উত্তরসূরি–৩য় পর্ব-সুনন্দ কুমার স্যান্যাল

গল্পের চতুর্থ অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

 

বিস্কুট আগেই খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। এখন সিগারেটটায় সুখটান দিয়ে আগে সেটা অ্যাশ ট্রের মধ্যে ভালো করে ঘষে ঘষে নেভায় দ্বীপ। তারপর এক চুমুকে চায়ের বাকিটা শেষ করে উঠে পড়ে রওনা হয় বাথরুমের দিকে। শীতের সময় বাইরে থেকে ফিরলেই বড় গা ম্যাজম্যাজ করে তার, তাই উষ্ণ জলে ভালো করে একটা শাওয়ার নিয়ে ফ্রেস হতে হবে। তারপর বেরোতে হবে বৈশাখী বৌদিদের বাড়ির উদ্দেশে। স্নানে ঢোকার আগে নিজের ওয়াইনের স্টক থেকে একটা ভালো বোতল আলাদা করে রাখল নিয়ে যাবে বলে। এখানকার নিমন্ত্রণে এ ধরনের একটা কিছু নিয়ে যাওয়াটাই রেওয়াজ।

স্নান সেরে সাড়ে ছটা নাগাদ তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ল দ্বীপ। শহরের একেবারে অন্য প্রান্তের শহরতলীতে মিত্রদের বাড়ি। ঘন্টাখানেকের রাস্তা, কিন্তু শুক্রবারের সন্ধের ট্রাফিকে সেটা কতক্ষণে দাঁড়াবে কেউ বলতে পারে না। আজ শিকাগোর শীতের মার্কামারা ওয়েদার, অর্থাৎ মেঘলা আকাশ আর হাড় হিম করা হাওয়া। আজ রাতে বৃষ্টি হবেই। আর দেরি না করে দ্বীপ ঝাঁপ দিল ট্রাফিকে, এগোতে লাগল স্বাভাবিক গতির চেয়ে অনেকটাই আস্তে।

এক সময় দ্বীপ ভেবেছিল পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরে কোথাও পড়াবে। কিন্তু এখন ফেরা শব্দটার অর্থই বদলে গেছে তার কাছে। মানুষ যেখান থেকে যাত্রা শুরু করে সেখানে ফেরে, আর যেখান থেকে ফেরে সেটা একটা সাময়িক গন্তব্যমাত্র। সে যখন এখানে এসেছিল, তার ফেরার কথা ছিল কলকাতায়। আর এখন সে কলকাতায় যায় বটে, ঘন ঘনই যায়, কিন্তু ফেরে সে কলকাতা থেকে এখানে। অথচ ঘর, মানে হোম বলতে যা বোঝায়, যা নাকি মানুষের আত্মপরিচয়ের ভিত্তি, সে কি কখনও আমেরিকাকে ঠিক সেভাবে গ্রহণ করতে পেরেছে? মাঝেমাঝে দ্বীপের সন্দেহ হুয়, লাতিন আমেরিকার প্রাচীন সভ্যতায় স্পেশালাইজ করলে যে ভারতবর্ষে চাকরি পাওয়ার কোনও আশা নেই তা তো সে জানত, তবু কেন সে দক্ষিণ এশিয়া নিয়ে কাজ করল না? তাহলে কি অবচেতনে তার দেশে না ফেরারই একটা বাসনা ছিল? আবার এও মনে হয়, দেশ মানে ঠিক কি? সে তো আজীবন ছিল কলকাতায়। তা ফিরে গিয়ে কলকাতার বদলে দিল্লি বা বম্বেতে চাকরি পেলে সেটা কি তার কাছে ঠিক ঘরে ফেরা হত? উল্টোদিকে, এই বিশ্বায়নের দুনিয়ায় কে কোথায় থাকল তাতে কী আসে যায়? তাত্ত্বিকরা তো এসব ইস্যুকে ডিকনস্ট্রাক্ট করে ভুষ্টিনাশ করে দিয়েছে। পনেরো বছর ধরে মার্কিন শিক্ষাজগতে থাকার পর দ্বীপ এই আসল-নকলের প্রশ্নে নিজেকে ঠকায় না। নিশ্চয় তার কলকাতার প্রতি টান আছে। সুকিয়া স্ট্রিটে তার জন্মভিটে। দুর্বলতা, নস্ট্যালজিয়া থাকবে না? তার সত্ত্বার একটা বড় অংশের সঙ্গে কলকাতা অবশ্যই জড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু নাড়ির টান, মাটির টান, ইত্যাদি প্যাচপ্যাচে ক্লিশে তার একেবারেই ধাতে সয় না। এতদিনে মার্কিন কালচারের একটা অংশও যে তার আচরণে, চিন্তায়, মূল্যবোধে মিশে গেছে তা অস্বীকার করার কোনো অর্থই হয় না। এই দুইয়ের সমন্বয়েই তার আত্মপরিচয়। শিকড়সংক্রান্ত প্যানপ্যানানি, কলকাতার প্রসঙ্গে উথলে ওঠা আবেগ দ্বীপের বস্তাপচা রোম্যান্টিক সেন্টিমেন্ট বলে মনে হয়। জাপানী জুতো, ইংরাজি পাৎলুন আর রুশি টুপির পরেও বুক ঠুকে তার দিল হ্যায় বাঙালি, এমন দাবি করার লোক নয় সে।

সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে গন্তব্যে পৌঁছে গেল দ্বীপ। ফ্রিওয়ে ছেড়ে শহরতলীর ছিমছাম পাড়াটায় ঢুকে এ রাস্তা সে রাস্তা করে যখন সে বড় দোতালা বাড়িটার সামনে এসে পৌঁছল তখন পৌনে আটটা বাজে, অর্থাৎ তেমন বাড়তি সময় লাগেনি। বাড়ির অত বড় ড্রাইভওয়েটা একগাদা গাড়িতে ভর্তি, রাস্তাতেও এখানে ওখানে গাড়ি পার্ক করা। তার মানে প্রায় সবাই এসে গেছে। অগত্যা দ্বীপকে বাড়ি থেকে একটু দূরেই পার্ক করতে হল। এখানকার বাড়ির দরজা জানলা বন্ধ থাকলে বাইরে থেকে বোঝার জো নেই ভিতরে কতগুলো লোক আছে। কেবল একবারে কাছাকাছি গেলে কিছু চাপা গুঞ্জন কানে আসে। সদর দরজাটা ঠেলে খুলতেই সেই মৃদু কথা আর হাসির শব্দ নিমেষে পাঁচগুণ বেড়ে গেল। জনা ত্রিশ লোক বাড়ির নানা জায়গায় একাধিক জটলায় ছড়িয়ে রয়েছে, গোটা দশেক বাচ্চা বাড়িময় দৌড়ে বেড়াচ্ছে, আর বিভিন্ন কোণে বসানো স্পিকারে মৃদুস্বরে বাজছে আধুনিক বাংলা গান।

এই ধরনের জমায়েতে এমন কিছু লোকের সাথে দেখা হয় যাদের সঙ্গে কোনোদিন দেখা না হলেও দ্বীপের কিছু যায় আসে না। এদেশের সিংহভাগ বাঙালি সায়েন্স বা টেকনোলজির লাইনে কাজ করে। দ্বীপের পেশা শুনে হাঁ করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেছে এমন লোকের সংখ্যা কম নয়। বোধহয় ভাবে কেন মরতে লোকে এই লাইনে যায়। কেউ কেউ আবার নিজের অজ্ঞতা ঢাকতে তার কাজের ব্যাপারে উৎসাহ দেখায়, তারপরেই মায়া সভ্যতার নাম শুনে হকচকিয়ে যায়। তারা যে মায়া কথাটার বাংলা মানে ছাড়া আর কিছুই জানে না সেটা স্পষ্ট ধরা পড়ে। বহুদিন যাবৎ এ হেন লোকেদের করুণা করাও ছেড়ে দিয়েছে দ্বীপ।

 

গল্পের চতুর্থ অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

 

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!