ইঁদুর বেড়ালের সমঝোতা, দোকানদারের বারোটা

এক মুদি দোকানে বাসা বেঁধেছিল দুষ্টু কিছু ইঁদুর। রাতের বেলা দোকানদার বাসায় চলে গেলে ইঁদুরদের নাচানাচি লাফালাফির উৎসব শুরু হয়ে যেত। একটা যেত তেলের বোতলে হামলা চালাতে, আরেকটা লাফাতো চালের বস্তার ওপর। অন্যরা চিনির বস্তা, আটার বস্তাসহ বিভিন্ন প্যাকেট আর বস্তা কাটার উৎসবে মেতে উঠতো। যা-ই সংগ্রহ করতো, সেগুলো নিয়ে জমাতো গর্তের ভেতর তাদের থাকার ঘরে। অন্য ইঁদুরেরা বাদাম, আখরোট ইত্যাদি যে যা পেত, খেয়ে পেট ভর্তি করে নিতো।

দোকানদার যত ওষুধ আর বিষই ছড়াতো, কোনো কাজ হতো না। দুই-একটা হয়তো মরতো, কিন্তু চারটা নতুন জন্ম নিতো। বন্ধুরা, যারা এ ধরনের সমস্যায় পড়েছিল, তারা চমৎকার একটা বুদ্ধি দিলো। তারা বলল, ‘ওষুধ-ফসুদে কোনো কাজ হবে না, এক কাজ করো, মোটা তাজা দেখে একটা বেড়াল এনে দোকানে রেখে দাও। দেখবে, ইঁদুরের বংশ ধ্বংস হয়ে গেছে।’

দোকানদার অনেক ঘুরে ফিরে শেষ পর্যন্ত মোটাতাজা একটা বেড়াল পেল। বেড়ালটা দিনভর এটা-সেটা খেয়ে দোকানের সামনেই ঝিমাতো, আর রাত হলেই দোকানের ভেতর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকাতো। অপেক্ষায় থাকতো কখন ইঁদুর বেরিয়ে আসে। ইঁদুর বের হলেই বেড়াল হামলা চালিয়ে কাজ সারা করে দিত।

এভাবে বেড়ালের উপস্থিতিতে ইঁদুরেরা আর আগের মতো দোকানের বস্তা কাটার উৎসব পালন করতে পারতো না। দোকানদার পরিস্থিতির উন্নতি দেখে খুব খুশি হলো। এখন আর ইঁদুরের দল তার দোকানের মালামাল নষ্ট করে না বা নিয়ে যায় না। বেড়ালও দোকানদারের ওপর খুব খুশি, কেননা সে তাকে দিনভর খাবার দেয়, বিশ্রামের সুযোগ দেয়।

তবে কিছু ইঁদুর বেড়ালের তন্দ্রার সুযোগ নিতে শুরু করলো। বস্তা কেটে নিজের জন্যে এবং অন্যদের জন্যেও খাবার নিয়ে যেতে লাগলো। দোকানদার এই দুই-একটা চোর ইঁদুরকেও কীভাবে পাকড়াও করা যায়, ভাবল। ভেবেচিন্তে সে দিনের বেলা বেড়ালটাকে কম খেতে দিতে শুরু করলো, যাতে রাতে বেড়ালের ক্ষিদে লাগে, আর ক্ষিদের কারণে বেশি বেশি ইঁদুর শিকার করে।

কয়েক সপ্তাহ এভাবে চলার পর, মোটাতাজা বেড়ালটি খাবার কম পেয়ে শীর্ণ হয়ে গেল। ক্ষুধার কারণে সে রাতে অনেক বেশি ইঁদুর শিকার করতে লাগলো। এতে ইঁদুরগুলোও দোকানের জিনিসপত্রের ওপর খুব একটা হামলা করতে পারছিল না। তবে বেড়াল খাবার না পাবার কারণে আগের মতো সন্তুষ্ট থাকলো না। দোকানদারও তার দিকে নজর দিচ্ছে না দেখে বেড়াল এবার নিজেও দোকানের খাদ্য সামগ্রীর ওপর হামলা করার কথা ভাবতে লাগলো।

ইঁদুরেরা বিষয়টি লক্ষ করলো এবং সবাই মিলে বৈঠকে বসল। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ইঁদুরগুলো বস্তা, প্যাকেট, এটাসেটার ফাঁকফোঁকরে একসাথে লুকিয়ে সাহসের সাথে মাথাটা বের করলো। সাহসী ইঁদুরটি বেড়ালের উদ্দেশ্যে বলল, ‘শোনো! আমার ওপর হামলা করার আগে এক মিনিট আমার কথা শোনো। তুমি নিশ্চিত থাকো, পালানোর পথ ঠিক করা আছে, তুমি আমার নাগাল পাবে না। তবে আমার কথাটা শুনলে তোমার উপকারও হতে পারে।’

বেড়াল চিন্তাভাবনা করে বলল, ‘ঠিক আছে, বলো!’

ইঁদুর বলল, ‘তুমি আসার পর থেকে আমাদের অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে, না খেতে পেয়ে মরার মতো অবস্থা।’

বেড়াল বলল, ‘তাই তো হবার কথা! তোমরা ভিন্ন কিছু আশা করছিলে নাকি?’

ইঁদুর বলল, ‘না, তা না… তবে একটু ভেবে দেখো, দোকানদার হলো মানুষ, আর তুমি এবং আমরা তো…’

বেড়াল ভেবেছিল ইঁদুর তাকে ছোট করার চেষ্টা করছে, তাই মাথা তুলতেই ইঁদুরটাও ঢুকে গেল বস্তার ফাঁকে। ঢুকেই বলল, ‘তুমি আমার কথাটা শোনো। গত ২-৩ সপ্তাহ ধরে দোকানদার তোমাকে এত কম খেতে দিচ্ছে যে কয়দিন পর হয়তো তোমার আর শিকার করার মতো শক্তিও থাকবে না।’

বেড়াল ভাবল, ইঁদুর তো ঠিকই বলছে। সে একটু সংযত হলো। বলল, ‘তাহলে কী বলতে চাও তুমি?’

ইঁদুর এবার একটু সামনে এসে বলল, ‘ক্ষুধায় তোমারও নিশ্চয়ই ইচ্ছে করে দোকানের মজার মজার খাবারের বস্তায় বা প্যাকেটে আঁচড় বসাতে, তাই না? নাহলে আমরা যদি অন্য কোনো গর্তে গিয়ে আশ্রয় নেই, তুমি তো মরে যাবে না খেয়ে। তাই আমাদের প্রস্তাব হলো, তুমি রাতের বেলা ঘণ্টাখানেক একটু বিশ্রাম নাও, আমরা এই ফাঁকে আমাদের কাজটা সেরে নেবো। বিনিময়ে তোমার জন্যেও পর্যাপ্ত খাবার আমরা দোকানের এক কোণে জমিয়ে রাখবো। তুমি তো আর তোমার ঐ ভোঁতা নখ দিয়ে বস্তা কাটতে পারবে না, তাই না?’

বেড়াল মনে মনে সাতপাঁচ ভেবে ইঁদুরকে পরীক্ষা করার জন্য বলল, ‘আমি আজ ভীষণ ক্লান্ত, ঘুমাবো। তোদের যা খুশি কর, যাহ!’

ইঁদুরেরা বুঝল, বেড়াল তাদের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেছে। গর্তে ফিরে গিয়ে সবাইকে নিয়ে রাতে হামলা চালালো যার যার পছন্দের খাবারের ওপর। ইচ্ছেমতো খেলো এবং নিয়েও গেল। আর কিছু খাবার রেখে গেল বেড়ালের জন্য।

ইঁদুরেরা চলে যাবার পর বেড়াল খাবারগুলো পেট ভরে খেয়ে দুই হাতের ওপর মাথাটা এলিয়ে দিয়ে ঘুমালো। পরের কয়েক রাতেও ইঁদুর-বেড়াল পারস্পরিক সহযোগিতামূলক চুক্তি ও কর্মসূচি ঠিকঠাকভাবেই বাস্তবায়িত হলো। এখন ইঁদুরেরাও খুশি, বেড়ালও খুশি।

কিন্তু বেচারা দোকানদার বুঝতেই পারল না যে এভাবে ‘বেড়ায় ক্ষেত খেয়ে’ যাচ্ছে। এই ঘটনা জানাজানি হয়ে গেল নিমেষেই। তারপর থেকে যখনই দুই শত্রুর মাঝে সমঝোতা হয় কিংবা দুই শত্রুর পারস্পরিক মিল হবার কারণে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন সবাই বলে:

‘ইঁদুর-বেড়ালের সমঝোতা, দোকানদারের বারোটা’।

 

কীসে আনন্দ? যেখানে অন্তর খুশি

জাদুর যাঁতা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *