পূর্ব কথা
আপনারা আগেই জেনে এসেছেন মহান রাসুল আল্লাহর বন্ধু ইবরাহীম (আঃ) এর কাহিনী। শুনেছেন তাঁর অগ্নীপরীক্ষার কথা, হিজরতের কথা এবং আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্যে দেশ থেকে দেশান্তরে ঘুরে বেড়ানোর কথা। শেষ বয়েসে মহান আল্লাহ তাঁকে দুটি পুত্র সন্তান দান করেন। দুজনকেই নবয়্যত দান করেন এবং আরো দান করেন উচ্চ মর্যাদা। তাঁদের একজন ইসমাঈল (আঃ) এবং অপরজন ইসহাক (আঃ)। ইসমাঈলের ইতিহাস তো আগেই বলে এসেছি। এবার শুনা যাক ইসহাকের কথা। হযরত ইব্রাহীমের ছিলেন দুই জন স্ত্রী। একজন সারাহ আর অপরজন হাজেরা। সারাহ প্রথম স্ত্রী। তাঁকে সাথে নিয়েই হযরত ইবরাহীম তাঁর মাতৃভূমি ইরাক থেকে হিজরত করেন। অনেক দেশ ঘুরে মিশরে যান। সেখানে বিয়ে করেন দ্বিতীয় স্ত্রী হাজেরাকে। সেখান থেকে ফিরে আসেন ফিলিস্তিনে। এখানে আসার পর হাজেরার ঘরে তাঁর একটি পুত্র সন্তান জন্মলাভ করেন। সে পুত্রই ছিলেন কুরবানীর নবী হযরত ইসমাঈল (আঃ)। আল্লাহর হুকুমে হযরত ইবরাহীম শিশুপুত্র ইসমাঈল ও তাঁর মাকে মক্কায় নিয়ে রেখে আসেন। সারাহ ফিলিস্তিনেই থেকে যান। হযরত ইবরাহীমও ফিলিস্তিনেই থাকতেন। আবার মক্কায় গিয়ে স্ত্রী ও পুত্র ইসমাঈলকে দেখাশুনা করে আসতেন।
সারাহর দুঃখ
কিন্তু সারার বড় দুঃখ। তিনি একজন বৃদ্ধা মহিলা। তাঁর সন্তানাদি হয়না। অথচ সব নারীই মা হতে চায়। সন্তানের মুখ দেখতে চায়। সন্তানকে বুকভরা আদর আর স্নেহ মমতা দিয়ে জড়িয়ে রাখতে চায়। মা ডাক না শুনলে কোন নারীরই বুক ভরেনা। সন্তান ছাড়া নারীর কোল থাকে শুন্য। বুকভরা আশা নিয়ে সারাহ সবসময় দয়াময় আল্লাহর কাছে দোয়া করেন সন্তান চেয়ে। কিন্তু আজো তাঁর সন্তান হয়নি। তিনি বৃদ্ধা হয়ে পড়েছেন। বয়েস হয়ে গেছে নব্বই। স্বামীও এখন শতায়ু বৃদ্ধ। সন্তান লাভের আর কি আশা? এ ঘরে সন্তান লাভের ব্যাপারে এখন দুজনই নিরাশ। কিন্তু হঠাৎ একটা কাণ্ড ঘটে গেলো। কী সে কাণ্ড?
সুসংবাদ পেলেন সারাহ
হঠাৎ একদিন হযরত ইব্রাহীমের বাড়িতে এলো কয়েকজন তাগড়া যুবক। অতি সুন্দর সুশ্রী হৃষ্টপুষ্ট ওরা। যেনো শক্তিশালী যোদ্ধা এবং বিরাট কোন সম্রাটের সৈনিক। তাঁদের আকস্মিক আগমনে ইবরাহীম ভয় পেয়ে গেলেন। তবে তারা এসেই হযরত ইব্রাহীমকে সালাম দেন এবং তিনিও সালামের জবাব দিয়ে তাঁদেরকে মেহমান হিসেবে গ্রহন করেন।
মেহমান এলে হযরত ইবরাহীম অত্যন্ত খুশি হতেন। কারন তিনি ছিলেন বড় মেহেমান নেওয়াজ। ওদের বসতে দিয়ে তিনি ভেতরে চলে গেলেন। অল্পক্ষনের মধ্যেই তাজা গরুর গোশত ভুনা করে নিয়ে আসলেন। সারাও পিছে পিছে এসে পর্দার আড়ালে দাঁড়ালেন। ইবরাহীম সারার ভুনা করা মজাদার গোশত তাঁদের পরিবেশন করতে থাকলেন। কিন্তু অবাক কাণ্ড। ওরা হাত গুটিয়ে রাখলো। খাবার স্পর্শ করছেনা। ইবরাহীম ভাবলেন- নিশচয়ই এরা শত্রু হতে পারে। বললেন- আপনারা কারা? আপনাদের তো চিনতে পারছিনা? আপনাদেরকে আমার ভয় হচ্ছে।
এবার তারা মুখ খুললো। বললো- আপনি ভয় পাবেননা। আমরা আল্লাহর দূত ফেরেস্তা। আমরা আল্লাহর কাছ থেকে আপনার জন্যে সুসংবাদ নিয়ে এসেছি। সারার ঘরে আপনার একটি বিজ্ঞ পুত্র সন্তান জন্ম হবে। একথা শুনে সারাহ বিস্মিত হয়ে সামনে এগিয়ে এলেন। কপালে হাত মেরে বললেন- এতো এক বিস্ময়ের খবর, আমি হয়ে গেছি বুড়ি থুরথুড়ি। তাঁর উপরে জনমের বন্ধ্যা। শুধু কি তাই? আমার স্বামীও শতায়ু বৃদ্ধ। কেমন করে হবে আমার ছেলে?
ফেরেস্তারা বললেন- “এতো আল্লাহর সিদ্ধান্ত। আপনি কি আল্লাহর ফায়সালার ব্যাপারে বিস্ময় প্রকাশ করছেন? এ সুসংবাদ নির্ঘাত সত্য। এর কোন নড়চড় হবেনা। আপনার গর্ভে ইসহাক জন্ম নেবেই। শুধু তাই নয়, ইসহাক একজন নবী হবে আর তাঁর ঘরেও জন্ম নেবে আরেক নবী ইয়াকুব। এ হচ্ছে আল্লাহর রহমত। পথভ্রান্তরা ছাড়া কি কেউ আল্লাহর রহমাত থেকে নিরাশ হয়? আল্লাহ মহাজ্ঞানী, মহাকৌশলী, সপ্রসংশিত, অতিশয় মর্যাদাবান। তিনি যা চান তাই হয়। হে ঘরবাসী, আল্লাহর রহমত আর বরকতের ধারা বর্ষিত হোক আপনাদের প্রতি।” (সূরা ১১ হুদ-৭২,৭৩)
জন্ম নিলেন ইসহাক
আল্লাহর হুকুমের নড়চড় নেই। হযরত ইবরাহীম আর সারার ঘর উজ্জ্বল করে জন্ম গ্রহন করলেন ইসহাক। চাঁদের মতো ফুটফুটে ছেলে। বুড়ো বয়েসে ছেলে হলে আদরের সীমা থাকেনা। বাবা মার আদরে লালিত পালিত হয়ে বড় হতে থাকলেন ইসহাক। যেমন বাপ তেমন ছেলে। মহান আল্লাহ ইসহাককে দান করেছেন দারুন মেধা, জ্ঞান এবং বুঝ ও বুদ্ধি।
নবুয়্যত লাভ
বড় হলে ইসহাককে আল্লাহ তায়ালা নবুয়্যত দান করেন। একজন প্রশংসিত নবী হিসেবে কুরআন মাজীদে বার বার তাঁর নাম উল্লেখ হয়েছে। ফিলিস্তিন অঞ্চলে তিনি তাঁর পিতা হযরত ইবরাহীম (আঃ) প্রতিনিধি ও স্থলাভিষিক্ত হিসেবে দ্বীন ইসলামের প্রচার ও প্রসারের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। হযরত ইবরাহীম যে বিরাট অঞ্চলে ইসলাম কায়েম করে গিয়েছিলেন, পরবর্তীতে তারা দুই ভাই ইসমাঈল ও ইসহাক তার দায়িত্ব গ্রহন করেন। হিজায অঞ্চলে দায়িত্ব পালন করেন বড় ভাই ইসমাঈল (আঃ)। আর ফিলিস্তিন অঞ্চলের দায়িত্ব পালন করেন ছোট ভাই ইসহাক (আঃ)।
হযরত ইসহাকের বংশ
হযরত ইসহাককে আল্লাহ তায়ালা এক ঐতিহাসিক গোত্রের পূর্বপুরুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর পুত্র ইয়াকুবকে আল্লাহ তায়ালা নবী মনোনীত করেন। ইয়াকুবের আরেক নাম ছিলো ইসরাইল। তাঁর সন্তানরা বনী ইসরাইল (ইসরাইলের বংশধর) হিসেবে খুবই খ্যাতি অর্জন করেছে। মূলত এ বংশের ধারাবাহিকতা হযরত ইসহাক (আঃ) থেকেই আরম্ভ হয়। এ বংশে আল্লাহ অসংখ্য নবী প্রেরন করেছেন। ইসলামের সঠিক আদর্শ থেকে বিচ্যুত অবস্থায় এ বংশের লোকেরা আজো পৃথিবীতে বর্তমান আছে।
হযরত ইসহাকের প্রশংসনীয় গুনাবলী
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআন মাজীদে তাঁর দাস ও নবী হযরত ইসহাক (আঃ) এর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। এবার কুরআন থেকে তাঁর প্রশংসা আর গুনাবলী জেনে নেয়া যাক। মহান আল্লাহ বলেন-
১। “আমার দাস ইবরাহীম, ইসহাক আর ইয়াকুবের কথা স্মরণ করো। তারা ছিলো বড় কর্মঠ আর দুরদৃষ্টি সম্পন্ন। একটি খাঁটি গুনের কারনে আমি তাঁদের মর্যাদাবান করেছিলাম। আর টা হলো পরকালের চিন্তা। তারা আমার কাছে বাছাই করা আদর্শ মানুষ।” (সূরা সোয়াদ, আয়াত ১০২)
২। “অতপর আমি ইব্রাহীমকে ইসহাকের সুসংবাদ দিলাম। বললাম- সে হবে একজন নবী ও উন্নত আমলের সুযোগ্য লোক।” (সূরা আস সাফফাত, আয়াত ১১২)
৩। “আর আমি তাঁকে দান করেছি ইসহাককে। তাছাড়াও ইয়াকুবকে। তারা প্রত্যেকেই ছিলো সৎ সুযোগ্য। আমি তাঁদের নেতা বানিয়েছি। তারা আমার নির্দেশ মতো মানুষকে সঠিক পথ প্রদর্শন করতো। আমি তাঁদের কাছে অহী করেছিলাম কল্যাণমূলক কাজ করার, সালাত কায়েম করার ও যাকাত পরিশোধ করার। তারা ছিলো আমার একান্ত অনুগত। ” (সূরা আল আম্বিয়া, আয়াত ৭৩)
৪। “অতপর আমি তাঁকে ইসহাক ও ইয়াকুবের মতো সন্তান দান করলাম। আর তাঁদের প্রত্যেককেই বানালাম নবী। নিজ রহমতে তাঁদের ধন্য করলাম আর মানুষের মাঝে তাঁদেরকে সত্যিকার সুনাম ও সুখ্যাতি দান করলাম।” (সূরা মরিয়ম, আয়াত ৪৯-৫০)
৫। “হে মুহাম্মাদ, আমি তোমার প্রতি তেমনই অহী নাযিল করেছি, যেমন করেছিলাম নুহ এবং তাঁর মধ্যবর্তী নবীদের উপর। যেমন আমি অহী পাঠিয়েছি ইব্রাহীন, ইসমাঈল, ইসহাক—এর প্রতি— এরা সবাই ছিলো সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী রাসুল।” (সূরা নিসা, আয়াত ১৬৩-১৬৫)
কুরআন মাজীদের এ আয়াতগুলো থেকে আমরা হযরত ইসহাক (আঃ) এর অনেকগুলো প্রশংসিত গুনাবলীর কথা জানতে পারি। মহান আল্লাহ নিজেই তাঁর এসব গুনাবলীর কথা উল্লেখ করেছেন। গুনগুলো হলো-
১। পরকালের চিন্তা। অর্থাৎ পরকালমুখী চিন্তা ও পরকালমুখী কাজ।
২। কর্মঠ। অর্থাৎ দক্ষতা ও কর্মমুখীতা।
৩। দূরদৃষ্টি।
৪। সততা ও যোগ্যতা।
৫। উন্নত আমল।
৬। আল্লাহর আনুগত্য ও বাধ্যতা।
৭। সুসংবাদদাতা। অর্থাৎ মুমিনদের জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন।
৮। সতর্ককারী। অর্থাৎ আল্লাহর পাকড়াও সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করেছেন।
৯। সামাজিক নেতৃত্ব দান।
১০। নেতৃত্ব লাভের পর-
ক. আল্লাহর বিধান মতো মানুষকে সঠিক পথ প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেছেন।
খ. জনকল্যাণমূলক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছেন।
গ. সালাত কায়েম করেছেন এবং
ঘ. যাকাত ভিত্তিক অর্থনৈতিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছেন।
এসব কারনে আল্লাহ তাঁকে উচ্চ মর্যাদা ও সুনাম সুখ্যাতি দান করেছেন।
কুরআনে উল্লেখ
কুরআন মাজীদে হযরত ইসহাকের নাম উল্লেখ হয়েছে ১৭ বার। যেসব সুরাতে উল্লেখ হয়েছে, সেগুলো হলো –
সূরা আল বাকারাঃ ১৩৩,১৩৬,১৪০। আলে ইমরানঃ ৮৪। নিসাঃ ১৬৩। আল আনআমঃ ৮৪। হুদঃ ৭১। ইউসুফঃ ৬,৩৮। ইব্রাহীমঃ ৩৯। মরিয়মঃ ৪৯। আল আম্বিয়াঃ ৭২। আন কাবুতঃ ২৭। আস সাফফাতঃ ১১২,১১৩। সোয়াদঃ ৪৫।