ঘড়িতে পাঁচটা বাজতে আট মিনিট বাকি। এমন সময় সাকিবের ঘুম ভেঙে গেল। ঘুমলাগা চোখে সে পাশের কক্ষে উঁকি দিয়ে দেখে আববু-আম্মু এসেছে কি না। না, আসেনি। দূর থেকে অস্পষ্ট টুংটাং শব্দ শোনা যাচ্ছে। হয় তো রান্নাঘরে রীনা আপা কাজ করছে।
সাকিবের বাবা-মা দু’জনই চাকরিজীবী। ব্যাংকার। সকালে একসঙ্গে অফিসে যান আবার একসঙ্গে ফেরেন। তাই রাত আর ছুটির দিন ছাড়া বাবা-মাকে খুব একটা কাছে পায় না সাকিব। স্কুল থেকে ফিরে সাকিবের সারাদিন হয় একা একা, নয় তো মায়ের দূর সম্পর্কের আত্মীয় রীনার সঙ্গে কাটে।
চারটায় অফিস শেষ করে প্রতিদিন এরই মধ্যে তো আববু-আম্মু বাসায় ফেরে। কিন্তু আজ দেরি হচ্ছে কেন? কোনো সমস্যা হয়নি তো? নাকি দু’জনে একসঙ্গে কোথাও বেড়াতে গেছেন কিংবা শপিং করছেন? কিন্তু না, আমাকে ফেলে যাওয়ার তো কথা নয়। তবে হয়েছে টা কী? ভাবনাগুলো দশ-বছর-বয়সী সাকিবের মনে সোনালি ফড়িঙের মতো উড়াউড়ি করে। না, একা-একা বসে থাকতে আর ভাল লাগছে না। রীনা আপা কিচেনে ব্যসত্ম। এই ফাঁকে নিঃশব্দে দরজা খুলে পাঁচতলার ছাদে চলে এল সে। ওদের বাসাটা দ্বিতীয় তলায়। উত্তরের জানালা দিয়ে খোলা মাঠ দেখা যায়। ওখানে ছোট ছেলে-মেয়েরা খেলা করে। মাঠটি সবুজ ঘাসে ভরা আর চারপাশে কিছু গাছপালাও চোখে পড়ে। সব মিলিয়ে ওটাকে কিছুটা গ্রামের মতো মনে হয়। সাকিব মাকে অনেক বলেছে ওই মাঠ থেকে একবার ঘুরিয়ে আনতে। মা নেয়নি, রীনাও নেয় না।
আজ ছাদ থেকে মাঠটিকে স্পষ্ট দেখতে পেয়ে সাকিবের মনে আনন্দ আর ধরে না। কাপড় দিয়ে চোখ-বাঁধা একজন অন্যদের ছুঁয়ে দিতে চাইছে আর সবাই দূরে সরে যাচ্ছে। কেউ বা বল নিয়ে খেলছে, দৌড়াদৌড়ি করছে। আবোল-তাবোল কী যেন বলছে আর ইচ্ছে মতোন ঘুরছে। বাহ, ভারি মজার তো! দৃশ্যগুলো ভীষণ পছন্দ হল সাকিবের। এ রকম খেলা সে আগেও একবার দেখেছে ওর দাদুবাড়ি। গ্রামে এমনি আরো কত কিছু দেখা যায়। তাই গ্রাম খুব ভাল লাগে তার। কিন্তু মা বলে, গ্রাম নাকি একদম পচাঁ। গত ঈদেও গ্রামে গিয়েছিল সাকিব। কিন্তু ওর পরীক্ষা এবং মায়ের শরীর খারাপ- এই অজুহাতে এবার শহরেই ঈদের ছুটি কাটিয়েছে তারা। হঠাৎ তার গ্রামে চলে যেতে ভীষণ ইচ্ছে হয়। আর ইচ্ছে করে বসিত্মর ওই ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে খেলতে। কিন্তু মায়ের চোখে পঁচা মাঠের ওই ছেলেদের সাথে কখনও কি সে মিশতে পারবে? ভাবতে ভাবতে অনেকক্ষণ গড়িয়ে গেছে। সু©র্য্যটাও হারিয়ে গেছে আকাশের কোলে। মাঠখানা ফাঁকা, খেলা শেষে সবাই ফিরে গেছে যে যার ঘরে। চারদিকে নেমে এসেছে অন্ধকার।
এদিকে বাসায় ফিরে সাকিবকে না-পেয়ে বাবা-মার সে কী খোঁজাখুজি! কোথায় গেল ছেলেটা? সামনের দরজাটা খোলা ছিল। কেউ ধরে নিয়ে গেল না তো তাকে। ওপর থেকে নিচ সব তলায় খোঁজা হয়ে গেছে। রীনা তিনবার ছাদ থেকে ঘুরে এসেছে। কিন্তু কাউকে দেখেনি। মা কাঁদছেন আর রীনাকে বকছেন- তুই আমার ছেলেকে না-দেখে কী করছিলি? পাশের বাসার সব আন্টিরা এসেছে সামত্মবনা দিতে। বাবাও ঘামছেন আর সবখানে ফোন করছেন। কিন্তু সাকিবের কোনো দেখা নেই।
হঠাৎ সাকিবের হুঁশ হয়- ছাদে তো বহুক্ষণ হয়ে গেছে। মা এসে ওকে খুঁজছে নিশ্চয়ই। উচ্চকণ্ঠে ‘মা’ বলে ডেকে সে নিচে নেমে আসে। বাসায় ঢুকে শোরগোল শুনে কিছুটা বিস্মিত হয়। অনেকগুলো মানুষ অবাক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। সে বুঝতে পারে না মামণি কাঁদছে কেন? অশ্রুভেজা চোখে মা একনাগাড়ে বলে বলে যায়- বাবা তুই এলি? মাকে ফেলে এতক্ষণ কোথায় ছিলি? তোকে খুঁজতে খুঁজতে……। আচমকা এতসব প্রশ্ন শুনে চমকে গেলেও সাকিব কিছু বলে না। সে দৌড়ে এসে চুপচাপ মায়ের বুকে মুখ লুকোয়। মায়ের অশ্রু ছাপিয়ে ওর চোখের কোণে ভেসে ওঠে খানিক আগের ভাবনাগুলো। সে জানে না, তার ইচ্ছের পাখিরা কখনও নীল ডানা মেলে উড়বে কি না!
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।