে অস্বস্তিকর বাংলা। ফিচার আর নিউজের ছেলেমেয়েদের নিয়ে তাকে বসতে বলছে আনিকা। ওরা লেখার মধ্যে ভুলভাল ইংরেজি ব্যবহার করছে, অশুদ্ধ অনুবাদ করছে, বাংলা অক্ষরে ইংরেজি শব্দ লিখতে নাকাল হচ্ছে। ভদ্রলোক গল্প করতে করতেই দু-চারটা নমুনা বলে বিদ্রূপ করছেন, উচ্চারণরীতির উদাহরণ দিচ্ছেন। একটা হঠাৎ করে কানে গেঁথে গেল- ‘এইসিমেট্রিক’! অপ্রতিসম, অর্থাৎ মাঝবরাবর থেকে দুদিকে দেখতে সমান বা একরকম না- এমন কিছু। আমরা উচ্চারণটা ভুল করে বলি এসিমেট্রিক অথবা অ্যাসিমেট্রিক…

ফুপাতো ভাইয়ের ইংরেজির লেকচার সেশন শেষ হতে হতে সন্ধ্যা নেমে গেল। আবছা আঁধারে ঘোলাটে সোডিয়াম বাতির সারি; পিচরাস্তার দুপাশ থেকে দুহাত বাড়িয়ে ঘরে ফিরতে বলছে। তবু ঘরমুখো মানুষের যেন তাড়া নেই- কেউ ঠেলাগাড়ির ফল কেউ ফুটপাথের কাপড় দেখছে, দরদাম করছে। কাল সকালে এরাই আবার ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটবে অফিসমুখী ঢল হয়ে। শাড়ি পরে বাস-মিনিবাসে ওঠার ঝক্কি অনেক, আজ রিকশা না নিয়ে উপায় নেই।

পাড়ার প্রথম মোড়ে এসে রিকশার চেইনটা আবার পড়ল, এ নিয়ে চারবার এই বিরক্তিকর ব্যাপারটা ঘটল আজ! ভাড়া মিটিয়ে সেখানেই নেমে গিয়ে হাঁটতে থাকি। একইরকম দেখতে তিনতলা পায়রার খোপগুলো পেরিয়ে যাই, একটার পর একটা, তারপর আরেকটা। কলোনিতে ইলেকট্রিসিটি নেই। ভূতুড়ে আলোয় সবগুলো কোয়ার্টার একইরকম লাগে, তবু এখানকার কেউই নিজের বাসা চিনতে ভুল করে না!

মিলিদের বাসার সামনে এ বেলায় ট্রাকের পাশে একটা জিপও দাঁড়িয়ে। জিপের খোলা দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো মাসুদ ভাই। চোখে পড়তেই একটু থমকে যাই। ভারী মাড়ের শাড়িটা এত খসখস করছে কেন? কেউ কি বলছে- টিপ-শাড়ি পরা কোন ছবি নেই তোমার, তমা? তোকে একদিন শাড়ি কিনে দেব বুঝলি, শাড়ি আর কানের দুল… একটা দিন এলোখোঁপা-কাজল আর শাড়িতে তোকে সাজাতে চাই, তুই কি আমার রাণী হবি, টুনটুনি? … … জানো তমা, তোমাকে চিঠি লেখা হয় না বটে, কিন্তু সারাদিন মনে মনে কত কথা বলে চলি… যে যা বলে বলুক, তুমি অনুমোদন করলে আমি প্রকাশ্য রাজপথে তোমার হাত ধরে হাঁটতে চাই! … … সেই কাঁপুনিগুলো কি আবার ফিরে আসছে? মাসুদ ভাই কি কিছু বলবে? নাহ্, নিজেকে ধমকে সামলে নিতে হয়। ‘এসব ভাবালুতা তোমার জন্য না, তমা! এইটুকু তো পথ, চলে যাও… স্রেফ পা চালিয়ে চলে যাও, জাস্ট পেরিয়ে যাও…’ অনিচ্ছুক পা-জোড়ায় মনের সবটুকু জোর জড়ো করে নিজেকে টেনে টেনে নিয়ে যাই বাসার দিকে।

সিঁড়িতে উঠতেই দেখি ওপরের ল্যান্ডিংয়ে মোমবাতি হাতে মা দাঁড়িয়ে। আমি আসব বলেই অন্ধকার সিঁড়িতে আলো হাতে এই প্রতীক্ষা? দৌড়ে উঠে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে আমার। না, মা ঘুরে দাঁড়িয়ে পা বাড়িয়েছে দরজার দিকে, আঁধারে আমাকে দেখতেই পায় নি! ভাবনাটা মিলল না, মা আসলে আমার অপেক্ষায় ছিল না।
-কেউ এসেছিল, মা?
-মিলির মার সঙ্গে তোর দেখা হয় নি? এইমাত্রই তো গেলেন ভাবী, কাল চলে যাচ্ছেন নিজের বাড়িতে।
-কেন এসেছিল? কোন অপমানটা বাকী রেখেছিল যে করতে এল আবার?
-এভাবে বলছিস কেন, এতবছর পাশে ছিল, নাহয় একটু ভুল বুঝেছিল একসময়…
হেডমাস্টারনীর কণ্ঠ হঠাৎ বড় কোমল শোনায়!
‘মাসুদের বিয়ের তারিখ পড়তে পারে মাস দুয়েকের মধ্যেই, খুব করে বলল তখন যেন আমরা সবাই যাই। কী হয়েছে জানিস,’ যেন দারুণ মজার কোন গল্প, বাকীটুকু এখনই না বললেই নয়, তেমনভাবে বলে চলে, ‘মিলির শ্বশুরবাড়ির দিকের অনেকেরই তো মেয়ে আছে, কিন্তু তাদের ছেলের নাকি কোন পাত্রীই পছন্দ হয় না! ছবি দেখে বলে ডান-বাম দুদিক থেকেই তোলা ছবি দিতে। বেশিরভাগ মেয়ের নাকি দুই পাশ থেকে প্রোফাইল না কী বলে ওটা দুইরকম দেখা যায়… আসলে এত ভাল ছাত্র ছিল, ভাল চাকরি করে, আবার বিদেশে যাবে ডিগ্রি করতে, তার খুঁতখুঁতানি একটু থাকবেই… …’- মা আজ মাসুদ বিষয়ক কথার তোড়ে ভেসে যাচ্ছে। সাড়া না পেয়েই বুঝি হঠাৎ আবার চেনা প্রসঙ্গে ফিরে আসে- ‘আচ্ছা তমা, তোর শরীর কেমন রে, অফিসের খাবার সহ্য হয়েছিল? এত দেরি করলি আজ, শাড়ি পরে সমস্যা হয় নি তো?’

মোমবাতিটা আমাদের ঘরে রেখে আমাকে কাপড় পাল্টানোর প্রাইভেসিটুকু দিতে মা রান্নাঘরে চলে যায়। এই রুমের জন্য আর ড্রেসিংটেবিল কেনা হয়নি। স্টিলের আলমিরার আয়নাতেই এখনও কাজ চলে আমাদের। একপাশে কাচকাটা ফুলপাতার নকশাটা ক্ষয়ে গেছে কোথাও কোথাও, তবু সে-আয়নার প্রতিফলনে ঘরজুড়ে মোমের আলো আরেকটু উজ্জ্বলতা পায়।

সাবেরা চাচী, মিলির মা, আমাকে চার সেফটিপিনের শাড়িপরা শিখিয়েছিলেন। এখন আমার লাগে সাতটা পিন। ডান বাহুর নীচে ব্লাউজের সঙ্গে শাড়ি-আটকানো ঢাউস সেফটিপিনটা দিয়ে এখন আমার আঁচল শুরু হয়। এটা না থাকলে আঁচল বসে না ঠিকমতো, খসে আসতে চায়। ঝুরঝুরিয়ে ঝরে পড়ার সময়ে চুলগুলো সেই যে কাটা হলো, আর বাড়েনি সেভাবে। নইলে লম্বা চুলে ঢাকা যেত ডানদিকটা।
এক এক করে সাতটা সেফটিপিন খুলে আয়নার সামনে দাঁড়াই। ব্লাউজের হুকগুলো খুলতেই বুকের ডানপাশে লম্বাটে কাটা দাগটা বেরিয়ে পড়ে। আশেপাশে ইতিউতি ফুলে ওঠা লিম্ফনোড; বাঁয়ের অক্ষত পাহাড়ের আদেশ মেনে ডানের দাগকাটা সমতলভূমিকে উপহাস করছে। একবছর আগেকার ব্রেস্ট রিমুভালের চিহ্ন। আরেকবার দেখে আজ বিকেলে শেখা ইংরেজি শব্দটার উচ্চারণ মনে পড়ে যায়। এইসিমেট্রিক…

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!