উত্তরসূরি–শেষ পর্ব-সুনন্দ কুমার স্যান্যাল

গল্পের ১ম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

সে কোলে চড়ার পক্ষে যথেষ্ট বড় হয়ে গেছে, তাই আবারও অবাক হয় যখন ভেকুদাদা তাকে কোলে নিয়ে অতিদ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নেমে সদর দরজার দিকে এগোয়। বসার ঘরের সামনে থমথমে মুখে পাড়ার বেশ কিছু লোকের জটলা। সেই ভিড় ঠেলে যাওয়ার সময় এক ঝলক চোখে পড়ে, ঠাম্মা ডিভানের ওপর নিথর হয়ে পড়ে আছে, আর মা মাথার কাছে বসে হাওয়া করতে করতে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ওদিকের সোফায় বসে বাবা, হাঁটুতে রাখা দু হাতের মধ্যে মাথা গুঁজে। তাদের চারপাশে পাড়ার মনু জেঠু, জেঠিমা, একজন পুলিশের পোশাক পরা লোক, আরও দুএকজন। তখনও দ্বীপের ঘুম পুরোপুরি কাটেনি, তাই পুরো ব্যাপারটা তার কাছে কেমন স্বপ্নের মতো বোধ হয়। দৃশ্যটা ভালো করে বুঝে ওঠার আগেই ভেকুদাদা তাকে নিয়ে বেরিয়ে আসে বাড়ি থেকে।

বাইরেও ইতিউতি অনেকের জটলা, একটা পুলিশের গাড়ি, অথচ কোনো চেঁচামেচি নেই। কেবল নিচুস্বরে গুঞ্জন আর ফিসফাস। চেনাদের কেউ কেউ ভেকুদাদার কোলে দ্বীপকে দেখে অদ্ভুতভাবে তাকায়। তখন সবে রাস্তা ধুয়েছে, সবদিক ফিটফাট, তবুও ভেকুদাদা তাকে কোল থেকে নামায় না। এরকম দৌড়েই একটা ট্যাক্সি ধরে দ্বীপকে একেবারে গাড়ির সিটে বসিয়ে দেয়, যেন ঐ মুহূর্তে তাকে নিয়ে সে ঐ পাড়া ছেড়ে পালাতে চায়। শিয়ালদা হয়ে ট্যাক্সি দক্ষিণের দিকে যেতে থাকলে এক সময় মুখ ফিরিয়ে দ্বীপ দেখে ভেকুদাদা নিঃশব্দে কাঁদছে। পুরো ব্যাপারটার একবিন্দুও বোধগম্য হয় না তার, কিন্তু সে এটা বোঝে যে সময়টা কোনো প্রশ্ন করার পক্ষে মোটেই উপযুক্ত নয়। তাই সে চুপচাপ গলা বাড়িয়ে অলস চোখে বাইরে চেয়ে থাকে। সকালের ঠাণ্ডা হাওয়ায় অল্পক্ষণের মধ্যেই তার চোখ বুজে আসে।

খবরটা এসেছিল দ্বীপের ঘুম ভাঙার ঘন্টাদুয়েক আগে, একেবারে ভোরের দিকে। দ্বীপদের বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটাপথে বেলেঘাটার পচাখাল। শেষরাতে সেখানে প্রাতঃকৃত্য করতে গিয়ে এক ঠেলাওয়ালা একেবারে পাড়ের কাছে দেখতে পায় ওদের তিনজনকে। প্রত্যেকের হাত পিছমোড়া করে বাঁধা, পরনে শুধু জাঙিয়া, শরীরে অজস্র ক্ষতচিহ্ন। পাঁকের মধ্যে মুখ গুঁজে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা রফিকুল মণ্ডল আর সুদীপ্ত ঘোষের মাথার পিছনে বুলেটের গর্ত। শুধু চিৎ হয়ে দীঘল দুটো ঘোলাটে চোখে কলকাতার রাতের আকাশে চেয়ে থাকা অশনির পেটটা ভোজালিতে এপাশ থেকে ওপাশ ফেঁড়ে দেওয়া। তার রক্ত আর নাড়িভুঁড়ি মিশে পচাখালের কদর্য পাঁক আরও বীভৎস।

পাড়ার মোড়ের ভাঙা শহীদ বেদীটায় পাথরে লেখা তিনটে নাম মলিন হয়ে গেলেও শেষেরটা চেষ্টা করলে এখনও পড়া যায় : ‘কমরেড অশনি লাহিড়ি (১৯৪৭-১৯৭২)’। ওয়াশিংটন ডিসিতে দ্বীপ দেখেছে ভিয়েৎনাম স্মৃতিসৌধের পালিশ করা কালো গ্র্যানাইটের দেওয়ালে খোদাই করা হাজার হাজার মৃত মার্কিন সৈনিকের নাম। লোকে সেখানে তাদের মৃত স্বজনের নাম খুঁজে নেয়, তারপর সেই নামের অক্ষরে হাত বোলায়, কাগজ চেপে ধরে পেন্সিল ঘষে ছাপ তোলে। দ্বীপ কখনও হাত বোলায়নি বেদীর ফলকে লেখা কাকাইয়ের নামের ওপর। ইচ্ছে হয়েছে কয়েকবার, কিন্তু পেরে ওঠেনি। ভয় হয়েছে পাড়ার লোকে পাগল বলবে। তাছাড়া, কতগুলো অক্ষরকে ছুঁয়ে কারও উপস্থিতিকে অনুভব করা সত্যিই কি সম্ভব?

চড়বড় করে বৃষ্টি নামল। হাতের সিগারেটের শেষটুকু অ্যাশ ট্রেতে গুঁজে দিয়ে আরেকটা ধরাল দ্বীপ। কিন্তু তারপরেই বুঝল ঠাণ্ডায় তার নাকের ডগা জমে যাওয়ার দাখিল। এবার ভিতরে যেতেই হবে। ডিনারের পর ফ্যাতাড়ূর স্ক্রিপ্ট পড়ার কথা, উদয়ন তাকে খুঁজবে। দুটো টান মেরে, অ্যাশ-ট্রেটাকে উপেক্ষা করে বুড়ো আঙুল আর মধ্যমায় ক্যারামের ঘুটি ছোড়ার ভঙ্গিতে দ্বীপ সিগারেটের বাকিটা ছুঁড়ে দিল সুখময়দার ড্রাইভওয়ের ধবল কংক্রীটের ওপর। জলের ফোঁটাগুলো বেশ ফাঁক রেখে পড়ছিল, তাই আশপাশের জমি ভিজে গেলেও, বাড়ির ভিতরে আড্ডারত কোনো এন আর আইয়ের ঝাঁ-চকচকে গাড়ির হাতখানেক দূরে একচিলতে শুকনো ডাঙায় পড়ে আধখাওয়া সিগারেটের আগুনটা অবাধ্য গোঁয়ারের মতো জ্বলতেই থাকল। তারপর হঠাৎ একটা নির্মম ফোঁটা পড়ল সিগারেটটার সাদা অংশে। আগুনটা তখনও জ্বলছে। দ্বীপ একদৃষ্টে দেখতে থাকল, সাদা অংশটার আর্দ্রতা দ্রুত ছড়াচ্ছে বাকি টুকরোটায়। কিন্তু তা আগুনে পৌঁছনোর আগেই এক অতিকায় ফোঁটা সটান এসে পড়ল আগুনটার একেবারে ঘাড়ের ওপর। অমনি সেটা নিমেষে নিভে গেল। তারপর আরও গোটা দুই ফোঁটার আঘাত খাওয়ার পর বস্তুটাকে দেখাতে লাগল একটা কুৎসিত, ন্যাতানো, মরা পোকার মতো। সেদিকে অল্পক্ষণ তাকিয়ে রইল দ্বীপ, তারপর ভিতরে যেতে যেতে আরও একবার নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করল, সিগারেটটা এবার সত্যিই ছাড়া দরকার।

গল্পের ১ম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

 

দুঃখিত!