আশ্চর্য মণিরত্ন-১

বহুকাল আগের কাহিনী। এক গ্রামে এক মা তার এক ছেলেকে নিয়ে বসবাস করতো। ছেলে তখনো কোনো কাজকর্ম করতো না। মা যা জোগাড় করতো তা দিয়েই তাদের জীবন চলতো। ছেলের কোনো আয় রোজগার ছিল না। একদিন মা ছেলেকে বললো: বাবা! এই টাকাটা নাও। বাজারে গিয়ে কিছু রুটি কিনে আনো।

 

ছেলে তো মায়ের অনুগত সন্তানের মতো টাকাটা হাতে নিয়েই পাড়ি জমালো বাজারের উদ্দেশ্যে। কিছুটা পথ গিয়েই দেখলো একদল দুষ্টু ছেলে কী নিয়ে যেন দুষ্টামি করছে।  এগিয়ে যেতেই দেখে একটা নিরীহ বিড়ালকে দড়ি দিয়ে বেঁধে দুষ্টেরা খেলছে, মজা করছে, একবার এদিকে টানছে আবার অন্যদিকে, আর বেড়ালটা কষ্টে মিউ মিউ শব্দ করে কাঁদছে।

 

ছেলেটার মন কেঁদে উঠলো বেড়ালের জন্য। সে দুষ্টু ছেলেদের কাছে গিয়ে বললো: বাচ্চারা! তোমরা বেড়ালটাকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছো কেন। ওকে ছেড়ে দাও।

 

দুষ্টুরা বললো: এমনিতেই ছেড়ে দেবো? তোর এতো মায়া লাগলে কিনে নিয়ে ছেড়ে দে!

 

ছেলেটা বললো: তোমরা বিক্রি করবে বেড়ালটাকে? ওর দাম কতো?

দুষ্টুরা বললো: হ্যাঁ, বিক্রি করবো। দাম খুব একটা বেশি না, সস্তাই। অর্ধেক রুটির দামের চেয়েও কম।

ছেলেটা বললো: এই নাও টাকা।

মায়ের দেওয়া সব টাকা দিয়ে সে বেড়ালটাকে কিনে নিলো এবং ছেড়ে দিলো। এরপর ভাবলো টাকা তো শেষ, বাজারে গিয়ে তো আর লাভ নেই। রুটি কেনার পয়সা তো নেই। তাই সে ফিরে গেল বাসায়।

 

মা ছেলেকে খালি হাতে বাসায় ফিরেছে দেখে জিজ্ঞেস করলো: ঘটনা কী! রুটি কোথায়! খালি হাতে ফিরেছো কেন…?

 

ছেলে তার মাকে পুরো ঘটনা খুলে বললো। মা ছেলের কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। ছেলে আস্তে করে বললো: মা! এক বেলা রুটি না খেলে কী আর এমন হবে! কিন্তু একটা নিরীহ প্রাণীর জীবন তো আমাদের এটুকু কষ্টের বিনিময়ে বাঁচলো, তাই না?

মা আর কিছু বললো না। পরদিন আবারও ছেলেকে টাকা দিয়ে বললো: ‘সোজা বাজারে গিয়ে কসাইর দোকান থেকে গোশত কিনে বাড়ি ফিরবি’। ছেলে মাথা নেড়ে টাকাটা হাতে নিয়ে বের হয়ে গেল।

 

 

বলছিলাম মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ছেলেটা আজও বের হয়ে গেল বাজারের উদ্দেশ্যে। কিন্তু পথে দেখা হয়ে গেল ওই দুষ্টু ছেলেগুলোর সাথে। ওরা আজ একটা কুকুরকে নিয়ে খেলছিল। খেলা আর কি! কুকুরকে পিটিয়ে লাথি মেরে মেরে মজা নিচ্ছিলো। কুকুরের কষ্ট দেখে ছেলেটার খুব খারাপ লাগছিল। সে দুষ্টু ছেলেদেরকে জিজ্ঞেস করলো: তোমরা কুকুরটাকে বিক্রি করবে? দুষ্টুগুলো সাথে সাথে জবাব দিলো: হ্যাঁ! বিক্রি করবো, খুব কম দামে দেবো।

 

ছেলেটা বললো: ঠিক আছে! বলো! কতো হলে বিক্রি করবে।

দুষ্টু ছেলেরা বললো: একদম সস্তা। অর্ধেক রুটির দামে বিক্রি করবো।

ছেলেটা মায়ের দেওয়া টাকার পুরোটাই দিয়ে দিলো দুষ্টুদেরকে। তারপর কুকুর কিনে নিয়ে ফিরে গেল বাড়ি। বাড়ি যাবার পর মা তাকে দেখেই চীৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিলো। বললো: তোকে নিয়ে তো আর পারছি না। আমার কি ধনভাণ্ডার আছে যে কুত্তা কিনে মজা করবো!

 

ছেলে মায়ের কথা শুনে বুঝতে পারলো মা রেগে গেছেন। তারপরও মাকে বুঝিয়ে সুজিয়ে বললো: মা! আমরা যদি এক বেলা গোশত না খাই কী আর এমন হবে! কিন্তু একটা প্রাণীর জান তো আমরা বাঁচাতে পারলাম, তাই না? মা আর কোনো জবাব দিলো না।

 

পরেরদিনও মা ছেলের হাতে টাকা দিলো। এবার ভালো করে বলে দিলো সোজা বাজারে গিয়ে যেন তেল কিনে আনে। ছেলে এবারও মাথা নেড়ে মায়ের কাছ থেকে টাকাটা নিয়ে বাজারের পথে পাড়ি জমায়। আজও সে পথে দেখতে পায় সেই দুষ্টু বালকদের। আজ তারা একটা ইঁদুরকে নিয়ে খেলছিল। ইঁদুরটাকে ধরে লেজে রশি বেঁধে আগুনে পোড়ানোর চেষ্টা করছে। তার মনটা ইঁদুরের জন্য কেঁদে উঠলো। সে আজও দুষ্টু ছেলেদের কাছ থেকে ইঁদুরটাকে কিনে নিয়ে বাসায় ফিরে এলো। মা আজ ছেলের হাতে ইঁদুর দেখেও না দেখার ভান করলেন।

 

এরপর কেটে গেল বহুদিন। ছেলে প্রায় প্রতিদিনই নদীর ধারে যায়। মাছ মারে। মাছ কেটে পরিষ্কার করে পরিত্যক্ত অংশগুলো কুকুর আর বেড়ালের সামনে দেয় আর বাকিটা নিয়ে যায় বাসায়। একদিন ছেলে বাসাতেই ছিল। তার কুকুর একটা মাছের মুখের ভেতর একটা পাথর পেলো। পাথরটা সূর্যের মতো জ্বলজ্বল করছিলো। কুকুর ওই পাথরটা নিয়ে দিলো মনিবের কাছে। মনিব মানে ছেলেটা জ্বলজ্বলে পাথর দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল। মজা করার জন্য সে পাথরটাকে মুখে নিয়ে জিহ্বার নীচে রেখে বললো: হে রত্নমণি! আমার খিদে লেগেছে। মজার মজার খাবার নিয়ে এসে টেবিল ভর্তি করে দাও। আশ্চর্যরকমভাবে চোখের পলকেই তা ঘটে গেল। ছেলে নড়েচড়ে উঠে খাবারগুলো পরীক্ষা করার জন্য মুখে দিলো। সে কি মজা রে বাবা! সেবাইকে ডেকে ওই মজার মজার খাবার খাওয়ালো।

 

 

এরপর একদিন ছেলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলো প্রান্তরের দিকে। পথিমধ্যে দেখতে পেলো খানের সুন্দরী মেয়েকে। তার ভালো লেগে গেল। বাসায় ফিরে মাকে বললো তার জন্য যেন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যায়। মা যতই চেষ্টা করলো আজগুবি এই প্রস্তাব থেকে সরে আসার জন্য, ছেলে কিছুতেই মানলো না। মাকে পাঠালোই খানের বাড়িতে। খান মহিলাকে দেখে বললো: কী চাও!

 

মহিলা বললো: তোমার মেয়ের সাথে আমার ছেলের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছি।

খান ভেবেচিন্তে বললো: এক শর্তে রাজি আছি। চল্লিশটি উটের পিঠ বোঝাই করা সোনা দিতে হবে মেয়ের মোহরানা।

মহিলা খানের কথাটা ছেলেকে জানালো। ছেলে বললো: মা চিন্তা করো না।

 

পরদিন সকালেই ছেলে খানের চাহিদা পূরণ করে চল্লিশ উটের পিঠ বোঝাই করা সোনা পাঠিয়ে দিলো। খান এবার মহিলার দিকে তাকিয়ে বললো: এবার একটা প্রাসাদ বানাতে হবে সোনা দিয়ে। ওই প্রাসাদে আমার মেয়ে থাকবে।

মহিলা আবারও খানের কথাটা ছেলেকে জানালো। ছেলে আজও বললো: চিন্তা করো না মা!

 

পরদিন সকালে ছেলে ঠিকই নদীর তীরে সোনা দিয়ে একটা প্রাসাদ বানিয়ে ফেললো। খানকে বলার পর সে আশ্চর্য হয়ে ওই প্রাসাদ দেখতে গেল। প্রাসাদ দেখে তো খানের আর কোনো অজুহাত তৈরির সুযোগ থাকলো না। বাধ্য হয়ে ওই ছেলের সাথে খান তার মেয়ের বিয়ে দিলো।

 

কিন্তু খানের মেয়ে একটা গ্রাম্য ছেলের সাথে জীবনযাপন করতে বিব্রত বোধ করলো। সে তার বাবাকে বললো এমন কিছু একটা করতে যাতে সে ওই ছেলের সাহচর্য থেকে চলে আসতে পারে। খান এক বৃদ্ধ মহিলাকে বললো এই অবস্থা থেকে তাকে মুক্তি দিতে। ওই বুড়ি যাদুকর খানকে কথা দিলো সে কিছু একটা অবশ্যই করবে। বুড়ি শুনেছিল যে ওই ছেলে প্রতিদিন গরিব ফকিরদেরকে খেতে দেয়, জামা কাপড় দেয়। বুড়িও একদিন ফকিরের পোশাক পরে ছেলের ঘরে গেল।#

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!