ইন্তেজারি

ফুলতারার ঘোর কাটে না। কাটে শুধু তার দিনরাত; ঘোরের মধ্যে।
সময় নাই অসময় নাই আধাঘুম-আধাজাগায় মন্থর অলসতার ঘোর, ঘুষঘুষে জ্বরের যাওয়া-আসার মাঝে তন্দ্রার মতোন এক ঘোর, কপালে জলপট্টি-গলায় মাফলার-গায়ে কাঁথার ভাসাভাসা ঘোর, অর্ধেক দেখার পর টুটে যাওয়া মধুর খোয়াবের মোহমুগ্ধতার এক ঘোর– তাকে জড়িয়ে রাখে দিনের পর দিন। ঘোরের মধ্যেই সে চাঁদসূর্য-মেঘরৌদ্র দেখে, ঘরঘাটউঠানে চলেফিরে, রাঁধেবাড়ে। সাতের রিপনের নানান কথায় হুঁ-হাঁ করে, আড়াইয়ের সুমির লালাঝরা মুখ মোছে। ঘোরগ্রস্ত আচ্ছন্নতার ভিতরেই জায়গির মাষ্টারের জন্য প্লাস্টিকের জগে পানি ভরে, ভাতের গামলার পাশে নুনের খোরা বসায়। মোবাইল ফোনের আলোকিত চৌখুপিতে সৌদির নাম্বার দেখা গেলে আবু তাহেরের সাথে কথা বলে। আর অপেক্ষা করে।

ফুলতারার মায়েরও ছিল অন্তহীন অপেক্ষার অভ্যাস। জন্মের পর থেকে মাকে সে দেখেছে একটার পর একটা কিছুর জন্য ধারাবাহিক প্রতীক্ষায় থাকতে। প্রতিবেশির বাগানে ঢোকা বাছুর, চরের তরমুজক্ষেতে হারানো ছাগল, আড়তদারের ট্রলারে মাছ ধরতে যাওয়া স্বামী- সবার জন্য অপেক্ষা! মেয়ে বালেগ হওয়ার পরে ঘরের খুঁটির গায়ে দাগকাটা হিসাবে চান্দ্রমাসের শেষ সপ্তাহের জন্য অপেক্ষা। গ্রামের বউঝিদের সমাচার-জিজ্ঞাসার জবাবে সেতারাবিবির বাঁধা বুলি ছিল- ‘ইন্তেজারির ভিত্রে আছি গো বোইন!’ কথাটা যে মিথ্যা না তা বোঝা যেত তার ক্লান্তিমাখা মুখে, অস্থির পায়চারিতে, দুই পা মেলে হতাশ বসে থাকায়, নিষ্পলক চোখের বেদিশা দৃষ্টিতে।

বিয়ের আগে ফুলতারার অপেক্ষা ছিল বিয়ের জন্য। বিয়ের পর স্বামীর জন্য অপেক্ষায় থাকার ইতিহাস তার দুই বারের– আট বছরে আবু তাহের ড্রাইভার ওই দুই বারের বেশি আসতে পারে নাই দেশে। এছাড়া যে কোন ভাগ্যবতী প্রোষিতভর্তৃকার রীতিমাফিক সে অপেক্ষা করে স্বামীর পাঠানো টাকার জন্য। তিন মাস পর পর পশ্চিমগাঁও জনতা ব্যাংকে সৌদি থেকে টিটি আসে, আর বাড়িতে আসে রুহুল আমিন- আবু তাহেরের চাচাত ভাই। বছরখানেক আগের সেই দিনটার পর থেকে ফুলতারা রুহুল আমিনের জন্যও অপেক্ষা করে। সেই দিন, যেদিন পেটের অসুখে পড়া সুমিকে ময়নার কাছে রেখে রুহুল আমিনের সাথে ব্যাংকে গিয়েছিল সে। সেদিন থেকে ফুলতারা টের পায়- ইন্তেজারির ভিত্রেও সুখ আছে!

এখন খেয়াল-বেখেয়ালের দোলাচলে দোলে তার চেনাজানা পৃথিবী– চাপকল, পাকঘর, চুলার দুয়ার, নারিকেলসুপারি, বাঁশবাগিচা, পুকুরঘাট, কলামুড়া, লাউমাচার সংসার। সমাজসংসার-নিত্যকর্মের ধামাচাপা আবেগে, দুনিয়াদারির ঝাপসাস্পষ্ট আবছায়াতে, সে স্বপন দেখে। তার স্বপনে ঘুরেফিরে আসে সেই দিনটা। হুডতোলা রিকশায় পাশাপাশি বসা, বোরকার ঘেরের আড়ালে রুহুল আমিনের সুঠাম হাতের বেড়। লাকসাম-রুটের টেম্পোর বাতাস, পলাশ সিনেমায় রাজাবাবুর শো। পর্দায় জড়াজড়ি প্রেমের গান, নায়িকার গালের তিলে নায়কের ঠোঁট। পাশে বসা রুহুল আমিনের ফিসফিসানি- ‘তোমার পিঠের মাঝ বরাবর যেই তিলা আছে, সেইখানে দিব আমি…’

রুহুল আমিন কথা রেখেছে। পিঠের মধ্যখানে শিরদাঁড়া বরাবর দীর্ঘ চুম্বনের পথ ধরে তার চেনাজানা রক্তমাংসের পৃথিবীটাকে দিয়েছে অচেনা সুখের সন্ধান। এখন ফুলতারা সমস্ত শরীর দিয়ে অপেক্ষা করে, মন-মগজ-স্নায়ুর সবটুকু অবশতা দিয়ে অপেক্ষা করে। সাড়-অসাড়ের ক্রমাবর্তে ডুবতে-ডুবতে ভাসতে-ভাসতে প্রহরের পর প্রহর প্রতীক্ষায় কাটায়। এই প্রতীক্ষার অবসানের সঠিক সময়কাল তার জানা থাকে- যত কাজই থাকুক, নির্ধারিত দিনক্ষণে রুহুল আমিন ঠিকই হাজির হয়- তবু অপেক্ষার বিরাম ঘটে না। অপেক্ষার মুহূর্তগুলি যে শিহরণের যোগান দেয় তার শিরায়-উপশিরায়; অনাস্বাদিতপূর্ব সেই উপভোগ্যতার নেশায় তাকে পেয়ে বসে। এ নেশা সর্বনাশের আগেকার মধুর মাদকতায় আচ্ছন্ন, কুলকিনারাহীন বিহ্বলতায় বিবশ!

নিথর দুপুরের ভাতঘুম-শয়নে বুকের উপর বসানো আয়নায় ফুলতারা সিঁথি কাটে। সিঁথির দুই পাশের চুলে চালতাপাতার শিরাবিন্যাসের আদল রচনা করে। কদুর তেলের গন্ধে রুহুল আমিনের মাথাব্যথা হয়- এই কথা জানার পর থেকে ফুলতারার ঘরের তাকে উঠে আসে সুবাসিত নারিকেল তেল। এখন কাঁকইয়ের গোড়ায় জটছেঁড়া চুলের গুছি বেশিক্ষণ গাঁথা থাকে না; স্নোর কৌটা, পাউডারের ডিব্বার গায়ে আর ধূল জমে না। পা-জোড়া দিনমান হাওয়াই চপ্পলে মজুত থাকে; যদিও উঠানের কাদা পায়ের তালুর চামড়া খায়- ব্যাপারটা সে এই প্রথম টের পেয়েছে, এমন না। ক্ষয়া গোড়ালির মতো নিজের শরীরের আরো কিছু গোপন খুঁত নতুনভাবে আবিষ্কার করে সে। কোনদিন তার নজরে আসে হাতের তালুর অমসৃণতা, কোনদিন তলপেটের আলিঝালি ফাটা দাগে গর্ভকালীন নিশানা। এই সব কিছুর সযত্ন পরিচর্যার সুঁড়িপথ ধরে প্রিয়বাঞ্ছিত ঘোরে তার প্রত্যাবাসন ঘটে।

বাড়ির আশ্রিতা ময়নার শরীরটা রোগাদুবলা বলে তার কাচা কাপড় থেকে ঠিকমতো পানি ঝরে না। তবু কাপড় ধোয়ার দায়িত্বটা ফুলতারা নিজে থেকেই ময়নার হাতে অর্পণ করে, শাড়ি শুকানোর দীর্ঘসূত্রিতায় উচ্চবাচ্য করে না। বরং ভেজা শাড়ির উছিলায় কোন কোন দিন- যেদিন রাতে রুহুল আমিনের আসার কথা থাকে- সায়ার উপর রুহুল আমিনের দেয়া ছিটকাপড়ের ম্যাক্সিটা পরার সুযোগ ঘটায় খুশি হয়। সামনের দিকে বুক থেকে পা পর্যন্ত আগাগোড়া ফাঁড়া লম্বা জামাটা যেন তার অপেক্ষমান দেহের দুয়ার, সেই দুয়ারে প্রবেশের অধিকার পেয়েছে অতি আকাঙ্ক্ষিত সংগোপন অতিথি।

রুহুল আমিন জানে তার জন্য ফুলতারার ইন্তেজারির কথা; এই প্রতীক্ষার তথ্য তাকে আনন্দ দেয়। যে কোন যুক্তিশীল ভোক্তার মতো উপযোগের মাত্রা বৃদ্ধির পক্ষপাতী রুহুল আমিন তার এই আনন্দকে দীর্ঘস্থায়িত্ব দিতে নানান রকম কায়দাকানুন করে- মোবাইলে মিসডকলের সঙ্কেত দেয়ার পরও টুয়েন্টিনাইনের আড্ডায় থাকে আরো কিছুক্ষণ; তাহের ভাইসাবের বাড়ির পথে পা দিতে ওয়াদাপ্রদত্ত সময়ের চেয়ে আরেকটু বেশি দেরি করে। তাস অথবা জুয়ার আড্ডার কথা ফুলতারার অজানা থাকে; তার কাছে বরং পেশাদার অভিনেতার দক্ষতায় নিজের ব্যস্ততার হাজারটা গপ ফাঁদে রুহুল আমিন। আজকে সালিশ-দরবার, কালকে কলেজের ইলেকশন, পরশু হাটের ডাক, তরশু জলমহালের ইজারা। রুহুল আমিন যে কাজের লোক, সেই কথা অবশ্য মিথ্যা না। নানান জায়গায় তার বেশুমার কাজ পড়ে ঠিকই, তবে কাজকারবারের দিনে নৈশকালীন অভিসারপর্বটি সাধারণত এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে সে। বিপরীতে তার আয়েশী দিনগুলিতেই কর্মভারজনিত বিলম্বের বয়ান শোনে ফুলতারা।

এতে রুহুল আমিনের লাভ হয় দুইদিকে। প্রথমত ফুলতারার কাছে তার গুরুত্ব বাড়ে। প্রেম-ভালোবাসার সাথে সমীহ যুক্ত হলে খাতিরযত্নের স্বাদ বাড়ে; শীতের কালে মিঠাপানির মাছের সালুনে খাট্টাবাইগুন আর ধনিয়াপাতা পড়লে যেমন হয়। দ্বিতীয় লাভটুকু আদায় হয় প্রায় সঙ্গে সঙ্গে। প্রতীক্ষার প্রহর দীর্ঘায়িত হলে সাক্ষাৎ হওয়ামাত্র অধীর ফুলতারা স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই ঝাঁপিয়ে পড়ে তার গতরে- যেভাবে রুহুল আমিন তার নেংটাকালে ঝাঁপ দিত ভরা বাদলার ডাকাতিয়ার বুকে। চল্লিশ ছুঁইছুঁই আবু তাহেরের সাথে যে পঞ্চদশী কিশোরীর বিয়ে হয়েছিল, সময়মতো কোদাল না পড়লে তার যৌবনে মরা-ডাকাতিয়ার বাঁকের মতোই চর পড়ে যেত। ব্যাপারটা বুঝতে পারে বলেই ফুলতারার উপবাসী শরীরের ক্ষুধা নিবারণে চেষ্টার কার্পণ্য করে না সে। একইসাথে মনে মনে আফসোসও করে তাহের ভাইসাবের জন্য- আরবদেশে খেজুরের বাক্স বইতে বইতে বেচারা নিজেই শুকনা খেজুর হয়ে গেল!

কখনোই খালি হাতে আসে না রুহুল আমিন। ফুলতারার জন্য দৈনিক সেব্য জন্মনিরোধকের আটাশ বড়ির প্যাকেট আনে নিয়ম করে; রিপন-সুমির পছন্দের চিপস-লজেন্সের নামও তার মুখস্ত থাকে। রাতের কালে লজেন্স খেতে বলে তাদের মাকেও। ফুলতারা লজেন্স চোষে, তার ঠোঁট চোষে রুহুল আমিন। একবার আনে আজব এক চীনদেশি কলম। মোটাকাটা কিসিমের কলমের গায়ে একটা মেয়ের হাসিমুখের ছবি; ভিতরে বিরাট কারিগরি। কলমটা উল্টা করে ধরলে কালির পর্দা সরসরিয়ে নেমে আসে, ছবির মেয়েটা হয়ে যায় উদাম গায়ের যৌবনবতী মেয়েমানুষ। মসিরমণীর এহেন বেলাজপনায় ফুলতারা যতটা অবাক হয় তার অধিক পড়ে চিন্তায়। দিনের মধ্যে শতেক বার খাটের তোষক উল্টে কলমটা বের করে, তারপর কলম উল্টে ধরে হাস্যময়ী কালিকামিনীর নাঙ্গা গতর দেখে। প্রতি দেখাতে মেয়েলোকটাকে আগের চেয়ে বেশি রূপবতী বলে মনে হয়। বোধের অতিরিক্ত কী এক আকর্ষণে শয়তানি কলমটা সে পুকুরে ছুঁড়ে ফেলতে পারে না, তবে এই বেহায়া আছর থেকে অবিবাহিত রুহুল আমিনকে রক্ষার জন্য এক ধরণের দায়িত্ব ও প্রতিজ্ঞার বোধ অনুভব করে।

দিনের বেলায় রুহুল আমিন আসে ঝড়ের বেগে ও সশব্দে; একশ সিসির ঝকঝকা মোটর সাইকেলের পিঠে সওয়ার হয়ে। পশ্চিমগাঁও বাজারে আবু তাহেরের দোকানের দেখভালের দায়িত্ব তার। এর বাইরে বহু বিচিত্র গৃহস্থালি সমস্যায়- কারেন্টের ফিউজ জ্বলে গেলে, গাইগরুর ওলানে হানক সাপে দাঁত বসালে, পুরানকালের বাক্সবন্দী টেলিভিশনের পর্দায় বিটিভির ঝিরঝিরানি বাড়লে- নিয়মিত তার ডাক পড়ে। পাড়া-প্রতিবেশির চক্ষু অথবা কর্ণের অন্তত একটিকে সাক্ষী রেখে সরবে কর্তব্য পালন করে সে। মানুষজনের সামনে রুহুল আমিনের প্রতি ‘ভাইসাব’ সম্বোধনে আমোদ পায় ফুলতারা। এই ধরণের অনুমোদনসিদ্ধ প্রকাশ্য সাক্ষাতে তার ঘোরগ্রস্ত প্রতীক্ষায় ক্ষণকালের ছেদ পড়ে; তবু অপেক্ষা আর অপেক্ষার মাঝে সাময়িক বিরতি- দুয়ের মধুরতার তুলনায় সে থই পায় না, অথবা সেইরকম কোন তুলনার চেষ্টাও করে না।

রাত্রিকালে রুহুল আমিনের সন্তর্পণ আগমন বাড়িজোড়া গভীর নিস্তব্ধতার ঘুম অটুট ও অক্ষুণ্ন রাখে। নির্ধারিত সময়ে ফুলতারার দেহের মতো ঘরেরও দুয়ার থাকে কপাট-খোলা; আলগোছে ভেজানো পাল্লা সরিয়ে গোপন মেহমানের নির্ঝঞ্ঝাট প্রবেশের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় সে ত্রুটি রাখে না। খাটের এককোণে বালিশ-পাহাড়ের আড়ালে আড়াই বছরের সুমির নিরাপদ নিদ্রার সংস্থান। উঠানের আরেক পাশে কাছারিঘরে জায়গির মাষ্টারের সাথে রিপনের থাকার বন্দোবস্ত। পাকঘরে পাতা চৌকিতে ময়নার শয়ন। ভোরের আজানের আগে তারা কেউ সজাগ পায় না। নিরুপদ্রব অভিসারের যাবতীয় স্বয়ংক্রিয় আয়োজন ফুলতারার মনে এক ধরনের সন্তুষ্টি ও কৃতজ্ঞতাবোধের জন্ম দেয়। যদিও কৃতজ্ঞতাটা আসলে কার প্রতি- নিজের কপাল নাকি কপালের লেখক সাত আসমানের ওইপারে থাকা দুনিয়াদারির মালিক আল্লাহপাক- তার কাছে ঠিক খোলাসা হয় না। এই বিষয়ক চিন্তা অবশ্য বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না; তার ঘোরের খোয়া বরং আরো ঘন ও ঘোলা হয়।

ঘন কুয়াশার সেই ঘোরের মাঝে কোন এক রাতে আকাশের রূপালি থালাটা বাঁশঝাড় পার হয়ে ছেঁড়াখোড়া মেঘের বুকে নিথর বসে মাঝপুকুরে মুখ দেখতে থাকে। জানালার বাইরে উপচে পড়া জোছনায় মাখামাখি হতে হতে উঠান আর টিনের চালা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়- যেভাবে ঘরের ভেতর ফিকে আলো-আঁধারিতে আদিম উষ্ণতায় গলে একাকার হয় দুটি প্রাণী! দুই বিলীনতার মধ্যখানে জানালার শিকে মুখ ঠেকিয়ে চেয়ে থাকা অবাক চোখজোড়া রতিবিবশ ফুলতারার নজরে আসে না; রাত্রিকালে জায়গির মাষ্টারের হাওলায় থাকা ছেলের ঘুমের খোঁজ নেয়ার অভ্যাস সে হারিয়ে ফেলেছে অনেকদিন আগেই। রুহুল আমিনের সদাসতর্ক মস্তিষ্ক অবশ্য দ্রুততম প্রতিবর্তিতায় ঘটনার পূর্বাপর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া অনুমানে সক্ষম হয়। অব্যবস্থিতচিত্ত ফুলতারার স্খলিত ও পরিত্যক্ত বসন ভদ্রস্থ হওয়ার আগেই রিপনের প্রাণহীন দেহটি সন্তর্পণে কাছারির চৌকাঠে স্থাপনপূর্বক পুস্করিণীর পানিতে হন্তাসহায়ক বালিশটির সদগতি করে সে।

।।দুই।।

‘আইজ কী অইব মামি? গোর খুইদা লাছ দেইখা আবারি গাইত্তালাইব, না লগে লয়া যাইব?’
‘লাছডি লইলে কবে ফিরত দিব? হেইদিন আবারি জানাজা ফড়ব? পুরান কব্বরেই গোর দিব না নয়াডি খুদব?’

ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে একই ধরনের প্রশ্ন সকাল থেকে অসংখ্যবার উচ্চারণ করে ময়না। ফুলতারা কোন জবাব দেয় না। পুত্রের হত্যাকাণ্ডের ধাক্কায় তার জবান বন্ধ হয়ে গেছে- এমন একটি বার্তা বিগত একান্ন দিন যাবত গোবিন্দপুর এবং এর আশপাশের গ্রামে ব্যাপক প্রচারণায় বিস্তৃত হয়ে আসছে। এই বিষয়ে তার মতামত জানার আগ্রহ প্রকাশ করে না কেউ; সবাই যেন ধরে নিয়েছে পুত্রশোকে পাথর জননীর নীরবতা অতি স্বাভাবিক ঘটনা, এবং এই পরিস্থিতিতে এটিই কাম্য।

রিপন হত্যার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই রুহুল আমিনের কর্মকুশলতায় বাড়িতে পুলিশের আগমন ঘটেছিল। পলাতক জায়গির মাষ্টারের ঘর থেকে সন্দেহজনক সামগ্রী আটক হয়েছে; ফলশ্রুতিতে রাষ্ট্র বনাম ফরিদ উদ্দিন মামলার কার্যক্রম চলতে শুরু করেছে। চরের আদি ভিটা নিয়ে সৎভাইদের সাথে আবু তাহেরের বিবাদের যোগসূত্রও গ্রামবাসীদের কারো কারো বিবেচনায় ছিল, অবশ্য কিয়ৎক্ষণের চিন্তাতেই রুহুল আমিন সেই রাস্তা পরিহারের সিদ্ধান্ত নেয়। মিশর সফরে থাকা আরবদেশি কফিলের সাথে বোঝাপড়ার অন্যথা ঘটান সম্ভব না হওয়ায় আবু তাহের দেশে ফিরতে পারে না। যদিও মোবাইল ফোনে ঘন ঘন যোগাযোগের মাধ্যমে শোকাচ্ছন্ন পিতা নিজের অক্ষমতা পোষানোর চেষ্টা করে।

এত কিছুর পরও রুহুল আমিনের জন্য ফুলতারার ঘোরগ্রস্ত প্রতীক্ষার বিশেষ ব্যতিক্রম ঘটে না। ছেলের ভাবনায় তার মুখে বেদনার ছায়া ঘনায়; কনডেন্সড মিল্কের কৌটা কাটতে গিয়ে তার হাত থমকে যায়, রিপনের বড় পছন্দ ছিল এই জিনিসটা! ময়নার নাকিসুরে গাওয়া বিলাপ-গীতের সংক্রমণে অথবা আপনা থেকেই সময়-সময় তার দুই চোখে নোনাজলের ধারা নামে। সেই পানি মুছতে মুছতেও রাত নামার অপেক্ষা করে সে। কেন যেন তার মনে হয়, শিরদাঁড়ার পাশের তিলটা ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে।

ফুলতারার প্রতীক্ষা সত্ত্বেও নিশিকালীন বিহারে রুহুল আমিন আজকাল যথেষ্ট নিয়ন্ত্রিত; তার সতর্ক পদক্ষেপ প্রতিবেশিদের চোখে সন্দিগ্ধ ধূলাবালির খচখচানির অনুমোদন দিতে নারাজ। দিনের বেলায় অবশ্য কার্যকারণসূত্রে আগমন অব্যাহত রাখে; তহশিল অফিসে আবু তাহেরের নামে চলতি সনের খাজনা শোধানো আর নামজারির বকেয়া কাজের কথা সময়মতো মনে পড়ে তার। দুধেল গাইয়ের খুরারোগের মৌসুমী আশঙ্কায় পটাশ-সোহাগার বন্দোবস্ত করে। পরবর্তী বকরিঈদের প্রস্তুতি হিসাবে দামড়া বাছুরটার মোটাতাজা করার দাওয়াই নিয়েও মাথা ঘামায়; ফার্মেসি থেকে কিনে আনা পামবড়ি গুঁড়া করে খড়বিচালির সাথে মিশ্রণের অনুপাতটি হাতেকলমে শেখায় ময়নাকে।

দাফনের একান্ন দিন বাদে ময়নাতদন্তের জন্য কবর খুঁড়ে রিপনের লাশ তোলা হবে- এই সংবাদে সকাল থেকে মসজিদ সংলগ্ন কবরস্থানে কাঁঠালভাঙা মাছির মতো ভিড় জমে যায়। কাজের ফাঁকে ফাঁকে ময়না দৌড়ে দৌড়ে সেই ভিড়ে সামিল হয়, ফিরে এসে সর্বশেষ সমাচার সরবরাহ করে নিশ্চল ফুলতারার কাছে।
‘হেরা আইতাছে উত্তুর দিক থেইকা, বরুড়া দিয়া ঢুইকা ফচ্ছিমগাঁও ধইরা।’
খানিক বাদে লাশতোলার লোকজনের আগমন বিষয়ক খবর হালনাগাদ হয়-
‘না গো, লাগে শাহরাস্তি ঘুইরা হাসনাবাদ থেইকা দহিন দিয়া আইবো।’

আবু তাহেরের বড় বোন প্রবাসী ভাইয়ের বাড়িতে কালেভদ্রে আসে। আজ সে আঠার মাইল দূরের শ্বশুরবাড়ি থেকে ভোরে-ভোরে মালমাত্তাসমেত হাজির হয়েছে; এর অর্থ- উপলক্ষটি যথেষ্ট গুরুত্ববাহী। পাকঘরে তার খুন্তি নাড়ার আওয়াজের ইশারায় ফুলতারা সেদিকপানে অগ্রসর হয়, যদিও মগজে যে চিন্তা ভর করে তাতে ননাসের প্রতি মেজবানির পরিবর্তে ঝামেলা অবসানের অন্তে রাত্রিকালে রুহুল আমিনের নিয়মিত পুনরাগমনের সম্ভাবনার ভাগ বেশি থাকে। নিত্যকর্মের অভ্যস্ততার এলাকায় ঘোরের পরিধি প্রসারিত করে সে; অথবা অনিবার্য ঘোরের মধ্যেই দম দেয়া পুতুলের মতোন গৃহস্থালির চর্চা করে। আসর ওয়াক্তের খানিক আগে ময়না যখন জিপগাড়ি, অফিসার সাহেব, পুলিশ আর মাতাল ডোমের খবর আনে, তখনও ফুলতারা অন্য কিছুর ঘোরে চিটাগুড়ের সান্দ্রতায় মৌমাছির মতো নিমজ্জিত থাকে।

‘কব্বরের মিদ্যে টিন উপ্তায়া কেরাছি ঢালছে ডপডপ কইরা, গন্দে নাকডি জ্বইলা গেছে গা’- ফুলতারা ভাবে কদুর তেলের গন্ধটা ভাল না; বড় বেশি কড়া।
‘কাফনের কাফড়ডি ফকফকা সাদা রইছে, কিচ্ছু অইছে না’- রোদে জ্বলে জ্বলে ম্যাক্সিটার রং নষ্ট হয়ে গেছে, তার মনে আসে।
‘মামি গো, নিশাখোর ডোম বেডায় কাফন হরায়া ডুলতে ডুলতে লাছডি খাড়া কইরা ধরছে, আর এইডা কী অইল, রিফনের ঠোঁড দুইখান খইসা মাডিত ফড়ল গো…’- নির্বাক ফুলতারা শুধু শোনে, শুনে যায়।

একান্ন দিনের বাসি লাশ থেকে ঠোঁট খসে পড়ার কাহিনী গ্রামবাসীর মুখে-মুখে খরস্রোতের বেগে প্রবাহিত হতে থাকে। এই রোমহর্ষক দৃশ্যটি কে সবচেয়ে কাছ থেকে দেখেছে- এমন একটি অঘোষিত প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় কবরস্থানে উপস্থিত জনতা। খসে পড়া ঠোঁটের বর্ণনায় কমলার কোয়া, গাবের বিচি, এমনকি জোঁকের উপমাও ব্যবহৃত হতে থাকে। ময়না মারফত সকলের বয়ান ফুলতারার কানে যায়; তবে তার মনের ভিতর কী ভাবনার আনাগোনা ঘটে, বরফজমা মুখ দেখে কারো ধরার উপায় থাকে না। মায়ের কোলে ঘুমন্ত সুমি পেশাব করে; আর্দ্র বলয় নিঃশব্দে গ্রাস করে ফুলতারার ডোরাছাপা সূতির শাড়ি।

রাতে ময়না বিছানা পাতে ফুলতারার ঘরের মেঝেতে। জীবিত রিপনের সাথে খাতিরের ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও কবরগর্ভ থেকে উত্তোলিত শিশুর ঈষৎ স্ফীত লাশ দেখার আতঙ্ক কিশোরীকে তাড়া করে ফিরছে। মশারির ভিতর প্রবিষ্ট হওয়ার আগে তাকে বড়ি গিলতে দেখে এগিয়ে যায় ফুলতারা।
‘হইলদা ফামবড়ি, চাইরকোনা’- ময়নার ঠোঁটে নতুন চাঁদের লাজুক হাসি- ‘খাইলে শইল মোডাতাজা অয়।’
‘পাইলি কই?’
‘একজনে দিছে’- আবার হাসে ময়না। কোনরকম পূর্বাভাস ছাড়াই হঠাৎ উল্টামুখে ঘুরে বসে পরনের কামিজের পেছনের বোতামটা খুলে দিয়ে ঝুঁকে পড়ে – ‘এট্টু দেহেন তো মামি আমার ফিডের মিদ্যে তিলা আছে নি?’

চকিতে ফুলতারা দু’চোখ বুজে ফেলে, যেন অদৃশ্য কোন উৎস থেকে তীব্র আলোকরশ্মি তেড়েফুঁড়ে এসে তার চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে! নিজের ভিতরে ঘটতে থাকা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সবটুকু সে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না, অথবা বোঝার চেষ্টাও করে না। বহুদিনের অভ্যস্ত ঘোরের গ্রহণ থেকে বেরিয়ে এসে টালমাটাল দিশাহীনতায় হোঁচট খেতে-খেতে, কিংবা অচেনা কোন নতুন ঘোরের অতলান্তিক গহনে তলিয়ে যেতে-যেতে রিপনের মায়ের শুধু মনে হয়, চোখ খুললেই একজোড়া ঠোঁট দেখবে সে- কমলার কোয়া, গাবের বিচি অথবা জোঁক হয়ে- কারো মুখ থেকে খসে পড়ছে।
.

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!