ঋণ— মনির মুকুল

দোকানের দিকে নজর করতেই তিনি খেয়াল করলেন অন্যদিনের তুলনায় আজ আজাদের দোকানে লোক সমাগম কম। বাম পাশের প্লাস্টিকের চেয়ারটাও আজ ফাঁকা। তবে বেঞ্চে দুই জন বসা আছে। এক কাপ চা পান করার জন্য দোকানের এ পরিবেশটা নিতামত্মই খারাপ না। তিনি সামনে এগুলেন।

রূপপুর হাইস্কুলের গলির মাথার আজাদের এই চায়ের দোকানটায় চা পানের বেশ হিড়িক পড়ে যায়। মাঝে মধ্যে তিনিও চা পানের জন্য আসেন। তিনি খাইরুজ্জামান ওরফে জামান মাস্টার। রূপপুর হাইস্কুলেই শিক্ষকতা করেন।

দোকানের বাম পাশের চেয়ারটা ফাঁকা। সামনের পাতা বেঞ্চটাতে একাধিক মানুষের হুড়াহুড়িতে বসার চেয়ে চেয়ারটাতে নিরিবিলি বসে পড়ার কথা ভাবলেন জামান সাহেব। আজাদ অন্য কারো অর্ডারে চা তৈরিতে ব্যসত্ম। পাশে দন্ডায়মান একটি শিশু কর্মচারী। চা তৈরি হয়ে গেলেই সে যথা স্থানে পৌঁছাবে।

হঠাৎ মটরবাইকের শব্দ পেয়ে জামান সাহেব পেছন দিকে তাকালেন। লাল রঙের পালসার-১৫০সিসি। বাইকের চালককে তিনি চেনেন না, তবে দোকানদার আজাদের ভাবামত্মর দেখে বোঝা গেল সে চালককে ভালোভাবেই চেনে।

জামান সাহেব চেয়ারের কাছাকাছি এসেছেন। আজাদ সেদিকটায় একবায় তাকিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বলে-‘এই পিচ্ছি চেয়ারটা মুইছা পল্টু ভাইরে বইতে দে।’

আজাদের কথায় জামান সাহেব কিছুটা থমকে গেলেন। তার কথাটার দ্বারা বোঝা গেল জামান সাহেব পল্টু নামের মটরসাইকেল আরোহীর চেয়ে কম যোগ্যতা সম্পন্ন মানুষ, আর তাই চেয়ারটা পল্টু ভাইয়ের জন্যই বরাদ্দ হয়েছে।

-‘বসবো না, এক প্যাকেট বেনসন দাও।’ আরোহী তার মটরসাইকেলে বসেই বললেন।

আজাদ হাতের কাজ রেখে আগ্রহের সাথে এক প্যাকেট বেনসন বের করে পিচ্ছির কাছে দেয়। পিচ্ছি মোটরসাইকেল আরোহীর কাছে পৌঁছে দেয়ার পর সেটা পকেটে রেখে এক ঝলক ধোঁয়া ছেড়ে চলে যায়।

জামান সাহেব তখনও পাশে দাঁড়িয়ে। আজাদ তার দিকে তাকিয়ে কিছুটা বিনয় দেখিয়ে বলে- -‘স্যার বসেন, চেয়ারে বসেন।’

অগত্যা জামান সাহেব চেয়ারে বসার সুযোগ পেলেন।

-‘স্যার চা দিমু?’

-‘দাও। এক গ্লাস পানিও দিও।’

-‘এই পিচ্ছি সুন্দর কইরা গ্লাস ধুইয়া স্যাররে এক গ্লাস পানি দে।’

জামান সাহেব ভালোভাবেই জানেন এ ধরনের কথার মধ্যে প্রফেশনাল চিমত্মাধারা থাকে। ছাত্রজীবনে দীর্ঘদিন তাকে মেসে থাকতে এবং হোটেলে খেতে হয়েছে। হোটেলের ওয়েটার প্রায়ই বলতো ‘এই সুন্দর চাইয়া একটা রুই মাছের পেডি ল’। তিনি খেয়াল করে দেখেছেন ওয়েটারের কথাটা শুধুমাত্র কাস্টমারকে খুশি করতেই বলা হয়, ভেতর থেকে ভালো-মন্দ যাচাই-বাছাই ছাড়াই খাবার আসে। তাই আজাদের কথায় প্রকৃত অর্থে যত্নসহকারে গ্লাস পরিষ্কার করে পানি আনা হবে এমন আস্থা তিনি রাখতে পারলেন না।

আজাদ চায়ের কাপে চামচ নাড়তে বলে- ‘স্যার আমার পোলাডারে কিন্তু আপনারে পড়াইতে হইব, ওর মাথায় কিন্তু গোবর ভরা।’ কথাটা বলার সময় ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে ওঠে।

জামান সাহেব এ কথাটা তার কাছ থেকে অনেকবারই শুনেছেন এবং প্রতিবারই তাকে আশ্বাস দিয়েছেন। আজাদের ছেলেটা এখন ক্লাস ফোরে পড়ে। আজাদ ছেলেটাকে পড়ানোর কথা বলে আসছে আরো বছর খানেক আগে থেকে। তিনিও বলে দিয়েছেন তার ছেলে হাইস্কুলে ভর্তি হলে তখন থেকে পড়াবেন। কিন্তু সে কথা আজাদ বার বার ভুলে যায় নাকি সে জামান সাহেবকে স্মরণ করিয়ে দেয় তা তিনি বুঝতে পারেন না। তাই যতবারই সে ছেলেটাকে পড়ানোর কথা বলে তিনি কথা না বাড়িয়ে একইভাবে আশ্বসত্ম করেন।

আজাদ কাপটা সামনে এগিয়ে দিয়ে তার মোবাইলটা হাতে তুলে নেয়। বেশিরভাগ সময় মোবাইলে গান বাজায় সে। চায়ের কাপে বার দুয়েক চুমুক দিতেই জামান সাহেবের কানে আজাদের মোবাইলের গানের সুর ভেসে আসে। গানটা শুনেই অবাক হন জামান সাহেব। জারি-সারি টাইপের কিছু একটা। এই যুগে এখনও কেউ এই গান শোনে! জামান একটু হাস্যোজ্জ্বল ভঙ্গিতে বললেন- ‘এ গান কোথায় পেলে আজাদ?’

-‘এসব গান তো আর যার তার কাছে পাওন যায় না, খুঁইজা খুঁইজা ম্যানেজ করছি স্যার। সোন্দর না গানডা?’ আজাদের চোখে-মুখে খুশির রেশ।

জামান সাহেব বুঝতে পারেন আজাদ তার কথার অর্থ বুঝতে পারেনি।

-‘গানডা লাগবো স্যার? ব্লুটুত চালু করেন দিয়া দিতাছি।’

-‘না, লাগবে না।’

-‘অসুবিধা নাই, লাগলে লন স্যার।’ জামান সাহেবকে একটু সন্তুষ্ট করতে পারলে পরক্ষণে তার ছেলের প্রতি সুনজর থাকবে এ ভাবনা থেকেই সাগ্রহে কথাটা বলে আজাদ।

-‘না না লাগবে না, তাছাড়া আমার ফোনেও ততটা চার্জ নেই।’

হাজার হোক জামানকে এখন ‘শিক্ষিত’ এবং ‘ভদ্রলোক’ বিশেষণের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। সেই পরিবেশে এ ধরনের গান শোভা পায় না। আজাদ তো জানে না তার রুচি বা পছন্দের লেবেল আর জামান সাহেবদের পছন্দের লেবেল এক নয়। আজাদরা অনায়াসেই ওয়েলকাম টিউন হিসেবে ‘পোলা তো নয় যেন আগুনেরই গোলা’ গান ব্যাবহার করতে পারে, কিন্তু তিনি তা পারেন না।

চা পান করতে করতে জামান সাহেবের মনে হলো তিনি যথেষ্ট সময় দেরি করে ফেলেছেন। তাকে এখন আলেয়া বিবির বাসায় যাওয়ার কথা। কোচিং সেন্টার থেকে আজ এক হাজার টাকা নিয়েছেন আলেয়া বিবিকে দেয়ার জন্য। তিনি দ্রুত চুমুক দিতে থাকলেন।

চা শেষ করে কাপটা সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বিলটা দেয়ার জন্য পকেটে হাত ঢুকিয়ে বিশ টাকার একটা নোট বের করে আজাদের দিকে বাড়িয়ে দিলেন। আজাদ চায়ের দাম রেখে বাকি টাকা ফেরত দিল।

জামান সাহেব সামনে হাঁটা শুরু করলেন।

 

২.

রান্নাঘরে রান্নার কাজে ব্যসত্ম নাহিদা বেগম। বুয়া আজকেও আসতে দেরি করছে। কিছু না বলে উধাও হওয়াটা বুয়াদের স্বভাবের মধ্যে একটি। ক’দিন আগেও কিছু না বলে দুই দিনের জন্য হারিয়ে গিয়েছিল। দুই দিন পরে এসে জানালো গ্রামের বাড়িতে তার খালা মারা যাওয়ায় সে গ্রামে গিয়েছিল। মাস দুয়েক আগেও একবার একইভাবে অন্য কার যেন মারা যাওয়ার কথা বলে তিন দিন আসেনি। যদিও বুয়ার চালচলনের ভিত্তিতে নাহিদার বিশ্বাসের ভিত কিছুটা নড়বড়ে ছিল তারপরও সে ততটা আমলে নেয়নি।

টেবিলের উপর মোবাইলটা বেজে উঠতেই নাহিদা রান্নাঘর থেকে ছুটে আসে। কিন্তু স্ক্রিনের উপর সেভ করা নম্বর দেখেই কিছুটা হতভম্ব হয়ে পড়ে। নম্বরটা তার চাচাত বোন সামিয়ার। রিংটোন শেষ হয়ে যাওয়ার শেষ মুহূর্তে নাহিদা রিসিভ করে।

মিনিট দুয়েক কথা হয় দুজনের। নাহিদা ভারাক্রামত্ম মনে ফোন রেখে আনমনে ভাবতে ভাবতে রান্না ঘরের দিকে যায়।

সামিয়ার ফোন পেলে রীতিমত লজ্জায় পড়ে যায়। ছয় মাস আগে একটা বিপদের মধ্যে পড়েছিল নাহিদা। তার একমাত্র সমত্মান সজীব দীর্ঘ দিন জ্বর-ম্যালেরিয়ায় ভুগেছিল। সেসময় অনেকদিন যাবৎ বাংলাদেশ মেডিকেলে চিকিৎসা নিতে হয়েছিল। তাদের সঞ্চয় খুব বেশি কিছু ছিল না। স্বামী জামান মাস্টার যতটুকু বেতন পান তার প্রায় সবটুকু সংসার খরচ আর বাসা ভাড়া দিতে চলে যায়। ছেলেকে সুস্থ করতে তাই অন্যের দারস্থ হতে হয়েছিল। সে সময় সামিয়ার কাছ থেকে পনের হাজার টাকা নেয়া হয়েছিল। এর মধ্যে পাঁচ হাজার শোধ করলেও দশ হাজার বাকী রয়ে গেছে। ঋণ শোধ করার জন্য সাংসারিক খরচও যথাসম্ভব কমানোর চেষ্টা করা হয়েছে। আগে জামান সাহেব স্টুডেন্ট পড়াতেন না, এখন একটা কোচিং সেন্টারে ঢুকেছেন।

বরাবরের মত আজও ফোনে সামিয়াকে আশ্বসত্ম করা হয়েছে যে তার স্বামী এখন একটা কোচিং সেন্টারে পড়ায়, এখন টাকাটা শোধ করতে বেশি সময় লাগবে না। সামিয়া কতটুকু আশ্বসত্ম হয়েছে সে-ই জানে তবে আপাতত সপ্তাহ দুয়েক তার থেকে কুকড়ে যাওয়া মনুষ্যত্বকে আড়াল রাখা যাবে নাহিদা এতে স্বসিত্ম খোঁজে। ঋণ মানুষকে মানুষের কাছে কতটা ছোট করে তা নাহিদার আগে জানা ছিল না।

হঠাৎ কলিং বেলের শব্দে নাহিদার ঘোর কাটে। এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে বুয়াকে দেখতে পায়। নাহিদা ফিরে আসে। বুয়া ভিতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়।

– ‘দেরি হলো কেন বুয়া?’

– ‘দরকারি কামে দেরি হইছে আফা।’ বুয়ার চোখে-মুখে অন্যরকম অভিব্যক্তি।

– ‘কি কাজ?’

– ‘কাল বিকালে স্যার আবার গেছিল ঐ মহিলার বাসায়। হ্যারে টাকাও দিয়া আইছে।’

কথাটা শুনেই বুয়ার দিকে ফিরে তাকায় নাহিদা। বুয়ার কথাটা যেন তাকে নির্বাক করে দেয়, কিছুটা অপ্রস্ত্ততও হয়।

– ‘সত্যিই তোমার স্যার ওখানে গিয়েছিল?’

– ‘হ আফা। আমি নিজেই স্যাররে যাইতে দেখছি।’

নাহিদা আরো চিমত্মামগ্ন হয়। সব কিছু যেন এলোমেলো হতে থাকে।

মাস খানেক আগে বুয়া একদিন জিজ্ঞেস করেছিল তাদের বসিত্মতে নাহিদাদের পরিচিত কেউ থাকে কি না? সেখানে সে জামান সাহেবকে কয়েকবার যেতে দেখেছে। ওখানে এক মহিলার সাথে কথা বলতে দেখেছে। কথাটা শুনে নাহিদার বেশ কৌতুহল হয়েছিল। সেখানে তো তাদের পরিচিত কেউ নেই। নাহিদা সেদিন বুয়াকে খোঁজখবর নেয়ার জন্য বলেছিল। বুয়া ব্যাপারটা তদমত্ম করে দুই দিন পর জানায় যে জামান সাহেব বুয়াদের বসিত্মর এক মহিলার সাথে মাঝে মধ্যে দেখা করে। মহিলাটার নাম আলেয়া। তার স্বামী কয়েক বছর আগে তাকে ফেলে চলে গেছে, আর আসে না। কোনো খোঁজখবরও নেয় না। তার আট-দশ বছরের একটা ছেলে আছে। নাম রফিক। বুয়ার এই অনুসন্ধানী রিপোর্ট নাহিদাকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছিল। আজ ব্যাপারটার গভীরতা যেন আরো বেড়ে গেল।

কাজ শেষ করে বুয়া চলে গেছে। নাহিদার মন এখনও ভারাক্রামত্ম। অন্য কোনো কিছুতে মনোযোগ বসছে না। বিয়ের সময় শোনা ‘পাত্র মেধাবী ও সৎচরিত্রবান’ কথাটা এতদিন প্রশ্নবিদ্ধ হয়নি। বিয়ের চৌদ্দ বছর পর এখন যেন তা কিছুটা ফিকে মনে হচ্ছে। ঐ পরিবেশেও সে কীভাবে যেতে পারে তাও ভাবনার বিষয়। এক মাস আগে বুয়া যখন বলেছিল তখন পুরোপুরি বিশ্বাস হয়নি, আজ সেটা চূড়ামত্ম লেবেল ছুঁয়েছে।

গত ক’মাস ধরে নাহিদা চেষ্টা করছে কীভাবে সংসারের খরচ কমিয়ে ঋণ শোধ করা যায় আর সেখানে তার স্বামী এভাবে টাকা ব্যয় করে তার ভাবতেই মাথাটা কেমন যেন করে ওঠে।

 

৩.

জামান সাহেব কিছুটা তাড়াহুড়া করে সকালের খাবার খাচ্ছেন। আজ একটু দেরি হয়ে গেছে। নাহিদা কিছুটা ভাবুক মনে কাজ করে যাচ্ছে। সে জামান সাহেবের বাটিতে তরকারি তুলে দিতে দিতে বলে- ‘কোচিং থেকে কত টাকা পাও তুমি?’

নাহিদার কথার মধ্যে একটু অন্যরকম টান অনুভব করলেন জামান সাহেব। সাধারণত কিছু জানতে চাওয়া কথাগুলো যে ধরনের হয়ে থাকে এটা তেমন না। একটু যেন তদারকি বা কৈফিয়তের সুর মেশানো। মাস খানেক যাবৎ নাহিদার আচারণ একটু অন্যরকমই মনে হচ্ছে জামান সাহেবের কাছে। তাকানোর ভাবটাও যেন ভারতীয় সিরিয়ালের মহিলাদের মত। নাহিদা প্রায়ই ভারতীয় সিরিয়াল দেখে। সমাজে এর খারাপ প্রভাব আসতে পারে এমনটা জামান সাহেবের তরফ থেকে তাকে বুঝানোর চেষ্টা করেও পরিবর্তন আসেনি। একবার স্যাটেলাইট কেবল অপারেটরদের সাথে আলাপ করেছিলেন, অমত্মত তার বাসার লাইনটাতে এই চ্যানেল বন্ধ রাখা যায় কি না। তারা জানিয়েছিল একটা ডিভাইস দিয়ে অনেকগুলো বাসার লাইন পরিচালনা করা হয়ে থাকে। বন্ধ করলে ঐ ডিভাইসের আওতাধীন সবগুলো বাসায় বন্ধ হয়ে যাবে, সেকারণে এটা সম্ভব নয়। ফলে সিরিয়ালের ঐ মহিলাদেরকে এ বাসায় আসার পথ বন্ধ করা যায়নি।

জামান সাহেবকে চুপ থাকতে দেখে নাহিদা আবার বলে- ‘বললে না যে কোচিং থেকে কত পাও?’

– ‘হাজার তিনেক পাই। কোনো মাসে স্টুডেন্ট কম থাকলে তার থেকেও কম পাই।’

জামান সাহেব ভাবলেন হঠাৎ এমন প্রশ্ন করার কারণ কি জানতে চাইবেন। কিন্তু নাহিদার ভাবমূর্তি দেখে মনে হলো জানতে চাইলে পরিস্থিতি অন্য দিকে গড়াতে পারে, তাই তিনি চুপ থাকলেন।

-‘গতকাল বাঁশবাড়ি বসিত্মর আলেয়ার কাছে কী জন্যে গিয়েছিলে?’ নাহিদা প্রশ্ন করে।

নাহিদার কথাটা শুনে কিছুটা ঘাবড়ে যায় জামান সাহেব। তিনি ভাবতেও পারেননি তাকে কখনো এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। মাস খানেক যাবৎ নাহিদার অমন আচারণের কারণ তাহলে এটাই। তিনি যেন কোনো কথা বলতে পারছেন না।

– ‘সে তোমার কি হয়? কিসের টাকা দাও তাকে?’

জামান সাহেব বাকরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছেন। ভিতরে ভিতরে ব্যাপারটা এতদূর গড়িয়েছে! তিনি বুঝতে পারছেন না এখন কি বলবেন। এদিকে স্কুলের সময় হয়ে যাচ্ছে। স্কুলে যাওয়ার পথে সজীবকে তার স্কুলে দিয়ে যেতে হয়, সেটাও দেরি হয়ে যাচ্ছে। সজীবের খাওয়া শেষ। মায়ের এমন অভিব্যক্তি আগে কখনো দেখেনি সে, তাই সেও কিছুটা বিহবল। জামান সাহেব খাবার রেখে হাত ধুয়ে ফেলেছেন। নাহিদা তার প্রশ্নের জবাব না পেয়ে আবারও মহিলাকে কিসের টাকা দেয়া হয় জানতে চায়।

জামান সাহেব কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন- ‘ঋণের টাকা’।

কথাটা নাহিদার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হলো না। সে জানায় যে তারা ঋণী হয়েছে সজীবের অসুখের সময়। তখন সঞ্চিত টাকা আর বাকীটা সামিয়ার কাছ থেকে ধার করে খরচ চালানো হয়েছে, এর বাইরে আর ঋণ করার মত কিছু হয়নি। তাছাড়া ঐ মহিলা তো তাদের কোনো আত্মীয় না এবং তাদেরকে ধার দেয়ার মত সামর্থও তার নেই তাহলে তাকে কিসের বাবদ টাকা দেয়া হয়?

জামান সাহেব একবার তার মোবাইলের দিকে তাকিয়ে সময়টা দেখলেন, তারপর বললেন- ‘স্কুল থেকে ফিরে এসে তারপর কথা বলি?’

নাহিদা চুপচাপ। বড় বড় শ্বাস প্রশ্বাস নিচ্ছে সে। নিশ্বাসের সাথে যেন বিস্ফোরিত হচ্ছে তার রাগ এবং ক্ষোভের ছায়া। জামান সাহেব তার হ্যান্ডব্যাগটা হাতে নিয়ে সজীবকে নিয়ে বের হতে উদ্যত হলেন। এমন সময় নাহিদা একটু জোরে বলে ওঠে- ‘আমাকে আর ভালো না লাগলে বলে দাও চলে যাই’।

কথাটা শুনে জামান সাহেব থমকে দাঁড়ালেন। সঙ্গে সঙ্গে হ্যান্ডব্যাগটা হাত থেকে পড়ে গেল নিচে। তিনি তোলার চেষ্টাও করলেন না। নাহিদার দিকে তাকিয়ে শামত্মভাবেই বললেন- ‘আমার অতীত জীবন সম্পর্কে খুব বেশি কিছু তুমি জানো না। তোমার প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে গেলে আমাকে অনেক পেছনে যেতে হবে।’

নাহিদা চুপ করে শোনে জামান সাহেবের কথা।

জামান সাহেব জানালেন দশ বছর বয়সে তিনি বাবাকে হারিয়েছেন। বাবা ছিলেন কৃষক। সম্পত্তি বলতে বসতভিটা ছাড়া আর কিছু ছিল না। ফলে তার মা অকূল সাগরে পড়ে। কোনো রকমে প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষ করলেও হাইস্কুলে পড়ার মত আর্থিক অবস্থা ছিল না। এ সময় আবুল কালাম নামে একজন মানুষ তাদের পাশে এসে দাঁড়ায়। স্কুলের ভর্তি ফি, পাঠ্যবই, গাইডসহ সমসত্ম খরচ তিনি দিতে থাকলেন। এস.এস.সি, এইচ.এস.সি পার হলেন তার সহায়তার উপর ভর করে। তারপর টিউশনি করে নিজে কিছুটা খরচ যোগালেও বেশিরভাগ খরচ উনিই দিতেন। আজ জামান সাহেবের শিক্ষক নামক মানুষ গড়ার কারিগর হওয়ার পেছনে পুরো কৃতিত্ব ঐ আবুল কালাম সাহেবের।

জামান সাহেব আরো জানালেন সে সময় ঐ রকম একজন মানুষ যদি এগিয়ে না আসতো তাহলে আজ তার জীবন হতে পারতো কোনো উদ্বাস্ত্তর জীবন অথবা কষ্টভরা কোনো শ্রমিকের জীবন। তাই জামান সাহেব মনে করেন তিনি ঋণী, আবুল কালাম সাহেবদের কাছে নয় (যেহেতু তারা সামর্থবান) বরং তিনি সমাজের কাছে ঋণী। আর এ ঋণ থেকে মুক্তি পাওয়ার একটাই উপায়- তার মত ঝরে পড়া কাউকে আলোর দিশা পেতে সাহায্য করা।

চার মাস আগে রফিক নামে এক টোকাইয়ের সাথে তার পরিচয় হয়। তার বাবা নেই, মার সাথে বাঁশবাড়ি বসিত্মতে থাকে। কথা বলে বুঝতে পেরেছিলেন পড়াশুনার প্রতি তার বেশ আগ্রহ আছে। গত বছর ক্লাস থ্রিতে থাকাকালীন তার রোল তিন ছিল। কিন্তু পেটের ধান্ধায় পড়ালেখা ছেড়ে এ পথে নামতে হয়েছে। এক পর্যায়ে তিনি ছেলেটির মা আলেয়া বেগমের সাথে কথা বলে জানতে পারেন পড়াশুনায় ভালো হলেও সংসারের দুরাবস্থার কারণে সে ছেলেটাকে পড়াতে পারছে না। জামান সাহেব রফিকের পড়ালেখার খরচ যোগানোর কথা বললে সে নতুন সম্ভাবনা খুঁজে পায়।

তারপর জামান সাহেব রফিককে স্কুলে ভর্তি করিয়ে পাঠ্যবই ও গাইডের ব্যবস্থা করে দিলেন। তিনি মাঝে মধ্যে গিয়ে রফিকের খোঁজখবর নেন এবং খরচ বাবদ কিছু টাকা দিয়ে আসেন। টাকা দেয়ার সময় প্রতিবারই তার মনে হয়েছে তিনি নিজের টাকা দিচ্ছেন না; জীবনের ঋণ শোধ করছেন।

নাহিদা স্বামীর কথা শুনছিল। জামান সাহেব আরো জানালেন যে আগামী মাসে রফিকের পরীক্ষা। রেজাল্টের পর তিনি রফিককে বাসায় এনে তখন নাহিদাকে সব জানাবেন ভেবেছিলেন কিন্তু তার আগেই ব্যাপারটা এমন হয়ে যাবে তিনি বুঝতে পারেননি।

নাহিদা চুপ করেই শুনে যাচ্ছে। জামান সাহেব আবার বলা শুরু করলেন। সামিনার ঋণটা শোধ না করা পর্যমত্ম তিনি যেমন হালকা হতে পারছেন না তেমনি রফিকের মত কারো জীবনকে আলোকিত করতে না পারা পর্যমত্ম জীবনের দায় থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারছেন না।

জামান সাহেব কথা শেষ করে চুপ করে নাহিদার দিকে চেয়ে রইলেন। নাহিদা স্বামীর দিকে তাকিয়ে কেঁদে ফেললো। জামান সাহেবের চোখ দুটিও ছল ছল করছে। হ্যান্ডব্যাগটা তখনও সেখানে পড়ে আছে। নাহিদা চোখ মুছে পরম যত্নের সাথে স্বামীর হ্যান্ডব্যাগটা তার হাতে তুলে দেয়।

জামান সাহেব সজীবকে নিয়ে বের হলেন। দরজায় নাহিদা বেগম দাঁড়িয়ে আছে। জামান সাহেব পেছনে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। কিছুক্ষণ আগে নাহিদার চেহারার মাঝে যে রাগান্বিত ক্ষোভের অগ্নিশর্মা ভাব দেখেছিলেন এখন সেখানে বিরাজ করছে অনুতাপের ছায়া।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!