উত্তরসূরি-সপ্তম পর্ব সুনন্দ কুমার স্যান্যাল

গল্পের শেষ অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

 

কোনো বিদেশীর পক্ষে এক জাপাতিস্তা বিদ্রোহী সম্পর্কে কৌতূহল দেখানো যারপরনাই বিপজ্জনক, তাই পরে আরও দুবার চিয়াপাসে গেলেও মার্কোসের খোঁজ করেনি দ্বীপ। খোঁজেনি, কিন্তু ভুলতেও পারেনি তাকে। আজও প্রায়ই মনে পড়ে রকেট লঞ্চার কাঁধে তার বলিষ্ঠ চেহারা, কফির মগ এগিয়ে দেওয়া হাত, সপ্রতিভ বাচনভঙ্গি। কে জানে কোথায় সে আজ। হয়তো জলে জঙ্গলে লড়ে চলেছে এখনও, বা কবেই মেক্সিকান মিলিটারির বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে, অথবা মেক্সিকো সিটির জেলের কোনো অন্ধকার সেলে পচছে। কিংবা হয়তো সে ফিরে গেছে তার গ্রামে, হেরে গিয়ে মেনে নিয়েছে চিরাচরিত শোষিতের জীবন। বুঝেছে যে গুটিকয় বন্দুক, হ্যাণ্ড গ্রেনেড আর বুকভরা সদিচ্ছা দিয়ে শক্তিমান সরকারের গায়ে টোল ফেলা যায়, কিন্তু তাকে ধরাশায়ী করা যায় না।

যেমন মেনে নিয়েছে দ্বীপদের পাড়ার অতুলকাকা। অল্প বয়েসে মেডিক্যাল রিপ্রেসেনটেটিভ ছিল সে, আর দৌড়বাজির জন্য ছিল পাড়ার গর্ব। রাজ্য চাম্পিয়নশিপ জিতেছিল। এশিয়াড অলিম্পিকের স্বপ্নও দেখত। তারপর লালবাজারের মারে একটা পা আর হাত চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেলে সে সব স্বপ্নের অবসান হয়। এখন অতুলকাকা পাড়ার লোকের ট্রেনের টিকিট কেটে আনা, ইলেকট্রিক বিল জমা দেওয়া ইত্যাদি ফাই ফরমাশ খাটে। এই কি জীবন? কি হল সেই রক্তাক্ত লড়াইয়ের?

পাড়ার মোড়ে রাস্তার কোণে বসানো একসময়কার জমকালো শহীদ বেদীটার পলেস্তারা খসে, ইঁট বেরিয়ে কদর্য চেহারা নিয়েছে আজ। লোহার রেলিং কবেই খুলে নিয়ে গেছে চোরে। মার্বেলের ফলকে লেখা নামগুলো এখন প্রায় পড়াই যায় না। বেদীর নিচে একটা চায়ের দোকান, যার ত্রিপলের প্রান্ত বাঁধা থাকে বেদীর গায়ে পোঁতা পেরেকে। সবাই জানে রাত্রে দোকানটা বাংলা মদের ঠেক হয়ে যায়। ল্যাপটপ কাঁধে, সেল ফোন পকেটে যে নবীন প্রজন্ম পাশ দিয়ে হেঁটে যায়, তাদের এতে বিন্দুমাত্র আসে যায় না। কলকাতার আনাচেকানাচে অমন আরও অনেক সৌধের গায়ে লেখা দিন বদলানোর এক ব্যর্থ চেষ্টার কাহিনী তাদের কাছে ইতিহাসের সংক্ষিপ্ততম ফুটনোট হওয়ারও যোগ্য নয়।

আর কেনই বা যাবে আসবে তাদের? এই প্রজন্মের? দ্বীপের প্রজন্মের? অতীতের কোনো ব্যর্থ বিপ্লবের জন্য তারা তো দায়ী নয়! তারা তো কোনো অসম্পূর্ণ লড়াইকে সম্পূর্ণ করার অঙ্গীকার করেনি কারো কাছে! যে বিশ্বায়নরত দুনিয়াকে দ্বীপরা উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছে, সেই দুনিয়ার শর্তে না বেঁচে তারা করবেই বা কী? যে বিকল্পের দিকে তাকিয়ে অতুলকাকারা লড়েছিল, সমতার জয়গান গাওয়া সেই সমাজব্যবস্থাই তো সারা পৃথিবীতে এখন এক বিকট রসিকতা। দ্বীপ তো কাউকে প্রতিশ্রুতি দেয়নি যে সে দেশে ফিরবে এবং বলি দেবে নিজেকে! আত্মহত্যার ফলে কবে কোন সমাজ বদলেছে? দ্বীপ প্রাণপণ চেষ্টা করে তার নিজের সঙ্গে প্রসূন দত্ত বা উৎপল খাসনবিশের একটা তফাৎ খুঁজে বের করতে। আর ওর এবং তাদের মাঝখানে রকেট লঞ্চার কাঁধে করুণামাখা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকে মার্কোস।

সুখময়দার বাড়িতে ভিতর এখন গানের পর আবৃত্তি চালানো হচ্ছে। দ্বীপ যেখানে দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার ঠিক পিছনে ঘরের মধ্যে বসানো একটা স্পিকার থেকে ক্ষীণ ভেসে আসে প্রদীপ ঘোষের গলায় বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটা কবিতার লাইন, ‘……. রাত গভীর হলে, গোপনে নিজের সন্তানের ছিন্নশির ভেট দিই দিল্লিকে / তারপর গঙ্গাজলে হাত ধুয়ে ভোরবেলা বুক চাপড়ে কেঁদে উঠি / হায়! আত্মঘাতী শিশুগুলি রক্তে আছে শুয়ে!’ …… কান পেতে শুনছিল দ্বীপ, কিন্তু তাতে ছেদ পড়ল হঠাৎ। ‘দ্বীপবাবা! ও দ্বীপবাবা!’ কে যেন ডেকে উঠল দ্বীপের একেবারে কানের কাছে। চমকে চারদিকে তাকাল দ্বীপ, ‘কে?! ভেকুদাদা?!’

মনোরম এক ১৩ই জানুয়ারির সকালে ঘুম ভেঙে যায় দ্বীপের। জানালা দিয়ে এসে পড়া শীতের নরম রোদ আর কার্নিশে কতগুলো চড়াইয়ের ঝগড়া এক নিমেষে তার মনটাকে খুশি করে দেয়। কিন্তু তারপরেই খেয়াল হয় ভেকুদাদা তাকে ধরে নাড়া দিচ্ছে আর গম্ভীর গলায় ডাকছে, ‘ওঠো দ্বীপবাবা, মাসির বাড়ি যেতে হবে।’ বাড়ির পুরোনো কাজের লোক ভেকুদাদা তার সাথে দিনরাত মজা করে, তাই ঘুমচোখেও এই গলাটা দ্বীপের যেন কেমন কেমন লাগে। তাছাড়া আজ না তার জন্মদিন! আজ সে পাঁচে পড়বে, বিকেলে বন্ধুরা আসবে, খাওয়াদাওয়া হবে, একগাদা উপহার পাবে সে। তো এখন বালিগঞ্জে মাসির বাড়ি গেলে সে সবের কী হবে? ভেকুদাদাকে প্রশ্ন করতে সে দায়সারাভাবে জানিয়ে দেয় মাসির বাড়িতেই নাকি তার জন্মদিন হবে। তাতে দ্বীপের সেরকম কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু এই পাড়ার বন্ধুরা কি অতদূরে যাবে? আশপাশে মা, বাবা, ঠাম্মাকেও দেখা যাচ্ছে না। তাই সে একটু চিন্তিতভাবেই উঠে ভেকুদাদার নির্দেশে হিসি করে, মুখ ধুয়ে, দুধ খেয়ে তৈরি হয়ে নেয়।

 

গল্পের শেষ অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

 

 

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!