গল্পের ষষ্ট অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন
হাসল। প্রসূন দত্তর লাল হয়ে যাওয়া মুখ দেখে বোঝা গেল মন্তব্যটা তার গায়ে লেগেছে। সে বলল,
—’এই হল মুশকিল! ওখানকার সমস্যা নিয়ে কিছু বলতে গেলেই সব ডিফেন্সিভ হয়ে পড়ে। আরে বাবা, ধুলো ঝাঁট দিয়ে খাটের তলায় পাঠালেই কি ঘর পরিষ্কার হয়?’ উদয়নও ছাড়ার পাত্র নয়। প্রসূনের কথা শেষ হতে না হতেই সে বলল,
—’না, তা হয় না। তবে ঝাঁটটা কে দিচ্ছে সেটা দেখতে হবে। কলকাতার লোকজন স্ট্রেসড আউট হয়ে থাকতেই পারে। কিন্তু তা নিয়ে যদি সমালোচনা করতে চান তো সেখানে যাওয়াটা আগে অভ্যেস করুন, তাদের পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটুন, তারপর করবেন। এখানকার ফুরফুরে জীবনযাত্রা থেকে নস্ট্যালজিয়ার তাগিদে কালে ভদ্রে ওখানে গিয়ে ওখানকার সমস্ত কিছুকে স্টিরিওটাইপ করবেন, সেটা কি ঠিক?’
চলতে লাগল তুমুল তর্ক। উদয়নের কাছে খাপ খোলা মুশকিল। সে দ্বীপের মতোই ঘন ঘন কলকাতায় যায়, অনেক সময় একাই। গিয়ে সমস্ত চলতি নাটক দেখে আর রাজ্যের নাটকের বই কিনে আনে। প্রসূন দত্ত উদয়নের সঙ্গে আপ্রাণ লড়তে লাগল তার মত আরও দুয়েকজনের সাহায্যে। তাদের একজন বলল, —’কলকাতা থেকে গাড়িতে মেদিনীপুর গেলাম, পথে একটাও রেস্ট এরিয়া নেই। বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে মহা সমস্যা।’ সুখময়দা মাঝেমাঝে স্মিতমুখে একেকটা টিপ্পনী দিতে লাগলেন। উদয়নের মতো এ সবের মধ্যে সটান ঝাঁপিয়ে পড়া দ্বীপের স্বভাব নয়, তাই সে অন্যমনস্ক হয়ে চুপ করে রইল।
তর্কাতর্কি শুনতে শুনতে বোধহয় একটু ঝিমিয়েই পড়েছিল দ্বীপ। প্রসঙ্গ কখন যেন এসে ঠেকেছে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে। হঠাৎ কানে এল প্রদীপ চক্রবর্তীর গলা,
—’আরে, গ্রামের সংগঠন নিয়ে তোমাদের যদি অতই বড়াই, তাহলে আজ রাজ্যে এত ম্যাওবাদী অসন্তোষ কোত্থেকে আসে বাওয়া? এও কি কেন্দ্রের চক্রান্ত বলতে চাও?’
এরপরই আড্ডার হাওয়া বদলে গেল। বোঝা গেল সবারই এ ব্যাপারে কিছু না কিছু মতামত তো আছেই, সেগুলো সবই আসছে একটা অদ্ভুত ভীতির জায়গা থেকে। কেবল সুখময়দা বললেন,
—’গ্রামাঞ্চলের এই ক্ষোভে তেমন আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। বছরের পর বছর ধরে করাপশান, ডেপ্রিভেশন আর দাদাগিরি মানুষের পিঠ একেবারে দেওয়ালে ঠেকিয়ে দিয়েছে।’
কিন্তু উৎপল খাসনবিশ তা মানতে নারাজ।
—’সে যে অবস্থাই হোক, এরকম টেরোরিস্ট অ্যাক্টিভিটিকে কোনোভাবেই সাপোর্ট করা যায় না।’
রাহুল চৌধুরী সঙ্গে সঙ্গে তার সাথে একমত হয়। চিন্তিতভাবে বলে,
—’এ কিন্তু এক নতুন আপদ! আমার তো ভয় হয় কোনদিন কলকাতাতেই না হামলা করে!’
—’করতেই পারে, এবং আমার ধারণা একসময় করবেও।’ উৎপলের সাফ জবাব। তারপর সে আরও বলে,
—’আরে বাবা! এর পথ তো সেই আমাদের ছাত্রবয়সেই তৈরি হয়ে আছে! আমরা তো দেখেছি, এক সময় বিপ্লবের নামে কী চ্যাংড়ামি হয়েছে! বই পোড়ানো, বোমাবাজি আর খুন!’
দ্বীপ একদৃষ্টে উৎপল খাসনবিশকে দেখতে থাকে। লোকটার বয়স ষাট হবে, পেশায় ইনকাম ট্যাক্সের উকিল। সত্তরের প্রথমদিকে এ দেশে এসেছিল মামা না কার স্পনসরশিপে। কিছুদিন আগে কাকে ট্যাক্স ফাঁকি দিতে সাহায্য করার অভিযোগে ওর ওকালতির লাইসেন্স হারাতে বসেছিল। দ্বীপ যতদূর জানে এখনও সে ব্যাপারে তদন্ত চলছে। উৎপল সোৎসাহে বলেই চলে,
—’আরে গ্রাম দিয়ে নাকি শহর ঘিরবে! কী হল? মাঝখান থেকে একগাদা ছেলের জীবন নষ্ট হল! এই যেমন সুদীপ্ত ঘোষ, কলেজে আমার চেয়ে এক বছরের সিনিয়র ছিল। মেধাবী ছাত্র ছিল, কিন্তু কী ভাবে বেঘোরে মরল ছেলেটা! সঙ্গে আরও দুজন…. কী যেন নাম…. তাদের মধ্যে একটা মুসলিম ছেলে…..’
দ্বীপের গা-টা ঘুলিয়ে উঠল। আশ্চর্য! একটামাত্র বীয়ারে তো তার এরকম হাওয়ার কথা নয়! কিন্তু মাথাটা এত ঘুরছে কেন খামোখা? আর এত ঘামছেই বা কেন? সে শুধু উৎপল খাসনবিশের মুখ নড়তে দেখল, একটা কথাও কানে ঢুকল না। শুধু মনে হল এক্ষুণি এদের সামনে থেকে একটু সরে যেতেই হবে। বহুক্ষণ সিগারেট খায়নি সে। শরীরে নিকোটিনের অদম্য দাপাদাপি। তাই নিঃশব্দে সবার অলক্ষ্যে সোফার কোণ ছেড়ে উঠে ক্লোসেট থেকে দ্রুত জ্যাকেটটা বের করে পায়ে জুতো গলিয়ে সদর দরজার বাইরে চলে এল।
দ্বীপের সিগারেটের অভ্যাস নিয়ে বৈশাখী বৌদি বকাবকি করলেও কার্ডিওলজিস্ট সুখময়দা কিন্তু কিছু বলেন না। বরং সদর দরজার বাইরে এক কোণে তার জন্য একটা অ্যাশ ট্রের ব্যবস্থা রেখেছেন। ভয়ানক ঠাণ্ডা হাওয়ার চাবুক পড়ল মুখে, অথচ তাতেই দ্বীপের একটা গভীর আরাম বোধ হল। জ্যাকেটের হুডটা টেনে দিয়ে, দরজার বাইরের চাতালে দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে হাওয়া আড়াল করে একটা সিগারেট ধরাল সে। তারপর একটা লম্বা টান দিয়ে