ইরানের ফারেস প্রদেশে সিরাজ নগর অবস্থিত। সিরাজ নগরের তাউস এলাকায় সৈয়দ আবদুল্লাহ নামে এক জ্ঞানী লোক বাস করেন। তিনি যেমনি জ্ঞানী তেমনি ভাল লোক ছিলেন। সৈয়দ সাহেব দীর্ঘদিন যাবত নিঃসন্তান।তিনি ও তার স্ত্রী ক্রমেই বৃদ্ধ হয়ে পড়ছেন। কিন্তু তাদের কোন সন্তান নেই। সৈয়দ সাহেব কেঁদে কেঁদে আল্লাহর কাছে সন্তান চেয়ে মুনাজাত করেন। শেষে একদিন সত্যি সত্যিই তাঁর স্ত্রী গর্ভবর্তী হলেন। ক্রমে দশ মাস দশদিন পার হল।
ময়মুরা খাতুন প্রসব বেদনায় কাঁদছেন। হঠাৎ মায়ের বুক আলো করে ফুটফুটে এক শিশুর জন্ম হল। শিশুর চাঁদ মুখ দেখে মা তার সব কষ্ট ভুলে গেলেন। পিতা নামাজে দাঁড়িয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন। সাতদিন কেটে গেল্ সৈয়দ সাহেব সন্তানের আকীকা দিয়ে নাম রাখলেন সরফুদ্দিন। সৈয়দ সাহেবের পিতার নাম ছিল সরফুদ্দিন। সেই নামে নাম রাখা হল।
সিরাজের শাসনকর্তা তোকলাহ বিন জঙ্গী বৃদ্ধ সৈয়দ সাহেবের পুত্র সন্তান লাভের ঘটনায় খুবই অবাক হন। সৈয়দ সাহেব শিশু পুত্রকে নিয়ে তাঁর দরবারে গেলেন। সরফুদ্দিনের হাসিমাখা মুখ আর মিষ্টি মিষ্টি কথা শুনে দরবারে সবাই মুগ্ধ। তোকলাহ বিন জঙ্গী খুশী হয়ে সরফুদ্দিনের পিতাকে একশ’ স্বর্ণমুদ্রা উপহার দিলেন।
মায়ের কাছে সরফুদ্দিন লেখাপড়া শুরু করেন। তিনি ৭ বছর বয়সেই কোরআন শরীফ শেষ করলেন। পিতা সরফুদ্দিনকে সিরাজ নগরের বিখ্যাত আলেম ও আল্লার ওলী হযরত শেষ মোসলেহুদ্দীনের কাছে নিয়ে এলেন। শেখ মোসলেহুদ্দিন সরফুদ্দীনের চেহারা ও লক্ষণ দেখে বুঝলেন, ভবিষ্যতে এছেলে বিখ্যাত লোক হবে। তিনি ছেলের পিতাকে সে কথা জানালেন। তিনি তার জন্য দোওয়া করলেন এবং সরফুদ্দিনের আরেক নাম দিলেন শেখ মোসলেহুদ্দিন।
সরফুদ্দিন শেখ মোসলেহুদ্দীনের কাছে ৩বছর থাকলেন। এ সময় তিনি কোরআন শরীফ মুখস্থ করলেন। হঠাৎ শেষ মোসলেহুদ্দীন ইন্তেকাল করলেন। বালক সরফুদ্দিন তার শিক্ষক শেখ মোসলেহুদ্দীনের জন্য অনেক কাঁদলেন।
রাজ পরিবারের ছেলেদের সাথে সরফুদ্দিনের খুব দোস্তি হয়ে গেল। তিনি তাদের সাথে যুদ্ধবিদ্যা শিখলেন। তরবারি চালনা ও অশ্ব চালনাও শিখলেন। সিরাজের নামকরা বিদ্যালয়ে সে সময় গন্ডগোল চলছিল। কাজেই সৈয়দ সাহেব নিজেই পুত্রকে লেখাপড়া শেখাতে লাগলেন।
সৈয়দ সাহেব স্ত্রী ও পুত্রকে নিয়ে হজ্বে গেলেন। সরফুদ্দিন পিতা-মাতার সাথে দুর্গম পার্বত্য পথ পাড়ি দিয়ে মক্কায় হজ্ব পালন করেন এবং পরে মদীনায় গিয়ে মহানবীর মাজার জিয়ারত করেন। পরে তারা নিরাপদে দেশে ফেরেন।
কিছুদিন পর সৈয়দ সাহেব েইন্তেকাল করেন। এর ফলে সরফুদ্দিন এতিম ও অসহায় হয়ে পড়েন। পিতা সরকারী চাকুরিী করতেন। যা কিছু পেতেন তা’ দিয়ে কষ্ট করে জীবন যাপন করতেন। হঠাৎ পিতার মৃত্যুতে তাদের আয় বন্ধ হয়ে গেল। সংসারে অভাব অনটন নেমে এল।
এ সময় তিনি সিরাজ নগরের আজদিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। কিন্তু রাজ্যের সর্বত্র তখন রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি চলছে। এরকম অবস্থায় তিনি বেশীদিন ঐ মাদ্রাসায় পড়ালেখা করতে পারলেন না। তিনি উচ্চ শিক্ষা লাভের আশায় বাগদাদে চলে যান। বাগদাদে এসে তিনি অনানাহারে আর অর্ধাহারে দিন কাটাতে লাগলেন। হঠাৎ ভাগ্যক্রমে তার পিতার এক বন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ হল। তিনি সরফুদ্দিনকে স্থানীয় এক মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেন। এখানে পড়ালেখা শেষ করে বাগদাদে বিখ্যাত নিজামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখঅনে তিন বিখ্যাত আলেম আল্লামা আবুল ফাতাহ ইবনে জওজী (র) এর কাছে তাফসীর, হাদিস ও ফিকাহ শাস্ত্র শিক্ষা লাভ করেন। মাত্র অল্পদিনেই তিনি মাদ্রাসার সেরা ছাত্র বিবেচিত হন এবং মাসিক বৃত্তি লাভ করেন। মাত্র ৩০ বছর বয়সে তিনি তাফসীর, হাদীস, ফিকাহ্, সাহিত্য দর্শন খোদাতত্ত্ব ও ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে অসাধারণ পান্ডিত্য অর্জন করেন।
তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভে সন্তুষ্ট ছিলেন না। বরং আল্লাহর ভালবাসায় নিজেকে পাগল পারা করতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। িএসময় তিনি সে যুগের অন্যতমওলী শেখ সাহাবুদ্দিন সোহরাওয়ার্দীর মুরিদ হন। তাঁর সাথে থেকে সরফুদ্দিনের অন্তরাত্মা হেরার আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। তার মন থেকে জগতের যাবতীয় অন্ধকার দূর হয়ে গেল।
৩০ বছর বয়সে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ করে সরফুদ্দিন বিদেশ ভ্রমণ শুরু করেন। তিনি এক জন সাধক দরবেশের মত খালি হাতে পায়ে হেঁটে বহুদেশ সফর করেন। এ সময় নিজেও যেমন জ্ঞান অর্জন করতেন তেমনি মানুষকেও জ্ঞানের পথে আহ্বান করতেন। তিনি সমগ্র ইরান, এশিয়া মাইনর, আরব ভূমি, সিরিয়া, মিসর, জেরুজালেম, আর্মেনিয়া, আবিসিনিয়া, তুর্কিস্তান, ফিলিপাইন, ইরাক, কাশগড়, হাবস, ইয়ামন, শাম, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ, ভারতের সোমনাথ ও দিল্লীসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ পায়ে হেঁটে ভ্রমন করেন। এসব ভ্রমন করতে তিনি পাড়ি দেন পারস্য উপসাগর, ওমান সাগর, ভারত মহাসাগর ও আরব সাগর। এই সফরের ফলে তিনি বিশ্বের ১৮টি ভাষায় পান্ডিত্য অর্জন করেন। তিনি পায়ে হেঁটে ১৪ বার হজ্ব করেন।
দেশ ভ্রমণকালে জালেম ও বর্বরদের হাতে সরফুদ্দিনকে বহুবার কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে। একবার ফিলিস্তিনের এক জঙ্গলে আশ্রয় নিয়ে আল্লাহর বন্দেগী করছিলেন। এমন সময় খৃস্টানরা তাকে আটক করে ইহুদী কৃতদাসদের সাথে মাটি কাটার কাজে নিয়োজিত করায়। সে সময় তাঁর দুরাবস্থার সীমা ছিল না। তিনি খুবই দুঃখ কষ্টের মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলেন। একদিন আলিপ্নো শহরে এক বনিক সে পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি সরফুদ্দিনকে আগে থেকে চিনতেন। সরফুদ্দিনকে মাটি কাটতে দেখে খোঁজ খবর নিলেন। প্রকৃত অবস্থা বুঝতে পেরে ১০ দিনার মূল্যে তাকে ক্রয় করে আজাদ করে দিলেন। তাকে সাথে করে আলিপ্নো শহরে তার বাড়ীতে আনেন। বনিকের এক বদমেজজী বয়স্কা কন্যা ছিল। তার সাথে তিনি ১০০ দিনার মহরানায় সরফুদ্দিনের বিয়ে দিলেন। মোহরের অর্থ বনিক নিজেই পরিশোধ করেন। সরফুদ্দিন বিপদে ধৈর্য্য হারাতেন না। বিয়ের পর স্ত্রীর বদ মেজাজের কারণ তার সংসার সুখেরহয়নি। স্ত্রী একদিন বিদ্রুপ করে বললেন, আচ্ছা তুমি কি সেই হতভাগা নও- যাকে আমার পিতা দয়া করে ১০ দিনার মূল্যে কিনে নিজের হাতে মুক্তি দিয়েছেন? সরফুদ্দিন বললেন, হ্যাঁ সুন্দরী, আমি সেই হতভাগা যাতে তোমার পিতা ১০ দিনার দিয়ে কিনে মুক্ত করে আবার ১০০ দিনার দিয়ে তোমার দাসত্বে নিযুক্ত করেছেন। পরবর্তীকালে সরফুদ্দিনের এই বিয়ে টেকেনি।
সরফুদ্দি বহু কাব্যগ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর এসব কাব্যে রয়েছে মানুষের নৈতিক চরিত্র সুন্দর করার অমূল্য বানী। আজও তার কাব্য গ্রন্থ-বিশেষ করে কারিমা, গুলিস্তা ও বোস্তা বিভিন্ন মাদ্রাসায় পাঠ্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। আলেমগণ ওয়াজ নসিহত কালে তার কবিতা আবৃত্তি করে থাকেন। শিশুরা তার কারিমা গ্রন্থের কবিতা আজও পাঠ করে।
“কারমা ব-বখশায়ে বর হালেমা
কে হাস্তম আমীরে কামান্দে হাওয়া।
বাংলা অনুবাদ: “হে দয়াময় প্রবু! আমার প্রতি রহম কর। আমি কামনা বাসনার শিবিরে বন্দী। তুমি ছাড়া আর কেউ নেই যার কাছে আমি দোয়া করবো। তুমি ছাড়া আর কেউ মাফকারী নেই। তুমি আমাকে গোনাহ থেকে রক্ষা কর। আমার গোনাহ মাফ করে নেকীর পথ প্রদর্শন কর।
সরফুদ্দিনের গুলিস্তা ও বোস্তা বিশ্ব সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। এটি ল্যাটিন, ফরাসী ইংরেজী, জার্মানি, আরবী, ওলন্দাজ, উর্দু, তুর্কী, বাংলঅ প্রভৃতি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। এছাড়া তাঁর আরও বুহ গ্রন্থ রয়েছে। যেমন নসিহত- আলমুলূক, রিসালায়ে আশ কিয়অনো, কিতাবে মিরাসী, মোজলেসে খামসা, তরজিয়াত, রিসালায়ে সাহেবে দিউয়ান, কাসায়েদল আরবী, আৎতবিয়ত ইত্যাদি।
সরফুদ্দিন ছিলেণ সদাই হাসিখুশী। লোকজন তার কাছে গেলে তাদের মন আনন্দে ভরে উঠতো। এজন্যে তার এক নাম সা’দী। শেষ শব্দটি জ্ঞানী ব্যক্তিদের নামের আগে বলা হয়। এজন্যে লোকজন তার আসল নাম ভুলে গিয়ে শেষ সা’দী নামেই তাকে চিনতো। তাঁর জন্ম ১১৭৫ সালে। তিনি ১২০ বছর বেঁচে ছিলেন। এছাড়া তিনি ফারেসের শাসনকর্তা অতাবেক সাদ বিন জঙ্গীর রাজত্বকালে যখন কবিতা লিখতেন তখন নিজের নামের সাথে সাদী লিখতেন। এভাতে তাঁর সাদী নামটিই পরিচিত হয়ে যায়।
শেষ সাদীর জীবনকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
প্রথম ৩০ বছর শিক্ষা লাভ, দ্বিতীয় ৩০ বছর দেশ ভ্রমণ, তৃতীয় ৩০ বছর গ্রন্থ রচনা ও চতুর্থ ৩০ বছর আধ্যাত্মিক চিন্তা ও সাধনা।
শেষ বয়সেশেষ সাদী (র) মাতৃভূমি সিরাজে ফিরে আসেন। তিনি এক নির্জন স্থানে এবাদত বন্দেগি করে জীবন কাটান। এখানে তিনি মোরাকাবা ও মোশাহাদা করতেন। মাঝে মাঝে কেউ সাক্ষাৎ করতে এলে তার সাথে দেখা করতেন। প্রতিদিন বিভিন্ন স্থান থেকে বিভিন্ন পেশার লোক তাঁর কাছে এসে তাঁর জ্ঞান গর্ভ উপদেশ শুনতেন। বার্ধক্যেও তিনি যুবকের মত শক্তিশালী ছিলেন। অবশেষে ১২/২৮ খৃস্টাব্দে ১২০ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। সিরাজ নগরে ‘দিলকুশা’ নামক স্থানের এক মাইল পূর্ববর্তী পাহাড়ের নীচে তাঁর মাজার রয়েছে। মাজার জেয়ারত কারীদের পাঠের জন্য শেষ সাদীর নিজ হাতে লেখা একটি কাব্যগ্রন্থ মাজারে রক্ষিত আছে। এ স্থানটি সাদীয়া নামে পরিচিত।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।