আসমানী ফয়সালা

ছোট্ট বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই আছে যাদেরকে হাতের লেখা খারাপ হওয়ার কারণে প্রায়ই বাবা-মা কিংবা শিক্ষকদের বকুনি খেতে হয়। খাবেই বা না কেন? লেখা খারাপ হওয়ার কারণে পরীক্ষার নম্বর কমে যাচ্ছে প্রতিবার। অবশ্য এ কথাও সত্য যে, সবাই চায় তার হাতের লেখা সুন্দর হোক, সবাই প্রশংসা করুক। তবে কেবল চাইলেই হবে না, সে জন্য চাই আন্তরিকতা ও ভালোবাসার সঙ্গে চর্চা। হাতের লেখা কিছুটা সাঁতার শেখার মতো। পানিতে না নামলে যেমন সাঁতার কাটা শেখা যায় না, তেমনি চর্চা না করে হাতের লেখাও ভালো করা যায় না।

হাতের লেখা সুন্দর করার চর্চা শুরু করতে হবে একদম শৈশব থেকে। কাদামাটি দিয়ে যেমন কোনো কিছুর সুন্দর একটি আকৃতি দেওয়া যায়, তেমনি একটি ছোট শিশুর কাঁচা হাতের লেখারও একটি সুন্দর রূপ দেওয়া সম্ভব। সাধারণত শিশুর হাতের লেখার হাতেখড়িটা পরিবারেই হয়। তাই প্রাথমিক দায়িত্বটা পরিবারেরই বেশি। এরপর বিদ্যালয় বা কোনো প্রতিষ্ঠানের হতে পারে।

হাতের লেখা সুন্দর করার জন্য শিশুদের মধ্যে প্রতিযোগিতার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। এক্ষেত্রে পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিংবা সামাজিক সংস্থাগুলোর এগিয়ে আসা উচিত। মদীনার মসজিদে নববীর গা ঘেঁষে ছোট্ট একটি কুঁড়েঘর। এ ঘরে স্নেহময়ী মায়ের আঁচলে বড় হচ্ছেন ছোট্ট দুই ভাই। বাবা আলী মুর্তাজার দিন কাটে এক ইহুদীর বাগানে কাজ করে। আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আমরা কাদের কথা বলছি? হ্যাঁ, আমরা মহানবী (সা.) এর প্রাণপ্রিয় দুই নাতি ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইনের শৈশবের কথা বলছি। আরবী ভাষায় হাসান ও হুসাইন নাম দুটির অর্থ প্রায় একই অর্থাৎ সুন্দর বা সৌন্দর্য। নামের মতোই এ দু’ভাইয়ের সবকিছু ছিল সুন্দর। পড়াশুনার প্রতি তাদের ছিল বেজায় ঝোঁক।

হাতের লেখা সুন্দর করার জন্য দু’ভাইয়ের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলতো। একদিনের ঘটনা। দু’ভাই হাতের লেখা শেষ করে ফেলেছেন। কিন্তু গোল বাধলো-কার হাতের লেখা বেশি সুন্দর হয়েছে, সে বিচার নিয়ে। দু’ভাই বিষয়টি মীমাংসা করার জন্য গেলেন বাবা আলী ইবনে আবি তালিবের কাছে। কিন্তু বাবা কিছুতেই বুঝতে পারছিলেন না, ফুলের মতো পবিত্র শিশু মনে কষ্ট দিয়ে কার লেখাকে ভাল আর কারটাই বা মন্দ বলবেন। অগত্যা তিনি এ বিষয়ে ফয়সালা জানার জন্য দু’ভাইকে মহানবী (সা.) এর কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন।

বাবার পরামর্শ অনুযায়ী ইমাম হাসান ও হুসাইন খুশি মনে ছুটে গেলেন নানাজীর কাছে। রাসূলেখোদা তখন মসজিদের নববীতে সাহাবীদের উপদেশ দিচ্ছিলেন। নাতিদের হাতের লেখা দেখে তিনি বললেন, আমার কাছে দু’জনের লেখায় সুন্দর লাগছে। তবে কারটা বেশি সুন্দর হয়েছে, এ ফয়সালার জন্য তোমরা বরং তোমাদের আম্মু ফাতেমার কাছে চলে যাও। সে-ই এ বিষয়ে মীমাংসা করে দিতে পারবে।

নানাজীর কথা শুনে দু’ভাই আবার দৌড়াতে শুরু করলেন বাড়ীর দিকে। ঘরে ঢুকেই তারা দেখতে পেলেন আম্মু জায়নামাযে বসে তসবিহ পড়ছেন। দু’ভাইকে কাছে টেনে নিয়ে মা ফাতেমা তাদের পেরেশানির কারণ জানতে চাইলেন। দম ছেড়ে দিয়ে দু’ভাই একসাথে বলে উঠলেন, আম্মু দেখ তো, আমাদের মধ্যে কার হাতের লেখা বেশি সুন্দর?

হযরত ফাতেমা দু’জনের লেখাই মনোযোগ দিয়ে দেখলেন। কিন্তু তিনিও কাউকে কষ্ট দিতে চাইলেন না। তাই দু’সন্তানকে উদ্দেশ করে বললেন, ও এই সমস্যা! এটা তো তোমাদের আব্বুই বলে দিতে পারতেন। মায়ের কথা শুনে ইমাম হাসান বললেন, আমরা তো আব্বুর কাছে গিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি আমাদের এ জন্য নানাজীর কাছে পাঠিয়ে দেন।

এরপর নানাজীর কাছে গেলে তিনি আমাদের হাতের লেখা দেখে খুব প্রশংসা করলেন। কিন্তু কার লেখা বেশি সুন্দর এ মীমাংসা করার জন্য আমাদেরকে তোমার কাছে পাঠিয়েছেন। এতক্ষণে মা ফাতেমা বুঝতে পারলেন ঘটনা কত দূর গড়িয়েছে। তিনি নিজেও কোন সমাধান দিতে চাইলেন না। কারণ একজনের লেখা সুন্দর বললে আরেকজন কষ্ট পাবে। অগত্যা হযরত ফাতেমা উপরের দিকে তাকালেন। যেন আল্লাহর সাহায্য চাইলেন এ গুরুত্বপূর্ণ কাজে। কিছুক্ষণ পর হযরত ফাতেমা তাঁর প্রিয় সন্তানদের বললেন, এখনই তোমাদের মীমাংসা হয়ে যাবে।

এই দেখ আমার হাতে একটা তসবিহ আছে। এতে আছে মোট তেত্রিশটি দানা। আমি এ দানাগুলো সূতো থেকে খুলে ফেলছি। এরপর ঘরের মেঝেতে সবগুলো দানা ছড়িয়ে দেব। আর তোমরা সেগুলো কুড়াতে থাকবে। যে বেশি দানা সংগ্রহ করতে পারবে তার লেখাটা হবে বেশি সুন্দর। আম্মুর এ মীমাংসা-পদ্ধতি শুনে ইমাম হাসান ও হুসাইন খুব খুশি হলেন। তারা তসবিহ্’র দানা সংগ্রহের জন্য প্রস্তুত হলে মা দানাগুলো মেঝেতে ছড়িয়ে দিলেন। শিশুরা দানা বিপুল উৎসাহ নিয়ে সংগ্রহ করতে লাগলেন। আর জায়নামাযে বসে মা ফাতেমা সে দৃশ্য দেখতে লাগলেন।

কিন্তু সময় যত এগিয়ে চললো মা ততই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়তে লাগলেন। কারণ যদি হাসান বেশি দানা কুড়ায় তা হলে হুসাইনের মনটা ভেঙে যাবে কিংবা যদি হুসাইন বেশি কুড়ায় তাহলে হাসানের কষ্ট পাবে। কিছুক্ষণের এ ভাবনায় ডুবে যাওয়া মা হঠাৎ তাকিয়ে দেখলেন আর একটি মাত্র দানা দূরে পড়ে আছে অর্থাৎ দু’ভাই ষোলটি করে দানা সংগ্রহ করতে পেরেছেন।

এই একটি দানা দিয়েই তা হলে চূড়ান্ত ফয়সালা হবে। এ কঠিন মুহূর্তে মা আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইলেন। মায়ের দোয়া আল্লাহর আরশে পৌঁছে গেল। আল্লাহর নির্দেশে আসমান থেকে নেমে এলেন জিবরাইল ফেরেশতা। এদিকে দু’ভাই ছুটে চলেছেন ওই দানাটি কুড়িয়ে নেবার জন্য। হঠাৎ দেখা গেল, অবশিষ্ট তসবিহ দানাটি সমান দু’ভাগে ভাগ হয়ে দু’ভাইয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে!

জিবরাইল ফেরেশতা দানাটিকে দ্বিখন্ডিত করে দিয়েছেন। অবশেষে দু’ভাই কুড়িয়ে নিলেন একটি করে টুকরো। এবার গণনার পালা। দু’জনের দানাগুলো আলাদাভাবে গুণে দেখা গেল, প্রত্যেকে কুড়িয়েছে সাড়ে ষোলোটি করে দানা। মায়ের বুকটা শান্তিতে ভরে গেল। আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতায় ভরে গেল তাঁর মন-প্রাণ। তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহ! তোমাকে শতকোটি শুকরিয়া। আমার বাচ্চাদের তুমি কষ্ট থেকে রক্ষা করেছো। আর সম্মান রেখেছো আমার। হে আল্লাহ! তোমার মীমাংসাই শ্রেষ্ঠ। তুমিই চূড়ান্ত ফয়সালাকারী।’

এতক্ষণ শিশুরা মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করছিলেন, মা কী বলেন তা শোনার জন্য। আল্লাহর শুকরিয়া জানানোর পর মা দু’সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর বললেন, তোমাদের ফয়সালা আসমান থেকে হয়ে গেছে বাবা। তোমরা দু’জনই একই সমান তসবিহ দানা কুড়িয়েছে। কাজেই তোমাদের দু’জনের হাতের লেখাই সমান সুন্দর। যেমনটা তোমাদের নানাজী বলেছিলেন।

এ কথা শুনে দু’ভাই খুব খুশি হলেন। এমন সুন্দর আসমানী ফয়সালা পেয়ে তারাও আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন।

সোনার মখমল

বেড়াল যখন বিচারক

বেড়াল যখন বিচারক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *