সেদিন ছিলো শনিবার। দূর-দূরান্ত থেকে লোক আসছে উলিপুরের হাটে। ঈদের আগে আর কোন হাট হবে না। সামনের রাস্তা দিয়ে দলে দলে লোক যাচ্ছে মালপত্র বিক্রি করে ঈদের কেনাকাটা করতে।
ছোট্ট শরীফ বায়না ধরলো সেও আজ হাটে যাবে। বাবা তাকে এতো করে বুঝালো হাটে আজ দারুণ ভিড় হবে। ধান পাট বিক্রি করে তবেই তো তার জন্য নতুন জামা টুপি কিনবে। শরীফ সাথে গেলে কেনাকাটা করা অসুবিধা হবে। কিন্তু সে কিছুতেই মানতে চাইলো না। বাবা বললো, ‘তার জন্য লাল জুতা আর সুন্দর মোজাও আনবে।’ কিন্তু শরীফ এমন কান্না শুরু করলো যে তাকে সাথে না নিয়ে কোন উপায়ই থাকলো না।
হাটের ভেতর লোকে লোকারণ্য। দারুণ ভিড় আর শোর হাংগামা। শরীফকে একটা চেনাজানা দোকানে বসিয়ে রেখে বাবা গেলো ধান আর পাট বেচতে। তাকে নিষেধ করলো দোকান ছেড়ে কোথাও যেন না যায়। দোকানীকে শরীফের দিকে খেয়াল রাখতে বললো বাবা। সে শুধু যাবে আর আসবে। বাবা গেলে কিক্ষুক্ষণ চুপ করে বসে থাকলো শরীফ। তারপর এক ফাঁকে দোকান থেকে বের হলো। বেচা বিক্রির কাজে ব্যস্ত থাকায় দোকানী মোটেই তা টের পেলোনা। শরীফ দেখলো পাশের দোকানে সুন্দর সুন্দর খেলনা ঝুলে আছে। নানান রকমের পুতুল আর রঙিন বেলুন দেখতে দেখতে সে বাবার কথা ভুলে গেলো। পাশের ছোট্ট মাঠে একটা অদ্ভূত পোষাক পরা লোক একটা ছেলেসহ ডুগডুগি বাজিয়ে নেচে নেচে গান করছে। চারদিকে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে অনেক লোক তা শুনছে।
ভেতরে যেয়ে শরীফ দেখলো বানরের নাচ আর সার্কাস হচ্ছে সেখানে। বানরের নাচ আর গানের তালে তালে একটা ছোট্ট মেয়ে সার্কাস দেখাচ্ছে ভিড়ের মাঝখানে।
বানরের নাচ শেষে সে দেখলো মাটির রঙিন হাঁড়ি পাতিল নিয়ে বসে আছে একটা সাদা দাঁড়িওয়ালা বুড়ো।
সেখানে আছে হরেক রকমের ঘোড়া এবং হাতি। একটা হাতির বাচ্চা শরীফের খুব পছন্দ হলো। সে হাতির বাচ্চাটা নিতে চাইলো। দোকানী বললো, পছন্দ হয়েছে তোমার? তাহলে টাকা দিয়ে এক্ষুণি নিয়ে যাও। অন্য কেউ নিয়ে নিলে তো আর পাবে না। বেশী না মাত্র দুই টাকা পঁচিশ পয়সা দাও।’
শরীফ বাবাকে খুঁজতে লাগলো। বাবার কাছে টাকা নিয়ে সে মাটির হাতি কিনবে। সে দেখেছে বাবা তো এদিকেই গেছে। এখান থেকে সেখানে। সেখান থেকে অন্যখানে। কোথাও সে তার বাবাকে খুঁজে পেলো না। লোকের ভিড়ে ভীতবিহবল হয়ে ঘুরে ঘুরে সে দারুণ কান্ত হয়ে পড়লো। ক্ষুধা আর পরিশ্রমে তার খুব ঘুম পাচ্ছিলো। একখানা গরুর গাড়ির ছইয়ের নিচে সে নীরবে ঘুমিয়ে পড়লো। গাড়ির মালিক হাটের কেনা-কাটা শেষ করে আপনমনে গরু খেদিয়ে বাড়ি চলে গেলো। বাড়িতে গিয়ে দেখলো অবাক কান্ড! একটা চার-পাঁচ বছরের ছেলে গাড়িতে শুয়ে আছে। স্ত্রী জহিরাকে ডেকে তার কোলে ছেলেটাকে দিলো সে। রাতে তারা শরীফকে ঘুম থেকে জাগালো না। অজানা জায়গায় এসে সে কান্নাকাটি করতে পারে।
সারারাত একটানা ঘুমালো শরীফ। অনেক বেলায় সে ইচ্ছেমতো ঘুম থেকে জাগলো। জেগে তার কাছে সবকিছু অচেনা মনে হলো। এ বাড়িটা কার! উত্তরের ঘরটায় খড়ের ছাউনি। বাড়ির অন্য ঘরগুলো অবশ্য টিনের। এ বাড়ি তার মামা বাড়ির মতো নয়। খালুর বাড়ির মতোও নয়। বাড়ির পেছনে উঁচু উঁচু সুপারি গাছ। সুপারি বাগানটা কেমন জানি ভয়জড়ানো অন্ধকার অন্ধকার। পাশে দাঁড়িয়ে আছে একটা ঝাঁকড়া আমলকি গাছ। তার ডালে ঝুলছে থোকা থোকা টসটসে আমলকি।
শরীফ দেখলো, বাড়ির সামনে পলাশ গাছে লাল লাল ফুল। কী একটা পাখি তার ডালে বসে আপন মনে গান গাচ্ছে। মাটির একটা ঢেলা তুলে শরীফ ঢিল ছুড়লো পাখিটাকে। পাখিটা ফুড়-ৎ করে উড়ে গেলে সে একা একা হাসলো। শরীফ ভাবলো, তাদের বাড়িটা কী রাতারাতি বদলে গেলো! তার মা বাবাই বা কোথায় গেলো তাকে একা রেখে। বাড়ির সামনে একটা বিরাট বিল দেখলো সে। হেঁটে হেঁটে সে বিলের ধারে গেলো। দামবাঁধা হাঁস আর পানকৌড়ির সাঁতার কাটা দেখলো সে বিলের কিনারে বসে। হঠাৎ তার মনে পড়লো সে তো বাবার সাথে নতুন জামা কেনার জন্য হাটে এসেছিলো। বাবার সাথে তো দেখা হয়নি আর। সে তো একখানা গরুর গাড়িতে ঘুমিয়ে পড়েছিলো।
তবে কী এ বাড়ির লোকেরা তাকে গাড়িতে করে নিয়ে এসেছে। যাই হোক এতে তার একদম কান্না পেলোনা। বরং সে আনন্দিত মনে বাড়িটার চারপাশ ভালো করে দেখে বেড়াতে লাগলো। ঘনকালো বেগুনগাছে উড়ে বেড়াচ্ছে চঞ্চল টুনটুনি ।
জংলী তোতারা লাল ঠোঁট বাঁকিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে পাকা মরিচের ক্ষেতে।
শরীফ একা একা ঘুরে বেড়ালেও তার দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখছিলো জহিরা। হারিয়ে যাওয়া ছেলে মনমতো ঘুরে একটু আনন্দ পাক। ঘরের কাজ শেষ করে শরীফকে ডেকে হাতমুখ ধোয়ালো জহিরা। বাড়ির কর্তা আফজাল সেখ তার সাথে গল্প করলো। নারকেলের নাড়ু আর মুড়ি পায়েশ খেলো একসাথে বসে। শরীফকে তারা সব কথা সরল মনে খুলে বললো। এসব কথা শুনে তার মোটেই খারাপ লাগলো না। সে ভাবলো এরা তার আপন খালা-খালুর মতো। সে তো আর হারিয়ে যায়নি। একে কি হারিয়ে যাওয়া বলে। নিজের বাড়িতে নেই এই যা।
একটু পরে তাকে সাবান ঘষে গোসল করিয়ে রুই মাছ আর মুরগীর কলিজা দিয়ে ভাত খাওয়ালো জহিরা।
খেতে খেতে তার কাছে বাড়ির ঠিকানা জেনে নিলো। শরীফ তাকে খালা বলে ডাকতে শুরু করেছে। তার সাথে নতুন খালু আফজালও ভাত খেলো নানান রকম গল্প করে করে। গরুর গাড়িখানা সুন্দর করে সাজিয়ে নিলো আফজাল। তারপর দুপুরের দিকে তাকে নিয়ে রওনা দিলো ওর বাড়ির দিকে। ঝুমকা পড়া বলদের ঘাড়ে লাল ঝালর সাজানো গাড়ির জোয়াল দেখে কথার খৈ ফুটতে লাগলো শরীফের মুখে।
গাড়ি চালাতে চালাতে আফজাল বললো, ‘সত্যি, অনেকদিন পর আজ শ্বশুড় বাড়ি যাচ্ছি।’
এ কথা শুনে শরীফ বললো, ‘খালু, আপনার শ্বশুড়ের নাম কি ?’
‘তুমিই তো আমার শ্বশুড়। গাড়ি সাজিয়ে তো তোমারই বাড়ি যাচ্ছি।’
‘ধুর! আমি আপনার শ্বশুড় হতে যাবো কেন, আমি তো ছোট মানুষ।’
গাড়ি চললো গ্রাম মাঠ বিল অতিক্রম করে। একখানে এস শরীফ বললো, ‘খালু এ গ্রামটার নাম কি ?’
‘বাদুড় খাওয়া।’ জবাব দিলো আফজাল।
‘ধেৎ, মানুষ আবার বাদুড় খায় নাকি?’
‘হ্যাঁ, একসময় এ গ্রামের মানুষ বাদুড় ধরে ধরে খেতো। সে জন্য এ গ্রামের নাম হয়েছে বাদুড় খাওয়া।’
রাস্তার পাশে একটা ছোট্ট বাজারে গাড়ি থামালো আফজাল। একটা দোকানে বসে নানান রকম সন্দেশ খেলো তারা। শরীফ প্রশ্ন করলো, ‘খালু এ বাজারটার নাম কি ?’
‘ভদের বাজার।’
এটা আবার একটা নাম হলো।
‘এ বাজারের পাশে ভদে নামে এক গরীব লোক ছিলো। তার নামে বাজারের নাম হয়েছে ভদের বাজার।’
খুব সুন্দর করে শরীফকে বুঝিয়ে দিলো আফজাল। শরীফের প্রশ্নের শেষ নেই। এ বিলটার নাম কী? এটা কী জিনিষ? ওরে বাবা, ওটা কেমন মানুষ? ওটা কার বাড়ি? এটা কী পাখি? ও খালু, ঐ বউটা নদী থেকে পানি নিয়ে কোথায় যায়? শরীফের এসব প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে তারা বিকেলের আগেই ওদের বাড়ি পৌঁছে গেলো।
শরীফ দৌড়ে যেয়ে তার মাকে জড়িয়ে ধরলো। হঠাৎ শরীফকে দেখতে পেয়ে ওর বাবা থ মেরে দাঁড়িয়ে থাকলো। সব ঘটনা তারা শুনলো আফজাল এবং জহিরার কাছে। শরীফকে পেয়ে তারা খুব আনন্দিত হয়ে হৃদয়ের আবেগে কাঁদতে লাগলো।
পাড়ার সব লোক এলো ওকে দেখার জন্য। তাকে খোঁজার জন্য সবখানে লোক পাঠানো হয়েছে। এত সহজে শরীফ ফিরে আসবে একথা কেউ ভাবতেও পারেনি। শরীফ তার নতুন খালা-খালুকে ঘরে নিয়ে যেয়ে বসতে দিলো। সব কথা সে তার বাবা মাকে বললো। ঘুমে ঘুমে নতুন খালুর বাড়ি যেয়ে তার খুব ভালোই লেগেছে। জহিরা শরীফের মায়ের বোন হয়ে গেলো। আর আফজাল হলো বোনজামাই।
শরীফের মন আজ খুশীতে ভরপুর। তার বাড়িতে কত মানুষ। কত হৈ চৈ, হাসি উৎসব। তার নতুন খালা খালু এসেছে গরুর গাড়ি সাজিয়ে। এদের পেয়ে তার ঈদের আনন্দটা আকাশ ছুঁয়ে যাবে।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।