উম্মতে মুহাম্মদীর পরিচয়

হযরত আবু দারদা রা. থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ সা. কে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ সা. কেয়ামতের দিন সব উম্মত যারা হযরত নূহ আ. থেকে আপনার উম্মত পর্যন্ত দুনিয়াতে এসেছে, তাদের মধ্যে আপনার উম্মতকে কিভাবে চিনবেন?
জওয়াবে রাসুলুল্লা সা. এরশাদ করেন, ওযর চিহ্নে তাদের চেহারা আলোকিত থাকবে। হাত পা শুভ্র হবে, তারা ছাড়া অন্য কেউ এমন হবে না। আমি তাদের এভাবেও চিনব যে, তাদের আমলনামা ডান হাতে থাকবে এবং এভাবেও চিনব, তাদের আগে আগে তাদের সন্তানেরা দৌড়াতে থাকবে। [মেশকাত শরিফ]
হাউজে কাউসার :
হাশরের ময়দানে বিপুল সংখ্যক হাউজ হবে     রাসুলুল্লাহ সা. এরশাদ করেন, প্রত্যেক নবীর একটি করে হাউজ থাকবে এবং প্রত্যেকেই গর্ব করবে , কার কাছে বেশি লোক পানি পান করতে আসে (প্রত্যেক নবীর উম্মত নিজ নিজ নবীর হাউজ থেকে পানি পান করবে)। আমি আশা করি সবচেয়ে বেশি লোক আমার হাউজ থেকে পানি পান করার জন্য আসবে।
হযরত আনাস রা. বর্ণনা করেন, আমি নবী করিম সা. এর কাছে আরজ করলাম, কেয়ামতের দিন আপনি কি আমার জন্য সুপারিশ করবেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ করব। আমি বললাম, আপনাকে কোথায় তালাশ করব?  বললেন, পুলসেরাতের উপর তালাশ করবে। আমি বললাম, যদি আপনাকে সেখানে না পাই তাহলে কোথায় তালাশ করব? বললেন যেখানে আমল মাপা হবে সেখানে তালাশ করবে। আমি বললাম, সেখানেও যদি না পাই তাহলে কোথায় তালাশ করব? বললেন, হাউজে কাউসারের নিকট তালাশ করবে। এ তিন জায়গার যে কোন এক জায়গায় আমাকে অবশ্যই পাবে।
রাসুলুল্লাহ সা. এর হাউজের বৈশিষ্ট্য
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সা. এরশাদ করেছেন, আমার হাউজের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ এত বড় হবে যে, তার এক পাশ থেকে অন্য পাশে যেতে এক মাস সময় লাগবে এবং তার সর্বদিক সমান হবে। তার পানি দুধের চেয়ে সাদা, ঘ্রাণ হবে মেশকের চেয়েও উত্তম এবং পানপাত্র হবে আকাশের তারার সমান সংখ্যক, যে তা থেকে পান করবে সে কখনও পিপাসিত হবে না।
হযরত আবু হোরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লা সা. এরশাদ করেন, নিশ্চয়ই আমার হাউজ দৈর্ঘ্য-প্রস্থে এত লম্বা যে, তার দু’দিকের মাঝের দূরত্ব আদন এবং আয়লার (আরবের দুটি স্থান) চেয়ে বেশি। বিশ্বাস কর, তা (হাউজে কাউসারের পানি) বরফের চেয়ে বেশি সাদা, মধুর থেকে বেশি মিষ্টি হবে, যাতে থাকবে দুধের মিশ্রন, তার পানপাত্র হবে তারকার সংখ্যার চাইতে বেশি। আর আমি অন্য উম্মতকে আমার হাইজে আসা থেকে ফিরিয়ে রাখব। যেমন দুনিয়াতে রাখাল তার পানি থেকে অন্যের উট সরিয়ে দেয়। সাহবায়ে কেরাম আরজ করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ সা., সেদিন আপনি আমাদের চিনতে পাবেন? রাসুলুল্লাহ সা. এরশাদ করেন, হ্যাঁ (অবশ্যই চিনতে পারব)। কারণ তোমাদের একটি আলামত থাকবে, যা অন্য উম্মতদের থাকবে না। তা হল, তোমরা যখন আমার হাউজের নিকট আসবে তখন তোমরা এ অবস্থায় আসবে যে, ওযুর চিহ্ণ দ্বারা তোমাদের চেহারা উজ্জ্বল আলোকিত এবং হাত পা শুভ্র হবে। [মুসলিম]
অন্য রেওয়াতে আছে, রাসুলুল্লাহ সা. এরশাদ করেন, আমার হাউজে আসমানের তারকা সংখ্যক সোনা-রূপার পানপাত্র দেখা যাবে। [মুসলিম শরিফ]
রাসুল সা. আরো এরশাদ করেন, সে হাউজের দুটি নালা যা জান্নাতের সাথে যুক্ত থেকে হাউজের পানি বৃদ্ধি করতে থাকবে। দুটি নালার একটি স্বর্ণের অপরটি হবে রূপার। [মুসলিম শরিফ]
সর্বপ্রথম হাউজের নিকট আগমনকারী
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সা. এরশাদ করেছেন, আমার হাউজ এত বড় হবে যে, তার একপাশ থেকে অন্য পাশের দূরত্ব হবে আদন এবং আয়লার মাঝের দূরত্বের সমান। তার পানি হবে বরফের থেকে বেশি ঠাণ্ডা, মধুর চেয়ে বেশি মিষ্টি এবং মেশকের থেকে বেশি সুঘ্রাণযুক্ত। তার পানপাত্র হবে আকাশের তারকার চেয়ে বেশি। যে একবার এ হাউজের পানি পান করবে, সে আর কখনও পিপাসিত হবে না। আমার হাউজ থেকে পানি পান করার জন্য সবার আগে দরিদ্র মুহাজিররা আসবে। জনৈক ব্যক্তি প্রশ্ন করেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ সা. তাদের অবস্থা বলে দিন। বললেন, তারা সেসব লোক, (দুনিয়াতে) যাদের মাথার চুল এলোমেলো এবং চেহারা (ক্ষুধা ও মেহনতের কারণে) বিমর্ষ, তাদের জন্য (রাজা বাদশাহ ধনী লোকেরা) দরজা খোলে না, ভাল বংশের মহিলাকে তাদের নিকট বিবাহ দেয়া হয় না। আর তাদের লেনদেন এত ভাল, তাদের কাছে অন্য কারো হক থাকলে তা পুরো করে দেয়। তাদের কোন হক যদি অন্যের কাছে থাকে তাহলে তা পুরো নেয় না; (বরং বেশির ভাগই) ছেড়ে দেয়। [তারগিব ওয়াত তারহিব]
অর্থাৎ, দুনিয়াতে তাদের অবস্থা এত খারাপ এবং করুণ ছিল, যাতে মাথার চুল গুছিয়ে বা কাপড়-চোপড় পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখবে, এমন সংগতি তাদের ছিলনা। তাদের দুঃখ কষ্ট দারিদ্র এত বেশি ছিল, যার সুস্পষ্ট ছাপ তাদের চেহারায় প্রকাশ পেত। ফলে দুনিয়ার রাজা-বাদশাহ ধনীরা তাদের খুবই তুচ্ছ মনে করত। সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে ডাকা তো দূরের কথা, তাদের জন্য ধনীদের দরজাও খোলা হতো না। আর এ দ্বীনদারদের নিকট ভালো বংশের ও  বিলাসিতার মধ্যে বড় হয়েছে এমন মহিলাদের বিবাহ দেয়া হত না। অথচ কেয়ামতের দিন তাদের সম্মান এত বেশি হবে যে, হাউজে কাউসারের নিকট তারাই সর্বপ্রথম আসবে এবং যারা তাদের তুচ্ছ মনে করত তারা তাদের পরে হাউজে কাউসারের পানি পান করবে (তবে তারা ঈমানদার এবং হাউজে কাউসারের পানি পান করার হকদার হওয়া পর্যন্ত)।
হাউজে কাউসারের কাছে সর্বপ্রথম সে সব লোক হাজির হবে যাদের মাথার চুল থাকত এলোমেলো, ময়লাযুক্ত থাকত কাপড় এবং যাদের নিকট ভাল বংশের মহিলাদের বিবাহ দেয়া হত না, যাদের জন্য দরজা খোলা হত না। এ হাদিস শুনে হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ রহ. বললেন, আমি তো এমন নই। আমার স্ত্রী খলিফা আবদুল মালেকের কন্যা ফাতেমা (শাহজাদী), আমার জন্য সবার দরজা খুলে যায়। অবশ্যই আমি এখন এমনই করব, যতক্ষণ পর্যন্ত আমার মাথার চুল এলোমেলো না হবে, কাপড় ময়লা না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত ধৌত করব না। [তারগিব ওয়াত তারহিব]
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ রহ. খলিফা (ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধান) ছিলেন। তাঁর আখেরাত চিন্তা সম্পর্কে বড় বড় কিতাবে অনেক ঘটনা বর্ণিত আছে।
হাউজে কাউসারের কাছ থেকে যাদের হটিয়ে দেয়া হবে
হযরত সাহল বিন সাদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সা. এরশাদ করেন, বিশ্বাস কর, কেয়ামতের দিন তোমরা আমার সামনা সামনি হবে (অর্থাৎ তোমাদের পানি পান করানোর জন্য আমি আগেই হাউজের কাছে পৌঁছে যাব) যে আমার নিকটবর্তী হবে সে পানি পান করবে। আর যে (আমার নিকটবর্তী হয়ে হাউজ থেকে) পানি পান করবে সে কখনও পিপাসিত হবে না।
অতঃপর এরশাদ করেন, অবশ্যই এমন কিছু লোক আমার কাছে পানি পান করতে আসবে, যাদের আমি চিনতে পারব এবং তারাও আমাকে চিনবে। অতঃপর (তাদের আমার কাছ পর্যন্ত আসতে দেয়া হবে না,) আমার এবং তাদের মাঝে আড়াল করে দেয়া হবে (তারা পানি পান থেকে বঞ্চিত হয়ে যাবে)। আমি বলব, এরা তো আমার লোক (তাদের ছেড়ে দেয়া হোক)। তখন আমাকে বলা হবে, আপনি জানেন না, আপনার পরে তারা কি কি নতুন বিষয় (বেদআত) উদ্ভাবন করেছে। এ কথা শুনে আমি বলব, আমার পরে যারা (দ্বীনে) পরিবর্তন পরিবর্ধন করেছ তারা দূর হও! দূর হও! [বুখারি শরিফ]
আহ! দ্বীনের মধ্যে নতুনত্ব সৃষ্টিকারীদের অবস্থা কি করুণই না হবে যখন তারা মসিবতে অসহায় এবং পিপাসায় কাতর হয়ে হাউজে কাউসারের কাছে যাবে, আর তাদের সেখান থেকে ধাক্কা দিয়ে ফিরিয়ে দেয়া হবে এবং রাহমাতুললিল আলামিন তাদের নতুনত্ব সৃষ্টির কথা শুনে ধুর ধুর করে তাড়িয়ে দিবেন।
কুরআন-হাদিসে যা বর্ণিত হয়েছে এবং তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে যা বলা হয়েছে, তার উপর চলার মধ্যেই কামিয়াবী রয়েছে। লোকেরা হাজারো বেদআত উদ্ভাবন করে রেখেছে এবং দ্বীনের মধ্যে পরিবর্তন পরিবর্ধন করেছে, করছে এবং করে চলেছে। যা দ্বারা তাদের দুনিয়াও চলছে এবং তারা প্রবৃত্তির মজাও উপভোগ করছে। বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন প্রকার বেদআত চালু করা হয়েছে। যদি তাদের বুঝানোর চেষ্টা করা হয়, তাহলে তারা উল্টা তিরস্কার ও অপমান করছে। আমি একটি সোজা এবং মোট কথা বলে দিচ্ছি, যে কোন কাজই করবেন, রাসুলুল্লাহ সা. যেমন করেছেন এবং যেমন বলেছেন তেমনি করবেন।
দুনিয়ার পীর ফকির মোল্লা মৌলবী যদি বলে, অমুক কাজ করলে সওয়াব পাবে, অমুক কাজ করলে  সওয়াব হয় এবং এ কাজ ভাল, তাহলে তাদের কাছে এর প্রমাণ দাবী করুন- হুযুর সা. করেছেন কিনা এবং হাদিসের কোন কিতাবে লেখা আছে, তিনি এ কাজ করেছেন কিংবা পছন্দ করতেন তাদের এসব কথা জিজ্ঞেস করুন।
জন্ম-মৃত্যু, বিবাহ-শাদী ইত্যাদিতে মহিলারা এবং দুনিয়াদার পীর-ফকীররা বড় বড় বেদআত ও শরিয়ত বহির্ভূত অনেক বিষয় আবিষ্কার এবং চালু করেছে। চেহলাম, কবরে চাদর মোড়ানো, ওরস করা ইত্যাদি অনেক কাজ কবরকে কেন্দ্র করে হয়। এর সবগুলোই বেদআত। এ ধরণের কাজ যারা করে তাদের চিন্তা করা উচিত।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!