- ঢাকার সবচেয়ে নিরাপদ জায়গাগুলোর মধ্যে একটা হলো বঙ্গভবন। বিশাল দেয়াল কড়া নিরাপত্তা, সেনা গার্ড আর নিরবচ্ছিন্ন নজরদারি সব মিলিয়ে এটা যেন অন্য এক পৃথিবী। এখানকার বাতাস ভারী ইতিহাস আর ক্ষমতার নীরব সাক্ষী।
কিন্তু ভেতরে কাজ করা পুরনো গার্ডরা ফিসফিস করে বলে বঙ্গভবনের সবচেয়ে নিরাপদ জায়গাটা নাকি একই সাথে সবচেয়ে অদ্ভুত, ভয়ঙ্কর এবং নিষিদ্ধও।
এটা হলো উত্তর সিঁড়ি।
যে সিঁড়ি দিয়ে আজ আর কেউ ওঠে না এমনকি দিনের আলোতেও কেউ ওটার ছায়া মাড়ায় না। কারণ সেখানে একটি ছায়া, একটি শব্দ আর একটি আলো এখনো থেমে নেই। এটি আর শুধু একটি পুরোনো স্থাপত্য নয় এটি এক অসম্পূর্ণ ট্র্যাজেডির করিডোর।
আমি তখন ইন্টার্ন রিসার্চার। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে আমাকে দেওয়া হয়েছিল একটি অদ্ভুত অ্যাসাইনমেন্ট: “বঙ্গভবনের পুরোনো স্থাপত্য নিয়ে নন-ফিকশন ফিচার।”
কাজটা ছিল শুষ্ক ইতিহাস-কেন্দ্রিক কিন্তু আমি জানতাম এই বিশাল স্থাপনার প্রতিটি ইটে লুকানো আছে না-বলা গল্প।
কাজ করতে করতে একদিন দুপুরে সামরিক কর্মীদের ক্যান্টিনে বসে ছিলাম। চা খেতে খেতে পুরোনো গার্ড আমজাদ ভাই হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি উত্তর সিঁড়িটা দেখেছো?”
আমি অবাক। “কোন সিঁড়ি? ভেতরের দিকে অনেক সিঁড়ি তো।”
তিনি একটু এগিয়ে এসে কণ্ঠ নিচু করে, চারপাশটা ভালো করে দেখে নিলেন। তাঁর চোখে ছিল এক অদ্ভুত সতর্কতা।
“যেটাতে ঠিক রাত তিনটার পর আলো জ্বলে… অথচ সেখানে কোনো বিদ্যুৎ লাইন নেই,” তিনি ফিসফিস করলেন। “আমাদের শিফটে যারা পড়ে, তারা জানে। ওদিকে তাকানোও বারণ।”
আমি ভেবেছিলাম এটা হয়তো নিরাপত্তাকর্মীদের মধ্যে ঘুরে বেড়ানো কোনো পুরোনো গুজব। টেনশন কাটাতে তারা হয়তো এমন গল্প ফেঁদেছে।
কিন্তু আমজাদ ভাই বললেন, “আমি হাসি-তামাশা করছি না বাবা। সেদিন ডিউটিতে ছিলাম। ঠিক রাত ৩:১৭ আমরা কন্ট্রোল রুমে বসেছিলাম, তখন আমাদের একজন চিৎকার করে উঠলো। আমরা সিসিটিভি দেখি না ওই ব্লকের। কিন্তু করিডোরের কাঁচের ফাঁক দিয়ে স্পষ্ট দেখলাম সিঁড়ির নিচ থেকে ওপর পর্যন্ত ধাপগুলো একে একে হালকা কমলা আলোয় জ্বলে উঠছে। যেন কেউ ওপরে উঠছে… একদম ধীর তালে, ধাপ ধরে ধরে। অদৃশ্য পায়ে।”
আমি হেসে ফেললাম। “বাতাসের প্রতিফলন হবে, কিংবা হ্যালুসিনেশন।”
কিন্তু তিনি আমার দিকে যে চোখে তাকালেন সেটা কৌতুক নয়, সেটা ছিল একেবারে খাঁটি শীতল ভয়। তাঁর চোখ যেন সেই সিঁড়ির আলোটা এখনো দেখছিল। “যেদিন নিজের চোখে দেখবে, সেদিন বুঝবে। ওটা আলো নয় ওটা চাপের প্রতিবিম্ব। যেন কারো ওজন পড়ছে আর ধাপটা জ্বলে উঠছে।”
পরের সপ্তাহে আমাকে ভেতরের একটি ব্লকে ছবি তুলতে পাঠানো হলো। সন্ধ্যা নেমে গিয়েছিল। ভেতরের নীরবতা ছিল অদ্ভুত। প্রধান সড়কগুলো আলোকিত কোর্টইয়ার্ডে ফুলের গন্ধ, কিন্তু আমার গন্তব্যের এক কোণ বরাবরই অন্ধকার। আলো সেখানে যেন পৌঁছাতে ভয় পায়।
গাইড বললেন, “ওদিকে যাবেন না। ওই অংশটা এখন আর ব্যবহৃত হয় না। একদম রিস্ট্রিক্টেড।”
“কেন?” আমি জানতে চাইলাম।
তিনি কাঁধ ঝাঁকালেন। “প্রশাসনিক নির্দেশ। অনেক পুরোনো অংশ। বলা হয়, যেকোনো মুহূর্তে ধ্বসে পড়তে পারে।”
কিন্তু কী নির্দেশ জানালেন না। তবে দূর থেকে দেখতে পেলাম একটা পুরোনো লোহার দরজা। তার পাশে ভাঙা কাঁচের জানালা এবং উপরে উঠে যাওয়া এক দীর্ঘ অসীম ধাপ উত্তর সিঁড়ি।
আমি দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। ভাঙা কাচের জানালা দিয়ে ভেতরে তাকাতেই মনে হলো আলোটা খুব অদ্ভুত ঠাণ্ডা, যেন ফ্রিজের ভেতর থেকে আসছে। সূর্যের আলো সেখানে পৌঁছায় না কখনোই। আর ধুলো জমা সিঁড়িগুলো মনে হচ্ছিল অসময়ে কাঁপছে যেন কেউ ওপর থেকে নিচে নেমে আসার জন্য তৈরি হচ্ছে।
আমি কৌতূহল সামলাতে না পেরে মোবাইল তুলতেই আমার গাইড চিৎকার করে বললেন, “ছবি তুলবেন না! ওটা… নিষিদ্ধ। এই কাজটার জন্য আপনার চাকরি যেতে পারে!”
আমি থমকে গেলাম। কিন্তু নিষেধের কারণ তিনি স্পষ্ট করলেন না। মনে হলো তিনিও জানেন না নাকি বলতে চান না। শুধু জানালন, “আমরা শুধু জানি, ওটার আশেপাশে দিনের আলোয়ও বেশিক্ষণ থাকা উচিত না।
আমি থামলাম না। কৌতূহল যেন আমাকে এক অদৃশ্য সুতো দিয়ে টেনে নিয়ে চলছিল। আমজাদ ভাইয়ের বলা প্রতিটি শব্দ আমার মাথায় বাজছিল।
পরদিন সিদ্ধান্ত নিলাম রাতে দেখব। রিসার্চ অফিসে রাত পর্যন্ত কাজ করার অনুমতি নিলাম। গার্ড বদলের পর করিডোরে কেউ থাকে না এই সময়টাই ঠিক। ঘড়িতে যখন ৩:১০ আমি নিঃশব্দে উত্তর ব্লকের দিকে গেলাম। আমার হার্টবিট যেন প্রতিটা নীরব ধাপে শব্দ করছিল।
চারদিক নিস্তব্ধ। শুধু দূরে একজন গার্ডের বুটের শব্দ আসছে। আমি তার যাওয়ার অপেক্ষা করলাম। করিডোরের শেষ মাথায় পৌঁছে আমি একটা পিলারের আড়ালে দাঁড়ালাম যেখানে আমাকে দেখা যাবে না।
৩:১৬।
হঠাৎ ঠান্ডা হাওয়া বয়ে গেল। দরজার ফাঁক দিয়ে বাতাস সিঁড়ির দিকে টেনে নিচ্ছিল যেন ভেতরে কেউ গভীর, ক্লান্ত নিঃশ্বাস নিচ্ছে। বাতাসের সেই শব্দটা আমার কানের ভেতরে গুঞ্জন তৈরি করছিল।
৩:১৭
চট
চট
চট
ধাপগুলো একে একে হালকা কমলা আলোয় জ্বলে উঠল। একদম ধীর তাল যেন কারো পায়ের নিচে চাপ পড়ছে। আলোটা যেন ধাপের গা থেকে নয় বরং ভেতর থেকে বেরোচ্ছিল।
ঠিক তখনই শুনলাম হালকা ধাতব শব্দ যেন লোহার রড মাটিতে ছুঁয়ে চলেছে। শব্দটা ভারি নয় কিন্তু তার তীব্রতা ভয়ানক।
আমার গলা শুকিয়ে গেল। অনুভব করলাম, সিঁড়ির ওপরে কেউ নেই কিন্তু কেউ উঠছে। কারো অদৃশ্য ওজন আছে।
আমি দরজায় হাত রাখতেই সিঁড়ির ৫ম ধাপটা জ্বলে উঠে নিভে গেল যেন ঠিক আমার দিকে তাকালো। ছায়াটি দেখা যাচ্ছিল না কিন্তু ধাপগুলো জানাচ্ছিল এটা বাস্তব। এটা কোনো আলোর বিভ্রম নয়। এটা কোনো শব্দের প্রতিধ্বনি নয়। এটা কারো চলমান, ভারবাহী অস্তিত্ব।
আমি পিছু হটলাম। পিলারের আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখলাম আলো ওপরের দিকে উঠে থেমে গেল ১১তম ধাপে। তারপর নিস্তব্ধতা। এক শূন্য গহ্বরের মতো নীরবতা। বাতাসটাও যেন থেমে গেছে।
হঠাৎ একটা মহিলা কণ্ঠ খুব নিচু, খুব ক্লান্ত স্বরে বলল,
“আরেকবার… শুধু আরেকবার… চেষ্টা করতে দাও…”
আমি জমে গেলাম। শব্দটা দূর থেকে আসেনি। এসেছিল আমার কানের পিছন থেকে, যেন কেউ একেবারেই কাছে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করছে। তার কণ্ঠস্বর কাঁপছিল, এক গভীর হতাশা আর যন্ত্রণায়।
আমি দৌড়াতে গিয়েও থেমে গেলাম। পেছনে তাকালাম কেউ নেই। শুধু বাতাসে কাঁপছিল পুরোনো সিঁড়ির মরিচা ধরা রেলিং। আমি শুধু দৌড়েই সেখান থেকে সরে এলাম।
পরদিন সকালে অফিসে গেলাম। তখনও আমার হাত-পা কাঁপছিল। একজন সিনিয়র কর্মকর্তা আমাকে চুপচাপ ডেকে বললেন, “গত রাতে তুমি উত্তর সিঁড়ির কাছে ছিলে?”
আমি হতবাক। কেউই তো আমাকে দেখেনি।
তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। “আমরা সিসিটিভি দেখি না ওই সেকশনের। কিন্তু গত রাতে সেনা গার্ড রিপোর্ট করেছে ওরা নাকি আবার দেখেছে সেই ছায়াটা। কেউ ওপর থেকে নেমে আসছিল… কিন্তু মাটিতে পৌঁছানোর আগেই ধোঁয়ার মতো মিলিয়ে গেছে।”
আমি বললাম, “ওটা কি… কোনো ইতিহাস? কোনো দুর্ঘটনা?”
তিনি ধীরে মাথা নেড়ে বললেন, “বহু বছর আগে এখানে এক ভয়ঙ্কর ধ্বস হয়েছিল। তখনকার রেনোভেশনে। একজন মহিলা স্টাফ আর্কাইভ বিভাগে কর্মরত তিনি ছিলেন পুরোনো নথি নামাতে ওই সিঁড়িতে। ধ্বস নামতেই তিনি চাপা পড়ে যান… আর উদ্ধার করা হয়নি আর।”
তিনি আর কিছু বলেননি। শুধু এতটুকু বললেন, “তাঁর নথিগুলো ছিল অসম্পূর্ণ। বলা হয়, তিনি মৃত্যুর আগের রাতে সহকর্মীকে বলেছিলেন, ‘কালকে শেষ করব… ফাইলটা বুকে পুড়ে আছে।’ হয়তো সেই অপূর্ণ কাজটাই তাঁকে বেঁধে রেখেছে। তিনি প্রতি রাতে চেষ্টা করেন সেই ১১তম ধাপ থেকে নিচে নামতে, তাঁর ফাইলটা শেষ করতে।
আমি অফিসের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু এক সপ্তাহ পর মধ্যরাতে আবার সেখানে যেতে হলো জরুরী কাগজপত্র আনার জন্য। মনস্থির করে গেলাম উত্তর সিঁড়ি আর দেখব না।
কিন্তু ফিরতি পথে করিডোরের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম একটি অবয়ব। দেয়ালের পাশে, আলোহীন জায়গায় এক মহিলা… পিঠ আমার দিকে। অত্যন্ত ধীরে ধীরে সিঁড়ির দিকে এগোচ্ছেন। চুলগুলো ছড়িয়ে আছে পরনে পুরোনো ধূসর শাড়ি। তাঁর চলার শব্দ ছিল না।
আমি নিষ্পলক তাকিয়ে রইলাম। তিনি সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা দিতেই ধাপটা নিজে নিজেই জ্বলে উঠল, ঠিক রাত ৩:১৭-এর মতো।
ঠিক তখনই তিনি থেমে, এক মিলিমিটারও না ঘুরে বললেন,
“তুমি তো দেখেছো… তাই না?”
আমার শরীর জমে গেল। তিনি যেন আমার ভয়ের গন্ধ পেয়েছিলেন, যেন আমার উপস্থিতি তাঁর কাছে আর গোপন ছিল না।
তিনি আরও বললেন, “আমার কাজটা শেষ হয়নি… তুমি কি দেখবে? শুধু একবার উপরে ওঠো। শুধু এক ধাপ… আমাকে সাহায্য করো।”
তাঁর হাত সামান্য উঠল প্রতিটি আঙুল অস্বাভাবিক উল্টো দিকে বাঁকা, যেন ধসে পড়ার সময় পাথরের নিচে চেপে গিয়েছিল। তাঁর কণ্ঠস্বর এবার আর ক্লান্ত নয়, সেটি ছিল এক আর্জি, যা মৃত্যুর ওপার থেকে আসা।
“ফাইলটা… অসম্পূর্ণ… আমাকে একা রেখে যেয়ো না…”
আমি আর দাঁড়াইনি। এক মুহূর্তও না। আমি তখন দৌড়াচ্ছি। শুধু দৌড়াচ্ছি।
আজও কেউ ওই সিঁড়িতে ওঠে না। ফ্লোরটা রিস্ট্রিক্টেড। বিদ্যুৎ লাইন নেই সিসিটিভিও নয়। কিন্তু গার্ডরা জানে ৩:১৭ হলে ধাপগুলো জ্বলে ওঠে। ধাপে ধাপে কেউ উঠে… অথবা নামে।
অনেকে বলে যেদিন তাঁর শেষ নথিটা খুঁজে পাওয়া যাবে, সেদিন আলো নিভে যাবে। সেদিন তাঁর অপূর্ণ কাজ শেষ হবে।
ততদিন উত্তর সিঁড়ি ঢাকার শান্তির সবচেয়ে বড় স্থাপনার ভেতর… এক অদৃশ্য পায়ের শব্দ বয়ে বেড়াবে।
চট
চট
চট…
হয়তো কারো অপূর্ণ দায়িত্ব আজও শেষ হয়নি। আর সেই দায়িত্বের ভারেই প্রতি রাতে জ্বলে ওঠে উত্তর সিঁড়ির আলো।
“এই গল্পটা শেয়ার করুন কারণ যে সিঁড়ির শব্দটা আজও থেমে নেই, সেটা হয়তো কেউ ভুলে গেলে আরও জোরে ফিরে আসবে।”
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।