ইবরাহীমী জীবনের পরীক্ষা সমূহ

ইবরাহীমী জীবন মানেই পরীক্ষার জীবন। নবী হবার পর থেকে আমৃত্যু তিনি পরীক্ষা দিয়েই জীবনপাত করেছেন। এভাবে পরীক্ষার পর পরীক্ষা নিয়ে তাঁকে পূর্ণত্বের সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত করা হয়েছে। অবশেষে তাঁকে ‘বিশ্বনেতা’ ঘোষণা করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন,

وَإِذِ ابْتَلَى إِبْرَاهِيمَ رَبُّهُ بِكَلِمَاتٍ فَأَتَمَّهُنَّ قَالَ إِنِّي جَاعِلُكَ لِلنَّاسِ إِمَاماً قَالَ وَمِنْ ذُرِّيَّتِيْ قَالَ لاَ يَنَالُ عَهْدِي الظَّالِمِينَ- (البقرة ১২৪)-

‘যখন ইবরাহীমকে তার পালনকর্তা কয়েকটি বিষয়ে পরীক্ষা করলেন, অতঃপর তিনি তাতে উত্তীর্ণ হ’লেন, তখন আল্লাহ বললেন, আমি তোমাকে মানবজাতির নেতা করব। তিনি বললেন, আমার বংশধর থেকেও। তিনি বললেন, আমার অঙ্গীকার যালেমদের পর্যন্ত পৌঁছবে না’ (বাক্বারাহ ২/১২৪)। বস্ত্ততঃ আল্লাহ ইবরাহীম ও তাঁর বংশধরগণের মধ্যেই বিশ্ব নেতৃত্ব সীমিত রেখেছেন। যেমন অন্যত্র আল্লাহ বলেন,

إِنَّ اللّهَ اصْطَفَى آدَمَ وَنُوحاً وَآلَ إِبْرَاهِيمَ وَآلَ عِمْرَانَ عَلَى الْعَالَمِينَ- ذُرِّيَّةً بَعْضُهَا مِن بَعْضٍ وَالله ُسَمِيعٌ عَلِيمٌ- (آل عمران ৩৩-৩৪)-

‘নিশ্চয়ই আল্লাহ আদম, নূহ, ইবরাহীম-এর বংশধর ও ইমরানের বংশধরকে নির্বাচিত করেছেন’। ‘যারা ছিল পরস্পরের বংশজাত। আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’ (আলে ইমরান ৩/৩৩, ৩৪)

বস্ত্ততঃ ইবরাহীম (আঃ)-এর পরবর্তী সকল নবী তাঁর বংশধর ছিলেন। আলে ইমরান বলতে ইমরান-পুত্র মূসা ও হারূণ ও তাঁদের বংশধর দাঊদ, সুলায়মান, ঈসা প্রমুখ নবীগণকে বুঝানো হয়েছে। যাঁরা সবাই ছিলেন ইবরাহীমের পুত্র ইসহাকের বংশধর। অপরপক্ষে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) ছিলেন ইবরাহীমের জ্যেষ্ঠ পুত্র ইসমাঈলের বংশধর। সে হিসাবে আল্লাহ ঘোষিত ইবরাহীমের বিশ্বনেতৃত্ব যেমন বহাল রয়েছে, তেমনি নবীদের প্রতি অবাধ্যতা, বংশীয় অহংকার এবং যিদ ও হঠকারিতার জন্য যালেম ইহুদী-নাছারাগণ আল্লাহর অভিশাপ কুড়িয়ে বিশ্বের সর্বত্র ধিকৃত ও লাঞ্ছিত হয়েছে। এক্ষণে ‘নবীদের পিতা’ ও মিল্লাতে ইসলামিয়াহর নেতা হযরত ইবরাহীম (আঃ)-কে কি কি বিষয়ে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল, আমরা সেদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করব।

ইবরাহীম (আঃ)-এর পরীক্ষা সমূহ ছিল দু’ভাগে বিভক্ত। (এক) বাবেল জীবনের পরীক্ষা সমূহ এবং (দুই) কেন‘আন জীবনের পরীক্ষা সমূহ। শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর জীবনের সঙ্গে পিতা ইবরাহীম (আঃ)-এর জীবনের সুন্দর একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। মুহাম্মাদী জীবনের প্রথমাংশ কেটেছে মক্কায় ও শেষাংশ কেটেছে মদীনায় এবং সেখানেই তিনি পূর্ণতা লাভ করেন ও মৃত্যুবরণ করেন। ইবরাহীমী জীবনের প্রথমাংশ কেটেছে বাবেল শহরে এবং শেষাংশ কেটেছে কেন‘আনে। সেখানেই তিনি  পূর্ণতা পেয়েছেন ও সেখানেই মৃত্যুবরণ করেছেন।

বাবেল জীবনের পরীক্ষা সমূহ :

ইবরাহীম (আঃ)-এর বাবেল জীবনের পরীক্ষা সমূহের মধ্যে (১) মূর্তিপূজারী নেতাদের সাথে তর্কযুদ্ধের পরীক্ষা (২) পিতার পক্ষ থেকে বহিষ্কারাদেশ প্রাপ্তির পরীক্ষা (৩) স্ত্রী ও ভাতিজা ব্যতীত কেউ তাঁর দাওয়াত কবুল না করা সত্ত্বেও তীব্র সামাজিক বিরোধিতার মুখে একাকী দাওয়াত চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে অটল থাকার মাধ্যমে আদর্শ নিষ্ঠার কঠিন পরীক্ষা (৪) তারকাপূজারীদের সাথে যুক্তিগর্ভ তর্কযুদ্ধের পরীক্ষা (৫) কেন্দ্রীয় দেবমন্দিরে ঢুকে মূর্তি ভাঙ্গার মত দুঃসাহসিক পরীক্ষা (৬) অবশেষে রাজদরবারে পৌঁছে সরাসরি সম্রাটের সাথে তর্কযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার পরীক্ষা এবং বিনিময়ে (৭) জ্বলন্ত হুতাশনে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করার মর্মান্তিক শাস্তি হাসিমুখে বরণ করে নেবার অতুলনীয় অগ্নি পরীক্ষার সম্মুখীন হওয়া। এছাড়াও সমাজ সংস্কারক হিসাবে জীবনের প্রতি পদে পদে যে অসংখ্য পরীক্ষার সম্মুখীন তাঁকে হর-হামেশা হ’তে হয়েছে, তা বলাই বাহুল্য।

উপরে বর্ণিত পরীক্ষাগুলির সবটিতেই ইবরাহীম (আঃ) জয়লাভ করেছিলেন এবং সেগুলির আলোচনা আমরা ইতিপূর্বে করে এসেছি। এক্ষণে আমরা তাঁর কেন‘আনী জীবনের প্রধান পরীক্ষাসমূহ বিবৃত করব ইনশাআল্লাহ।

কেন‘আনী জীবনের পরীক্ষা সমূহ :

১ম পরীক্ষা: দুর্ভিক্ষে পতিত হয়ে মিসর গমন : কেন‘আনী জীবনে তাঁর প্রথম পরীক্ষা হ’ল কঠিন দুর্ভিক্ষে তাড়িত হয়ে জীবিকার সন্ধানে মিসরে হিজরত করা। এ বিষয়ে পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে।

২য় পরীক্ষা: সারাকে অপহরণ : মিসরে গিয়ে সেখানকার লম্পট সম্রাট ফেরাঊনের কুদৃষ্টিতে পড়ে স্ত্রী সারাকে অপহরণের মর্মান্তিক পরীক্ষা। এ বিষয়ে পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।

৩য় পরীক্ষা: হাজেরাকে মক্কায় নির্বাসন : মিসর থেকে ফিরে কেন‘আনে আসার বৎসরাধিককাল পরে প্রথম সন্তান ইসমাঈলের জন্ম লাভ হয়। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই তিনি শিশু সন্তান ও তার মা হাজেরাকে মক্কার বিজন পাহাড়ী উপত্যকায় নিঃসঙ্গভাবে রেখে আসার এলাহী নির্দেশ লাভ করেন। বস্ত্ততঃ এটা ছিল অত্যন্ত মর্মান্তিক পরীক্ষা। এ বিষয়ে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা নিম্নরূপ:

হযরত ইবরাহীম (আঃ) যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে শিশু পুত্র ইসমাঈল ও তার মাকে মক্কায় নির্বাসনে রেখে আসার নির্দেশ পান, তখনই তার অন্তরে বিশ্বাস জন্মেছিল যে, নিশ্চয়ই এ নির্দেশের মধ্যে আল্লাহর কোন মহতী পরিকল্পনা লুক্কায়িত আছে এবং নিশ্চয়ই তিনি ইসমাঈল ও তার মাকে ধ্বংস করবেন না।

অতঃপর এক থলে খেজুর ও এক মশক পানি সহ তাদের বিজনভূমিতে রেখে যখন ইবরাহীম (আঃ) একাকী ফিরে আসতে থাকেন, তখন বেদনা-বিস্মিত স্ত্রী হাজেরা ব্যাকুলভাবে তার পিছে পিছে আসতে লাগলেন। আর স্বামীকে এর কারণ জিজ্ঞেস করতে থাকেন। কিন্তু বুকে বেদনার পাষাণ বাঁধা ইবরাহীমের মুখ দিয়ে কোন কথা বেরুলো না। তখন হাজেরা বললেন, আপনি কি আল্লাহর হুকুমে আমাদেরকে এভাবে ফেলে যাচ্ছেন? ইবরাহীম ইশারায় বললেন, হ্যাঁ। তখন সম্বিৎ ফিরে পেয়ে অটল বিশ্বাস ও দৃঢ় মনোবল নিয়ে হাজেরা বলে উঠলেন, إذَنْ لايُضَيِّعُنَا اللهُ ‘তাহ’লে আল্লাহ আমাদের ধ্বংস করবেন না’। ফিরে এলেন তিনি সন্তানের কাছে। দু’একদিনের মধ্যেই ফুরিয়ে যাবে পানি ও খেজুর। কি হবে উপায়? খাদ্য ও পানি বিহনে বুকের দুধ শুকিয়ে গেলে কচি বাচ্চা কি খেয়ে বাঁচবে। পাগলপরা হয়ে তিনি মানুষের সন্ধানে দৌঁড়াতে থাকেন ছাফা ও মারওয়া পাহাড়ের এ মাথা আর ও মাথায়। এভাবে সপ্তমবারে তিনি দূর থেকে দেখেন যে, বাচ্চার পায়ের কাছ থেকে মাটির বুক চিরে বেরিয়ে আসছে ঝর্ণার ফল্গুধারা, জিব্রীলের পায়ের গোড়ালি বা তার পাখার আঘাতে যা সৃষ্টি হয়েছিল। ছুটে এসে বাচ্চাকে কোলে নিলেন অসীম মমতায়। স্নিগ্ধ পানি পান করে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন। হঠাৎ অদূরে একটি আওয়ায শুনে তিনি চমকে উঠলেন। উনি জিবরীল। বলে উঠলেন, لا تخافوا الضَّيعةَ، إنَّ هذا بيتُ الله يَبْنى هذا الغلامُ و أبوه وإن الله لايُضيعُ أهلَه-   ‘আপনারা ভয় পাবেন না। এখানেই আল্লাহর ঘর। এই সন্তান ও তার পিতা এ ঘর সত্বর পুনর্নির্মান করবেন। আল্লাহ তাঁর ঘরের বাসিন্দাদের ধ্বংস করবেন না’। বলেই শব্দ মিলিয়ে গেল’।

অতঃপর শুরু হ’ল ইসমাঈলী জীবনের নব অধ্যায়। পানি দেখে পাখি আসলো। পাখি ওড়া দেখে ব্যবসায়ী কাফেলা আসলো। তারা এসে পানির মালিক হিসাবে হাজেরার নিকটে অনুমতি  চাইলে তিনি এই শর্তে মনযুর করলেন যে, আপনাদের এখানে বসতি স্থাপন করতে হবে। বিনা পয়সায় এই প্রস্তাব তারা সাগ্রহে কবুল করল। এরাই হ’ল ইয়ামন থেকে আগত বনু জুরহুম গোত্র। বড় হয়ে ইসমাঈল এই গোত্রে বিয়ে করেন। এঁরাই কা‘বা গৃহের খাদেম হন এবং এদের শাখা গোত্র কুরায়েশ বংশে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আগমন ঘটে।

ওদিকে ইবরাহীম (আঃ) যখন স্ত্রী ও সন্তানকে রেখে যান তখন হাজেরার দৃষ্টির আড়ালে গিয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন এই বলে,

رَّبَّنَا إِنِّيْ أَسْكَنْتُ مِنْ ذُرِّيَّتِيْ بِوَادٍ غَيْرِ ذِيْ زَرْعٍ عِنْدَ بَيْتِكَ الْمُحَرَّمِ رَبَّنَا لِيُقِيْمُوا الصَّلاَةَ فَاجْعَلْ أَفْئِدَةً مِّنَ النَّاسِ تَهْوِيْ إِلَيْهِمْ وَارْزُقْهُم مِّنَ الثَّمَرَاتِ لَعَلَّهُمْ يَشْكُرُوْنَ- (ابراهيم ৩৭)-

‘হে আমাদের পালনকর্তা! আমি আমার পরিবারের কিছু সদস্যকে তোমার মর্যাদামন্ডিত গৃহের সন্নিকটে চাষাবাদহীন উপত্যকায় বসবাসের জন্য রেখে যাচ্ছি। প্রভুহে! যাতে তারা ছালাত কায়েম করে। অতএব কিছু লোকের অন্তরকে তুমি এদের প্রতি আকৃষ্ট করে দাও এবং তাদেরকে ফল-ফলাদি দ্বারা রূযী দান কর। সম্ভবত: তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ  করবে’।

শিক্ষণীয় বিষয়:

(১) ইবরাহীম (আঃ) তাঁর স্ত্রী ও দুগ্ধপোষ্য সন্তানকে জনমানব শূন্য ও চাষাবাদহীন এক শুষ্ক মরু উপত্যকায় রেখে আসলেন, কোন সুস্থ বিবেক এ কাজকে সমর্থন করতে পারে না। কিন্তু যারা আল্লাহতে বিশ্বাসী, তাদের জন্য বিষয়টি মোটেই আশ্চর্যজনক নয়। আর সেকারণেই হাজেরা গভীর প্রত্যয়ে বলে উঠেছিলেন, إذَنْ لا يُضَيِّعُنِيَ اللهُ ‘তাহ’লে আল্লাহ আমাকে ধ্বংস করবেন না’। আল্লাহ যে কেবল বিশ্বাসের বস্ত্ত নয়, বরং তিনি সার্বক্ষণিকভাবে বান্দার তত্ত্বাবধায়ক, ইবরাহীমের উক্ত কর্মনীতির মধ্যে তার স্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে। অতি যুক্তিবাদী ও বস্ত্তবাদীদের জন্য এর মধ্যে রয়েছে বড় ধরনের এক শিক্ষণীয় বিষয়।

(২) ইবরাহীমের দো‘আ আল্লাহ এমন দ্রুত কবুল করেছিলেন যে, দু’একদিনের মধ্যেই সেখানে সৃষ্টি হয় পানির ফোয়ারা, যা যমযম কূয়া নামে পরিচিত হয় এবং যার উৎসধারা বিগত প্রায় সোয়া চার হাযার বছর ধরে আজও সমভাবে বহমান। কিন্তু এই পানির রূপ-রস-গন্ধ কিছুরই কোন পরিবর্তন হয়নি। এ পানির কোন হ্রাস-বৃদ্ধি নেই। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, এ পানিতে এমন সব উপাদান রয়েছে, যা মানুষের জন্য খাদ্য ও পানীয় উভয় চাহিদা মেটাতে সক্ষম। পৃথিবীর অন্য কোন পানিতে এ গুণ নেই। দৈনিক লাখ লাখ গ্যালন পানি ব্যয় হওয়া সত্ত্বেও এ পানির কোন ক্ষয় নেই, লয় নেই, কমতি নেই। এর কারণ অনুসন্ধানে বছরের পর বছর চেষ্টা করেও বৈজ্ঞানিকেরা ব্যর্থ হয়েছেন। ফালিল্লা-হিল হাম্দ।

(৩) তখন থেকে অদ্যাবধি মক্কা মু‘আয্যমায় চাষাবাদের তেমন কোন ব্যবস্থা নেই। কিন্তু সারা পৃথিবী হ’তে তাবৎ ফল-ফলাদি সর্বদা সেখানে আমদানী হয়ে থাকে এবং সর্বদা অধিকহারে মওজূদ থাকে। আধুনিক বিশ্বের কোন শহরই এর সাথে তুলনীয় নয়। নিঃসন্দেহে এটা হ’ল ইবরাহীমের দো‘আর অন্যতম ফসল।

(৪) ইবরাহীম (আঃ)-এর দো‘আয় বলা হয়েছিল, ‘আমি আমার সন্তানকে এখানে রেখে যাচ্ছি যেন তারা এখানে ছালাত কায়েম করে’। আল্লাহর রহমতে সেদিন থেকে অদ্যাবধি এখানে ছালাত, ত্বাওয়াফ ও অন্যান্য ইবাদত সর্বদা জারি আছে।

(৫) দো‘আয় তিনি বলেছিলেন, ‘মানব সমাজের কিছু অংশের হৃদয়কে তুমি এদের প্রতি ঝুঁকিয়ে দাও’। নিঃসন্দেহে সেই অংশটি হ’ল সারা বিশ্বের মুসলিম সমাজ। ইবরাহীম (আঃ) জানতেন যে, বিশ্বের সমস্ত লোক কখনো মুমিন হবে না। তাছাড়া তাবৎ বিশ্ব যদি কা‘বার প্রতি ঝুঁকে পড়ত, তাহ’লে সেখানে বসবাস, স্থান সংকুলান ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার সংকট দেখা দেওয়া অবশ্যম্ভাবী ছিল। তখন থেকে এযাবত সর্বদা একদল শক্তিশালী ও ধর্মপরায়ণ মানুষ মক্কার সুরক্ষা ও নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত রয়েছে। দেড় হাযার বছর পূর্বে খৃষ্টান গভর্ণর আবরাহার সকল প্রচেষ্টা যেমন ব্যর্থ হয়েছিল, ক্বিয়ামত অবধি শত্রুদের সকল চক্রান্ত এভাবেই ব্যর্থ হবে ইনশাআল্লাহ।

৪র্থ পরীক্ষা: খাৎনা করণ :

ইবরাহীমের প্রতি আদেশ হ’ল খাৎনা করার জন্য। এসময় তাঁর বয়স ছিল অন্যূন ৮০ বছর। হুকুম পাওয়ার সাথে সাথে দেরী না করে নিজেই নিজের খাৎনার কাজ সম্পন্ন করলেন। বিনা দ্বিধায় এই কঠিন ও বেদনাদায়ক কাজ সম্পন্ন করার মধ্যে আল্লাহর হুকুম দ্রুত পালন করার ও এ ব্যাপারে তাঁর কঠোর নিষ্ঠার প্রমাণ পাওয়া যায়।

খাৎনার এই প্রথা ইবরাহীমের অনুসারী সকল ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে আজও চালু আছে। বস্ত্ততঃ খাৎনার মধ্যে যে অফুরন্ত কল্যাণ নিহিত রয়েছে, চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যবিজ্ঞানীগণ তা অকুণ্ঠচিত্তে স্বীকার করেছেন। এর ফলে খাৎনাকারীগণ অসংখ্য অজানা রোগ-ব্যাধি হ’তে মুক্ত রয়েছেন এবং সুস্থ জীবন লাভে ধন্য হয়েছেন। এটি মুসলিম এবং অমুসলিমের মধ্যে একটি স্থায়ী পার্থক্যও বটে।

৫ম পরীক্ষা: পুত্র কুরবানী :

একমাত্র শিশু পুত্র ও তার মাকে মক্কায় রেখে এলেও ইবরাহীম (আঃ) মাঝে-মধ্যে সেখানে যেতেন ও দেখা-শুনা করতেন। এভাবে ইসমাঈল ১৩/১৪ বছর বয়সে উপনীত হ’লেন এবং পিতার সঙ্গে চলাফেরা করার উপযুক্ত হ’লেন। বলা চলে যে, ইসমাঈল যখন বৃদ্ধ পিতার সহযোগী হ’তে চলেছেন এবং পিতৃহৃদয় পুরোপুরি জুড়ে বসেছেন, ঠিক সেই সময় আল্লাহ ইবরাহীমের মহববতের কুরবানী কামনা করলেন। বৃদ্ধ বয়সের একমাত্র নয়নের পুত্তলী ইসমাঈলের মহববত ইবরাহীমকে কাবু করে ফেলল কি-না, আল্লাহ যেন সেটাই যাচাই করতে চাইলেন। ইতিপূর্বে অগ্নিপরীক্ষা দেবার সময় ইবরাহীমের কোন পিছুটান ছিল না। কিন্তু এবার রয়েছে প্রচন্ড রক্তের টান।

দ্বিতীয়তঃ অগ্নি পরীক্ষায় বাদশাহ তাকে বাধ্য করেছিল। কিন্তু এবারের পরীক্ষা স্বেচ্ছায় ও স্বহস্তে সম্পন্ন করতে হবে। তাই এ পরীক্ষাটি ছিল পূর্বের কঠিন অগ্নি পরীক্ষার চেয়ে নিঃসন্দেহে কঠিনতর। সূরা ছাফফাত ১০২ আয়াত হ’তে ১০৯ আয়াত পর্যন্ত এ বিষয়ে বর্ণিত ঘটনাটি নিম্নরূপ:

فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعْيَ قَالَ يَا بُنَيَّ إِنِّي أَرَى فِي الْمَنَامِ أَنِّي أَذْبَحُكَ فَانظُرْ مَاذَا تَرَى قَالَ يَا أَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ سَتَجِدُنِي إِن شَآءَ اللهُ مِنَ الصَّابِرِينَ- (الصافات ১০২)-

‘যখন (ইসমাঈল) পিতার সাথে চলাফেরা করার মত বয়সে উপনীত হ’ল, তখন (ইবরাহীম) তাকে বললেন, হে আমার বেটা! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে যবহ করছি। এখন বল তোমার অভিমত কি? সে বলল, হে পিতা! আপনাকে যা নির্দেশ করা হয়েছে, আপনি তা কার্যকর করুন। আল্লাহ চাহেন তো আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত দেখতে পাবেন’ (ছাফফাত ৩৭/১০২)

ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হয়েছে যে, মক্কা থেকে বের করে ৮ কি: মি: দক্ষিণ-পূর্বে মিনা প্রান্তরে নিয়ে যাওয়ার পথে বর্তমানে যে তিন স্থানে হাজীগণ শয়তানকে পাথর মেরে থাকেন, ঐ তিন স্থানে ইবলীস তিনবার ইবরাহীম (আঃ)-কে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছিল। আর তিনবারই ইবরাহীম (আঃ) শয়তানের প্রতি ৭টি করে কংকর নিক্ষেপ করেছিলেন। সেই স্মৃতিকে জাগরুক রাখার জন্য এবং শয়তানের প্রতারণার বিরুদ্ধে মুমিনকে বাস্তবে উদ্বুদ্ধ করার জন্য এ বিষয়টিকে হজ্জ অনুষ্ঠানের ওয়াজিবাতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এখানেই অনতিদূরে পূর্ব দিকে ‘মসজিদে খায়েফ’ অবস্থিত।

অতঃপর পিতা-পুত্র আল্লাহ নির্দেশিত কুরবানগাহ ‘মিনায়’ উপস্থিত হ’লেন। সেখানে পৌঁছে পিতা পুত্রকে তাঁর স্বপ্নের কথা বর্ণনা করলেন এবং পুত্রের অভিমত চাইলেন। পুত্র তার অভিমত ব্যক্ত করার সময় বললেন, ‘ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ছবরকারীদের অন্তর্ভুক্ত দেখতে পাবেন’। ইনশাআল্লাহ না বললে হয়ত তিনি ধৈর্য ধারণের তাওফীক পেতেন না। এরপর তিনি নিজেকে ‘ছবরকারী’ না বলে ‘ছবরকারীদের অন্তর্ভুক্ত’ বলেছেন এবং এর মাধ্যমে নিজের পিতা সহ পূর্বেকার বড় বড় আত্মোৎসর্গকারীদের মধ্যে নিজেকে শামিল করে নিজেকে অহমিকা মুক্ত করেছেন। যদিও তাঁর ন্যায় তরুণের এরূপ স্বেচ্ছায় আত্মোৎসর্গের ঘটনা ইতিপূর্বে ঘটেছিল বলে জানা যায় না। আল্লাহ বলেন,

فَلَمَّا أَسْلَمَا وَ تَلَّهُ لِلْجَبِينِ، وَنَادَيْنَاهُ أَن يَّآ إِبْرَاهِيْمُ، قَدْ صَدَّقْتَ الرُّؤْيَا إِنَّا كَذَالِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِيْنَ، إِنَّ هَذَا لَهُوَ الْبَلآءُ الْمُبِيْنُ، وَفَدَيْنَاهُ بِذِبْحٍ عَظِيْمٍ، وَتَرَكْنَا عَلَيْهِ فِي الْآخِرِيْنَ، سَلاَمٌ عَلَى إِبْرَاهِيْمَ- (الصافات ১০৩-১০৯)-

‘অতঃপর (পিতা-পুত্র) উভয়ে যখন আত্মসমর্পণ করল এবং পিতা পুত্রকে উপুড় করে শায়িত করল’। ‘তখন আমরা তাকে ডাক দিয়ে বললাম, হে ইবরাহীম’! ‘তুমি তোমার স্বপ্ন সত্যে পরিণত করেছ। আমরা এভাবেই সৎকর্মশীলগণের প্রতিদান দিয়ে থাকি’। ‘নিশ্চয়ই এটি একটি সুস্পষ্ট পরীক্ষা’। ‘আর আমরা তার পরিবর্তে একটি মহান যবহ প্রদান করলাম’ ‘এবং আমরা এ বিষয়টি পরবর্তীদের মধ্যে রেখে দিলাম’। ‘ইবরাহীমের উপর শান্তি বর্ষিত হৌক’ (ছাফফাত ৩৭/১০৩-১০৯)। বর্তমানে উক্ত মিনা প্রান্তরেই হাজীগণ কুরবানী করে থাকেন এবং বিশ্ব মুসলিম ঐ সুন্নাত অনুসরণে ১০ই যুলহিজ্জাহ বিশ্বব্যাপী শরী‘আত নির্ধারিত পশু কুরবানী করে থাকেন।

শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ :

(১) ইবরাহীমকে আল্লাহ স্বপ্নাদেশ করেছিলেন, সরাসরি আদেশ করেননি। এর মধ্যে পরীক্ষা ছিল এই যে, স্বপ্নের বিভিন্ন ব্যাখ্যা হ’তে পারত। যেমন নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা মহাপাপ। অধিকন্তু পিতা হয়ে নির্দোষ পুত্রকে নিজ হাতে হত্যা করা আরও বড় মহাপাপ। নিশ্চয়ই এমন অন্যায় কাজের নির্দেশ আল্লাহ দিতে পারেন না। অতএব এটা মনের কল্পনা-নির্ভর স্বপ্ন (أضغاث أحلام ) হ’তে পারে। কিন্তু ইবরাহীম ঐসব ব্যাখ্যায় যাননি। তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে, এটা ‘অহি’। কোন কোন বর্ণনায় এসেছে যে, তিনি পরপর তিনদিন একই স্বপ্ন দেখেন। প্রশ্ন হ’তে পারে, আল্লাহ জিব্রীল মারফত সরাসরি নির্দেশ না পাঠিয়ে স্বপ্নের মাধ্যমে নির্দেশ পাঠালেন কেন? এর জবাব এই যে, তাহ’লে তো পরীক্ষা হ’ত না, কেবল নির্দেশ পালন হ’ত। ইবরাহীমকে তার স্বপ্নের কাল্পনিক ব্যাখ্যার ফাঁদে ফেলার জন্যই তো শয়তান মাঝপথে বন্ধু সেজে তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। এর দ্বারা আরেকটি বিষয় প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহর নির্দেশ পালনের সময় অহেতুক প্রশ্ন সমূহ উত্থাপন ও অধিক যুক্তিবাদের আশ্রয় নেওয়া যাবে না। বরং সর্বদা তার প্রকাশ্য অর্থের উপরে সহজ-সরলভাবে আমল করে যেতে হবে।

(২) আল্লাহর মহববত ও দুনিয়াবী কোন মহববত একত্রিত হ’লে সর্বদা আল্লাহর মহববতকে অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং দুনিয়াবী মহববতকে কুরবানী দিতে হবে। ইবরাহীম এখানে সন্তানের গলায় ছুরি চালাননি। বরং সন্তানের মহববতের গলায় ছুরি চালিয়েছিলেন। আর এটাই ছিল পরীক্ষা। যদি কেউ আল্লাহর মহববতের উপরে দুনিয়াবী মহববতকে অগ্রাধিকার দেয়, তখন সেটা হয়ে যায় الإشراك في المحبة বা ভালোবাসায় শিরক। ইবরাহীম ও ইসমাঈল দু’জনেই উক্ত শিরক হ’তে মুক্ত ছিলেন।

(৩) পিতা ও পুত্রের বিশ্বাসগত সমন্বয় ব্যতীত কুরবানীর এই গৌরবময় ইতিহাস রচিত হ’ত না। ইসমাঈল যদি পিতার অবাধ্য হ’তেন এবং দৌড়ে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে যেতেন, তাহ’লে আল্লাহর হুকুম পালন করা ইবরাহীমের পক্ষে হয়তবা আদৌ সম্ভব হ’ত না। তাই এ ঘটনার মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে, সমাজের প্রবীণদের কল্যাণময় নির্দেশনা এবং নবীনদের আনুগত্য ও উদ্দীপনা একত্রিত ও সমন্বিত না হ’লে কখনোই কোন উন্নত সমাজ গঠন করা সম্ভব নয়।

(৪) এখানে মা হাজেরার অবদানও ছিল অসামান্য। যদি তিনি ঐ বিজন ভূমিতে কচি সন্তানকে তিলে তিলে মানুষ করে না তুলতেন এবং স্রেফ আল্লাহর উপরে ভরসা করে বুকে অসীম সাহস নিয়ে সেখানে বসবাস না করতেন, তাহ’লে পৃথিবী পিতা-পুত্রের এই মহান দৃশ্য অবলোকন করতে পারত না। এজন্যেই বাংলার বুলবুল কাজী নজরুল ইসলাম গেয়েছেন,

মা হাজেরা হৌক মায়েরা সব

যবীহুল্লাহ হৌক ছেলেরা সব

সবকিছু যাক সত্য রৌক

বিধির বিধান সত্য হৌক।

বলা চলে যে, এই কঠিনতম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর ইবরাহীম (আঃ) বিশ্ব নেতৃত্বের সম্মানে ভূষিত হন। যেমন আল্লাহ বলেন,

وَإِذِ ابْتَلَى إِبْرَاهِيْمَ رَبُّهُ بِكَلِمَاتٍ فَأَتَمَّهُنَّ قَالَ إِنِّيْ جَاعِلُكَ لِلنَّاسِ إِمَاماً، (بقرة ১২৪)-

‘যখন ইবরাহীমকে তার পালনকর্তা কয়েকটি বিষয়ে পরীক্ষা করলেন, অতঃপর তিনি তাতে উত্তীর্ণ হ’লেন, তখন আল্লাহ বললেন, আমি তোমাকে মানবজাতির নেতা করলাম’ (বাক্বারাহ ২/১২৪)

উপরোক্ত আয়াতে পরীক্ষাগুলির সংখ্যা কত ছিল, তা বলা হয়নি। তবে ইবরাহীমের পুরো জীবনটাই যে ছিল পরীক্ষাময়, তা ইতিপূর্বেকার আলোচনায় প্রতিভাত হয়েছে।

আরো পড়তে পারেন...

ইমাম আবু হানিফা রহ: এর সাথে কিছু নাস্তিকদের বিতর্ক

গল্পটি অনেক আগের। একবার একদল নাস্তিক ও তাদের নেতারা একজন বিখ্যাত মুসলীম নেতার ( ইমাম…

অহংকারের ফল

এক পালোয়ান মল্ল যুদ্ধে খুব পারদর্শিতা অর্জন করেছিলো। মল্ল বিদ্যায় সে তিনশত ষাটটি কৌশল আয়ত্ব…

অন্যকে সহযোগিতা করুন, নিজেও তা পাবেন

অনেক দিন আগের কথা। নীল আকাশের নিচে নীল সাগরের নীল পানিতে নীল জেলের বাস ছিল।…