গল্পের পঞ্চম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
বড় লিভিংরুমটায় সুখময়দা জনা দশেককে নিয়ে জমিয়ে বসেছেন। দ্বীপ ঢুকতেই তিনি হাঁক পাড়লেন,
—’আরে ক্রুসোভায়া! এসো এসো! এত দেরি যে?’
—’কী করব দাদা, স্কুল থেকে বাড়ি গিয়ে আবার এতটা রাস্তা আসা……. বোঝেনই তো! দ্বীপ ধরাচুড়ো খুলে ক্লোসেটে রাখতে রাখতে বলল।
সুখময়দার আশপাশ থেকে আরও দু-চারজন তার দিকে হাত নাড়ল। ‘দাঁড়ান, ভিতর থেকে আসছি’, বলে সে রান্নাঘরের পাশে ছোট বসার জায়গায় গেল ওয়াইনের বোতলটা রাখতে ও বৈশাখী বৌদির সাথে দেখা করতে। বৌদি সেখানে একদল মহিলার সঙ্গে আসর জমিয়েছেন। দ্বীপ লক্ষ্য করেছে অনেকদিন বিদেশে থাকা সত্ত্বেও বাঙালিদের জমায়েতে কিভাবে পুরুষ আর মহিলাদের আড্ডা আপনা থেকেই আলাদা হয়ে যায়।
—’এই যে এলিজিবল ব্যাচেলার! এত দেরি করে আগমন কেন?’ দ্বীপকে দেখেই মন্তব্য বৌদির। দ্বীপ জানে বৌদি তাকে ঐ নামে ডাকা মানেই বিয়ের কথা তুলবেন ও কারও সাথে ঘটকালি করার চেষ্টা করবেন, যেমন আগে কয়েকবার করেছেন। তাই কোনোমতে দেরির সাফাই দিয়ে সেখানে থেকে সরে পড়ল দ্বীপ। কিন্তু পালাতে গিয়ে আর এক বিপত্তি। একেবারে মুখোমুখি উদয়নের সাথে।
উদয়ন ভট্টাচার্য দ্বীপেরই সমবয়সী। এমবিএ করে একটা ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানিতে ভালো চাকরি করে। কিন্তু মূল কেরিয়ারের চেয়ে তার অনেক বেশি মনোযোগ নাটক করায়। মনোযোগ বললে ভুল হবে, সে নাটক নিয়ে অবসেস্ড। সমবয়সীরা তার নাম দিয়েছে আঁতলা খ্যাপা। এমন নাটকপাগল লোক দ্বীপ এ দেশে আর একটাও দেখেনি। এমন কি সে তার ছেলের নাম রেখেছে রুদ্র। উদয়নের মতে, আমেরিকায় বাঙালিদের আস্ত একটা প্রজন্ম বড় হয়ে উঠল, অথচ সে তুলনায় তাদের সাংস্কৃতিক দিকটা অতীব নিকৃষ্ট রয়ে গেছে। পুজোর ফাংশনে সেই বেসুরো গান আর অখাদ্য ভাঁড়ামির নাটক সমানে চলেছে। সে মনে করে এখানে প্রয়োজন ইমিগ্র্যান্ট কালচারের নতুন একটা ধারার, যা থেকে তরুণ প্রজন্ম শিক্ষা নেবে। নাটকের ব্যাপারে দ্বীপের নিজের উৎসাহও কম নেই, বার দুয়েক উদয়নের সাথে করেওছে নাটক, কিন্তু উদয়নের প্যাশনের সঙ্গে সে ঠিক তাল রাখতে পারে না।
দেখামাত্রই উদয়ন তাকে একতলার স্টাডি রুমে টেনে নিয়ে গেল, যেখানে আরও জনাতিনেক নাট্যোৎসাহী আগে থেকেই বসেছিল।
—’বস্! অনেক কষ্টে কলকাতা থেকে ‘ফ্যাতাড়ু’র স্ক্রিপটা আনিয়েছি। এবার এটা নামাব ঠিক করেছি!’
—’ফ্যাতাড়ু? মানে নবারুণ ভট্চাযের?’ দ্বীপের চোখ কপালে।
—’হ্যাঁ রে বাবা! ফ্যাতাড়ু আবার কজনের আছে? আগামী সামার নাগাদ স্টেজ করব। তোমাকে কিন্তু পুরন্দর ভাটের রোলটা করতে হবে।’
—’তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে?’ দ্বীপের কপালে ভাঁজ, কিন্তু গলায় কৌতুক। ‘ঐ সব ভাষা শুনলে এন আর আই বাঙালির আমাশা হয়ে যাবে! মেরে স্টেজ থেকে নামিয়ে দেবে!’
—’আরে গুরু, সে ধরনের একটা ধাক্কাই তো দরকার! দেখি না কেমন রিঅ্যাক্ট করে! এদের এই ক্যালানে কালচারের কোনো অলটারনেটিভ তৈরি করতে গেলে প্রথমে একটু বাওয়াল তো হতেই পারে! হোক না কন্ট্রোভার্সি! আমরা আগে থেকেই জানিয়ে দেব যে এই নাটকে এক্সক্লুসিভ ভোকাবুলারি আছে। চিলড্রেন নট অ্যালাওড।’
দ্বীপ হেসে বলল, —’সে তুমি যতই আগে থাকতে জানাও। যখন স্টেজে আবৃত্তি হবে ‘আকাশ হইতে গুখেগো শকুন হাগিতেছে তব গায় / বাঙালি শুধুই খচ্চর নয়, তদুপরি অসহায়’, তখন দর্শকের, এবং সেই সূত্রে আমাদের কী হাল হবে ভাবতেও ভয় হয়!’ উদয়ন ছাড়ার পাত্র নয়। চোখ মিটমিট করে একটু ভাবল, তারপর একগাল হেসে বলল, —’ঠিক আছে, তাহলে আজই একটা টেস্ট হয়ে যাক! স্ক্রিপটা আমার গাড়িতেই আছে। আজ রাতে ডিনারের পর সকলের পারমিশন নিয়ে আর ছোটদের সরিয়ে দিয়ে এখানেই তার কিছুটা অন্তত পড়া হোক! তাহলেই বোঝা যাবে বঙদের টলারেন্স লেভেল! ফ্যাৎ ফ্যাৎ সাঁই সাঁই!’
উদয়নের অন্যান্য চেলারা এই প্রস্তাবে একটু অস্বস্তি প্রকাশ করলেও দ্বীপের ভুরু কুঁচকে হাসা দেখেই বোঝা গেল তার এতে সায় আছে। আজ রাতে একটা মনে রাখার মতো অভিজ্ঞতা হবে, ভাবল দ্বীপ। এরপর তারা সকলে গিয়ে বসল সুখময়দাকে ঘিরে জমে ওঠা আড্ডায়। যাওয়ার আগে দ্বীপ রান্নাঘর থেকে একটা বীয়ার নিয়ে নিল।
আসরে তখন জোর আলোচনা চলছে হালফিলের কলকাতা নিয়ে। কলকাতা থেকে সদ্য ঘুরে আসা প্রসূন দত্ত হাত পা নেড়ে সেখানকার গল্প শোনাচ্ছে। দ্বীপ যতক্ষণে এসে বসল ততক্ষণে উদয়নের সঙ্গে প্রসূনের তুমুল তর্ক শুরু গেছে। প্রসূন বলছে,
—’আজকাল কলকাতায় লোকজন সবসময় কিরকম তেরিয়া হয়ে থাকে! ভদ্রভাবে কথা বলতেই যেন ভুলে গেছে লোকে! গায়ে ধাক্কা লাগলেও সরি বলে না।’
উত্তরে উদয়নের চটপটে জবাব, —’তিন বছর পর তিন সপ্তাহের জন্য ট্যুরিস্টের চশমা পরে কলকাতায় গেলে ওরকম অনেক কিছু মনে হয়।’ উদয়ন ঠোঁটকাটা, যা বলার সোজাসুজি বলে, যার জন্য অনেক সময়েই সে লোককে অস্বস্তিতে ফেলে। ওর এই হাজির জবাবে দ্বীপ মুখ টিপে