গল্পের ৩য় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
আনসারিং মেশিনের আলোটা দপদপ করছে। ভয়েস মেল শোনার বোতামটা টিপে দিয়ে, একটা সিগারেট ধরিয়ে মোড়ার ওপর পা তুলে সোফায় গা এলিয়ে বসল দ্বীপ। মেসেজে মায়ের গলা: ‘নিশ্চয় বেরিয়েছিস। কাল সকালে একবার ফোন করিস বাবা! আর সাবধানে গাড়ি চালাস! বড় চিন্তা হয়! রাখছি।’ আমেরিকায় ড্রাইভিং নিয়ে মায়ের বরাবরই দুশ্চিন্তা। বহু বুঝিয়েও ফল হয়নি। প্রত্যেকবার এই সাবধানবাণী দেবেনই। কাল শনিবার, ১৩ই জানুয়ারি। দ্বীপের ছত্রিশতম জন্মদিন। বহু বছর আগে, তার ছোটবেলাতেই তা পালন করা বন্ধ হয়ে গেছে। ঐদিন সে পৃথিবীর যেখানেই থাকুক, মা-বাবাকে একবার ফোন তাকে করতেই হয়।
কাকাইয়ের এই চেহারাটা তার মনে থাকার কথা নয়, কিন্তু আছে। ছেলেবেলার কিছু কিছু ঘটনা আশ্চর্য স্পষ্টভাবে মনে আছে, যা বললে অনেকেই বিশ্বাস করতে চায় না। টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলা কোনো সিনেমার অসংলগ্ন ক্লিপের মতন। মনে পড়ে কাকাইয়ের মুখটা। ভীষণ ভালোবাসত তাকে। কিন্তু হঠাৎ একদিন কোথায় চলে গেল কাকাই। মা বাবা ঠাম্মাকে জিজ্ঞাসা করলে বলত ‘কাজে গেছে’। তারপর একটা রাতের কথা দ্বীপের পরিষ্কার মনে পড়ে। তার বয়স বোধহয় তখন চার। গভীর রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখে কোঁকড়া চুলওয়ালা এই মুখটা, ঠিক ছবির এই মুখটা তার মুখের ওপর ঝুঁকে রয়েছে। কেবল এই ছবির মতো সেটা এত প্রাণবন্ত নয়, বরং খুব রোগা আর ক্লান্ত। একদৃষ্টে তাকে দেখছে আর চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। স্বপ্ন না সত্যি তার তোয়াক্কা না করেই সে উত্তেজনায় উঠে বসেছিল, ‘কাকাই! কোথায় গেছিলে তুমি?’ উত্তরে একটু হেসে তার কপালে একটা চুমু দিয়ে তাকে আবার শুইয়ে দিয়ে কাকাই বলেছিল, ‘ঘুমো বাবা।’ মনে হয় যেন এই সেদিনের ঘটনা। চায়ের জলের কেটলি সিটি মারায় সম্বিৎ আসে দ্বীপের। উঠে রান্নাঘরে গিয়ে গরম জল কাপে ঢেলে। তাতে টি-ব্যাগ চুবিয়ে চা তৈরি করে। তারপর চায়ের কাপ আর গোটা দুয়েক বিস্কুট নিয়ে আবার এসে বসে সোফায়। আবার একটা সিগারেট ধরায়।
দ্বীপ এখানকার বাঙালিদের মধ্যে খুব বেশি লোকের বাড়ি যায় না। তবে বৈশাখী ও সুখময় মিত্রের বাড়িতে খুবই যায়। এখানকার বাকি সকলের সঙ্গেও তার ওদের ওখানেই আলাপ। বৈশাখী বৌদি এক বলার মতো চরিত্র। পঞ্চাশের এপাশ ওপাশ বয়স। দারুণ সুন্দরী নন মোটেই, তবে ঈষৎ ভারি হয়ে গেলেও চেহারায় এমন একটা চার্ম আছে যা একঘর লোকের মাঝেও নজরে পড়ে। চওড়া কপালে ইয়াবড় এক টিপ পরেন মহিলা, এবং তাতে তাঁর চেহারা যে আরও বেশ কিছুটা আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে সে ব্যাপারে তিনি ভালোরকম সচেতন। আড়ালে তাঁকে অনেকেই বিন্দিরানি বলে। অনর্গল কথা বলেন, ভালো অভিনয় করেন। চাকরি সামলে পিকনিক, রবীন্দ্রজয়ন্তী ইত্যাদির উদ্যোগ নেওয়া ছাড়াও প্রায়ই পার্টি দেন নিজের বাড়িতে অকারণেই, এবং সব রান্না নিজে করেন। বছর পাঁচেক আগে চাকরি নিয়ে শিকাগোতে আসারা পর এখানকার দুর্গাপুজোর আসরে যখন নির্বান্ধব দ্বীপ একা একা বসেছিল, তখন উনিই যেচে আলাপ করেছিলেন তার সঙ্গে। নিজের কাছে অস্বীকার করে না দ্বীপ, যাকে এ দেশে বলে ক্রাশ, প্রথমদিকে বৈশাখী বৌদির প্রতি সেরকম একটা রোম্যান্টিক ভালো লাগা ছিল তার। প্রায়ই চোরাচোখে তাঁকে দেখত সে। বৌদির চেয়ে বছর পাঁচেকের বড়ো সুখময়দা তুলনায় অনেক শান্ত মানুষ, এক তাঁর বাড়ি কাঁপানো অট্টহাসিটা ছাড়া। শ্যামবর্ণ, সুদর্শন চেহারা, অসম্ভব সাদাসিধে আর রসিক লোক। একটা ফুটো লুঙ্গি পড়ে সোফায় পা মুড়ে বসে বাটিতে করে মুড়ি চানাচুর মাখা চিবোতে চিবোতে যখন আড্ডা মারেন আর হা হা করে হাসেন, তখন বিশ্বাস করা কঠিন যে উনি বেশ নামকরা একজন কার্ডিওলজিস্ট। উনি নিজে অবশ্য নিজেকে বলেন হৃদয়গুরু। রবিনসন ক্রুসোর গল্পের সঙ্গে দ্বীপের নামকে জড়িয়ে তাকে তিনি ডাকেন ক্রুসো বলে। চমকে দেওয়ার মতো গানের গলা সুখময়দা’র। ওঁদের একমাত্র মেয়ে তিত্লি, মানে বর্ষা নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে জার্নালিসম নিয়ে পড়ছে।
প্রবাসে দেশওয়ালিদের সাথে সম্পর্ক অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেশের সম্পর্কগুলোর তুলনায় অগভীর হয়। এখানকার সম্পর্কে পারস্পরিক সহিষ্ণুতার সীমারেখা সহজেই নজরে পড়ে। একটা পর্যায়ের পর প্রত্যেকে নিজের পরিবার, ব্যক্তিগত আবর্তে ঘোরে। বলা যায়, দেশের বন্ধুত্বে যদি ডুব দেওয়া যায়, এখানে হাঁটুজলেই স্নান সারতে হয়। প্রথম প্রথম এতে দ্বীপের বেশ অসুবিধা হত, কিন্তু ক্রমে অভ্যেস হয়ে গেছে। এখন সে এখানকার এই অলিখিত নিয়ম মেনেই চলে, মিত্র পরিবারের ক্ষেত্রেই যার একমাত্র ব্যতিক্রম। সুখময়দা আর বৌদির মাই ডিয়ার স্বভাব আর বিভিন্ন বিষয়ে আগ্রহের জন্য দ্বীপের ভালো লাগে এই দুজনকে। তাঁরাও ওকে যথেষ্ট স্নেহ করেন।
গল্পের ৩য় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।