ইস্কুলের গল্প–সুকুমার রায়-১ম পর্ব

গল্পের শেষ পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

চন্ডীপুরের ইংরেজি স্কুলে আমাদের ক্লাসে একটি নতুন ছাত্র

আসিয়াছে। তার বয়স বারো-চোদ্দোর বেশি নয়। সে স্কুলে আসিয়া প্রথম দিনই সকলকে জানাইল, “আমি পোইট্রি লিখতে পারি!” এ কথা শুনিয়া ক্লাশসুদ্ধ সকলে অবাক হইয়া গেল; কেবল দু-একজন হিংসা করিয়া বলিল, “আমরাও ছেলেবেলায় ঢের ঢের কবিতা লিখেছি।” নূতন ছাত্রটি বোধ হয় ভাবিয়াছিল, সে কবিতা লিখিতে পারে, শুনিয়া ক্লাশে খুব হুলুস্থল পড়িয়া যাইবে, এবং কবিতার নমুনা শুনিবার জন্য সকলে হাঁ হাঁ করিয়া উঠিবে। যখন সেরূপ কিছুরই লক্ষণ দেখা গেল না, তখন বেচারা, যেন আপন মনে কি কথা বলিতেছে, এরূপভাবে, যাত্রার মত সুর করিয়া একটা কবিতা আওড়াইতে লাগিল—

“ওহে বিহঙ্গম তুমি কিসের আশায়
বসিয়াছ উচ্চ ডালে সুন্দর বাসায়?
নীল নভোমণ্ডলেতে উড়িয়া উড়িয়া
কত সুখ পাও, আহা ঘুরিয়া ঘুরিয়া!
যদ্যপি থাকিত মম পুচ্ছ এবং ডানা
উড়ে যেতাম তব সনে নাহি শুনে মানা”—
কবিতা শেষ হইতে না হইতেই ভবেশ অদ্ভুত সুর করিয়া এবং মুখভঙ্গি করিয়া বলিল—

“আহা যদি থাকত তোমার ল্যাজ এবং ডানা
উড়ে গেলেই আপদ যেত— করত না কেউ মানা!”
শুনিয়া সকলে হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিল।

নূতন ছাত্র তাহাতে রাগিয়া বলিল, “দেখ বাপু, নিজেরা যা পার না, তা ঠাট্টা করে উড়িয়ে দেওয়া ভারি সহজ। শৃগাল ও দ্রাক্ষাফলের গল্প শোন নি বুঝি?” একজন ছেলে অত্যন্ত ভালোমানুষের মতো মুখ করিয়া বলিল, “শৃগাল অবং দ্রাক্ষাফল! সে আবার কি গল্প?” অমনি নূতন ছাত্রটি আবার সুর ধরিল—

“বৃক্ষ হ’তে দ্রাক্ষাফল ভক্ষণ করিতে
লোভী শৃগাল প্রবেশ করে দ্রাক্ষাক্ষেতে
কিন্তু হায় দ্রাক্ষা যে অত্যন্ত উচ্চে থাকে
শৃগাল নাগাল পাবে কিরূপে তাহাকে?
বারম্বার চেষ্টায় হয়ে অকৃতকার্য
‘দ্রাক্ষা টক’ বলিয়া পালাল ছেড়ে (সেই) রাজ্য—”
সেই হইতে আমাদের হরেরাম একেবারে তাহার চেলা হইয়া গেল। হরেরামের কাছে আমরা শুনিলাম যে ছোকরার নাম শ্যামলাল। সে নাকি এত কবিতা লিখিয়াছে যে একখানা দুপয়সার খাতা প্রায় ভর্তি হইয়াছে— আর আট-দশটি কবিতা হইলেই তাহার একশোটা পুরা হয়, তখন সে নাকি বই ছাপাইবে। শুনিয়া কেহ কেহ আরো অবাক হইয়া গেল— কাহারো কাহারো হিংসা আরো দ্বিগুণ জ্বলিয়া উঠিল।

ইহার মধ্যে একদিন এক কাণ্ড হইল। গোপাল বলে একটি ছেলে স্কুল ছাড়িয়া যাইবে, এই উপলক্ষে শ্যামলাল এক প্রকাণ্ড কবিতা লিখিয়া ফেলিল! তাহার মধ্যে ‘বিদায় বিদায়’ বলিয়া অনেক ‘অশ্রুজল’ ‘দুঃখশোক’ ইত্যাদি কথা ছিল। গোপাল কবিতার আধখানা শুনিয়াই একেবারে তেলেবেগুনে জ্বলিয়া উঠিল। সে বলিল,“হতভাগা, ফের আমার নামে পোইট্রি লিখবি তো এক থাপ্পড় মারব।

কেন রে বাপু দুনিয়ায় কি কবিতা লিখবার আর কোনো জিনিস পাও নি?” হরেরাম বলিল, “আহা, বুঝলে না? তুমি ইস্কুল ছেড়ে যাচ্ছ কিনা, তাই ও লিখেছে।” গোপাল বলিল, “ছেড়ে যাচ্ছি তো যাচ্ছি, তোর তাতে কি রে? ফের জ্যাঠামি করবি তো তোর কবিতার খাতা ছিঁড়ে দেব।” দেখিতে দেখিতে স্কুলময় রাষ্ট্র হয়ে পড়িল।

ছেলেরা, বিশেষত নিচের ক্লাশের ছেলেরা, দলে দলে শ্যামলালের কবিতা শুনিতে আসিতে লাগিল! ক্রমে কবিত লেখার বাতিকটা ভয়ানক রকমের ছোঁয়াচে হইয়া স্কুলের প্রায় অর্ধেক ছেলেকে পাইয়া বসিল। ছোটো-ছোটো ছেলেদের পকেটে ছোটো-ছোটো কবিতার খাতা দেখা দিল—বড়োদের মধ্যে কেহ কেহ ‘শ্যামলালের চেয়ে ভালো কবিতা’ লিখিবার জন্য কোমর বাঁধিয়া লাগিয়া গেল! স্কুলের দেয়ালে, পড়ার কেতাবে, পরীক্ষার খাতায়, চারিদিকে কবিতা গজাইয়া উঠিল।

গল্পের শেষ পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!