পৃথিবীর বিখ্যাত নগরী বাগদাদের নাম অবশ্যই শুনেছ। মুসলমানদের অনেক কিছুই জড়িয়ে আছে এ শহরের সাথে। তখনকার যুগে আজকালকার মতো এতো ঝাঁকঝমক ছিল না। শহরের পরিধি ছিল খুব সঙ্কীর্ণ। শহর থেকে বের হয়ে একটু দূরে গেলেই মরুভূমি। আরবের মরুভূমি বলেই কথা। খুব দূরে-দূরে এখানে-সেখানে ছড়িয়ে থাকত কিছু ঝুপড়ি। রুক্ষ-গরম আবহাওয়া। ফল নেই, ফুল নেই। সারি সারি গাছের শামিয়ানা নেই। রাত নেমে আসলে সৃষ্টি হয় এক ভূতুড়ে পরিবেশ।
এসব সত্ত্বেও বেদুঈনের জীবন ছিল শামিত্ম-সুখে ভরা। শহুরে কোলাহলমুক্ত তাদের জীবন ছিল নিতামত্ম পবিত্র। পাহাড়ি ঝরনার মতো স্বচ্ছ ছিল তাদের স্বভাব। বিদ্যালয়ে পড়া শোনার সাথে তাদের কোনো পরিচয়ই ছিল না। তবু তাদের যোগ্যতা ও প্রতিভা ছিল সময়ের এক বিস্ময়। সে যুগে কালজয়ী সব কবিতা লিখেছেন বেদুঈনরাই। বেদুঈন কবিদেরই একজন ছিলেন আলী বিন জাহাম। তখন দেশের বাদশাহ্ ছিলেন খলীফা মুতাওয়াক্কিল। নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী বাদশাহ্, যাঁর প্রতিটি চোখের ইশারাও তামিল হতো মুহূর্তেই। এসব কথা আজ থেকে বহু-বহু দিন আগের। আজ থেকে প্রায় বারশত বছর আগের।
রুক্ষ্ম স্বভাবের বেদুঈন কবি আলী বিন জাহাম বাইরের জগৎ সম্পর্কে তেমন কিছু জানেন না। তার পুরো জীবন কেটেছে মরুভূমির খিটখিটে পরিবেশে। তিনি বাগদাদ শহরে আসেন খুব কদাচিৎ। বাদশাহ্দের শান-মান সম্পর্কে অবগত নন তিনি। কি এক প্রয়োজনে একসময় তিনি বাগদাদ আসেন। সেখানে এসে শুনতে পান এক আশ্চর্য খবর। তার জন্য একটু সুসংবাদও বটে। তিনি শুনতে পান, বাদশাহ্ মুতাওয়াক্কিল খুব কবিতাপ্রেমিক। তাঁর দরবারে নিয়মিত কবিতার আসর হয়। আসরও আবার ভিন্নরকম। কবিতা আবৃত্তি করে শুকনোমুখে যে যার মতো করে ফিরে যায় এমন নয়। বাদশাহ্ শুধু কবিতা শুনেই ক্ষামত্ম হন না। কবিদের পুরস্কৃতও করেন। অঢেল পুরস্কার। আলী বিন জাহাম এ খবর শুনে তো আনন্দে আটখানা। মুহূর্ত বিলম্ব না করেই রওনা দেন রাজ-দরবারের দিকে।
আলী বিন জাহাম বুকভরা আত্মবিশ্বাস নিয়ে ঢুকে পড়েন দরবারে। কি ঝকঝকে শানদার দরবার! চমৎকার সেই কবিতার আসর। আসর জুড়ে বিরাজ করছে পিনপতন নীরবতা। কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে শুধু কবিদেরই। গেয়ে যাচেছন বাদশাহ্র বন্দনায় ভর্তি সব কবিতা। কবিতা আবৃত্তি শেষ হতে না হতেই দর্শকদের সে কি মুহুর্মুহু করতালি! বাহ্-বাহ্ শব্দ! কবিতা পড়ে যে যার মতো করে বাগিয়ে নিচেছন লোভনীয় সব পুরস্কার। অবস্থা দেখে কবি আলী বিন জাহাম তো অবাক। কতো কবিতা, কতো গান গেয়ে তিনি সারাটা জীবন কাটিয়েছে! কই কোনো পুরস্কার তো তিনি পাননি। পাননি এমন নগদ প্রতিদান। তার ভেতরটা কেমন করে ওঠে হঠাৎ। আসরে কবিতাপাঠের মোহ চড়চড়িয়ে ওঠে তার। পালাক্রমে কবিতা শুনাবার সুযোগ পেয়ে যান তিনিও। বাদশাহ্কে সম্বোধন করে তিনি বলেন :
মহামান্য বাদশাহ্!
‘ভালোবাসা ও বিশবসত্মতা রক্ষার ক্ষেত্রে আপনি কুকুরের মতো।
বিপদ প্রতিরোধে আপনি পুরুষ ছাগলের মতো।
আপনি কূপের বড় বালতির ন্যায়।
এমন বিশাল বালতি, যা আমি কখনো হারাতে চাই না।’
আলী বিন জাহামের কবিতা আবৃত্তি চলছে। ওদিকে বাদশাহ্র চেহারা বিবর্ণ। উপস্থিত সবাই পরস্পরের দিকে চাওয়াচায়ি করছে। পুরো দরবারজুড়ে বিরক্তি-ক্রোধ ভাব। কী অবাক কান্ড! এই কিছুক্ষণ আগে বাদশাহ্কে বলা হয়েছে চাঁদ, সূর্য ও পাহাড়চূড়া। আর গন্ডমূর্খ কবি কোথা থেকে ঢুকে পড়লেন? কুকুর, কূপ, ভেড়া এবং মাটির সাথে উপমা দিচেছন মহামান্য বাদশাহ্কে! মহারাজ তো এসব শুনে একেবারে থ। রাগে রক্ত চড়ে তাঁর মাথায়। বাদশাহ্র দেহরক্ষীরাও জ্বলে ওঠল ক্ষোভে। মুহূর্তেই প্রস্ত্তত তরবারি, প্রস্ত্তত জল্লাদও। এক্ষুণি গর্দান উড়িয়ে দেওয়া হবে বদমাশ আলী বিন জাহামের।
কিন্তু বাদশা কী যেন ভেবে একটু নড়েচড়ে বসলেন। তিনি ভাবলেন, আসলে এখানে আলী বিন জাহামের কোনো দোষ নেই, দোষ যা সব তার স্বভাবের। মরুবাসী বেদুঈন কবির স্বভাব, ভাষা ও উপমাশৈলী এমন হওয়া অস্বাভাবিক নয়। সুতরাং এখন তাকে হত্যা করে কোনো লাভ নেই। এর চেয়ে বরং তার স্বভাবকে হত্যা করার পেছনে চেষ্টা করা দরকার।
বাদশাহ্ আদেশ দিলেন, আলী বিন জাহামকে শানদার প্রাসাদে থাকতে দাও কিছুদিন। শহরের সবচেয়ে সুন্দর দাস-দাসি যেন তার আশে-পাশে থাকে সারাক্ষণ। রকমারি খাবার ও পানীয় যেন সবসময় হাজির থাকে তার হাতের নাগালে।
আলী বিন জাহাম এখন শাহী দরবারের একজন নিত্য সদস্য। রাজ পরিবারের বিচিত্র নাজ-নেয়ামতের সাথে পরিচিত হওয়া শুরু হয় তার। শাহী গদীর কোমল স্পর্শ পেতে শুরু করে তার মরু-কর্কষ পিঠ। শহরের শিষ্ট ও মিষ্টভাষী গায়ক ও কবিদের সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেয়ে যান তিনি। এভাবে কেটে যায় সাত সাতটি মাস।
শাহী দরবারের নিয়মানুযায়ী আরেক রাত বসল কবিতার আসর। আসরে হঠাৎ বাদশাহ্র মনে পড়ল আলী বিন জাহামের কথা। তাকে খবর দেওয়া হলো। মুহূর্তের ভেতরই তিনি উপস্থিত। আজ কিন্তু সবার চোখে-মুখে অন্যরকম একটা আবহ। যেন সকলে তার অপেক্ষায় আছেন। বাদশাহ্ আজ তার কবিতা শুনার জন্য উন্মুখ। চোখের চাহনি বুঝেই তিনি কবিতা আবৃত্তি শুরু করলেন।
‘আমি জানি বা না জানি,
রুসাফা এবং সেতুর মাঝখানে নীল গাভির মতো ডাগর চক্ষু
প্রেমের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে।
তিনি পুরনো অনুরাগকে জাগিয়ে তুলেছে।
অথচ আমার দুঃখ ভুল ছিল না।
সে চক্ষুগুলো কয়লার উপর কয়লা রেখে
জ্বলমত্ম স্ফূলিংঙ্গকে আরো তেজ করে দিয়েছে।’
কী বিস্ময়! কী বিপ্লব! এবার তো আলী বিন জাহামকে আর চেনা যাচ্ছে না। চেনা যাচ্ছে না তার আগেকার কথনশৈলী। সুন্দর-শিল্পময় কথামালা দিয়ে এবার হৃদয় স্পর্শ করল সবার। এবার বাদশাহ্র উপমা বদলে গেল চাঁদ, সূর্য এবং তরবারিতে।
বুদ্ধিমানের সুচিমিত্মত পন্থা, চিমত্মার এক অভিনব কারিগরি কীনা করতে পারে? করতে পারে অনেক কিছু। ফলাতে পারে স্বর্ণ। চরিত্র-রুচিতে ঘটাতে পারে মহাবিপ্লব।
বাদশাহ্র দরবারে কবিতার আসর আবার কখন বসে কে জানে? আলী বিন জাহামও তা জানেন না। তিনি ফিরে যেতে চান কবিতার মরু-উদ্যানে। তিনি এখন নতুন মানুষ। নতুন তার সবকিছু।…