গল্পের সপ্তম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
কয়েক সেকেণ্ড সেটা ভিতরে ধরে রেখে, নাকমুখ দিয়ে গলগল করে ধোঁয়া ছাড়ল। অনুভব করল প্রথম টানটার আমেজ। হিমেল হাওয়ার ভিজে গন্ধ বলে দিচ্ছে যে কোনও মুহূর্তে বৃষ্টি নামবে। সে বাইরে পা দেওয়া মাত্রই বাড়ির বাইরের মোশান সেন্সার দেওয়া আলোটা আপনা থেকেই জ্বলে উঠেছে। আলো পড়ে ঝকমক করছে ড্রাইভওয়েতে ভিড় করে থাকা অতিথিদের গাড়িগুলো। দ্বীপ আনমনে চেয়ে রইল সেদিকে।
দ্বীপের সাথে কস্মিনকালেও কোনো মাওবাদীর পরিচয় ছিল না। সে শুধু চেনে মার্কোসকে। মেক্সিকোর কোনো এক প্রত্যন্ত গ্রামের চাষী মার্কোস। দক্ষিণ মেক্সিকোর চিয়াপাস দেশের সবথেকে দরিদ্র রাজ্য। আমেরিকায় আসার বছরতিনেক পর দ্বীপকে একবার সেখানে যেতে হয়েছিল কাজে। এক বিকেলে সাইটে কাজ সেরে জঙ্গলের পথে ফিরছিল, সঙ্গে শুধু এক মার্কিন সহকর্মী আর মেক্সিকান ড্রাইভার। হঠাৎ তাদের ল্যাণ্ড রোভার বিগড়াল। ড্রাইভার হুড খুলে সমস্যাটা বোঝার চেষ্টা করছে, এমন সময় নিঃশব্দে জঙ্গল ফুঁড়ে হাজির হল ছ’জন মানুষ। প্রত্যেকের মুখ ঢাকা স্কি মুখোশ বা রুমালে, হাতে রকেট লঞ্চার, এলএমজি, একে ফর্টি-সেভেন, কোমরে ম্যাগাজিন আর হ্যাণ্ড গ্রেনেড। দ্বীপ দেখল নিমেষে তার সঙ্গীদের মুখ রক্তহীন। ড্রাইভার কেবল কাঁপা গলায় ফিসফিস করে বলতে পারল, ‘জাপাতিস্তা!’
মায়ারা নিজেদের দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ ভেবেছিল। যুদ্ধ করে বশে এনেছিল মধ্য আমেরিকার বিশাল এক অঞ্চল, তৈরি করেছিল আশ্চর্য এক নগরভিত্তিক সাম্রাজ্য। আবিষ্কার করেছিল নিজেদের লিপি, ক্যালেণ্ডার, জ্যোতির্বিদ্যা, অঙ্কে শূন্যের ব্যবহার। বহু আঞ্চলিক শাখায় ভাগ হয়ে গড়ে উঠেছিল মায়া ভাষার এক বিচিত্র সম্ভার। অথচ আজ সেই সাম্রাজ্যের অবশিষ্ট কেবল বিস্তীর্ণ সব ভগ্নস্তূপ: চিচেন-ইৎজা, তিকাল, বোনামপাক, কোপান, প্যালেঙ্কে। আজ মধ্য আমেরিকার দেশগুলোতে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা আধুনিক মায়ারা হতদরিদ্র, নিপীড়িত, অপমানিত একদল মানুষ। ইউরোপীয় বংশোদ্ভূত দেশী শাসকদের সঙ্গে তাদের অনেকদিনের বিরোধ। নব্বইয়ের দশকে চিয়াপাস অঞ্চলে বহুকালের দুর্নীতি আর বঞ্চনার প্রতিবাদে এই মায়ারা সশস্ত্র গেরিলা সংগঠন গড়েছিল মেক্সিকোর সরকারের বিরুদ্ধে, তৈরি করেছিল মুক্তাঞ্চল। একদিকে তাদের প্রেরণা ছিল প্রাচীন মায়া জাত্যাভিমান, অন্যদিকে মেক্সিকোর ঐতিহাসিক কৃষক বিদ্রোহের কিংবদন্তী নেতা এমিলিয়ানো জাপাতার নামে তারা নিজেদের নাম দিয়েছিল জাপাতিস্তা। মেক্সিকোর সরকার ও সেনাবাহিনীর দুঃস্বপ্ন এই দলকে আমেরিকা টেরোরিস্ট আখ্যা দিতে দেরি করেনি।
তার সঙ্গীরা আতংকে আধমরা হলেও দ্বীপের কিন্তু কোনো ভয় করেনি দলটাকে দেখে। কেন এই বিশ্বাস, কিসের ভিত্তিকে একদল সশস্ত্র ভিনদেশী বিদ্রোহীর প্রতি তার এই আস্থা তা দ্বীপ জানে না। কিন্তু তার মনে হয়েছিল তার বা তার সঙ্গীদের কোনো ক্ষতি হবে না। দলের নেতার নাম মার্কোস। একমাত্র সে-ই খুলেছিল তার মুখোশ, যার নিচে থেকে বেরিয়েছিল বছর পঁচিশের এক গ্রাম্য যুবকের পোড়খাওয়া মুখ। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ড্রাইভারকে নিয়ে গাড়ি সারাতে লেগে গিয়েছিল দলের একজন, দুজন দাঁড়িয়েছিল পাহারায়। মার্কোস ও বাকি দুজন দ্বীপ আর তার মার্কিন বন্ধুকে চোখ বেঁধে নিয়ে গিয়েছিল তাদের জঙ্গলের আস্তানায়। সেখানে চোখ খুলে দেওয়ার পর মগে করে তাদের তিতকুটে কফি খেতে দিয়েছিল, আর শুনিয়েছিল তাদের গল্প।
চিয়াপাসের বহু মানুষই স্প্যানিশ বলে না, কিন্তু মার্কোস বলত। আর মায়ার যে শাখা তার মাতৃভাষা সেই ৎসেলটাল দ্বীপেরও কিছুটা জানা ছিল। তাই দুই ভাষাতেই কথা হয়েছিল তাদের। মার্কোস তার স্ত্রী ও দুই সন্তানের ছবি দেখিয়েছিল দ্বীপকে, বলেছিল তার পরিবারের কথা, গ্রামের কথা। শুনিয়েছিল প্রবঞ্চক প্রশাসনের কিস্সা, জমি চুরি, জাতিবিদ্বেষ, গ্রামে গ্রামে ঢুকে মেক্সিকোর পুলিশ মিলিটারির নির্বিচারে খুন আর গণধর্ষণের কাহিনী। ‘সিস্টেমের মধ্যে থেকে লড়লে তুমি অবিচারেই ভেড়া হয়ে যাবে, নয়তো ভেড়ার ভক্ষক’, বলেছিল মার্কোস। ‘আর সিস্টেমের বাইরে থেকে লড়তে গেলে তোমার তকমা হবে টেরোরিস্ট।’ ভারতবর্ষ কোথায় সে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না মার্কোসের, কিন্তু এক বিদেশীর মুখে তার অবহেলিত ভাষা শুনে আপ্লুত হয়েছিল সে।
ঘন্টাখানেক পর গাড়ি সচল হওয়ার খবর এলে আবার চোখ বেঁধে দলটা তাদের ফিরিয়ে এনেছিল। ‘গ্রাসিয়াস আমিগো! আদিয়োস!’ স্প্যানিশে বিদায় নিয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল দ্বীপ। জমি চষা হাতে তার হাতে চাপ দেওয়ার সময় হাসিতে উজ্জ্বল হয়েছিল মার্কোসের গেঁয়ো মুখ। তারপর দ্বীপ যখন গাড়িতে ওঠার জন্য পা বাড়িয়েছে, তখন পিছন থেকে ডেকেছিল সে, ‘সেন্যর!’, দ্বীপ ফিরে তাকাতে ৎসেলটালে বলেছিল, ‘ওদের গিয়ে বোলো আমরা বোকা নই। আমরা জানি আমাদের পূর্বপুরুষদের আধিপত্য আর ফিরবে না। আমরা লড়ছি আমাদের উত্তরসূরিদের জন্য। যাতে তারা মানুষের মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে পারে। এছাড়া আমাদের আর কোনো রাস্তা নেই।’