ঋতুপর্ণ

শীত পড়েছে ভেবে সবে লেপের কভার কাচার প্ল্যান নিয়ে ভাবনা চিন্তা শুরু করেছি অম্নি ঝুপ্স করে গরম পরে গেল। ফোন করলাম আবহওয়া দপ্তরে, বিভ্রান্ত নাগরিক হিসেবে জানতে চাইলাম যে আবার শীত ফিরবে কিনা? আরো বিভ্রান্ত করে দিয়ে তারা, জানালো সুপ্রিম কোর্টের সারদা কেসের রায় বেরোবার আগে সেরকম ভাবে কিছু বলা যাবে না। তা সুপ্রিম কোর্টে কেস করেছে রাজ্য সরকার তার সাথে শীত না ফেরার কি সম্পর্ক? উত্তরে দপ্তর থেকে জানানো হলো যে রাজ্যের আবহওয়া এতটাই রাজনৈতিক হয়ে গেছে যে বাতাসের বেগ থেকে পারদের ওঠা নামা সব কোর্টকেই ঠিক করে দিতে হচ্ছে। কি আর করব, লেপ গুটিয়ে কাঁথা গায় দিয়ে শুয়ে পড়লাম।

ঠিক মাঝরাতে নবুদার ফোন , “জেগে আছিস?” “হুম, বলো ..” “বলছি, লেপ কম্বল সামলে রাখিস , বই মেলাটা গেলে পরে হেব্বি ঠান্ডা পড়বে। একেবারে ভেতরের পাক্কা খবর !” “বই মেলা শেষ হলে ঠান্ডা পড়বে কেন?” “কেননা , তখন দিল্লিতে নতুন সরকার আসবে। ” “হ্যাঁ তাতে এখানে জলবায়ু বদলাবে কেন ?” “আহ বড় ফালতু হ্যাজাস , বড়দিন , নিউ ইয়ার , সংক্রান্তি, সরস্বতী পুজো ,বইমেলা , নির্বাচন , উপনির্বাচন, ভ্যালেনটাইনস ডে সব হয়ে গেলে লোকের আর কিছু করার থাকবেনা তাই ঠান্ডা পরবে , ব্যাস। ” “বেশ, এমনিতে ব্যাপারটা জলের মতন তরল ও সরল। তবু পরে দেখা হলে আরেকটু বুঝিয়ে বোলো যাতে করে আমি অন্যদেরকেও এই নিয়ে দু চার কথা বলতে পারি। ” বোধহয় ক্ষেপে গিয়ে ফোন কেটে দিল নবুদা।

আমারও পরে আর ফোন করা হয়নি। তকাইয়ের হটাত একদিন শখ হলো যে সে কাঠকয়লার গুড়ো ও তিসির তেল মিশিয়ে শুকনো ছাগলের চামড়ার ওপর আঁকাআঁকি করবে। তাই এদিক সেদিক বিটকেল তার আবদারি সব জিনিস পত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছি, হটাত নবুদা হাজির। ভালো কথা , তকাইকে যারা চেনেননা তাদেরকে বলে রাখি সে কিন্ত আমার নাম ভাড়িয়ে আজকাল লোকের কাছ থেকে টাকা পয়সা ধার করছে ! একটু সাবধান, ওর পাল্লায় পরবেন কেননা না হলে ও আপনাকে দাড়িপাল্লায় চাপিয়ে নীলগঞ্জের হাটে সের দরে বেচে দিয়ে আসতে পারে। অনেক দিন দেখা নেই, দেখলাম নবুদা আগের চেয়ে বেশ খানিকটা রোগা হয়ে গেছে।
জিগ্গেস করলাম, “এরকম শুকিয়ে গেছ কেন?” উত্তর এলো , “মরশুমী প্রভাব , ঋতু পাল্টালেই সব ঠিক হয়ে যাবে। ” “তা তোমার কোনও মরশুম স্যুট করে না বলে তো জানা ছিল না , নতুন রোগ টোগ বাধাওনি তো?” ” আরে না না , বসন্তটা আসতে দে, দেখবি কোকিলের ডাকে ডাকে চেহারা ফিরে পাচ্ছি। ” “হুঃ , কোথায় আর বসন্ত আর কোথায় বা কোকিল ?” “এই তো শীত প্রায় শেষ , এরপর নতুন পাতা, ফুল , বাংলার বুকে চিরবসন্ত নামবে। দেখে নিস ! ” “হ্যাঁ তোমার জন্যে বসন্তসেনা নেমে আসবেন, ফুলই বটে, আগে ভাগে এপ্রিল ফুল !” নবুদা বিড়ি ধরালো ও আমরা হাটতে হাটতে গঙ্গার দিকে এগোতে থাকলাম। রোদ্দুর পরে গেছে অনেকক্ষণ , দু ভার চা কিনে কোণের দিকে একটা ফাঁকা বেঞ্চি বেছে বসলাম দুজনে। “ওরম বলিস না , তোর্ ক্যাটক্যাটে কথা বাঙালির জন্য বড়ই বেদনাদায়ক, বেঁচে থাকলে ঋতুপর্ণ বড়ই কষ্ট পেতো। ” “কোন ঋতুপর্ণ ? ফিল্মমেকার ?” “আর কটা ঋতুপর্ণ কে চিনিস? মানুষটা ন্যাকা ন্যাকা গলায় বকাঝকা করতে করতে কতগুলো বই বানালো বলত?

অ্যাওয়ার্ডও তুলেছিল কাঁড়ি কাঁড়ি, নেহাত জটিল অস্ত্রপচার করতে গিয়ে অকালে টেশে গেল বেচারা। ” “ঋতুপর্ণ , সালা নাম শুনলেই লোকাল ট্রেনে সাঁটা ঋতুবন্ধের বিজ্ঞাপন ও পর্ণ ফিল্মের কথা মনে পরে যায় !” “ব্যাস, বাঙালিদের এই মার্কামারা চিন্তাভাবনার জন্যই তো মালটা তোদের মত সিকনিখেগোদের ওপর খেপে ছিল, চিত্রাঙ্গদা দেখেছিস ?” “দেখা শুরু করেছিলাম, বালের বই ! যিশু কে নিয়ে এমন ধ্যাষ্টামো শুরু করলো, টানতে পারলাম না। ” “তা পারবে কেন, তুমি তো যিশুর রাঁড় ! গায়ে তো লাগবেই। ওদিকে রেনকোটে ঐশর্য রাইয়ের জামা ছাড়া দেখতে বা সোহা আলীর বুড়ো জ্যাকির সাথে খাটের ওপর ক্যাঁচ ক্যাঁচ শুনতে তো কোনো অসুবিধে দেখিনা?” “ধ্যাত্তেরিকা , একটা এড জগতের মানুষ সিনেমা বানাতে শুরু করলো আর অম্নি তোমরা সব হুরমুর করে তার ন্যাকা নান্দনিক ভিডিওগ্রাফি দেখতে ছুটলে। ” “বাংলা সিনেমা তাহলে কিছুই পেলনা লোকটার কাছ থেকে বলতে চাইছিস?” “আচ্ছা কি মুশকিল , কথা হচ্ছিল মরশুমী পাতা নিয়ে।
সেখান থেকে ঋতুপর্ণ এলো ! তা এলো তো এলো, তুমি আমাকে ঋতুপর্ণের তিনগুন মেজাজে বোকাবকি শুরু করলে কেন ?” “বকছি কোথায় , বলছি ! বলছি তোদের মতন হিপোক্রিটরা থাকলে এ বাংলায় কোনো ভালো কাজ হবে না। বই লিখলে বাওয়াল , ফিল্ম বানালে ঝামেলা এমনকি অণুকবিতা লিখলেও তোদের আপত্তি। ” “কি যা তা বলছ? এখন জনগণ মোবাইল দিয়ে ফিল্ম বানিয়ে ফেলছে।

ট্যাবে লিখে বই পাবলিশ করে ফেলছে আর তুমি বলছ আমি হিপোক্রিট !” “আলবাত হিপোক্রিট, কেননা তুই এসব কিছু করিস না সুধু এর তার ঘরে বসে বসে সমালোচনা করিস। ” “যাচ্চলে ,কার সমালোচবা করলাম আবার ?” “এইত এই যে বললি, ঋতুপর্ণ মানে কি সব বিজ্ঞাপন না কি যেন?” “আরে সেতো নামটাকে নিয়ে বলেছি। আর আমার তো বাড়িওয়ালী, তিতলি, দোসর, আবহমান যথেষ্ট ভালো লেগেছে। খামোকা আমাকে ঋতুপর্ণ বিরোধী করে তুলছো কেন বুঝতে পারছিনা?” “তার মানে তুই বলছিস ঋতুপর্ণ একজন সরেশ চিত্রনির্দেশক ?” “নিশ্চই, এবং একজন ভালো অভিনেতা ও মিউজিক ডিরেক্টরও বটে !” “অভিনেতা…উমম জোর করে বলছিস নাতো ?” “না মেমোরিস ইন মার্চে বা আরেকটি প্রেমের গল্পতে ভালই লেগেছে।

” “আর চিত্রাঙ্গদাতে?” “বললাম তো দেখিনি। ” “হুম ..” “আচ্ছা কি হয়েছে বলতো , আজ হটাত এবিপি আনন্দের মত গাম্বাট প্রশ্ন করে করে আমার বিপি বাড়াচ্ছ কেন?” হটাত বেঞ্চির পাশ দিয়ে একটা কালো বেড়াল ছুটে বেরিয়ে গেলো। গঙ্গার হাওয়াটাও হুট করে একটু বাড়লো হয়ত। দু তিনটে পাতা নাকি মাকড়সা বুঝি সর সর করে পায়ের ওপর দিয়ে চলে গেলো। নবুদা বিড়িতে শেষ টান দিয়ে বলল “আসলে ময়দানে বইমেলার সময় ঋতু মাঝে মাঝে এই ঘটেই বসে লিখত টিখত। এখনও শুনেছি সে ‘ঋতু পরিবর্তনের’ সময় এইখানেতেই এদিক সেদিক ঘোরে ফেরে । দেখ ঐদিকটাতে তোর পাশেই বসে আছে হয়ত !” তর্ক করতে করতে ঘামে জামাটা ভিজে গেছিলো। বুকটা ছ্যাঁত করে উঠলো, চমকে পাশে তাকালাম , মুখ দিয়ে অস্ফুটে বেরিয়ে গেলো “নাহ, কেউ নেই !” নবুদা বলল ,”কিরে, ঠান্ডা লাগছে?”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো পড়তে পারেন...

আবিষ্কার

১ ‘ টুবলু, টুবলু, টুবলু উ উ উ ‘ মার গলা, অনেকক্ষন ধরেই শুনতে পাচ্ছি। …

সরল ও হাতি

সরল এখন খুব খুশি । কারণ সরল ইশকুলে ভর্তি হয়েছে । বাবু সরলকে ইশকুলে যেতে…

পুষুর দুঃস্বপ্ন

আলমারির তাকে থরে থরে সাজানো মধুভর্তি বয়ামগুলোর দিকে তাকিয়ে পুষুর দু চোখ চকচকিয়ে উঠলো। ‘কি…