ইণ্ডিয়া আর ভারতবর্ষ— সুচিত্রা ভট্টাচার্য

জাতীয় সড়ক ধরে ছুটছিল শৌনকের গাড়িখানা। গতির কাঁটা একশো ছুঁইছুঁই। ব্রেকফাস্ট সেরেই রওনা দিয়েছে চাঁদিপুর থেকে। পথে খানিকটা গোলমেলে অঞ্চল, সেটুকু ঝটপট পেরিয়ে থামবে খড়্গপুর, সেখানে জমিয়ে লাঞ্চ, তার পর বিকেল বিকেল কলকাতা— মোটামুটি এ রকমই ছকা আছে প্ল্যানটা। বাড়ি গিয়ে আর নড়তে-চড়তে ইচ্ছে করবে না, ডিনারটা আনিয়ে নেবে কাছাকাছি কোনও রেস্তোরাঁ থেকে। রাতটুকু বিশ্রাম নিয়ে কাল থেকে আবার তো সেই অফিস আর অফিস। সাড়ে আটটার মধ্যে হুড়মুড় করে বেরোনো, ন’টা-দশটার আগে বাড়ি ফেরার কোনও সিন নেই, গোটা সপ্তাহ জুড়ে সেই একই রুটিন, এক রুটিন।
সামনের সিটে শৌনকের পাশে রুদ্র। একটু যেন উশখুশ করছে। ছোট্ট আড়মোড়া ভেঙে বলল— এ বার একটু জানলার কাচটা নামালে হয় না?
— সিগারেট খাওয়ার ধান্দা! সঙ্গে সঙ্গে পিছন থেকে সুলগ্না ঝনঝন— একদম নয়। সেকেণ্ডে গাড়ি ধুলোয় ভর্তি হয়ে যাবে।
— তোমরা যেন কী! সারাক্ষণ এসি ভাল লাগে? মিচকে হেসে রুদ্র তর্ক জুড়ল, বাড়িতে এসি, অফিসে এসি, গাড়িতে এসি, হোটেলে এসি…! মাঝে মাঝে একটু ন্যাচারাল এয়ারও নাও।
— দু’দিন ধরে তো ঢের সমুদ্রের হাওয়া খেলে। ঝুমুর সানগ্লাসে ঢাকা চোখ দু’খানা গাড়িতে ফেরাল। ঠোঁট টিপে বলল, ফুসফুস তো এখন ওজোনে বোঝাই থাকার কথা।
— ধুস্‌, ওই তো সমুদ্রের ছিরি! ঢেউয়ের কোনও জোশ নেই, কাদা-কাদা বিচ, গরু-ছাগল চরছে, কুকুর ঘুরছে, পদে পদে ডাবের খোলায় হোঁচট…
— অত নিন্দে কোরো না। কাল সানরাইজটা কী দারুণ ছিল…! প্লাস, মোহনার সাইডটাও যথেষ্ট চার্মিং।
— তবে বড্ড মাছের গন্ধ। সুলগ্না নাক কুঁচকোল, আমার ও-দিকটা গিয়ে যা গা গুলোচ্ছিল…
— যা-ই হোক না কেন, একটা আউটিং তো হল। শৌনক স্টিয়ারিং থেকে ফুট কাটল, আমার নতুন গাড়িটার একটা ট্রায়াল রানও মেরে দিলাম।
— সেভেন-সিটার কিনে বুদ্ধিমানের কাজ করেছিস। এ বার থেকে আর দুটো গাড়ির পেট্রোল পোড়ানোর ঝঞ্ঝাট রইল না, একটাতেই দিব্যি তোরা আমরা হুটহাট বেরিয়ে পড়তে পারব।
— ইস্‌, কে বলে রে এ কথা! ঝুমুর সানগ্লাস মাথার ওপর তুলেছে। চোখ নাচিয়ে বলল, কত বার সাধ্যসাধনার পর তবে না তোমাদের ডেট মিলল!
— এ বার থেকে রেগুলার বেরোব। প্রমিস। নেক্সট কবে যাবে বলো?
— এক্ষুনি এক্ষুনি আর নো চান্স। ঋকের সামার ভেকেশান পড়ার আগে পর্যন্ত আউটিং-ফাউটিং সব বন্‌ধ। সেশন স্টার্ট করলেই তো তুর্কি নাচ শুরু হবে। অবিরাম ক্লাসটেস্ট। একের পর এক।
— থ্যাঙ্ক গড, গুলুকে নিয়ে এখনও ওই প্রবলেমটা নেই। ওদের টিচিং মেথডটাই তো অন্য রকম। ক্লাস ফোর অবধি নো বই, নো হোমওয়ার্ক, নাথিং। স্কুলে যা শিখল, ব্যস। বাড়িতে আর বসাতে হয় না।
— দাঁড়া, সবে তো ক্লাস টু। প্রাইমারিটা পেরোক, জাঁতা কাকে বলে তখন টের পাবি।
— চাপ তো এক সময়ে না এক সময়ে পড়বেই রে। পড়া তো উচিত। নইলে বাচ্চারা থোড়াই সিরিয়াস হবে।
— ঋক তো প্রেশারেও ডোন্ট কেয়ার। সারাক্ষণ হয় টিভি, নয় কম্পিউটার। অথচ দ্যাখ, সিক্সে উঠল… আর চার বছর পরেই বোর্ড এগজাম… হুহু করে ফাইনাল পরীক্ষা এসে যাবে।
— আমার গুলু তো আর এক টাইপ। তিনি এখনই যা ওভার কনফিডেন্ট। সরস্বতী পুজোর দিন বলা হল মা’র কাছে বিদ্যে চাও, বুদ্ধি চাও… কী উত্তর দিল জানিস? মিছিমিছি চাইব কেন? আমার তো বুদ্ধি আছে!
— ওমা, তাই? হিহি। হিহি।
ঝুমুর-সুলগ্নার হাসির ছোঁয়াচ লেগেছে শৌনক আর রুদ্রর ঠোঁটেও। কিন্তু যাদের নিয়ে এত আলোচনা, সেই ঋক আর গুলু দিব্যি বিন্দাস। ঋক মজে আছে টিনটিনে, বাবার মোবাইলখানা দখল করে একমনে গেমস খেলছে গুলু। শ্রীমান ঋকের হাতে চিপসের খোলা প্যাকেট, তার থেকে মাঝে মাঝে খাবলা মারছে গুলু, চিবোচ্ছে কচরমচর।
একটা ছোট্ট বাজার পেরোল গাড়ি। পথের দু’ধারে রুক্ষ প্রান্তর। এবড়োখেবড়ো। শস্যহীন। শুকনো বাতাস বইছে এলোমেলো, ধুলো উড়ছে মাঠে। তারও ওপারে গ্রাম। ধূসর সবুজ জনবসতি। হঠাৎই শৌনক বলল, একটা ব্যাপার লক্ষ করেছিস?
— কী রে?
— অনেকক্ষণ কিন্তু উল্টো দিক থেকে কোনও গাড়ি আসছে না।
— ইজ ইট?
বলতে না বলতে গাড়ির গতি কমেছে আচমকা। সামনে একটা যানজট না? হ্যাঁ, তাই। আরও খানিকটা এগিয়ে শৌনককে থামতেই হল পুরোপুরি। গোটা রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে সার সার গাড়ি। ট্রাক, বাস, প্রাইভেট কার… কেউ একচুল নড়ছে না। নিশ্চল যানবাহনের বোঝায় শ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে বম্বে রোডের।
শৌনক ভুরু কুঁচকে বলল, কেসটা কী বল তো?
রুদ্র কাঁধ ঝাঁকাল, সামনে বোধ হয় অ্যাক্সিডেন্ট-ফ্যাক্সিডেন্ট…
— অন্য কিছুও হতে পারে। শৌনকের ভুরুর ভাঁজ বাড়ল, আমরা কিন্তুএখন লোধাশুলির কাছাকাছি! নট ফার ফ্রম জঙ্গলমহল!
— ও নো…! মাও বেল্ট?
— হুঁ। এ সব দিকেই তো যত গণ্ডগোল।
— সর্বনাশ। ঝুমুরের গলা ঠিকরে উঠল, ল্যাণ্ডমাইন পেতে রাস্তাফাস্তা উড়িয়ে দেয়নি তো?
— ধ্যাৎ, প্যানিক করছ কেন? শৌনক জোরের সঙ্গে বলল বটে, তবে গলা ঈষৎ কেঁপে গেল যেন। হাত উল্টে বলল, বড়জোর কোনও অবরোধ-টবরোধ…
— তা হলেও তো ফেঁসে গেলাম। নেমে দ্যাখো না ব্যাপারটা।
— না না, দরকার কী! কোথায় কী সিচুয়েশন হয়ে আছে কিছুই জানি না…। সুলগ্না খাড়া হয়ে বসেছে— ব্যাক করা যায় না?
উঁহু, সেই সম্ভাবনাও নেই আর। পিছনেও গাড়ির লাট লেগে গেছে। ইঁদুরকলে আটকে পড়েছে শৌনকের সেভেন-সিটার।
অবশ্য দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই ব্যাপারটা জানা গেল। অবরোধই চলছে বটে। তবে মাওবাদী-ফাওবাদী নয়, স্থানীয় মানুষ নাকি আটকে রেখেছে রাজপথ। কী সব হ্যাড্ডাফ্যাড্ডা দাবি আছে তাদের, সেগুলো মেটার সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি না মেলা পর্যন্ত জট খুলবে কি না সন্দেহ।
চোরা আতঙ্ক এ বার বদলে গেছে বিরক্তিতে। বেজার মুখে শৌনক বলল, যাহ্‌ শালা, আজই আটকাতে হল?
রুদ্র কপাল চুলকোল, এ রাস্তা দিয়ে না ফিরলেই বোধ হয় ভাল হত রে।
— কেন? যাওয়ার সময়ে তো দিব্যি বেরিয়ে গেলাম।
— তখনও কিন্তু রিস্ক ছিল। এই সব ডিস্টার্বড এরিয়া…
— সত্যি, তুমি যে কেন সেফ রাস্তাটা ধরো না? ঝুমুরের স্বরে ঝাঁঝ— যদি আমরা ভায়া দিঘা ফিরতাম…
— বাজে বোকো না তো। চাঁদিপুর হোটেলে শুনলে না ওই রাস্তাটার কী হাল!
— তবু নিরাপদ তো বটে।
— হোক। ও-রকম ভাঙাচোরা রাস্তায় কক্ষনও আমার নতুন গাড়িকে নিয়ে যাব না।
— বেশ তো। তোমার নয়া গাড়ি এখন তা হলে খানিক ইটপাটকেল খাক।
শৌনক রীতিমত চুপসে গেল। ঝামেলা যদি বাড়ে, ওই ধরনের অঘটন ঘটতে কতক্ষণ! আর পাবলিকের যা স্বভাব, এ রকম চকচকে গাড়ি দেখলেই তাদের হাত নিশপিশ করবে। এখন শৌনকের যে কী উপায়!
দু’জোড়া স্বামী-স্ত্রীর মুখমণ্ডলেই দুশ্চিন্তার ছায়া। শুধু পিছনে ঋক-গুলুর কোনও হেলদোল নেই। এক জন গেমস খেলেই চলেছে, অন্য জন গেঁথে আছে কমিকসে। এতক্ষণ এসির কল্যাণে ভেতরটা বেশ ঠাণ্ডা ছিল, সামনের দুটো কাচ নেমে যেতে প্রথম চৈত্রের তপ্ত বাতাসে হিমেল ভাবটুকু উধাও। আর তাতেই বুঝি মনোনিবেশে ক্ষণিক ব্যাঘাত ঘটল ঋকের। চোখ তুলে দেখছে এ-দিক ও-দিক।
সপ্রতিভ স্বরে ঋক প্রশ্ন ছুড়ল, কী হয়েছে বাবা? ট্রাফিক জ্যাম?
সুলগ্না উত্তর দিল, না রে, সামনে রাস্তা আটকেছে।
— কারা আটকাল?
— লোকাল পিপল।
— কেন?
— বোধ হয় কোনও গ্রিভান্স আছে।
— কী গ্রিভান্স?
— আহ্‌ ঋক, বোর কোরো না। চুপচাপ বসো। শৌনক মুঠো ঝাঁকাল। তিরিক্ষি গলায় বলল, কেন যে সবাই কথায় কথায় এমন অবরোধ করে? কী যে লাভ হয়?
— এ এক ধরনের পাওয়ার শো রে ভাই। গ্রামের লোকরাও এখন শিখে গেছে। রুদ্র মুখ বেঁকাল, আজকাল তো কোনও কারণটারণও লাগে না। দেখিস না, কলকাতাতেও কেমন দুমদাম রাস্তা বন্ধ করে দেয়! কর্তাগিন্নির মারপিট, তাতেই হয়তো দু’পাঁচটা লোককে জুটিয়ে গাড়িঘোড়া থামিয়ে দিল!
— এটা নিশ্চয়ই সে রকম কেস নয়। সুলগ্নার স্বরে ফের শঙ্কার আভাস, নির্ঘাত একটা বড় কিছু হয়েছে।
— কী আর হবে বলো? বড়জোর দু’চারটে খুনজখম। যেমন ঘটছে রোজ।
— কেন যে এ রকম চলছে? মিনিংলেস, অ্যাবসোলিউটলি মিনিংলেস। শৌনক জোরে জোরে মাথা নাড়ল, এ ভাবে কিস্যু হয় না। ডেমোক্রেসিতে রয়েছ, ডেমোক্রেসির নিয়ম মানো। স্টার্ট ডায়ালগ।
— এরা কি সত্যিই কিছু অ্যাচিভ করতে চায়? নিজেরাও মিসগাইডেড, আনপড় মানুষগুলোকেও ভুলভাল চালাচ্ছে। আরে বাবা, কাঁধে আর্মস নিলেই হল? গভর্নমেন্টের পাওয়ারের সঙ্গে তোরা কতক্ষণ যুঝবি?
— মাঝখান থেকে আমাদের যত হ্যারাসমেন্ট। দুটো দিন রিল্যাক্স করে শান্তিতে বাড়ি ফিরব, সেখানেও বাম্বু। এখন বউবাচ্চা নিয়ে… পথের মাঝে… হেল্পলেসলি…
বিরক্ত, রাগ আর সমালোচনার তাতে গাড়ির অভ্যন্তর উষ্ণতর। ঝুমুর-সুলগ্না নিজেদের দু’পাশের কাচ দুটোও নামিয়ে দিল। বাইরে একটা চাপা গুঞ্জন। থেমে থাকা বাসের ড্রাইভার, কণ্ডাক্টর, ট্রাকের খালাসি, অনেকেই চরে বেড়াচ্ছে রাস্তায়। ছোট ছোট জটলায় গুলতানি চলছে। গাড়ি আর বাসের যাত্রীদেরও কেমন হালছাড়া ভাব। দেখে মনে হয় কারওরই যেন গন্তব্যে পৌঁছনোর ছটফটানি নেই। শৌনকদের ডান পাশে একটা বড়সড় অ্যাম্বুল্যান্স পর্যন্ত নির্বিকার দাঁড়িয়ে। হাওয়াতে মিশে আছে পোড়া ডিজেলের কটু গন্ধ।
ফের ঋকের স্বর বেজে উঠেছে, আর কতক্ষণ এ ভাবে বসে থাকতে হবে?
ঝুমুর ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলল, কী করে বলব? অন্য গাড়িরা চললে আমরাও যাব।
— ও। …আমি কি আর একটা চিপস পেতে পারি?
— একটু আগেই তো একটা প্যাকেট শেষ করলি!
— আমি কোথায় খেলাম? গুলু তো বেশিটা মেরে দিল।
— মোটেই না। মোবাইলের বোতাম টিপতে টিপতে গুলুর প্রতিবাদ, আমি জাস্ট ফাইভ নিয়েছি।
— ঠিক আছে, ঠিক আছে, নো ঝগড়া। এ বার দু’জনকে দুটো দিচ্ছি, শান্তিতে বসে খাও।
— আর হ্যাঁ, মোবাইল নিয়ে খেলাটা এ বার বন্ধ হোক। সুলগ্না নির্দেশ জুড়ল— ব্যাটারির চার্জ চলে গেলে তোমার বাবার কিন্তু মুশকিল হবে।
অনিচ্ছা ভরে সেলফোন হস্তান্তর করল গুলু। বিনিময়ে চিপসের সঙ্গে জুটেছে কোল্ড ড্রিঙ্কস। মা ছেলে দু’জনেই চুমুক দিচ্ছে তরলে। দেখে রুদ্ররও বুঝি তৃষ্ণা জাগল, ঝোলা থেকে বেরিয়ে পড়েছে বিয়ারের ক্যান। ঝড়াক খোলা, তড়াক পান। শুধু শৌনক-রুদ্র নয়, ঝুমুরও দু’চার ঢোক ঢালল গলায়। প্রখর মধ্যাহ্ন, এই উটকো অবরোধ, আর বুঝি তত অসহ লাগছে না, মেজাজও খানিক সমে ফিরল যেন।
ক্যানগুলো জড়ো করে সিটের তলায় রাখল শৌনক। নামল স্টিয়ারিং থেকে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাত-পা খেলাচ্ছে। নেমেছে রুদ্রও। সিগারেট ধরিয়ে এগোল সম্মুখ পানে। ঠাণ্ডা পানীয় পেটে যেতে ঋকের শুশু পেয়েছে। দেখাদেখি গুলুরও। দুই মূর্তিকে মাঠের দিকে নিয়ে গিয়ে হিশি করিয়ে আনল শৌনক। ফিরে দেখল ঝুমুর-সুলগ্না কোথায় কোন শপিং মলে কী নতুন কস্টিউম জুয়েলারি এসেছে তাই নিয়ে গভীর আলাপচারিতায় মগ্ন। দু’চার সেকেণ্ড শোনার পর শৌনকের আর ধৈর্য রইল না, অসহায় আলস্যে হেলান দিয়েছে সিটে।
একটু বুঝি চোখ জড়িয়ে এসেছিল, তখনই আচমকা রুদ্রর ডাক— অ্যাই, গেট আপ।
শৌনক ধড়মড়িয়ে তাকাল, কেন? কী হয়েছে?
— আমাদের কপালটা ভাল রে। রাস্তা ক্লিয়ার হয়ে গিয়েছে। এ বার গাড়ি ছাড়বে।
— সরে গেল অবরোধকারীরা?
— পুলিশ এসে হঠিয়ে দিয়েছে।
রুদ্র গাড়িতে উঠে পড়ল। ঘাড় ঘুরিয়ে সুলগ্নাদের বলল, তোমরা ভাবতেও পারবে না কারা ডেমনষ্ট্রেশান দিচ্ছিল!
— ওই যে শুনলাম… লোকাল গ্রামবাসী…
— হ্যাঁ, গ্রামবাসী তো বটেই। তবে নো পুরুষ। কতগুলো বউমেয়ে আর স্কুলের বাচ্চারা মিলে বসে পড়েছিল হাইওয়েতে।
— সে কী? কেন? তারা কী চায়?
— অবিলম্বে বাচ্চাদের স্কুল খুলতে হবে।
— স্কুল বন্ধ বুঝি?
— হ্যাঁ। শোনোনি, মাওবাদীদের সঙ্গে কম্ব্যাট করতে সিআরপি-টিআরপি এসেছে এ দিকে? পুলিশ-সিআরপি’দের থাকার বন্দোবস্ত তো হয়েছে স্কুলটুলেই। ছেলেমেয়েগুলো তাই কাঁইকাঁই করছে, এক্ষুনি ও-সব ফোর্স হঠাও।
— দাবি কি মেনে নেওয়া হল?
— ধুস্‌, পুলিশ জাস্ট লাঠি উঁচিয়ে রাস্তা সাফ করে দিল।
— এটা কিন্তু ভারী অন্যায়।
— কোনটা? ভাগিয়ে দেওয়াটা?
— না। স্কুল বন্ধ থাকাটা। ছি ছি… বাচ্চাগুলো মাসের পর মাস পড়াশোনা করতে পারছে না…
— তো কী করা যাবে? ফোর্সকেও তো কোথাও না কোথাও থাকতে হবে। তাদের তো একটা সেফ জায়গা চাই।
— সেফটি অ্যাট দ্য কস্ট অব বাচ্চাদের পড়াশোনা? নাকি এ সেই হিটলারের মতো জুদের স্কুলগুলো আগে দখল করে সেখানে মিলিটারির আস্তানা গাড়ো!
— তোমরা একটা মাইনর ইস্যুকে এমন ফোলাও! কী করলে ভাল হত, অ্যাঁ? ফোর্স কি জঙ্গলে গিয়ে থাকবে? তাঁবু খাটিয়ে? বেঘোরে মরার জন্যে?
— সেটা ফোর্সের ভাবনা। কিংবা গভর্নমেন্টের। বাচ্চারা সাফার করবে কেন?
— খুব ওদের উকিল হয়েছ তো! রুদ্র হ্যা হ্যা হাসল, তুমিও গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লে পারতে।
— আওয়াজ মেরো না। আমাদের প্রত্যেকের কিন্তু ব্যাপারগুলো নিয়ে চিন্তা করা উচিত।
বাক্যালাপের মাঝেই উল্টো দিক দিয়ে ট্রাক আসছে পর পর। অতি সন্তর্পণে চলে যাচ্ছে, পথের কিনার বেয়ে। সামনের গাড়িগুলোও এ বার নড়েচড়ে উঠল। জানলার কাচ তুলে দিল শৌনক, গাড়ি স্টার্ট করে ফের এসি মেশিন চালু। সেভেন-সিটার গুটিগুটি এগোচ্ছে। প্রতি মুহূর্তে আশঙ্কা, আশপাশের কোনও বুরবক ড্রাইভার না ঠুকে দেয়। বেশ খানিকটা গিয়ে দর্শন মিলল পুলিশের। ছোটাছুটি করে যানজট ছাড়াচ্ছে।
অবশেষে অবরোধকারীদেরও দেখা গেল। চলে যায়নি এখনও, শুকনো মাঠে নেমে দাঁড়িয়ে আছে ছড়িয়েছিটিয়ে। ন্যাতা ন্যাতা শাড়ি জড়ানো গ্রামের গোটা পঞ্চাশ বউঝি, আর বিবর্ণ ইউনিফর্ম গায়ে শতখানেক স্কুলের ছেলেমেয়ে। ফ্যালফ্যাল চোখ খুদে খুদে পড়ুয়াদের হাতে প্ল্যাকার্ড। কঞ্চিতে লটকানো বড় বড় কাগজের টুকরোয় লেখা রয়েছে স্লোগান। কাঁচা কাঁচা হস্তাক্ষরে।
ঋক চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করল, এদের সকলেরই স্কুল বন্ধ?
ছেলের প্যাকেট থেকে ঝুমুর চিপস নিচ্ছিল। মুখে পুরে বলল, হ্যাঁ বেটা।
— তার মানে ওদের অ্যানুয়াল এগজাম দিতে হয়নি?
— দিতে পারেনি বেটা। স্কুলই তো বসছে না।
এ বার গুলুর কৌতূহল জাগ্রত হয়েছে। চোখ পিটপিট করে বলল, এরাই কি মাওবাদী, আন্টি?
— না রে। এ তো কচিকাঁচা।
— তা হলে মাওবাদী কারা?
— অত তোমায় জানতে হবে না। সুলগ্না ছেলেকে মৃদু ধমক দিল। চতুর্দিকে চোখ চালাতে চালাতে বলল, ওফ্‌, ভালয় ভালয় জায়গাটুকু পেরোতে পারলে বাঁচি।
— এই তো, মোটামুটি মেরে এনেছি। শৌনক স্টিয়ারিংয়ে টানটান, এ বার সাঁ সাঁ চালাব। তখনই আবার ঋকের প্রশ্নবাণ, আমাদের কলকাতায় মাওবাদী নেই, তাই না বাবা?
— কেন রে?
— থাকলে তো পুলিশ নিশ্চয়ই আমাদের স্কুলগুলোও নিয়ে নিত। তখন নো টেস্ট, নো টেনশন। ঋক অনাবিল হাসল, ইস্‌, কী মজাই না হত তা হলে!
— ধ্যাৎ, ও রকম কখনও হয় নাকি? অত সহজ?
— কেন? সোজা নয় কেন?
প্রশ্নটা গাড়িতেই রয়ে গেল। ভেতরের নরম শীতলতায় বুঝি ঘুমিয়েই পড়ল। শৌনক গাড়ির গতি বাড়িয়েছে। ছুটছে মসৃণ।

দুঃখিত!