একমাত্র আদুরের দুলালী মিষ্টি মেয়ে টুনটুন। সারাবেলা সে দৌড়ে বেড়ায় এই রুম থেকে ওই রুম। কখনো বিছানার উপর লাফাবে, কখনো সোফার উপর লাফাবে, কখনো বা মায়ের আঁচল ধরে টানাটানি করবে। এমনি করে আরো কত কিছুই যে করবে সে, দুষ্টুমির যেন শেষই হয় না টুনটুনের। মাঝে মাঝে চুপটি মেরেও আপন মনে বসে থাকবে কোথাও, নয়তো একা একাই বসে পুতুল নিয়ে খেলা করবে। যদি কোনদিন বৃষ্টি আসে সেটাও জানালা দিয়ে অবাক চোখে দেখতেও ভুলে না যেন টুনটুন। আবার একটু ভয় পেলেই দৌড়ে গিয়ে মায়ের আঁচলের তলায় লুকিয়ে পরে। আর সবার ছোট্র বেলার মতই যেন এই ছোট্র টুনটুন।
বাবা অফিস থেকে ফিরে এলে পরে কিংবা ছুটিতে বাসায় থাকলে পরে, টুনটুনের আহ্লাদ ও দুষ্টুমি যেন আরো দ্বিগুণ বেড়ে যায়। বাবার চারিপাশে ছুটাছুটি করতে থাকবে। কখনো বাবার গলায় জড়িয়ে ধরবে, আবার কখনো বা কোলে উঠে বসে থাকবে। টিভি দেখার সময় কিংবা পত্রিকা পড়ার সময়ও টুনটুন তার বাবার মুখের সামনে এসে ছোট্র দুহাত দিয়ে ধরে আহ্লাদ আর দুষ্টুমি করতে থাকবে। বাবার পায়ের উপর বসে দুলতে থাকবে, আবার বাবার সাথেই লুকোচুরি খেলা খেলতে চাইবে। বাবার সাথেই ঘুমাতে চাইবে, এবং ঘুমানোর সময় ঘুম পাড়ানো গল্পও শুনতে চাইবে। বাবার কাছে টুনটুনের চাওয়া বা আবদারের যেন শেষ হবার নয়। মোটকথা টুনটুন চায়, তার বাবা-মা যেন সারাক্ষণ তাকে নিয়েই ব্যস্ত থাকে।
একদিন তার বাবা বসে খুব মনোযোগ দিয়ে পত্রিকা পড়ছিল এবং তার মা চা নিয়ে এসে বসে টিভি দেখছিল। টুনটুন তখন বাবা-মায়ের সামনেই ছুটাছুটি আর লাফালাফি করছিল খুব। বাবা-মাকে একসাথে পেয়ে যেন তার দুষ্টুমির মাত্রা আরো বেড়ে গেল। মা তখন ধমক দিয়ে বলল চুপ করে বসতে, টুনটুন তাই একটু অভিমান করে বাবার পাশে গিয়ে বসলেও, পরক্ষণেই আবারও প্রচন্ড রকম দুষ্টুমি শুরু করে দেয় সে। টুনটুনকে অনেকবার বলেও থামাতে না পেরে বাবা ভীষণ রকম রেগে যান, এবং হাতে থাকা পত্রিকা থেকে পড়া একটি পৃষ্ঠা টেনে ছিঁড়ে ফেলেন তিনি। তারপর সেটাকে দুহাত দিয়ে ধরে দুই টুকরো করে ফেলেন এবং এইভাবে কয়েকবার করে ছিঁড়ে ছোট ছোট টুকরা করে ফেলেন। অবশেষে বাবা টুকরাগুলো তুলে নিয়ে টুনটুনের হাতে দিয়ে বললেন, ‘এইগুলি নিয়ে তোমার রুমে যাও এবং সবগুলো টুকরো একসাথে করে পৃষ্ঠাটা ঠিক করে নিয়ে আসবে।’
তারপর বাবা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ভাবলেন, ‘যাক বাঁচা গেল, এটা দিয়ে টুনটুন অনেকক্ষণ ব্যস্ত থাকবে।’ এবং নিশ্চিত ছিলেন যে, পৃষ্ঠাটা ঠিক করতে দিনের পুরো সময়টাই টুনটুনের লেগে যেতে পারে হয়ত। এমনকি টুনটুন এটা ঠিক করতে পারে কি না পারে, সেটা নিয়েও বাবা সন্দিহান ছিলেন। তবে বাবার বিশ্বাস ছিল, টুনটুন এটা করতে চেষ্টা করবেই, কারণ সে তার বাবাকে যে খুব ভালবাসে। টুনটুন একটুও মন খারাপ করলো না, কারণ সে বুঝতে পেরেছে যে, তার দুষ্টুমির জন্যই বাবা একটু রাগ করেছেন। তাই সে বাবার দেওয়া টুকরোগুলো হাতে নিয়ে নিরবে সোজা তার রুমে চলে গেল।
এইসব দেখে মা একটু মন খারাপ করতেই বাবা বলল, ‘চিন্তা করোনা, সব ঠিক হয়ে যাবে, তাছাড়া টুনটুনও কিছুক্ষণ ব্যস্ত থাকবে এবং সে কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতে পারবে।’
মা বলল, ‘না ঠিক আছে, ও আসলে আজ একটু বেশিই দুষ্টুমি করছিল। মাঝে মাঝে ছেলেমেয়েদের একটু শাসন করতেই হয়, নয়তো বাবা-মায়ের কথাই পরে শুনতে চাইবে না। একটু পরে ওকে আদর করে দিলেই হবে।’
অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই তার বাবা-মাকে অবাক করে দিয়ে টুনটুন আস্ত একটা পৃষ্ঠা হাতে নিয়ে ফিরে এলো এবং বাবার হাতে দিয়ে বলল, ‘এই নাও আব্বু। দেখো, আমি টুকরোগুলো সব একসাথে করতে পেরেছি।’
মা তো টুনটুনের কান্ড দেখে খুশিতে হাসতে থাকে। আর বাবা অবাক হয়ে পৃষ্ঠাটার দিকে তাকিয়ে থাকে এবং টুনটুনকে জিজ্ঞেস করে, ‘কিন্তু এত অল্প সময়ে এতগুলো টুকরো একসাথে করে এত সুন্দরভাবে পৃষ্ঠাটা ঠিক করলে কিভাবে, মা?!!’
টুনটুন খুব আনন্দিত হয়ে বর্ণনা দিতে থাকলো, ‘ওহ! আব্বু, ওই পৃষ্ঠাটার অন্য দিকে মানে পেছনের দিকে মানুষের মুখের একটা বড় ছবি ছিল। আমি তো শুধু টুকরোগুলো একসাথে করে সেই মানুষের মুখের ছবিটাকে ঠিক করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু পরে দেখি পুরো পৃষ্ঠাটাই ঠিক হয়ে গিয়েছে।’ বলেই টুনটুন তার আশ্চর্যান্বিত বাবা-মাকে রেখেই দৌড়ে চলে গেল বাহিরে, বন্ধুদের সাথে খেলতে।
মূলতঃ এই পৃথিবীতে আমরা যে কোনো ধরণের অভিজ্ঞতারই সম্মুখীন হই না কেন, সেই অভিজ্ঞতার মূলে প্রতিটারই অন্য একটি দিক থাকে মানে অন্য একটি পাশ থাকে সব সময়। তাই যখনই আমরা যে কোনো ধরণের পরিস্থিতির সম্মুখীন হই না কেন, আমাদের উচিত সেই পরিস্থিতির অন্য দিকটি বা অন্য পাশটিও দেখে নেওয়া বা খুঁজে দেখা। তাতে করে, সহজভাবেই আমাদের সকল সমস্যার মোকাবেলা বা সমাধান করার খুব সহজ একটা উপায় পাওয়া সম্ভব এবং যা নাকি দেখে আমাদেরও বিস্মিত হতে হবে।