কলকাতা বেড়েই চলেছে। গ্রাম যাচ্ছে মরে। ভূত নেই। হাওয়া নেই। বাতাস নেই। রামলালের ওঝাগিরিও তাই চলছে না। তাও যদি কিছু ঝোপঝাড় থাকত, লোকে রাতের বেলা সাদা থান পরা শাকচুন্নি দেখতে পেত। সবই গেছে প্রমোটারের হাতে। রামলাল তাই পৈলানের পাট চুকিয়ে চলেছে নৈনানের দিকে। দামোদর পার হয়ে শিবগঞ্জ। ওখান থেকে ভগবানপুর। মাসির বাড়ি। ওখানে ওঝাদের রমরমা বাজার। কথায় আছে, নদী এক পাড় ভাঙে অন্য পাড় গড়ে। ব্যবসা পড়ে যেতে রামলালের মনটা খুব ভেঙে পড়েছিল। কী করবে, কোথায় যাবে, কিছুই মাথায় আসছিল না। এমন সময় মাসি এল ঘুরতে। খাতির করে মাসিকে বসতে বলল। ভারী শরীর নিয়ে ভাঙাচোরা মোড়াতে বসতেই মোড়াটা ভূমি নিল। মাসিও। বহু চেষ্টা করে মেঝে থেকে মাসিকে তুলল বটে, কিন্তু মাসির কোমরে খিঁচ লাগা রোধ করতে পারল না। কোমরের ব্যথায়, কিংবা হয়তো ভাগ্নের দুর্দশায়, মাসির চোখে জল চলে এল। বলল, ঘরের এ কী হাল করেছিস বাপ? একটা চেয়ারও জোটে না। রামলাল এ কথা শুনে কেঁদে ফেলল। আর চেয়ার! অর্ধেক দিন না খেয়েই কাটাতে হচ্ছে। কয়েক বছর ধরে অপদেবতা বিমুখ হয়েছে আমার ওপর। কাউকে দেখা দেয় না। কারও ওপর ভরও করে না। — বুঝেছি। তোদের এখানে এসেই বুঝেছিলাম। এ জায়গা আর অপদেবতার পবিত্র বাসস্থান রইল না। এতগুলো মানুষ জুটলে বেচারাদের যে দমও বন্ধ হয়ে যায়। তা, তুই এখানে পড়ে রইলি কেন? আমার কাছে গেলেই পারতিস। তোর মেসোর তো এখন ঢালাও কারবার। একা সব কেস সামলাতে পারে না। বয়সও হয়েছে। তুই এখানকার পাট চুকিয়ে চ’। তোর কপাল ফিরে যাবে। রামলাল তো তখনই এক পায়ে খাড়া। দু’দিন মাসিকে নিজের কাছে রেখে তোয়াজ করে খাওয়াল। ভেতরে-ভেতরে খদ্দের দেখাও শুরু করে দিল। যাবার সময় মাসি বলেছিল, ‘দেরি করিস না বাবা। যত তাড়াতাড়ি পারিস চলে আয়।’ তাড়াতাড়ি আর করা গেল না। বাড়ি বিক্রি করতে আর ধারদেনা চুকোতে দু’সপ্তাহ কেটে গেল। মাসির বাড়িতে রামলাল পৌঁছল দুপুর বারোটায়। মাসি-মেসো দু’জনেই রামলালকে দেখে খুশি হল। ওদের নিজেদের কোনও ছেলেপুলে নেই। রামলালকে নিজের ছেলে বলেই মনে করে। মেসো বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে বের হচ্ছিল। রামলাল মেসোর হাত থেকে ব্যাগটা কেড়ে নিয়ে বলল, ‘তোমাকে যেতে হবে না। আমিই হাটে যাব।’ মেসোও প্রতিবাদ না করে ওর হাতে ব্যাগ দিয়ে দিল। এখানকার পথঘাট সবই রামলালের চেনা। হাট থেকে দেখেশুনে ভাল দুটো ইলিশ কিনল। আর ফেরার পথেই ঘটল ঘটনাটা। হঠাৎ কে যেন পিছন থেকে ব্যাগটা টেনে ধরল। পিছন ফিরে দেখল রামলাল। কাউকেই দেখতে পেল না। আবার হাঁটতে শুরু করতেই আবার পড়ল টান। আবার ফিরে ও কাউকে দেখতে পেল না। রামলাল ব্যাপারটা কিছুটা আঁচ করল। পাত্তা না দিয়ে হ্যাঁচকা টান মেরে ব্যাগ ছাড়িয়ে নিয়ে হাঁটতে শুরু করল। এ বার ভূত বাবাজি রামলালের পথ আগলে দাঁড়াল। অনুনয়ের সুরে বলল, একটা মাছ দেবে? — কেন রে? তুই আমার কে? রেগেমেগে বলল রামলাল। ভূত বাবাজিও কম যায় না। বাঁজখাই গলায় চিৎকার করল, আমি ভূত! তোমার ভগবান! — সত্যি! বলে রামলাল ভূতটার হাত চেপে ধরল। লাই পেয়ে ভূত আব্দার করে বসল, দুটো মাছ কিনেছ। একটা আমাকে দিয়ে যাও। রামলাল নরম সুরে বলল, মাত্র দুটো মাছ কিনেছি রে। অনেক দিন পর একটু রসিয়ে খাব বলে। তোরা একবার আমার কারবারটা জমিয়ে দে, ভাল করে মাছ খাওয়াব। ভূতটা নাছোড়। ঘাড় চুলকে, মাথা চুলকে বলেই চলে, পরের কথা পরে। আমাকে এখনই একটা দিতে হবে। এখনই দিতে হবে। — বললাম মাত্র দুটো মাছ। একটা দিলে দুপুরের খাওয়াটাই মাটি হয়ে যাবে। — একটা দাও, রাতে তোমাকে অনেক মাছ দেব। — কী করে? — রাতের বেলা সামনের নদীতে জাল ফেললে বুঝতে পারবে। মন না চাইলেও একটা মাছ ভূতটাকে দিয়ে বিদেয় করল রামলাল। সে-দিন রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে মেসোর খ্যাপলা জাল নিয়ে বেরিয়ে পড়ল রামলাল। বাড়ির সামনে শ্মশানের পরেই নদী। দোনামনা করে নদীতে জাল ফেলল। কিন্তু জাল টেনে তুলতে প্রাণ যায় যায় অবস্থা। কোনও রকমে জাল ডাঙায় তুলে দেখে
মাছ আর মাছ। চাঁদের আলোয় মাছগুলোর গা থেকে যেন হীরকের দ্যুতি ঠিকরাচ্ছে। মাছগুলো ব্যাগে ভরে আবার জাল ফেলল। আবার উঠল মাছ। এ রকম ভাবে সারা রাত মাছ ধরে ব্যাগে না কুলোতে পেরে একটা শুকনো ডাঙায় ফেলে রাখল। সকালবেলা মেসো তাকে ডাকতে এসে এই কাণ্ড দেখে অবাক! বলল, এ মাছ হাটে গিয়ে বিক্রি করতে হবে এখনই, নইলে সব মাছ পচে যাবে। মেসোর কথা শুনে রামলাল জাল গুটিয়ে মেসোর সঙ্গে গেল হাটে মাছ বিক্রি করতে। মাছ বিক্রি করে প্রচুর টাকা পেল। টাকাগুলো মেসোর হাত দিয়ে ঘরে পাঠিয়ে আবার দুটো ইলিশ মাছ কিনল। ফেরার পথে ভূতটা আজ আবার পথ আটকে দাঁড়িয়ে বলল, আমাকে একটা ইলিশ মাছ দেবে? কথাটা শুনে রামলালের হাসি পেয়ে গেল। কোনও রকমে হাসি চেপে বলল, তুমি এত মাছ ধরে দিলে, মাছ চাওয়ার দরকার কী তোমার? নিজেই তো মাছ ধরে খেতে পারো। ভূতটা হেসে বলল, আমি তো ইলিশখেকো ভূত। ইলিশ ছাড়া কোনও মাছ মুখে তুলি না। আর এই নদীতে ইলিশ পাওয়া যায় না। তা ছাড়া, ভূত কখনও মাছ ধরে নাকি? মাছ ধরে মানুষে। ভয় দেখিয়ে মাছ আদায় করাই ভূতের ধর্ম। ভূত হয়ে শেষে মানুষের কাজ করব? ছিঃ, একটা প্রেস্টিজ নেই
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।