ইমু এখন মামাবাড়ি। ইমুর মেজো মামা দীর্ঘ আট বছর পর গতকাল বাড়ি এসেছেন। সপরিবারে মেজো মামা এখন সৌদি আরবের রিয়াদে বসবাস করেন। সেখানে প্রথমে গিয়ে চাকুরি করলেও এখন আর চাকুরি করেন না। নিজেই এখন একটা বড় ডিপার্টমেন্টাল স্টোর বা শপিং সেন্টারের মালিক। ব্যবসা ক্রমশ বিসত্মার লাভ করায় এখন তিনি বাংলাদেশের দু’জন কর্মচারীও রেখেছেন। সেই কর্মচারীদের উপর দায়িত্ব দিয়ে মেজো মামা দীর্ঘদিন পরে সপরিবারে দেশে এসেছেন। ইমুর আম্মা ছোট মেজো মামা বড়। ইমুর আরো দু’জন মামা আছেন, বড় মামা এবং ছোট মামা। ইমুর কোন খালা নেই। ইমুর স্কুলে এখন গ্রীষ্মের ছুটি চলছে। মেজো মামা আসার সংবাদ ক’দিন আগেই পাওয়া গেছে। গতকাল এয়ারপোর্টে নামার সংবাদ পেয়েই ইমুর আম্মু তাকে আর তিতলীকে নিয়ে চলে এসেছেন। তিতলী ইমুর ছোটবোন। অনেকদিন পরে মেজা মামা দেশে আসছেন-এ সংবাদ শুধু মামাদের বাড়ি নয়; গ্রামের সকলের কাছেই যেন একটা কৌতূহলের বিষয়। সত্যি সত্যি মাগরিবের কিছুটা পূর্বে যখন মেজো মামাকে বহন করা গাড়িটা এলো, তখন সেই গাড়ির আরোহীদের দেখতে গ্রামের আত্মীয়-অনাত্মীয় সকলেই সেখানে একটা হুলস্থূল কান্ড সৃষ্টি হয়ে গেল। কান্নাকাটি-কোলাকুলি সব হলো।
ইমু দূরে দাঁড়িয়ে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করলো। একসময় মেজোমামা নিজে থেকেই ইমুর খোঁজ করলেন,নূরজাহানের ছেলে কই? নূরজাহান ইমুর আম্মুর নাম। ইমুর আম্মু মামাদের একমাত্র বোন। মামাদের কাছে ইমুর আদর তাই আকাশ ছোঁয়া! মেজো মামা খোঁজ করতেই ইমু সেই ছোটখাটো ভীড় ঠেলে মামার কাছে এগিয়ে যায়। যেন রাজদরবারে মহারাজা সামান্য কোনো এক প্রজাকে জনারণ্যে আহবান জানাচ্ছেন-ইমু যেন সেই সামান্য প্রজা। ইমু মেজো মামার কাছে এগিয়ে গেলে মামা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আবেগে বলে ফেলেন, ঞযব ঔঁহরড়ৎ ঞধষষবহঃ ইধহমধষর- সু টহপষব!. ইমুর মাথায় চুমু খেয়ে মামা আবারও বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে ইংরেজিতে উচ্চারণ করেন, ইধহমধষ ঞযব ঔঁহরড়ৎ!. মোবাইল ফোনে কথা বলার সময় মেজো মামা সকলের সাথে সাবলীল বাংলা বললেও ইমুর সাথে কথা বলেন ইংরেজিতে। ইমুও কম যায় না, সে-ও যতটুক সম্ভব মামার সাথে ইংরেজিতেই কথাবার্তা বলে। মামা তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা চার-পাঁচ’ বছরের মেয়েকে ইমু বার বার আড়চোখে খেয়াল করছিল। মেজো মামা এবার তাকেই কাছে টেনে নিয়ে ইমুকে দেখিয়ে বলেন, আম্মু এই তোমার ইমু ভাইয়া! প্রাইমারি বৃত্তি পরীক্ষায় সববাইকে টেক্কা দিয়ে জেলার মধ্যে সেকেন্ড ট্যালেন্টপুলে! সকলের সামনে মামা যেভাবে ইমুর পাবলিসিটি করলো তাতে ইমুর ভালোও লাগলো আবার একটু লজ্জাও করতে লাগলো। তবে লজ্জাটা শুধু ইমুকেই নয় যাকে শুনিয়ে মামা এ পাবলিসিটি করলো লজ্জাটা তাকেও আক্রামত্ম করলো। তাই আপাতত সে তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আম্মুর আঁচলের নিচে সেই লজ্জাগুলো লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করতে লাগলো। ইমু এই আপাতত লজ্জায় নুইয়ে পড়া এই বালিকাকে চিনতে না পারলেও মামার কথায় বোঝা গেল, এই-ই মামার একমাত্র কন্যা ইলমা। ইমু মামা-মামিকে সর্বশেষ যখন দেখেছিল তখন সে খুবই ছোট ছিল। তখনও সে স্কুল ধরেনি। তবে খুব ছোট অবস্থায় দেখলেও তাদের মুখ ইমুর মানসপটে স্পষ্টই ছিল এতদিন। মামা-ভাগনের সেই রাজকীয় উষ্ণ আলিঙ্গনের পরে ভাগনে ইমু তার মামা ও মামির পায়ে কদমবুচি করলো। মামা-ভাগনের এই মহামিলনের সময় ইমুর আম্মু পাশে দাঁড়িয়ে ধারাবিবরণী দেবার মতো করে বলতে থাকেন, সবসময় ইমুর মুখে শুধু মেজোমামার কথা। কোনো প্রশ্ন মাথায় উদয় হলেই মেজো মামাকে ফোন করে, মামা এটা কী, মামা ওটা কী! এবার ইমুর আম্মু মেজো মামার দিকে ইংগিত করে বলতে থাকেন, মেজো ভাইও সেরকম, ইমু ফোন করলেই ‘আঙ্কেল’ বলতে অজ্ঞান। দুই মামা ভাগনে ফোনের মধ্যে কী যে সব আলাপ-সালাপ করে! সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে গেলেও ইমুর মামাদের উঠোন সেদিন জমজমাট হয়ে থাকে। যেন কোন বিয়ে বাড়ি বা কোন উৎসব! এ উৎসব প্রতিবেশীদের মধ্যেও ছড়িয়ে যায়। প্রতিবেশী-অনাত্মীয়রাও মামাবাড়ির উঠোনে অনেক রাত পর্যমত্ম ভীড় করে থাকে, মেজো, মামি তিতলীকে দেখে। মেজো মামার সাথে খেলাধুলা করেছেন এবং এক সাথে স্কুলে পড়েছেন এমন ক’জন মেজো মামার সাথে কোলাকুলি করতে যেয়ে উভয়েই কেuঁদ-কেটে একাকার হয়ে গেলেন। মামা তার এক পুরোনো বন্ধুকে কোলাকুলি শেষে জিজ্ঞেস করেন, হ্যারে হাসান, মতি, রবিউল, করিম এরা কেমন আছে রে? স্নিগ্ধার কয় ছেলেমেয়ে-কোথায় থাকে? ইমু মেজো মামার কাছে শুনেছে, হাই স্কুলে স্নিগ্ধা নামের একটা মেয়ে মামাদের সাথে পড়তো। মামাদের ক্লাসে ওই একটাই মেয়ে। তখন গ্রামের হাই স্কুলে কোন মেয়ে পড়তো না। স্নিগ্ধাই বোধ হয় মামাদের স্কুলের প্রথম ছাত্রী। শিক্ষকদের কমন রুমের পাশে স্নিগ্ধা বসে থাকতো। স্যার ক্লাসে আসার সময় স্নিগ্ধাকে সঙ্গে আনতেন। ক্লাস শেষ হলে সে আবার স্যারের সাথে চলে যেতো, যেমন সে আসতো। অনেক রাত পর্যমত্ম মামাদের উঠোনে যেন ছোটখাটো একটা সেমিনার হয়ে গেল। সেই সেমিনারে ইমুর মামাই প্রধান বক্তা। কী কষ্ট করে মরুভূমির বুকে প্রথমে তিনি গাড়ির ড্রাইভার হিসেবে কাজ করেছেন, তারপর নিজে টাকা জমিয়ে একটা গাড়ি কিনে চাকুরি ছেড়েছেন। অবশেষে নিজেই একটা শপিং সেন্টারের মালিক হয়েছেন। এর মাঝে কীভাবে সৌদি পুলিশ ও স্থানীয় সৌদিরা তাকে কয়েকবার নাজেহাল করেছে এসব গল্প বলে চলেন মেজো মামা। উঠোন ভর্তি নারী-পুরুষ, পাড়া-প্রতিবেশী,আত্মীয়-অনাত্মীয় সকলের সাথে ইমুর বড় মামা-ছোট মামাও মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনলেন মেজো মামার বিদেশের সেই জীবন সংগ্রামের কথা। এতকাল মামা কাউকে এসব বলেননি। এমন কি ইমুকেও নয়। শুনলে কষ্ট পাবে এ কারণেই হয়তো বলেননি। বড় মামা-ছোট মামার পরিবারের সকলের জন্য, এমন কি কাছেপিছে পাড়ায় যারা বসবাস করে তাদের জন্যও মেজো মামা নানা ধরণের কাপড় চোপড় ও উপহার সামগ্রী এনেছেন। রাতেই সেসব যথাসম্ভব বণ্টন করা হয়ে গেল। এপাড়ার বাইরে থেকেও যারা এসেছিল- যাদের জন্য কোন উপহার দেওয়া সম্ভব হলো না, তাদেরকে মেজো মামা নগদ টাকা দিতে গেলেন। কয়েকজন মেজো মামার কাছ থেকে হাত পেতে টাকা নিলেও অনেকেই নিলো না। তবে মেজো মামাকে দোয়া করে বললো, তোমার মুখখানা দেখতে পেলাম এতেই আমরা খুশি! আল্লাহ পাক আমাদেরকে ভালোই রেখেছেন। এই নির্লোভ মানসিকতাই বাংলাদেশের গ্রামের মানুষের সাধারণ চরিত্র। শত কষ্টে থাকলেও, অভাবী-দরিদ্র হলেও কখনো সহজে তারা কারো কাছে হাত পাতে না! ইমুর জন্য স্পেশাল গিফট; একটা কাগজের মসত্মবড় কার্টুন ভর্তি বই। ইমুর একার পক্ষে সে স্পেশাল গিফটের কার্টুন বহন করা সম্ভব নয়। ছোট মামা ইমুকে সাহায্য করলেন। অত বই উপহার হিসেবে পেয়ে ইমুর মনের আকাশে আতসবাজির উৎসব শুরু হয়। সে উৎসবের তরঙ্গ ইমুকে আপাতত উঠোন থেকে তার নানিজানের ঘরে টেনে নিয়ে যায়। নানিজানের ঘরের মেঝেতে ছোটমামা বই এর কার্টুনটা রেখে আবার উঠোনের জনসমাবেশে মিশে যান। জায়নামাজে নানিজান তখনও তসবীহ্ হাতে। ঘরের মধ্যে হাঠাৎ তার ছোটছেলে আর ইমুকে ঢুকতে দেখে নানিজান তার বন্ধ রাখা চোখ খুলে ইমুকে দেখতে পায়। বই পড়ার প্রতি আগ্রহের কথা মেজো মামা শুনেছেন। এখনকার ছেলেমেয়েদের মতো টিভি কিংবা ভিডিও গেম নয়-বই। বই পেলে ইমুর নাওয়া খাওয়া বন্ধ। অমন ভাগনে আর ক’জনের হয়? তাই মেজো মামা ইমুর পড়ার উপযোগী এক কার্টুন বই এনেছেন। এক কার্টুনে অনেক বই-যেন কোন লাইব্রেরির জন্য আনা। ইমুর মতো নানিজানও খুব খুশি। নাতির গর্বে নানিজানেরই কি কম সুখ? ইমুর পীড়াপীড়িতেই তার নানিজানকে জায়নামাজ থেকে উঠতে হলো। কোথায় ব্লেড অথবা চাকু আছে বের করে দেও, আমি দেখবো এতে কি কি বই আছে। ইমুর যেন তর সইছে না। নানিজান তাকে আপতত একটা সুপারি কাটার যাঁতি দিলেন। সেটার সাহায্যেই বই এর কার্টুনের দড়ি কাটা হলো।
তারপর ইমু পেয়ে যায় তার গুপ্তধন। কার্টুনের মধ্যে থরে থরে সাজানো চমৎকার সব বই! ইমুর আম্মুও নানিজানের ঘরে এসে তার বইপাগল ছেলের উপহারগুলো দেখে গেলেন। তারপর ছোট মামার মতো ইমুর আম্মুও যেয়ে উঠোনে তার পূর্বস্থানে গিয়ে বসলেন। উঠোন থেকেই দেখা যায়, ইমু বইয়ের কার্টুন থেকে লোভনীয় বিস্কুটের মতো এক এক করে বইগুলো হাতে নিচ্ছে আর তার পাতা ওল্টাচ্ছে। নানিজান ছোট্ট শিশুর কৌতূহল নিয়ে ইমুর পাশে দাঁড়িয়ে তার বই পাগল নাতির কান্ড কারখানা দেখতে থাকেন। ইমুর তখন কারো দিকে খেয়াল নেই। সফল কোন বাণিজ্য শেষে যেন কোন সওদাগর তার হিসেব মিল করছে-ইমুর মধ্যে তখন এধরণের ব্যসত্মতা।
এক একটা বই হাতে নিতেই ইমুর চোখ খুশিতে ঝিলিক দিয়ে উঠছে। ইমুর বইপ্রীতি নিয়ে অনেক মজার মজার ব্যাপার আছে। বাড়িতে পড়তে অসুবিধা বোধ করলে সে মাঠে চলে যায়। মাঠে যেয়ে কখনো উঁচু পাটক্ষেতের আইলে, আবার কখনো ধানক্ষেতের পাশে বই পড়ায় মগ্ন হয়ে পড়ে। ইমুকে মাঠে যেতে দেখলেই আম্মু তার পেছন পেছন বাড়ির কাজের ছেলে আক্কাসকেও মাঠে পাঠায়। আক্কাস দূরে দাঁড়িয়ে ফসলের ক্ষেত পাহারা দেয়, নয়তো বাড়ির ছাগলের জন্য ক্ষেতের আইল থেকে ঘাস সংগ্রহ করতে থাকে। তবে তার মূল লক্ষ্য থাকে ইমুর দিকে। পড়ার সময় পাশে একটু শব্দ হলেও ইমুর কাছে তা বড্ড বিরক্তিকর ঠেকে। নির্জন স্থানে পড়ার জন্য তাই ইমু অনেক সময় গাছে উঠেও বই পড়ে। পাতায় ছাওয়া গাছের বড় ডালের ফাঁকে বসে নাওয়া খাওয়া ভুলে কত দুপুর-বিকেল কেটে গেছে ইমুর বই পড়ে। শুধু গল্পের বই নয়; ইতিহাস, বিজ্ঞান আর গোয়েন্দা কাহিনীও তার খুব প্রিয়। ক্লাসের বই পড়াতেও বা ইমু কম কিসের? ওদের স্কুলের ক্লাস সেভেনে ইমুইতো এখন ফার্স্টবয়।
প্রাইমারি স্কুলের সমাপনী পরীক্ষায় ইমুই প্রথম ওদের গ্রামে গোল্ডেন এ প্লাসসহ ট্যালেন্ট পুলে বৃত্তি পেয়েছে। ইমুর বৃত্তি পাবার সংবাদ শুনেই তো মেজোমামা মোবাইল ফোনে ইমুকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, তাকে একটা স্পেশ্যাল গিফট দেওয়া হবে। মেজো মামা যখন দেশে আসবেন তখন সেই গিফটও সঙ্গে আনবেন। ইমুর স্পেশাল গিফটের জন্য মেজো মামাকে বেশ কয়েকটা দেশে যোগাযোগ করতে হয়েছে। সৌদি আরবে সব পাওয়া যায় না। তাই তিনি ফ্রাঙ্কফুর্ট, লন্ডন, নিউইয়র্ক, সিডনী, কোলকাতা এমন কি ঢাকাতেও অনলাইনে যোগাযোগ করে ইমুর সেই স্পেশাল গিফট জোগাড় করতে হয়েছে। মেজো মামা যে ইমুকে কথা দিয়েছেন! তাই ইন্টারন্যাশনাল কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে মেজো মামা ইমুর সেই মহামূল্যবান গিফ্ট-অর্ধশত পুসত্মক বা বই সংগ্রহ করেছেন। এখন বিশ্বের যে কোনো স্থানে বসে ইন্টারনেটে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে বইসহ নানাবিধ পণ্য ক্রয় করা যায়। মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই সেসব পণ্য এখন ইন্টারন্যাশনাল কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে মালিকের ঠিকানায় পৌঁছে যায় । কি মজার মজার সব বই! ভারতের লেখক সুনীল, সুকুমার, সত্যজিত, শিবরাম, তারাপদ ছাড়াও বাংলাদেশের হুমায়ূন, জাফর, মিলনসহ আরো বেশ ক’জন নামকরা লেখকদের সব বই! বইগুলো দেবার সময় মেজো মামা শর্ত দিয়েছেন, পরীক্ষার ক্ষতি হয় এমন সময়ে কিছুতেই ওসব বই পড়া যাবে না। পরীক্ষার ব্যাপারে ইমুর নিজস্ব একটা দায়িত্ববোধ আছে, পড়ার ক্ষতি হয় এমন কিছুই সে করে না। ইমুদের ক্লাসে তার ক’জন বন্ধুর নিজস্ব মোবাইল ফোন আছে। ইমু কখনো ভুলেও ভাবে না তার মোবাইল ফোনের দরকার। প্রয়োজন হলে আম্মুর মোবাইল ফোনটাই তো সে ব্যবহার করতে পারে। তাহলে কেন সে নিজের জন্য আলাদা মোবাইল ফোন কিনবে? সে কি কোন ব্যবসায়ী নাকি কোনো গুরুত্বপূর্ণ অফিসার? এই বয়সে কেন তার মোবাইল ফোন লাগবে? ইমুর মধ্যে এসব বিবেচনাবোধ আছে বলেই সে বাড়িতে এবং স্কুলে সকলের এত প্রিয়। কার্টুনের মধ্যে থাকা চুয়ান্ন খানা বই নেড়েচেড়ে দেখার পরে ইমু উঠোনে আসে। মেজো মামা জানতেন, কার্টুনের মধ্যে যে সব বই আছে তা না দেখা পর্যমত্ম ইমুকে কেউ কাছে পাবে না। এমন কি ইমুর ঘুমও আসবে না রাতে। বইগুলো পর্যবেক্ষণ শেষে উঠোনে আসতেই এবার মেজো মামা ইমুকে কাছে ডাকেন এবং কেমন গিফট হলো সে বিষয়ে ইমুর অনুভূতি বুঝতে চান। ইমুর চোখ মুখ দেখেই মেজো মামা বুঝতে পারলেন, অমন গিফট এই ত্রিভুবনে ইমু কখনো চোখেও দেখেনি। ইমুর মাথায় মেজো মামা হাত বুলিয়ে আদর করেন। মেজো মামার কথায় জানা গেল, সৌদিতে বসবাসরত বাঙালিরা তাদের ছেলেমেয়েদেরকে বাংলা ভাষা ও বাঙালিয়ানা শেখানোর জন্য কত চেষ্টা করে থাকেন।
বাংলাদেশের মতো স্বল্প দূরত্বের মধ্যে স্কুল নেই। বাঙালি ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার জন্য কিছু বাঙালি কিন্ডারগার্টেন টাইপের কিছু স্কুল খুলেছেন। সেসব স্কুলও বেশ দূরে এবং অত্যমত্ম ব্যয়বহুল। তবু সেখানে অবস্থিত বাঙালিরা নিজেদের ছেলেমেয়েদের বাঙালি পড়াশুনা শেখানোর জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন। মামার একমাত্র মেয়ে ইলমার জন্ম সৌদি আরবেই। এবছর ইলমা ওখানে একটা বাংলা কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি হয়েছে। সেখানকার কিন্ডারগার্টেনে শেখা জসীম উদদীনের ‘বনভোজন’ কবিতা আবৃত্তি করলো। ইলমা ছোট্ট মানুষ, এখনও পুরোপুরি দম রাখতে পারে না। দম রাখতে না পারলে আবৃত্তি বা গান ভালোভাবে পরিবেশন করা যায় না। তবু ইলমার কণ্ঠের ‘বনভোজন’ শুনে সকলেই হাত তালি দেয়। হাততালির প্রভাবে আবৃত্তিকারের চোখমুখ গর্বে-খুশিতে উজ্জ্বল হয়। পরদিন সকালে সে কি নাশ্তার বাহার! মামাদের বাড়িতে তৈরি রুটি-পরটা-হালুয়ার সাথে সৌদিআরব থেকে আনা বিভিন্ন বিস্কুট, ফলের জুস, খেজুর, আঙুর এসবও নাশ্তার সাথে দেওয়া হলো। নাশ্তা তাই আর শুধু নাশ্তা রইলো না,বরং সকাল বেলাতেই যেন ছোটখাটো ভোজ হয়ে গেল। মামার পীড়াপীড়িতে ইমুকে কিছুটা বেশিই খেতে হলো। মেজো মামা এসেছেন বলে এরই মধ্যে তাদের বাড়িতে ক’জন বিনা বেতনের ঝি-ও জুটে গেছে। তারা জানে মেজো মামা যাবার সময় সবাইকে মোটা অংকের বকশিস্ দিয়ে যাবেন। তাই না ডাকলেও মামাদের পাড়ার তিন-চারজন দরিদ্র গোছের মহিলা মামাবাড়ির রান্নাঘরে এটা ওটা কোটাকুটি, পানি আনা, ঝাড়ু দেওয়া ইত্যাদি কাজে ব্রতী হয়েছে। অবশ্য সকাল বেলাতেই যে পরিমাণ নাশতা তৈরির প্রয়োজন হলো তাতে স্বেচ্ছায় কাজে ব্রতী হওয়া মহিলারা না থাকলে বেশ বিড়ম্বনাই হতো। শুধু বাড়ির জন্য নয়; বাইরের অনেকের জন্যও নাশতা তৈরি করতে হলো।
মেজো মামার আগমন সংবাদে সকাল থেকেই তার কাছে বিভিন্ন মানুষ সাক্ষাৎ করতে আসছে। সৌজন্য সাক্ষাতের জন্য এলেও অনেকেরই আগমনের হেতু, তার ছেলে কিংবা ভাই, কিংবা জামাই এর জন্য সৌদি আরবে যাবার একটা ভিসার ব্যবস্থা করা। মেজো মামা আশ্বাস দেন, চেষ্টা করে দেখবেন তিনি। বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর কত মানুষ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজ করতে যাচ্ছে,তবুও এদেশ থেকে বেকারত্ব দূর হচ্ছে না। এজন্য দরকার নিজের দেশেই শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা। মেজো মামার সাথে যারাই সাক্সাৎ করতে আসছেন সকলের জন্যই কিছু না কিছু খানাপিনার ব্যবস্থা করা হচ্ছে- এ ব্যাপারে মেজো মামার কঠোর হুকুম রান্নাঘরে। তিনি যে ক’দিন দেশে থাকবেন সে ক’দিন আত্মীয়-মেহমান কেউ যেন না খেয়ে বাড়ি ফেরে না। ইমুর বোন তিতলীকে পেয়ে ইলমা মহা খুশি। দু’জনের মধ্যে বেশ ভাব হয়েছে! যেখানেই যাচ্ছে দু’জনে মাণিকজোড়ের মতো একসাথে। দু’জনের মধ্যে ফিস্ফিস্ করে কী সব আলাপও হচ্ছে। ইমু বা অন্য কেউ তাদের কাছাকাছি হলেই সেই ফিস্ফিস্ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ইলমা বাংলাদেশের অনেক কিছুই চেনে না। তাই গাইড হিসেবে তিতলীকে পেয়ে সে-ও বেশ খুশি। বাড়ির মধ্যে ঘুরে বেড়ানো, হাঁস, মুরগি, ছাগল-বেড়াল এসব দেখে ইলমা তিতলীকে জিজ্ঞেস করে, ওটা কী, ওরা কী খায়, কোথায় থাকে? একটা মুরগি দেখে ইলমা জানতে চায়, ওটা কী কামড়ায়? তিতলী হাসতে হাসতে জবাব দেয়, দূর মুরগি কী কামড়াতে পারে নাকি! ইলমার একটা হাত নিয়ে তিতলী একটা ছাগলের পিঠে রাখে। ছাগলটা আরাম পেয়ে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে থাকে।
ব্যাপারটা দেখে ইলমা খুব মজা পায়। সৌদি আরবের মাটিতে জন্ম নেওয়া ইলমা এভাবেই তিতলীর মাধ্যমে বাংলাদেশকে জানার চেষ্টা করে। তিতলীর নিচের পাটির সামনের দু’টো দাঁত মাস তিনেক হলো বিদায় নিয়েছে। দাঁতহীন সেই শূন্যস্থানে এখন নিচ থেকে নতুন দু’টো দাঁত উঁকি দিতে শুরু করেছে। বর্তমানে সে দাঁত দু’টো কেবল ফিফটি পার্সেন্ট মাথা তুলতে সমর্থ হয়েছে। দাঁত দু’টোর আগার দিক ধানকাটা কাঁচির ধারের মতো খাঁজকাটা। তিতলী হাসলে বা কথা বলার সময় সেই অসমাপ্ত দাঁত দেখা যায়। উত্তম শ্রোতা পেয়ে তিতলী সেই অসমাপ্ত দাঁত নিয়েই হেসে হেসে ইলমাকে ‘এলেম’ দিয়ে চলে। ইমুর মামাদের বর্তমান বাড়িটা তিন-চার পুরুষ আগে আরো পশ্চিমে নদীর ধারে ছিল । এগ্রামের পশ্চিম দিক দিয়ে বয়ে চলা ছোট্ট বারুই নদীটা এখনো আছে; তবে আগের মতো তার আর জৌলুস নেই। এ নদীতে একসময় বড় বড় মহাজনী নৌকা চলতো। সেসব নৌকা মাল বোঝাই করে কোলকাতা-নারায়ণগঞ্চ-চাঁদপুর চলে যেতো। আবার ওসব স্থান থেকে নানান পণ্য নিয়ে ফিরে আসতো গোকুলখালি কিংবা ঘোলদাড়ির কুঠির বাজারে। শুধু মালামাল পরিবহসের জন্যই নয়, চলাচলের জন্যও তখন নৌযান অপরিহার্য ছিল।
গ্রামের মানুষ বড় বড় গাছের কাষ্ঠ- খোদাই তক্তা বানিয়ে সেসব নৌযান তৈরি করতো। নদীর পাড়ের বাড়িগুলোতে সেজন্য একটা করে ঘাটও থাকতো। প্রত্যেক বাড়ির নিজস্ব ঘাট থাকতো। বর্ষাকালে পানি বৃদ্ধি পেলে কিংবা কার্তিক মাসে নদীর পানি কমতে থাকলে নদীতে নামতে যাতে কষ্ট না হয় সে জন্যই ঘাট তৈরি হতো। সেসব ঘাট গাছের গুড়ি ফেলে, বাঁশ দিয়ে যেমন তৈরি হতো ঠিক তেমনি আবার তা ইট-সুরকির গাঁথুনি দিয়ে পাকাও করা হতো। ইমুর নানাদের পুর্বপুরুষদের নদীর ঘাটটা ইটের তৈরি পাকা করা ছিল। ইংরেজ সাহেবদের আমলে এই বারুই নদী দিয়েই ভিনদেশী ডাকাত-দস্যু আর সাহেবদের পেয়াদা এসে ঘাটে নৌকা বেঁধে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়তো। তারপর তারা টাকাকড়ি, ছাগল-গরু, হাঁস-মুরগি যা পেতো তাই-ই জোর করে নিয়ে যেতো। তাছাড়া গ্রামে গ্রামে ইংরেজরা কুঠি তৈরি করায় সে অঞ্চলের বাঘ-শূকর নদীর চরাঞ্চলে এসে উপদ্রুব করতে থাকে। আগেকার দিনে এ অঞ্চলে গৃহস্থ বাড়িতে বাঘ হানা দিয়ে ছাগল ধরে নিয়ে যেতো। গ্রামের মানুষ এজন্য সারারাত আগুন জ্বালিয়ে রাখতো অথবা কাঁসার থালা-বাসন বাজিয়ে শব্দ করতো। এসব করলে সে গ্রামে বাঘ আসতো না। বন্য শূকরও তখন পথে ঘাটে মানুষকে আক্রমণ করতো। বারুই নদীর ধারে ইমুর নানাদের পূর্বপুরুষেরা এসব অত্যাচারের কারণেই ফসলী সমতল জমিতে বসবাসের সিদ্ধামত্ম নেয়। যে স্থানে তাদের পুরাতন বাসগৃহ ছিল এখনো নদীর ধারে সেই পুরাতন ভিটার মাটি খনন করলে অতীতের মাটির তৈরি ভগ্ন তৈজসপত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। বেশ কয়েকদিন এক নাগাড়ে টানা বৃষ্টি হলে বৃষ্টির ধারায় মাটির ভেতর থেকে অগণিত মাটির খাপড়া জেগে ওঠে।
অনেকে এরকম বৃষ্টির পরে ওই ভিটায় সোনা-রুপার গহনা ও মুদ্রাও নাকি পেয়েছে। বছর দুই আগে ইমু এরকম বৃষ্টির পরে মামাদের সেই পুরাতন ভিটেয় গিয়ে বেশ কয়েকটা পুরাতন কড়ি খুঁজে পেয়েছিল। ইমু নানিজানকে সে কড়িগুলো দেখালে, তিনি বলেছেন আগে নাকি টাকা-পয়সার পরিবর্তে কড়ি ব্যবহার করা হতো। এজন্যই এখনো মানুষ পয়সার সাথে কড়ি শব্দটাও ব্যবহার করে থাকে। বারুই নদীর যে স্থানে মামাদের বাড়ি ছিল সেখানে এখনো মানুষ গোছল-টোছল করে। এই জায়গাটার নাম শরীয়তের ঘাট। ইমু অনেকদিন ভেবেছে, এই স্থানটার নাম শরীয়তের ঘাট কেন হয়েছে? নিশ্চয় বিনা কারণে এ নাম হয়নি। ইমু তার মামাদের গ্রামের কয়েকজন বয়স্ক লোকের কাছে জানতে চেয়েছে, কেন এই ঘাটের নাম শরীয়তের ঘাট রাখা হয়েছে। তারা এ প্রশ্নের উত্তরে বলেছে যে, শরীয়ত নামের একজন কামেল পীর নাকি এই ঘাটে নেমেছিল। আর একজন বলেছেন, একজন আউলিয়া গোছের মানুষ শরীয়ত বা ইসলামের বিধি-বিধান প্রচারের জন্য এ ঘাটে নেমেছিল বলেই এ স্থানের এরূপ নামকরণ। তাদের এই তথ্য ইমুকে আরো কৌতূহলী করে তোলে। ইমু নানিজানকে জিজ্ঞেস করে কিছু তথ্য পেলো তবে তা কৌতূহলের তুলনায় যৎসামান্য। তবে নানিজানও শরীয়ত নামে একজন মানুষের এ গ্রামে আসার কথা শুনেছেন। ইমু স্কুলের ইতিহাস স্যারের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেছেন, বৃটিশ শাসনামলে এ অঞ্চলে অর্থাৎ বৃহত্তর নদীয়া (বর্তমান বাংলাদেশের অংশের নাম কুষ্টিয়া) যশোর, ঢাকা ও ফরিদপুর অঞ্চলে হাজী শরীয়ত উল্লাহ নামের একজন ইসলাম প্রচারক ও সমাজ সংস্কারক ছিলেন। বাংলাদেশের ইতিহাস বইতে ফরায়েজী আন্দোলনের নেতা সেই হাজী শরীয়ত উল্লাহর নাম আছে। সেই হাজী শরীয়ত উল্লাহর নামের কারণেই তো শরীয়তপুর জেলা হয়েছে। ইমু ইতিহাস স্যারের কাছ থেকে মোটামুটি একটা ধারণা লাভ করার পরে মেজো মামার কাছে মোবাইল ফোনে ব্যাপারটা জানায়। ইমু ভেবেছিল মেজো মামাও হয়তো তাদের গাঁয়ের অন্যাদের মতোই ধারণা পোষণ করে আছেন। কিন্তু না, ইমুর মেজো মামা এ বিষয়ে অনেক কিছু জানেন। শুধু হাজী শরীয়ত উল্লাহ কেন, এই শরীয়তের ঘাটে এদেশের অনেক নামকরা ব্যক্তি এসেছেন। নেসার আলী ওরফে তীতুমীরও এসেছেন এ গাঁয়ে। তবে শরীয়ত উল্লাহ ছিলেন সকলের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
তাই তাঁর নামানুসারেই এ গাঁয়ের বারুই নদীর পাড়ের ওই বিশেষ ঘাটকে শরীয়তের ঘাট নাম দেওয়া হয়েছে। ইমুর নানার দাদাজান নফরদ্দি খাঁর সাথে নাকি হাজী শরীয়ত উল্লাহর সাক্ষাৎ হয়েছিল কোলকাতায়। তার আমন্ত্রণেই হাজী শরীয়ত উল্লাহ ইমুর নানাদের গ্রামে এসেছিলেন। এ গ্রামে অবস্থানকালে হাজী শরীয়ত উল্লাহর একজন সহচর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ইমেত্মকাল করেন। তাকে বারুই নদীর তীরে ইমুর নানাদের পারিবারিক কবরস্থানেই সমাহিত করা হয়। পরবর্তীকালে ইমুর নানার দাদাজান নফরদ্দি খাঁ কোলকাতা থেকে ওসত্মাগর এনে সেই কবরটা পাকা করে দিয়েছিলেন। এখনো নাকি সেই বাঁাধানো কবরটা আগের মতোই আছে। ইমুর নানাদের পারিবারিক কবরস্থানে এরকম একজন মহৎ মানুষের সহচরের সমাধির কথা এবং নানাদের পূর্বপুরুষ নফরদ্দি খাঁর কথা জানতে পেরে ইমুর গর্ব হয়। ইমু তো মাতৃকুলে সেই নফরদ্দি খাঁরই বংশধর! ইমু স্কুলের লাইব্রেরিতে গিয়ে লাইব্রেরিয়ানের কাছে জানতে চায়, কোন বই থেকে সে হাজী শরীয়ত উল্লাহ সম্পর্কে জানতে পারবে? লাইব্রেরিয়ান তাকে এ সম্পর্কিত একটি বই খুঁজে দিয়েছিলেন। সেই বই পাঠ করে ইমু জানতে পারে, পলাশী যুদ্ধের চবিবশ বছর পরে ফরিদপুর জেলায় শরীয়ত উল্লাহ্র জন্ম। শৈশবে পিতৃ-মাতৃহারা শরীয়ত প্রথমে কোলকাতা যান।
তারপর কোলকাতার বাসারত আলী নামের একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমানের সাথে শরীয়ত উল্লাহ আরবদেশের মক্কা নগরীতে পৌঁছেন। মক্কায় হজ্বব্রত পালন শেষে তিনি আরো কিছুদিন মক্কায় থেকে ইসলাম ধর্মের নানাদিক জানার চেষ্টা করেন।
তারপর দেশে ফিরে এসে তিনি তাঁর লব্ধ জ্ঞান দ্বারা এদেশের ক্ষয়িষ্ণু মুসলমানদেরকে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করেন। এজন্য তিনি বাংলার পথে-প্রামত্মরে কখনও পদব্রজে, কখনো নৌযানে ঘুরে বেড়াতে থাকেন এবং মানুষকে সত্যিকার ইসলামের পথে আসার আহবান জানাতে থাকেন। আর সে কারণেই হয়তো তাঁর জীবদ্দশায় কোনো এক সময় বারুই নদীর পাড়ে ইমুর নানাদের বাড়িতে এসেছিলেন। ইমুর নানাদের তাঁরই নামানুসারে হয়ে যায়, শরীয়তের ঘাট। মেঝো মামার সাথে ফোনে আলাপ এবং স্কুলের ইতিহাস বই পড়ার পর থেকেই ইমু মামাদের পারিবরিক কবরস্থানটা দেখার জন্য কৌতূহলী হয়ে ওঠে। সেই সাথে শরীয়তের ঘাটখানাও যে স্থানে সেই স্থানে ইমু গিয়ে একটু বসতে চায়। স্কুলের পড়াশুনার চাপে ইমু বেশ ক’মাস মামাবাড়ি আসতে পারেনি । এবার মেজো মামার বাড়ি আসার কারণেই তার আসা হলো। মামা বাড়িতে আসার পর থেকেই ইমু মনে মনে পরিকল্পনা আঁটতে থাকে, কিভাবে সে ওই কবরস্থানে প্রবেশ করবে।
নানিজান,মামা কিংবা আম্মু জানতে পারলে কখনোই তার সেখানে যাওয়া হবে না। ব্যাপারটা তাই অতি গোপনেই ইমু সারতে চায়। পরদিন নাশ্তা করার পরে ইমু মামাদের পাড়ার মধ্যে বেড়াতে যাবার অজুহাতে সোজা চলে আসে সেই শরীয়তের ঘাটে। তিন-চার মিনিটের হাঁটা পথ। বারুই নদীর কোল ঘেঁষে এখনো এক জায়গায় ইটের গাঁথুনির কিছু অংশ মাথা তুলে আছে। বর্ষাকালে তা চোখে পড়ে না,পানির নিচে থাকে। এখন জ্যৈষ্ঠমাস চলছে। আর ক’দিন পরেই ওই জায়গাটা পানির নিচে হারিয়ে যাবে। নদীর ধারে এ অঞ্চলটা একসময় বঘনবসতিপূর্ণ হলেও বর্তমানে তা একদম ফাঁকা। বর্তমানে সারাক্ষণ এ এলাকাটা এত নির্জন থাকে যে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া তেমন কেউ এদিকে আসে না। পুরাতন এলাকার এসব বসত ভিটা নিয়ে নানা ভীতিকর কাহিনী-কিংবদমত্মী চালু আছে। এ গাঁয়ের অনেকেই নাকি দিনের বেলাতেই নদীর ধারে সাদা কাফন পরা অচেনা লোকজনকে ঘুরে বেড়াতে দেখেছে। তাদের শরীরে বসন সাদা ধবধবে। তাছাড়া রাতের বেলা প্রায়ই নাকি এ গোরস্থানে আলো-টালোও জ্বলতে দেখা যায়। কে একজন একদা রাতে হারানো গরুর খোঁজে নদীর ধারে এসে দেখতে পেয়েছিল পুরাতন কবরস্থানে আলো জ্বলছে। সে আলোয় পরিষ্কার দেখা গিয়েছিল, একজন হুজুর মাহফিলে বক্তৃতা করছেন। সে মাহফিলের শ্রোতারা সকলেই সাদা বসন পরা । ইমু এসব কথা বিশ্বাস করেনি।
কোনো প্রমাণও অবশ্য কেউ দিতে পারেনি। কোন স্থানকে কেউ ভীতিকর বলে ঘোষণা দিলে সে এলাকায় চলাচলের সময় আপনা আপনিই একটা যুক্তিহীন অজানা ভয় কাজ করে। ব্যাপারটা অবশ্য সাইকোলজিক্যাল। সব মানুষের মধ্যেই একটা অযৌক্তিক-আবেগ বিদ্যমান থাকে। কখনো কখনো তার মাত্রাগত তারতম্য ঘটে। তখন কেউ কেউ অবাসত্মব অনেক কিছু দেখে, শোনে ও বিশ্বাস করতে থাকে। এভাবেই নিজের মনের সাথে বোঝাপড়া করার পরে ইমু ফাইনাললি ডিসিশন নেয়, কবরস্থানে ঢুকবেই। কবরস্থানে ঢুকে ইমুর একমাত্র কাজ হাজী শরীয়ত উল্লাহর সেই শিষ্য বা সহচরের কবরটা খুঁজে বের করা- যেটা নফরদ্দি খাঁ বাঁধাই করে দিয়েছিলেন। যেহেতু ওটা পাকা করে বাঁধানো সেহেতু তাতে নাম-ধাম এবং জন্ম-মৃত্যুর বিবরণ থাকাও বিচিত্র কিছু নয়। জ্যৈষ্ঠ মাসের সকালটায় তখন চারপাশে মেঘমুক্ত আকাশের উজ্জ্বল রৌদ্রালোক। বারুই নদীটা এখন এতটাই শীর্ণ যে নদীর ওপারের মাঠে যারা গরু চরাচ্ছে তাদের মুখখানা পরিষ্কার বোঝা না গেলেও তাদের পরণে কী রঙের কাপড় এবং তাদের গরুগুলোর গায়ের রঙও বেশ বোঝা যায়। ইমুকে কি নদীর ওপারের গরুচরাণো রাখালেরা দেখতে পাচ্ছে? ইমু বারদুয়েক চোখ বন্ধ করে একটা ‘ক্যালকুলেশন’ করে নেয়, নদীর ওপারের গরুর রাখালেরা তাকে দেখতে না পেলেও চিৎকার করলে তার শব্দ শুনতে পাবে। কবরস্থানে প্রবেশের আগে ইমু মনের সাথে আর একবার বোঝাপড়া করে নেয়, কবরস্থানে তার কি কোনো বিপদ কার হতে পারে? উত্তরে জিরো ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না।
জীবিত মানুষদের বসবাস নয় বলে সাধারণত কবরস্থানের সুরক্ষা ও সৌন্দর্যের প্রতি মানুষের আগ্রহ কম থাকে। জীবিত মানুষেরা কবরস্থানে এসে বেশি সময় থাকতেও চায় না। তাই কবরস্থানের নান্দনিক বিষয়টাও তাই প্রায়ই অনুল্লেখ থাকে। তবে ইমুর মামাদের এই পারিবারিক গোরস্থানটা যে একসময় নান্দনিকতা নিয়েই গড়ে উঠেছিল, তার প্রমাণ এখনও এর গেট এর ইটের নকশা থেকে বোঝা যায়। গেট ছাড়াও এর চারপাশে প্রাচীরও করা হয়েছিল। এখনও সেই শ্যাঁওলা পড়া গেটের সাথে শালকাঠের একপাটি চৌকাঠের অর্ধেকটা ঝুলে আছে। সেই অর্ধেক চৌকাঠের সাথে একটা মরচে পড়া লোহার বাঁকানো দন্ডও চোখে পড়ে। ইমু লোহাটা স্পর্শ করে, গাছের নিচে শীতল পরিবেশ বলে লোহার দন্ডটা জ্যৈষ্ঠের গরমেও বেশ শীতল। দিনের বেলা হলেও এলাকার বেশিরভাগ জুড়ে বাঁশ বাগান থাকায় দিনের বেলাতেও কেমন একটা ভূতুড়ে অন্ধকার অন্ধকার ভাব। কবরস্থানের চারপাশের প্রাচীরটা ইমুর কোমর সমান উঁচু। জায়গায় জায়গায় সে প্রাচীরের কিছু অংশ ভেঙে পড়েছে। আর মূল গোরস্থানের ভেতরে কয়েকটা বড় বড় গাছও হয়ে গেছে। গোরস্থানের গাছ বলেই হয়তো কেউ আজো সেসব গাছ কাটেনি, তবে এর ফলমূল লোকে নিয়ে যায়। গাছের পাতা, শুকনো ডাল, ঝোঁপ-ঝাঁড়ের কারণে এ কবরস্থানের মধ্যে হাঁটা-চলা করা করা খুব একটা সুবিধাজনক নয়। কবরস্থানের ভেতরে কয়েক কদম অগ্রসর হতেই দ্রুত কোনকিছুর অপসৃত হবার শব্দ শোনা যায়। ইমুর ‘হাইভোল্টেজ’ সতর্ক চোখ শব্দটার উৎস সন্ধানে ব্রতী হয়। দু’টো খরগোশ মানুষের অসিত্মত্ব টের পেয়ে পালাচ্ছে। লোকজনের যাতায়াত না থাকায় বুনো ঝোঁপঝাড়ে, বিভিন্ন কাঁটালতায় আর গাছের শুকনো ডাল-পাতায় জায়গাটা কবরস্থানের পরিবেশটা ইমুর কাছে প্রাগৈতিহাসিক যুগের মতো মনে হয়। দুই একর জায়গা জুড়ে এই কবরস্থানে সর্বমোট পাঁচটা কবর পাকা করা। সেই পাঁচটা কবরের প্রাচীর থাকায় চেনা যায়। বাকি এখানে কতজন শুয়ে আছে তার সঠিক তথ্য কে দিতে পারে? ইমুর সন্ধানী চোখে কোনো পাথরে বাঁধাই করা কবর ধরা পড়ে না।
বাঁধানো পাঁচটা কবরের তিনটা ইমুর নানা ও তার দুই ভাইয়ের। অন্য দুটোর নাম পড়ার মতো নেই; সিমেন্ট বালুর প্লাস্টারে খোদাই করে নামা-ধাম লেখা। সেই প্লাস্টারই যখন উঠে গেছে তখন নাম ধাম থাকবে কি করে? একটা জায়গায় ইমু দেখতে পায় সুড়ঙ্গের মতো খুবই সরু পথ। পথটা মসৃণ। সাধারণত সাপ বা বেজি দীর্ঘদিন চলাচল করলে অমন মাটির সুড়ঙ্গপথে অমন মসৃণ হয়। নির্জন কবরস্থানে সাপ বা বেজি থাকতেই পারে। ইমুর কাঙ্ক্ষিত সেই শরূয়ত উল্লাহর সহচরের কবর কোনটা, কোথায় সেটা? ইমু বুঝতে পারে বয়স্ক কোনো মানুষ ছাড়া, বিশেষ করে যারা চেনে তারা ছাড়া সে কবরের সন্ধান পাওয়া সম্ভব নয়। ইমুর মধ্যে যখন পুরোপুরি নৈরাশ্য ভর করেছে, তখন সে থেয়াল করে পশ্চিমের কোণার দিকে একটা জায়গায় পুরাতন পাতার সত্মূপটা বেশ উঁচু। খরগোশ -বেজি বা সজারু থাকার আদর্শ জায়গা বটে। আছে নাকি কোনকিছু ওর মধ্যে? ইমু একটা শুকনো ডাল নিয়ে সেই পাতার সত্মূপের ভেতরে সেঁধিয়ে দিতেই টের পায় পাতার নিচের জমিন পাকা করা। এটাই কি তাহলে সেই ঐতিহাসিক কবরস্থান? ইমু এবার শুকনো ডালটা ফেলে দিয়ে দু’হাতে পাতা সরিয়ে জায়গাটা পরিষ্কার করতে থাকে। হ্যাঁ এটা সেই কবর না হয়ে পারেই না। লম্বায় দশ-এগারো ফুট তো হবেই। সাধারণ ইটের তৈরি নয়; বড় সাইজের পাথর সুন্দরভাবে সেট করে কবরের উপরিভাগ ঢেকে দেওয়া হয়েছে।
পাথরগুলো নিশ্চয় চুন-সুরকি বা এধরণের কোনো মশলার আসত্মরণ দ্বারা গাঁথা হয়েছে। পশ্চিমদিকের দেওয়ালের গা ঘেষে একটা পাথরে খোদাই করা কিছু আরবি হরফ চোখে পড়লো। তবে হরফ আরবি হলেও ভাষাটা আরবি নয় । পাথরে খোদাই করা সেই দুর্বোধ্য হরফগুলোর উপর দীর্ঘদিনের শ্যাঁওলার আসত্মরণ জমে তার পাঠোদ্ধারকে আরো দুর্বোধ্য করে ফেলেছে। ইমু তার আরবি পাঠের স্বল্পজ্ঞান প্রয়োগ করে বুঝতে পারলো,পাথরে খোদাই করা আরবি বর্ণমালাগুলো দিয়ে যে বাক্য রচিত হয়েছে তা ফারসি ভাষার। সে ভাষার অর্থ ইমু না বুঝলেও একটা সংখ্যা সে পড়তে সমর্থ হলো- যা আরবি হরফের। সংখ্যাটা হলো (১৮৪২)। ইমু পড়তে পারবে না তবু সেই ফারসি ভাষার বর্ণগুলোস্পষ্ট করার জন্য নিকটের একটা গাছের পাতা ছিড়ে পরিষ্কার করতে লাগলো।
কিছুক্ষণ সেই লেখাটার উপর পাতা দিয়ে ঘসতেই প্রকৃত লেখাগুলো ফুটে উঠতে লাগলো। ইমু ভাবলো একসময় কাগজ কলম এনে এতে যা লেখা আছে তা লিখে নিয়ে গিয়ে এর অর্থ বা বক্তব্য জানার জন্য ফারসি জানা কোন ব্যক্তিকে দেখাবে। ফিরে আসার সময় ইমু সেই লেখাটার উপর উবু হয়ে চুমু দেবার উদ্যোগ করতেই সে বুঝতে পারলো তার মাথাটা নিচে নামাতে পারছে না। আর একবার চেষ্টা করতেই তার মনে হলো কেউ কথা বললো, ইয়ে মাসুম বান্দা,পায়ের পাদুকা খুলে ফেল! কথাটা শোনার সাথে সাথেই ইমু খেয়াল করে সে স্যান্ডেল পায়ে দিয়েই কবরস্থানে প্রবেশ করেছে। সঙ্গে সঙ্গে ইমু পায়ের স্যান্ডেল খুলে ফেলে মোনাজাতের ভঙ্গিতে দু’হাত উঁচু করে বলে, হে আল্লাহ্! হেপাক-পরোয়ার দিগার আমাকে মাফ করে দাও! এরপর সে সেই ফার্সিলিপির উপর উবু হয়ে ঠোঁট স্পর্শ করতেই চতুর্দিক থেকে তার কানে ভেসে আসতে থাকে গুরুগম্ভীর শোঁ-শোঁ, গমগমে আওয়াজ! যেন সে কোন ঝর্নার পাশে দাঁড়িয়ে আছে, যেন কোন সুউচ্চ পর্বত থেকে সেই ঝর্না পতিত হচ্ছে।
সহসা সেই নির্জন-প্রায়ান্ধকার গ্রাম্য গোরস্থান আলোয় ঝলমল করে ওঠে! সেই সাথে ইমুর সমগ্র ঘ্রাণেন্দ্রিয় উপলব্ধি করতে থাকে এক আলৌকিক -স্বর্গীয় সুবাস! ইমুর চারপাশে ওরা কারা গুলবাগিচায় বিচরণ করছে ? কারা শরবতের সোরাহি নিয়ে ইমুর দিকে এগিয়ে আসছে? আকাশ থেকে ওরা কারা ইমুর সাথে আলিঙ্গন করতে দুবাহু বাড়িয়ে তাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে?