ইঁদুর তাড়ানো তাবিজ (রম্য গল্প) —শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

 

অগ্রহায়ন মাস। সব ঘরেই এলোমেলো ভাবে ধান ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা আছে। ঘরে বা উঠানে ধান একদিন বা দু’দিন রাখলেই ইঁদুর মাটি ফুঁড়ে গর্ত করে মাটির নিচে নিয়ে যায়। ইঁদুরের এই উৎপাত থেকে কোন ভাবেই রেহাই পাওয়া যাচ্ছে না। এমন কি ঘরে তুলে রাখা কাঁথা কাপড়গুলাও কেটে টুকরো টুকরো করে দিচ্ছে।

ইঁদুরের উৎপাত সহ্য করতে না পেরে দাদী দাদাকে দিয়ে হাট থেকে ‘ইদুরের যম’ নামে ইঁদুর মারার বিষ টোপ কিনে এনেছেন্। সন্ধ্যার সময় দাদী ইঁদুরের মুখরোচক খাবার শুটকির গুড়া, চাউল ভাজা, গম ভাজা ইত্যাদির সাথে বিষ টোপ মিশিয়ে যেখানে ইঁদুরের গর্ত আছে ঠিক তার উপরে কিছু কিছু করে বিষ টোপ দিয়ে রেখেছেন। এমনভাবে খাবারগুলো দাদী রেখে দিয়েছেন, ইঁদুর গর্ত থেকে বের হলেই খাবারগুলো সামনে পরবে অমনি মজা করে খেয়ে মরে যাবে। খাবারগুলো শুধু দু’এক জায়গায় নয় বাড়ির ঘরে-বাইরে যেখানেই ইঁদুরের গর্ত দেখেছেন সেখানেই বিষ টোপ দিয়েছেন। বিষ টোপ প্রয়োগ করে দাদী মনে মনে ভেবেছেন, এই বিষ টোপ খেয়ে ইঁদুর লাইন ধরে মরে থাকবে, আর সকাল বেল তিনি লেজ ধরে ধরে দুরে ফেলে দিয়ে আসবেন। এই ভেবে হয়তো দাদী সারা রাত নিশ্চিন্তে মনের সুখে ঘুমিয়েছেন। কিন্তু দুখের বিষয় সকাল বেলা সারাবাড়ি খুঁজে একটা মরা ইঁদুরও পাওয়া গেল না। গর্তের উপর যেমনভাবে বিষ টোপ দেয়া ছিল তেমনই পড়ে আছে। অবস্থা দেখে দাদী মনের দুখে ইঁদুর না মরার রাগটা দাদার উপর ঝাড়তে লাগলেন। দাদাকে শুনিয়ে শুনিয়ে জোরে জোরে বললেন, বুড়া হইলে মাইনষের হুঁশ জ্ঞান কম হয় জানি, কিন্তু এতো কম হয় তা তো জানি না। এতো কইরা কইলাম, যত ট্যাকা লাগে ইঁন্দুরের ভাল বিষ টোপ কিনা আনার জন্যে, যাতে ইঁন্দুর একবার খাইলেই মইরা যায়, উনি এমন বিষ টোপ কিনা আনছেন, ইন্দুর মরা তো দুরের কথা বিষ টোপ খায়া ইন্দুর আরো উল্টা নাচানাচি শুরু কইরা দিছে। একটা ইঁন্দুরও মরে নাই। এমন ব্যাক্কল বুইড়া আমার কপালে জুটছিল। সারাটা জীবন খালি ভুইগা গ্যালাম।

দাদা ঘরেই বসা ছিল। দাদীর খোঁচা মারা কথা দাদার পৌরুষত্বে আঘাত হানল। তিনি মুহুর্তেই চটে উঠলেন। গলায় জোর খাটিয়ে দাদীকে ধমক দিলেন। কিন্তু পরক্ষণেই আবার চুপ হয়ে গেলেন। কারণ সারাবাড়িতে বিষ টোপ খেয়ে একটা ইঁদুরও মরে নাই। দাদীর খোঁচা মারা কথা দাদার সহ্য হওয়ার কথা নয়। বয়সকালে দাদার মুখের উপর কথা বলা তো দুরের কথা, চোখ তুলে তাকাতেও দাদীর সাহস হতো না। এখন বুড়া হয়েছেন। দাদা বুড়া হলে কি হবে এখনও গায়ে যথেষ্ট শক্তি আছে। কারো খোঁচা মারা কথা তো দুরের কথা, সামান্য অন্যায় পেলেও তাকে ছেড়ে দেন না। দাদা এমন প্রতিবাদী মানুষ হয়েও দাদীর আলপিনের খোঁচার মত কথাগুলো সহ্য করে গেলেন। তবে রাগে দুখে বাড়ির ভিতরে নয় বাড়ির বাইরে চলে গেলেন।

এদিকে ইঁদুর মরে নাই দেখে দাদী বিষ টোপগুলো পরিস্কার করার কথা চিন্তাও করেন নাই এবং কাউকে পরিস্কার করতেও বলেন নাই। দাদী না বলার কারণে বিষটোপ পরিস্কার করার কথা কেউ মুখেই আনে নাই। যেখানে যে অবস্থায় বিষ টোপ ছিল ঔ অবস্থায় পড়ে থাকল।

সকাল দশটার দিকে হঠাৎ বাড়িতে হইচই শুরু হয়ে গেল। ইঁদুর না মরলে কি হবে বাড়ির পোষা মুরগীগুলো ঠিকই মরা শুরু হয়েছে। ইঁদুর বদমায়েসগুলো না খেলেও সারা রাতের অনাহারী মুরগীগুলো খোয়ার থেকে ছাড়া পেয়েই ক্ষিদের জ্বালায় মুখোরচক বিষ টোপগুলো টপাটপ গিলে ফেলেছে। বিষয়টি কেউ লক্ষ্যই করে নাই। চোখের সামনে দেখতে দেখতেই অর্ধেক মুরগী মরে সাফ। দাদী মরা মুরগীগুলো জড়ো করে মাথায় হাত দিয়ে হায় হায় করতে লাগলেন। এদিকে মুরগী মরার খবর পেয়ে দাদা কোত্থেকে যেন হন্ত দন্ত হয়ে ছুটে এলেন। মুরগী মরার জন্য নয়, তার ক্রয় করা বিষ টোপ যে দুই নম্বর নয়, আসল বিষ টোপ, মুরগী মরে এটা প্রমাণ হওয়ায় তিনি বাহাদুর সেজে গেলেন। দাদীর বকঝকায় চুপসে যাওয়া দাদার গলা সপ্তমে উঠে গেল। দাদীর উপর হাম্বাই তাম্বাই শুরু করে দিলেন। দাদীকে তিনি যাইচ্ছে তাই গালাগালি করতে লাগলেন। এমন অবস্থা শুরু করে দিলেন, পারলে দাদীকে লাঠি নিয়ে মারতে যান। কেউ তাকে শান্ত হতে বললে দ্বিগুন জোরে চিৎকার করে উল্টো তাকে ধমক দিয়ে উঠেন। দাদার তর্জন গর্জনে দাদী মেচি বিড়াল হয়ে গেলেন। ডরে ভয়ে দাদার গালাগালির কোন জবাবই দিলেন না। শুধু মরা মুরগীগুলো জড়িয়ে ধরে হায় হায় করে কাঁদতে লাগলেন। এতোগুলো মুরগী মরায় দাদী মাথায় হাত দিয়ে ঠায় বসে থাকলেন। মুরগীর শোকে দু’দিন ভাতই খেলেন না।

কয়েক দিন পরের ঘটনা। দাদী বাড়ীর সামনে দাঁড়িযে আছেন। এমন সময় দু’জন বেদেনী সামনের রাস্তা দিয়ে, ’শিঙা লাগাই, রস খসাই, বাত খসাই’ ইত্যাদি নানা ধরনের আকর্ষণীয় বাক্য বলতে বলতে যাচ্ছিল। দাদিকে দেখে বেদেনী দু’জন রাস্তা থেকে বাড়িতে চলে আসল। এসেই দাদীকে লক্ষ্য করে বলল, শিঙা লাগাবি বু।
দাদীর মুরগী মরার শোক তখনও যায় নাই। সেই দুখে দাদী ডান হাত নাড়িয়ে তাড়াতাড়ি জবাব দিলেন, না না, আমার কোন বাত বেদনা নাই, আমার শিঙা লাগান লাগবো না। তোমরা অন্য বাড়ি যাও।
দাদী যতই না না করতে থাকেন ততই তারা দাদীকে পটানোর চেষ্টা করতে থাকে। দাদীও শক্ত মনের মানুষ কোন ভাবেই তাদের কথায় রাজী হয় না। বেদেনীরাও নাছোর বান্দা। কোন না কোনভাবে দাদীকে পটাতেই হবে এমন শপথ নিয়ে বসেছে। তারা যখন দাদীকে পটানোর চেষ্টা করে ব্যার্থ হয় হয় অবস্থা, ঠিক তখনই একটি ইঁদুর পাশের ধানের খড়ের পালার ভিতর থেকে বের হয়ে অন্য খড়ের পালায় গিয়ে ঢুকল। ইঁদুরের দৌড়ানো দেখে অল্প বয়সী বেদেনী বলে উঠল, কি গো বু, তর বাড়িতে দেহি ইন্দুরের খামার, দিনের বেলায় ইন্দুর ঘুইরা বেড়ায়, ইন্দুরের চিকিৎসা করস না ক্যা?

ইঁদুরের কথা বলায় দাদীর মুখটা কালো হয়ে গেল। দু’দিন আগে ইঁদুর মারতে গিয়ে বিষ টোপে অনেকগুলো মুরগী মেরেছেন। বুকের মধ্যে সেই জ্বালা এখনো জ্বলছে। বেদেনীর কথায় দাদীর জ্বালা আরো বেড়ে গেল। মুখটা ঝামটা দিয়ে বলে উঠলেন, আরে ব্যাক্কল মহিলা কস্ কি? আমরা চাই ইন্দুর মইরা সাফ হয়া যাক, তুই আবার ইন্দুরের চিকিৎসা করবার কস্। বিনা চিকিৎসায়ই ইন্দুর বাড়ি ভইরা গ্যাছে। চিকিৎসা করলে তো ইন্দুরের জ্বালায় বাড়িতেই থাকা যাইবো না।
যুবতী বেদেনীটা লম্বা টানে কথা বলে উঠল, আরে — বু — ইন্দুরের রোগের চিকিৎসা করবার কই না–, ইন্দুর যাতে ঘরে না থাকে– হেই চিকিৎসা করবার ক– ই–। ইন্দুর খ্যাদাইনা তাবিজ দিমু, ইন্দুর ঘর ছাইড়া পলাইতে দিশা পাইবো না। আল্লাহ রসুলের দোহাই দিয়া কইতেছি, কোন পয়সা নিমু না, তাবিজ নিয়া সন্ধা রাইতে ঘরের দরজায় বাইন্ধা হুইয়া থাকবি, দেখবি একটা ইন্দুরও ঘরে ঢুকবো না। ইন্দুরের উৎপাত না থাকলে আরামে ঘুমাবি, আরামে থাকবি, জিনিস-জানা নষ্ট হইবো না।
কথাটি যেন দাদীর মনঃপুত হলো। তাবিজ বেঁধে দিলে যদি ইঁদুর ঘর ছাড়া হয়, তা হলে তো এটাই ভালো। বিষ টোপ গিলে আর কোন মুরগী মরবে না। দাদীর শক্ত মন মুহুর্তেই পরিবর্তন হয়ে গেল। দাদী তাবিজ নিতে রাজী হলো। তারা পয়সা নিবে না বললেও, নানা রকম কথার কলা কৌশল প্রয়োগ করে, আল্লা রসুলের দোহাই দিয়ে, হাজার লোকের সিন্নি খাওয়ানোর কথা বলে, অবশেষে তিন সের চাল দাদীর কাছ থেকে নিয়েই ছাড়ল।
তিন সের চাল পেয়ে বয়স্ক বেদেনী তার ঝোলা থেকে বিভিন্ন রকম গাছের ডাল, শিকড়-বাকড় বের করে, তার থেকে এক ইঞ্চি পরিমান একটি শিকড় চাকু দিয়ে কেটে, লাল সুতা দিয়ে বেঁধে, দাদী যে ঘরে থাকে সেই ঘরের দরজার উপরের চৌকাঠের সাথে সুতা দিয়ে বেঁধে দিল। গাছের শিকড়টি বেঁধে দেয়ার সময় ছন্দাকারে ইঁদুর তাড়ানো একটি মন্ত্র পড়ল —

ইন্দুরেরি হুড়াহুড়ি,
ইন্দুরেরি দোড়াদোড়ি,
ইন্দুরের মাথায় বাঁশ
পথে ঘাটে মারা যাবি
যদি কিছু খাস।

মন্ত্রটি কিছুটা জোরে জোরেই বলল। মন্ত্রটি পড়ে ঝুলানো তাবিজের দিকে তিনটা ফুঁ দিয়ে দিল। বেদেনীর ছন্দাকারে মন্ত্র পড়া দাদীর খুব মনঃপুত হলো। দাদীর খুশি খুশি ভাব দেখে বয়স্ক বেদেনী দাদীর কাছে আরো কিছু দাবী করার চেষ্টা করল কিন্তু দাদী রাজী হলো না। দাদী বলল, যদি ইন্দুর ঘর ছাইরা যায়, তাইলে সাত দিন পরে আইসিস, আরো চাল দিয়া দিমু।

বেদেনী চাল পেয়ে ঝোলা কাঁধে নিয়ে চলে গেল। দাদী ঘরের দরজায় তাবিজ ঝুলিয়ে রেখে রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমালেন। তার মনে হলো ইঁদুর কিছুটা কমেছে। তাই কাঁথা-বালিশ, কাপড়-চোপড়, ধান-চাল যেখানে যা আছে তা পরীক্ষা করা আবশ্যক মনে করলেন না। কয়েক দিন পরে হঠাৎ দিনাজপুর থেকে দাদীর ভাগ্নী জামাই বেড়াতে এলেন। জমাইটি নতুন। এর আগে কখনও আসেন নাই, তাই তাকে আদর যতেœর সাথে ভালো বিছানা দেয়া দরকার। রাতে জামাইয়ের জন্য ছিকায় তুলে রাখা নিজ হাতে সেলাই করা নকসী কাঁথা বের করতে গিয়ে থমকে গেলেন। ইঁদুরে কাঁথা কেটে ভিতরে বাসা বেঁধেছে। কাঁথার অবস্থা দেখে দাদী মাথায় হাত দিয়ে হায় হায় করতে লাগলেন। এর আগে ইঁদুরে অনেক কিছু কেটেছে কিন্তু ছিকায় তুলে রাখা কাঁথা কখনও কাটে নাই। তাবিজ নেয়ার পর ইঁদুর আরামে বসে বসে তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিষটি কেটে টুকরো টুকরো করেছে। কাঁথার টুকরাগুলো হাতে নিয়ে বেদেনীর চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করে খানিক বকাবকি করে মনের ঝাল মিটালেন। কিন্তু বকাবকি করলে কি হবে কাঁথা তো আর ভালো হবে না। বাধ্য হয়ে অন্য কাঁথা বের করে জামাইয়ের বিছানার ব্যাবস্থা করে দিলেন। কিন্তু মনের ভিতর বেদেনীদের উপর তার প্রচন্ড ক্ষোভ জমা থাকল।

দু’দিন পরেই আরেক দল বেদেনী এসে ‘রস খসাই, শিঙা লাগাই, বাত খসাই’ বলে যেই চিৎকার চেচামেচি শুরু করেছে, অমনি দাদী বাড়ির সামনে গিয়ে তাদের হাত ইশারায় ডাক দিলেন। বেদেনীরা দাদীর হাত ইশারায় খুশি হয়ে চলে এলো। কাছে আসার সাথেই দাদী রণমূর্তী ধারণ করে তাদের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করে বকাবকি শুরু করলেন। তার রণমূর্তীর ভাব ভঙ্গী আর বকাবকি দেখে বেদেনীরা থতমত খেয়ে দাদীর মুখের দিকে চেয়ে রইল। দাদীর বকাবকি কিছুটা কমে আসলে একজন বেদেনী দাদীকে বলল, বু– রে–, তুই যত পা-রো–স গাইল দে, গাইল দিতে না করমু না, আরো– গাইল দে, কিন্তু তুই খুইলা ক তো–, তর সমস্যাডা কি–?
বেদেনীর কথায় দাদী আরো রেগে গিয়ে বললেন, আরে হারামজাদীরা তিন সের চাল নিয়া ইন্দুর খ্যাদাইনা তাবিজ দিয়া গ্যাছোস। হাউস কইরা জামাই ঝির জন্য খ্যাতা সিলাই কইরা রাখছি, তাবিজ দেওয়ার পরে হেই খ্যাতা ইন্দুরে কাইটা শ্যাষ করছে। তারপরেও কস্ সমস্যাডা কি?
— আরে বু–, তাবিজ যে দিছে তারে না গাইল দিবি, আমরা তো তরে তাবিজ দেই নাই, তুই আমাগোরে হুদাহুদি গাইল দ্যাশ ক্যা?
— তগো গাইল দিমু না তো কারে গাইল দিমু। যারা তাবিজ দিছে তারা তো তগো গুষ্ঠি, হেই জন্যে তগো গাইল দেই।
সাথের আরেক বাইদানী তখন বলে উঠল, বু– রে–, মাথাডা ঠান্ডা কইরা আমার একটা কথা শোন। তাবিজটা যে দিছিল, ক্যামনে দিছিল।
দাদী তাবিজ বাঁধার নিয়ম কানুনসহ পুরো কাহিনী বললে বেদেনী হাসি দিয়ে বলল, সেই জন্য তো ইন্দুর ঘর থাইকা বাইর হয় নাই। বুঝছি, ওরা আসল বাইদানী না। আসল বাইদানী হইলাম আমরা। ঘরের দরজায় একটা তাবিজ দিলে ঘর বন্ধ হয় না। ঘরের চার কোনা বন্ধ করা লাগে। আর যে মন্তর পড়ছে ওইডা ইন্দুর খ্যাদাইনা মন্তর না। এই জন্য ঘর বন্ধ হয় নাই। আমরা ঘর বন্ধ কইরা যাই, দেখবি, একটা ইন্দুরও ঘরে ঢুকবো না। বলেই ঝোলা থেকে চারটি শিকড় বের করে কালো সুতা দিয়ে বেঁধে ঘরের চার কোনায় চালের সাথে একটি করে বাঁধে আর মন্ত্র পড়ে—

হারে ইন্দুর, ইন্দুরের গুষ্ঠী
চাল খাবি এক মুষ্ঠি
মনের মধ্যে রাখবি তুষ্টি
খ্যাতা বালিস যদি খাস
মাথার উপর পড়বো বাঁশ।

বলেই একটি করে ফুঁ দেয়। ঘরের চার কোনায় চারটি তাবিজ বেঁধে আল্লাহ রসুলের দোহাই দিয়ে তাবিজের মূল্য নিবে না বলে সিন্নির চাল দাবী করে বসল। দাদী দিতে নারাজ হলে, দাদীর ছেলে-মেয়ে, নাতি-পুতির উপর বালা মুসিবত সহ নানা রকম ক্ষয়-ক্ষতি হওয়ার ভয় ভীতি দেখিয়ে দের শের চাল নিয়েই ছাড়ল। এরা চলে যাওয়ার পর দাদীকে খুব খুশি খুশি মনে হলো। কারণ এদের মন্ত্র পড়া এবং তাবিজ বাঁধার নিয়ম কানুন দাদীর খুব মনঃপুত হয়েছে। দাদীর মনে হয়েছে এবার মন্ত্র এবং তাবিজ ভালো কাজ করবে। তারপরেও তার ভিতরে কিছুটা অবিশ্বাস কাজ করতে লাগল তাই তিনি ইঁদুর যাতে কিছু না কাঁটে সেদিকে সতর্ক থাকলেন। প্রায় দিনই কাঁথা বালিশ পরীক্ষা করে দেখতেন ইঁদুরে কাটল কিনা। এই তাবিজ নেয়ার পর ইঁদুর আর কোন কাঁথা বালিশ কাঁটে নাই। দাদী মনে মনে বেদেনীদের উপর খুশিই হলেন।

প্রায় একমাস পরের ঘটনা। পাশের গ্রামে বিয়ের দাওয়াত। বিয়ে বাড়িতে একটু সেজে গুজে যাওয়া দরকার। গত বছর দাদীর বড় মেয়ের জামাই দাদীকে একটি ভালো শাড়ী কিনে দিয়েছেন। দাদী শাড়ীটি একবারও পরেন নাই। কোন অনুষ্ঠানে শাড়ীটি পরে যাবেন এমন আশা নিয়ে কাঠের বাক্সে ভালো করে গুছিয়ে রেখেছেন। বিয়ের দাওয়াতে সেই শাড়ীটি পরার জন্য কাঠের বাক্স খুলে বের করতে গিয়ে থ হয়ে গেলেন। ইঁদুর কাঠ কেঁটে বাক্সের ভিতর ঢুকে তার সেই শাড়ীটিসহ ভালো ভালো কাপড়গুলো সবই কেঁটেছে। ইঁদুর কাটা শাড়িগুলো হাতে নিয়ে দাদী প্রায় কেঁদেই ফেললেন। বেদেনীদের চৌদ্দগুষ্ঠি নয় আরো যদি কোন গোষ্ঠি থাকে, সেটা তুলেও বকাবকি করতে লাগলেন। বেদেনীদের উপর দাদীর মনের ক্ষোভ আরো দ্বিগুন আকার ধারন করল। ক্ষোভে দুখে দাদী আমাকে সহ আরো নাতীদের ডেকে আদেশ দিলেন, এই শোন, তোরা বাইাদানী যেইখানে পাবি, সেইখান থিকাই চুলের মুঠি ধইরা টাইনা হেঁইচড়া আমার কাছে নিয়া আসবি।

দাদীর এই আদেশ দেয়ার তিন দিন পরেই দেখি দু’টি বেদেনী বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। একটির কাঁধে ঝোলা, আরেকটির মাথায় সাদা কাপড় দিয়ে বাঁধা ছোট বড় দু’টি কাঠের বাক্স। দৌড়ে গিয়ে দাদীকে বেদেনী আসার খবর দিলাম। দাদী সাথে সাথে বলল, মাগীদের চুলের মুঠি ধইরা নিয়া আয়। মাগীদের মিছা কথার মুখে আইজকা ঝাড়– পিটান দিমু।

দৌড়ে গিয়ে বেদেনীদের ডাক দিতেই খুশি হয়ে তারা আমার পিছনে পিছনে বাড়ির উঠানে চলে এলো। বাড়ির উঠানে এসে একজন ঝোলা কাঁধে দাঁড়িয়ে আছে আরেকজন মাথার পোটলা নামিয়ে কেবল সাদা কাপড়টি খুলে কাঠের বাক্স বের করেছে। অমনি দাদী বাড়ির ভিতর থেকে দৌড়ে এসে ঝাড়– উল্টা পাশে ধরে অগ্নিমুর্তি ধারণ করে বেদেনীদের মারতে উদ্যত হলেন। দাদীর মারের ভাব দেখে ঝোলাওয়ালা মহিলা ঝোলা নিয়েই দিল দৌড়, তার পাছে পাছে পোটলাওয়ালা মহিলা কাঠের বাক্স রেখেই দৌড়ে পালালো। বেদেনীদের উপর রাগ ঝাড়তে না পেরে বেদেনীদের রেখে যাওয়া কাঠের বাক্সের উপর দাদী রাগ ঝাড়তে লাগলেন। বেদেনীদের গালাগালি করতে করতে কাঠের বাক্সের উপর বাড়ি দিতেই বক্সের উপরের ঢাকনা খুলে গেল। ঢাকনা খোলার সাথে সাথেই বাক্সের ভিতর থেকে গুখরো সাপ মাথাটা এক হাত উঁচু করে ফোঁস করে উঠল। সাপ ফোঁস করার সাথে সাথেই দাদী ‘ওরে বাবারে’ বলে একটা চিৎকার দিয়ে বাড়ির ভিতরে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। তার আঁৎকা চিৎকার শুনে দাদা ঘরের ভিতর থেকে এক দৌড়ে ঘরের বাইরে চলে এলেন। ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসে সাপের ফোঁস ফোঁসানি দেখে তিনিও ‘আঁউ আঁউ’ করতে করতে চিৎকার দিয়ে বাড়ির ভিতর গিয়ে উল্টে পড়ে গেলেন। দাদা দাদীর গলা ফাটানো চিৎকার শুনে আশেপাশের বাড়ি থেকে লোকজন ছুটে এলো। বাড়ি লোকজনে ভরে গেল। মহা হুলুস্থুল কান্ড। দাদা-দাদী দু’জনই জ্ঞান হারিয়েছেন। তাদের এই অবস্থা দেখে কেউ মাথায় পানি ঢালছে, কেউ বুকে-পিঠে গরম তেল মালিশ করছে। উভায়ের জ্ঞান ফেরানো নিয়ে সবাই ব্যাস্ত।
অনেক ক্ষণ পরে দাদার জ্ঞান ফিরে এলো। দাদাকে একজন জিজ্ঞেস করল, আপনার এ অবস্থা হলো কেমনে? দাদার তখনও সাপের ভয় কাটে নাই। মুখ দিয়ে শুধু ‘সাপ সাপ’ উচ্চারণ করলেন। ইতিমধ্যেই দাদীরও জ্ঞান ফিরেছে। দাদীর জ্ঞান ফিরলে তাকিয়ে দেখে আমি সামনে দাঁড়ানো আছি। অমনি চোখ দু’টা বড় বড় করে বললেন, এই ব্যাক্কেল, আমি তরে কইছি শিঙা লাগাইনা বাইদানী ডাকতে। তুই সাপওয়ালা বাইদানী ডাইকা আনছোস ক্যা?
আমি হাত নাড়িয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম, আপনেই না কইলেন, বাইদানী পাইলেই ডাইকা আনবি। তাই আনছি। ওরা যে সাপওয়ালা বাইদানী, আমি কি জানি?
আমার কথা শুনে উপস্থিত লোকজন হো হো করে হেসে উঠল। দাদী লজ্জা পেয়ে চুপ হয়ে গেলেন। কিন্তু দাদা হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, দেখতো বাইদানীরা কই? শালাগোরে বাইন্ধা পিটামু।
দাদার এ কথায় বেদেনীদের ধরার জন্য কেউ কেউ উঠে দাড়ালো কিন্তু ততক্ষণে বেদেনীরা সাপ খাঁচায় তুলে সবার অজান্তেই পালিয়ে পগার পার।

০০০ সমাপ্ত ০০০

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!