ইচ্ছাপূরণ-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-১ম পাঠ

সুবলচন্দ্রের ছেলেটির নাম সুশীলচন্দ্র । কিন্তু সকল সময়ে নামের মতো মানুষটি হয় না । সেইজন্যই সুবলচন্দ্র কিছু দুর্বল ছিলেন এবং সুশীলচন্দ্র বড়ো শান্ত ছিলেন না । ছেলেটি পাড়াসুদ্ধ লোককে অস্থির করিয়া বেড়াইত , সেইজন্য বাপ মাঝে মাঝে শাসন করিতে ছুটিতেন ; কিন্তু বাপের পায়ে ছিল বাত , আর ছেলেটি হরিণের মতো দৌড়িতে পারিত ; কাজেই কিল চড়-চাপড় সকল সময় ঠিক জায়গায় গিয়া পড়িত না । কিন্তু সুশীলচন্দ্র দৈবাৎ যেদিন ধরা পড়িতেন সেদিন তাঁহার আর রক্ষা থাকিত না ।
আজ শনিবারের দিনে দুটোর সময় স্কুলের ছুটি ছিল , কিন্তু আজ স্কুলে যাইতে সুশীলের কিছুতেই মন উঠিতেছিল না । তাহার অনেকগুলা কারণ ছিল । একে তো আজ স্কুলে ভূগোলের পরীক্ষা , তাহাতে আবার ও পাড়ার বোসেদের বাড়ি আজ সন্ধ্যার সময় বাজি পোড়ানো হইবে । সকাল হইতে সেখানে ধুমধাম চলিতেছে । সুশীলের ইচ্ছা , সেইখানেই আজ দিনটা কাটাইয়া দেয় । অনেক ভাবিয়া , শেষকালে স্কুলে যাইবার সময় বিছানায় গিয়া শুইয়া পড়িল । তাহার বাপ সুবল গিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন , “ কী রে , বিছানায় পড়ে আছিস যে । আজ ইস্কুলে যাবি নে ? ” সুশীল বলিল , “ আমার পেট কামড়াচ্ছে , আজ আমি ইস্কুলে যেতে পারব না । ” সুবল তাহার মিথ্যা কথা সমস্ত বুঝিতে পারিলেন । মনে মনে বলিলেন , ‘ রোসো , একে আজ জব্দ করতে হবে । ‘ এই বলিয়া কহিলেন , “ পেট কামড়াচ্ছে ? তবে আর তোর কোথাও গিয়ে কাজ নেই । বোসেদের বাড়ি বাজি দেখতে হরিকে একলাই পাঠিয়ে দেব এখন । তোর জন্যে আজ লজঞ্জুস কিনে রেখেছিলুম , সেও আজ খেয়ে কাজ নেই । তুই এখানে চুপ করে পড়ে থাক, আমি খানিকটা পাঁচন তৈরি করে নিয়ে আসি । ‘ এই বলিয়া তাহার ঘরে শিকল দিয়া সুবলচন্দ্র খুব তিতো পাঁচন তৈয়ার করিয়া আনিতে গেলেন ।
সুশীল মহা মুশকিলে পড়িয়া গেল । লজঞ্জুস সে যেমন ভালোবাসিত পাঁচন খাইতে হইলে তাহার তেমনি সর্বনাশ বোধ হইত । ও দিকে আবার বোসেদের বাড়ি যাইবার জন্য কাল রাত হইতে তাহার মন ছট্‌ফট্‌ করিতেছে , তাহাও বুঝি বন্ধ হইল । সুবলবাবু যখন খুব বড়ো এক বাটি পাঁচন লইয়া ঘরে ঢুকিলেন সুশীল বিছানা হইতে ধড়্‌ ফড়্‌ করিয়া উঠিয়া বলিল , “ আমার পেট কামড়ানো একেবারে সেরে গেছে , আমি আজ ইস্কুলে যাব । ” বাবা বলিলেন , “ না না , সে কাজ নেই , তুই পাঁচন খেয়ে এইখানে চুপচাপ করে শুয়ে থাক্ । ” এই বলিয়া তাহাকে জোর করিয়া পাঁচন খাওয়াইয়া ঘরে তালা লাগাইয়া বাহির হইয়া গেলেন । সুশীল বিছানায় পড়িয়া কাঁদিতে কাঁদিতে সমস্তদিন ধরিয়া কেবল মনে করিতে লাগিল যে , ‘ আহা , যদি কালই আমার বাবার মতো বয়স হয় , আমি যা ইচ্ছা তাই করতে পারি , আমাকে কেউ বন্ধ করে রাখতে পারে না । ‘ তাহার বাপ সুবলবাবু বাহিরে একলা বসিয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিলেন যে , ‘ আমার বাপ মা আমাকে বড়ো বেশি আদর দিতেন বলেই তো আমার ভালোরকম পড়াশুনো কিছু হল না । আহা , আমার যদি সেই ছেলেবেলা ফিরে পাই, তা হলে আর কিছুতেই সময় নষ্ট না করে কেবল পড়াশনো করে নিই । ‘ ইচ্ছাঠাকরুন সেই সময় ঘরের বাহির দিয়া যাইতেছিলেন । তিনি বাপের ও ছেলের মনের ইচ্ছা জানিতে পারিয়া ভাবিলেন , আচ্ছা, ভালো , কিছুদিন ইহাদের ইচ্ছা পূর্ণ করিয়াই দেখা যাক ।

এই ভাবিয়া বাপকে গিয়া বলিলেন , “ তোমার ইচ্ছা পূর্ণ হইবে । কাল হইতে তুমি তোমার ছেলের বয়স পাইবে । ” ছেলেকে গিয়া বলিলেন , “ কাল হইতে তুমি তোমার বাপের বয়সী হইবে । ” শুনিয়া দুইজনে ভারি খুশি হইয়া উঠিলেন । বৃদ্ধ সুবলচন্দ্র রাত্রে ভালো ঘুমাইতে পারিতেন না , ভোরের দিকটায় ঘুমাইতেন । কিন্তু আজ তাঁহার কী হইল , হঠাৎ খুব ভোরে উঠিয়া একেবারে লাফ দিয়া বিছানা হইতে নামিয়া পড়িলেন । দেখিলেন , খুব ছোটো হইয়া গেছেন ; পড়া দাঁত সবগুলি উঠিয়াছে ; মুখের গোঁফদাড়ি সমস্ত কোথায় গেছে , তাহার আর চিহ্ন নাই ।
রাত্রে যে ধুতি এবং জামা পরিয়া শুইয়াছিলেন , সকালবেলায় তাহা এত ঢিলা হইয়া গেছে যে , হাতের দুই আস্তিন প্রায় মাটি পর্যন্ত ঝুলিয়া পড়িয়াছে , জামার গলা বুক পর্যন্ত নামিয়াছে , ধুতির কোঁচাটা এতই লুটাইতেছে যে , পা ফেলিয়া চলাই দায় । আমাদের সুশীলচন্দ্র অন্যদিন ভোরে উঠিয়া চারি দিকে দৌরাত্ম্য করিয়া বেড়ান , কিন্তু আজ তাহার ঘুম আর ভাঙে না ; যখন তাহার বাপ সুবলচন্দ্রের চেঁচামেচিতে সে জাগিয়া উঠিল তখন দেখিল, কাপড় চোপড়গুলো গায়ে এমনি আঁটিয়া গেছে যে , ছিঁড়িয়া ফাটিয়া কুটিকুটি হইবার জো হইয়াছে ; শরীরটা সমস্ত বাড়িয়া উঠিয়াছে ; কাঁচা-পাকা গোঁফে-দাড়িতে অর্ধেকটা মুখ দেখাই যায় না ; মাথায় একমাথা চুল ছিল , হাত দিয়া দেখে সামনে চুল নাই — পরিষ্কার টাক তক্‌‌‌‍তক্ করিতেছে। আজ সকালে সুশীলচন্দ্র বিছানা ছাড়িয়া উঠিতেই চায় না । অনেকবার তুড়ি দিয়া উচ্চৈঃস্বরে হাই তুলিল ; অনেকবার এপাশ ওপাশ করিল ; শেষকালে বাপ সুবলচন্দ্রের গোলমালে ভারি বিরক্ত হইয়া উঠিয়া পড়িল। দুইজনের মনের ইচ্ছা পূর্ণ হইল বটে , কিন্তু ভারি মুশকিল বাধিয়া গেল ।
আগেই বলিয়াছি , সুশীলচন্দ্র মনে করিত যে , সে যদি তাহার বাবা সুবলচন্দ্রের মতো বড়ো এবং স্বাধীন হয় , তবে যেমন ইচ্ছা গাছে চড়িয়া , জলে ঝাঁপ দিয়া , কাঁচা আম খাইয়া , পাখির বাচ্ছা পাড়িয়া , দেশময় ঘুরিয়া বেড়াইবে ; যখন ইচ্ছা ঘরে আসিয়া যাহা ইচ্ছা তাহাই খাইবে, কেহ বারণ করিবার থাকিবে না। কিন্তু আশ্চর্য এই , সেদিন সকালে উঠিয়া তাহার গাছে চড়িতে ইচ্ছাই হইল না। পানাপুকুরটা দেখিয়া তাহার মনে হইল , ইহাতে ঝাঁপ দিলেই আমার কাঁপুনি দিয়া জ্বর আসিবে । চুপচাপ করিয়া দাওয়ায় একটা মাদুর পাতিয়া বসিয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিল। একবার মনে হইল , খেলাধুলোগুলো একেবারেই ছাড়িয়া দেওয়াটা ভালো হয় না , একবার চেষ্টা করিয়াই দেখা যাক। এই ভাবিয়া কাছে একটা আমড়া গাছ ছিল , সেইটাতেই উঠিবার জন্য অনেকরকম চেষ্টা করিল । কাল যে গাছটাতে কাঠবিড়ালির মতো তর তর করিয়া চড়িতে পারিত আজ বুড়া শরীর লইয়া সে গাছে কিছুতেই উঠিতে পারিল না ; নিচেকার একটা কচি ডাল ধরিবামাত্র সেটা তাহার শরীরের ভারে ভাঙিয়া গেল এবং বুড়া সুশীল ধপ করিয়া মাটিতে পড়িয়া গেল । কাছে রাস্তা দিয়া লোক চলিতেছিল , তাহারা বুড়াকে ছেলেমানুষের মতো গাছে চড়িতে ও পড়িতে দেখিয়া হাসিয়া অস্থির হইয়া গেল।
সুশীলচন্দ্র লজ্জায় মুখ নিচু করিয়া আবার সেই দাওয়ায় মাদুরে আসিয়া বসিল; চাকরকে বলিল, “ওরে, বাজার থেকে এক টাকার লজঞ্জুস কিনে আন্।” লজঞ্জুসের প্রতি সুশীলচন্দ্রের বড়ো লোভ ছিল । স্কুলের ধারে দোকানে সে রোজ নানা রঙের লজঞ্জুস সাজানো দেখিত ; দু-চার পয়সা যাহা পাইত তাহাতেই লজঞ্জুস কিনিয়া খাইত ; মনে করিত, যখন বাবার মতো টাকা হইবে তখন কেবল পকেট ভরিয়া ভরিয়া লজঞ্জুস কিনিবে এবং খাইবে । আজ চাকর এক টাকায় একরাশ লজঞ্জুস কিনিয়া আনিয়া দিল ; তাহারই একটা লইয়া সে দন্তহীন মুখের মধ্যে পুরিয়া চুষিতে লাগিল ; কিন্তু বুড়ার মুখে ছেলেমানুষের লজঞ্জুস কিছুতেই ভালো লাগিল না। একবার ভাবিল ‘এগুলো আমার ছেলেমানুষ বাবাকে খাইতে দেওয়া যাক’; আবার তখনই মনে হইল ‘না কাজ নাই , এত লজঞ্জুস খাইলে উহার আবার অসুখ করিবে’। কাল পর্যন্ত যে-সকল ছেলে সুশীলচন্দ্রের সঙ্গে কপাটি খেলিয়াছে আজ তাহার সুশীলের সন্ধানে আসিয়া বুড়ো সুশীলকে দেখিয়া দূরে ছুটিয়া গেল । গল্পটির ২য় পাঠ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

আরো পড়তে পারেন...

একটা আষাঢ়ে গল্প-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-১ম অংশ

দূর সমুদ্রের মধ্যে একটা দ্বীপ । সেখানে কেবল তাসের সাহেব , তাসের বিবি , টেক্কা…

একটা আষাঢ়ে গল্প-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-২য় অংশ

এমনি তো কিছুকাল যায় । কিন্তু এই তিনটে বিদেশী যুবক কোনো নিয়মের মধ্যেই ধরা দেয়…

একটা আষাঢ়ে গল্প-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-তৃতীয় অংশ

মাথার উপরে পাখি ডাকিতে থাকে , বাতাস অঞ্চল ও অলক উড়াইয়া হূহু করিয়া বহিয়া যায়…