(পাওয়ান মানচান্দা এতই ব্যস্ত ছিল যে সে ওই নামটির বাইরে আর কোনো নাম তার মাথায় আসেনি। কারণ মানচান্দার বিয়ের ব্যাপারে ভরদ্বাজের মেয়ের ঘটকালির একটা ভূমিকা ছিল) কারণটি হচ্ছে তার সহায়-সম্পত্তির আয়কর কিছুটা কমিয়ে দিতে হবে।
বিস্তারিত তদন্তের পর প্রকাশ পায় যে ঘুষ নেওয়ার সময় রামলাল হাতেনাতে ধরা পড়ে। আমরা সবাই জানি মাঝেমধ্যে চুনোপুঁটি কেরানি বা ছোটবাবুদের তিন বা চার অঙ্কের ঘুষ হাতেনাতেই ধরা পড়ে। কারণ লঘু ঘুষের ব্যাপারটা ওপর-ওপরই ভাসে এবং সেটা দেখা যায়, কিন্তু ওজনদার ঘুষগুলো ভারের কারণেই টুপ করে ডুবে যায় এবং চোখে পড়ে না।
আপনি তন্নতন্ন করে খুঁজে, বিশ্লেষণ করে দেখতে পারেন, স্বাধীন ভারতে যুগের পর যুগ এসব নগণ্য ব্যক্তিরাই ওই নোংরা কাজের জন্য আইনের হাতে ধরা খেয়েছে। ওই ফাইলে রয়েছে একটি অভিযোগনামা এবং চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশও। এখন এটি রয়েছে অফিসের সর্বোচ্চ কর্তার স্বাক্ষরের অপেক্ষায়।
এটা তো অবধারিত যে যখন অফিসের এ ঘর ও ঘরে একটি অভিযোগনামা এবং অব্যাহতির সুপারিশ চালাচালি হয়, তখন সংশ্লিষ্ট লোকটির গর্দান যে কাটা যাবেই, সে বিষয়ে তো সে জ্ঞাত থাকবেই। মানচান্দা বিষয়টি ব্যাখ্যা করেই সাংবাদিক ও রিপোর্টারদের সন্ধ্যায় একটা পাঁচতারা হোটেলে একটু পানাহারের আমন্ত্রণ জানায়।
ঘাপলা আছে এমন খবরে কিছুটা জল ঢেলে তরল করে দিতে পারে স্কচ। সবচেয়ে চমকপ্রদ ব্যাপার হচ্ছে, দুই পক্ষই জানে ও বোঝে যে একে অপরকে ঘোল খাওয়াচ্ছে।
‘এই বেজন্মা পিআরও ব্যাটা একটা বেশ্যার মতো মিটমিট করে হাসছে। যেন আমরা কিছুই জানি না…’ খুব মনোযোগ দিয়ে গ্লাসে হুইস্কি ঢালতে ঢালতে এবং টিক্কা, কাবাব ও আরো কিছু উপাদেয় খাদ্য খেতে খেতে রিপোর্টাররা ভাবছিল। অপরদিকে পিআরওর মগজেও ধারণাটা খেলা করছিল যে ‘নে শালা বেজন্মারা, মাগনা মদ গিলে নে, জারজের বাচ্চাগুলো। যে কয় পয়সা মাইনে পাস, তা দিয়ে দেশি মাল কেনারও তো ক্ষ্যাম নেই। তোদের কলমের সঙ্গেই যে তোরা বেশ্যাপনা করছিস তা কে না জানে?’
কিন্তু পিআরও ও রিপোর্টাররা হাসি বিনিময় করেই চলেছে। কারণ ওই দুর্গন্ধময় সংবাদগুলো সম্মানজনকভাবেই ছাপতে হবে। কেন, আপনি কি জানেন না যে আমরা সভ্য ও সংস্কৃতিবান মানুষ? সংস্কৃতিবান নগ্ন সত্যকে এড়িয়ে চলে, তারা সত্যকে সুন্দরভাবে কাপড়ে মুড়িয়ে রাখে।
প্রত্যেক পিআরও-ই জানে, পেটে মদ পড়ার পর তাদের আর অফিসে যাওয়ার মুরোদ থাকবে না, লেখার ইচ্ছাও উবে যাবে। বরং বাড়ি গিয়ে সটান বিছানায়। মধ্যরাতের পর তাদের ঘুম কিছুটা পাতলা হলেও নেশাটা যে থাকবে, তাতেই বউকে নিয়ে ঘুমানোর সময় ভাববে হেমা মালিনী কিংবা মাধুরী দীক্ষিতদের বউ ভেবে নিয়ে ঘুমোচ্ছি।
এই অবস্থায় মূল ঘটনার কী হবে? এর শেষই বা কোথায়? কিন্তু এর পরও প্রত্যেক সমস্যার মধ্যেই একটা সমাধান থাকে। মানচান্দার পরিকল্পনাটা কাজে দিয়েছে এবং ঘটনাটা কিছু সময়ের জন্য প্রচারমাধ্যমে আসেনি। প্রত্যেকেই তাদের নিউজ এডিটরের কাছে রিপোর্টটা দেবে তার পরদিন।
প্রতিটি পেশারই তো একটা নীতি-আদর্শ থাকে!
অতএব রামলালের নিজের কারণেই তার মৃত্যুর ব্যাপারটা সাধারণ মানুষের জানাশোনার বাইরে থেকে গেল। তবে সম্ভাবনাটা একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। এটা একসময় প্রকাশ পাবে, যখন তার দেহটা হবে এক মুঠো ছাই এবং এক বস্তা হাড়।
আত্মা? আত্মা তো বাতাসের ফুঁ। এ ছাড়া ওই আত্মা নিয়ে কে এখন মাথা ঘামায়? ওটা নিয়ে খামোখা ঘাঁটাঘাঁটি করার মানেই হয় না। যা চোখে দেখা যায় না কিংবা ক্ষতিকর নয়, তার জন্য বিচলিত হওয়ার কী আছে! পরদিন, অর্থাৎ তৃতীয় দিনে প্রত্যেক খবরের কাগজে খবরটা বেরোল যে রামলাল আত্মহত্যা করেছে এবং প্রত্যেকটি কাগজে এমন খবরই বেরিয়েছে। তার বিরুদ্ধে যে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে তাতে উল্লেখ আছে, দুর্নীতি ও ঘুষের অভিযোগ রয়েছে। সে যে সাসপেন্ড হয়ে যাবে, এ ভয়েই সে টাউন হলের সর্বোচ্চ তলা থেকে লাফ দিয়ে তার জীবন শেষ করে দিয়েছে।
সেই দুই দিনে রামলালের বিধবা বউ ও সন্তানরা শুধু ভেবেছে তারা পাথরকুচির নিচে চাপা পড়ে ছিল। তার মৃত্যুটা তাদের কাছে ছিল একটা ভূমিকম্পের মতো।
সেই দিনগুলোতে তার প্রতিবেশীরাই খাবারদাবার সরবরাহ করেছে। এখন এটা এমন একটা বিষয় যে এ ধরনের ঘটনা যেন উঁচুতলার সমাজে ঘটে না। সেখানে কেউ মারা গেলে মৃত্যুর মতো নিঃশব্দ অবস্থা বিরাজ করে ঠিকই; কিন্তু জীবন তো থেমে থাকে না। যে যেখানেই হোক, চাকরবাকররা খায়, সান্ত্বনা বা সহানুভূতি জানানোর জন্য লোক এলে তাদের চা দিয়ে আপ্যায়ন করতেই হয়, এসব কারণে রান্নাঘরের কাজ কখনো বন্ধ থাকে না।
তুলনায় দেখা যায় নিম্নবিত্তদের চেয়ে উচ্চবিত্তদের শোক প্রকাশ অনেক বেশি মার্জিত ও ভদ্রসম্মত।
একেবারে নিম্নস্তরের মানুষদের এসব সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় না। কারণ অধিকাংশেরই বাসার চেহারা একেবারেই হতচ্ছাড়া গোছের। তাদের এই ক্ষুদ্র ও জঘন্য বাসা অধিকাংশ সময়ই থাকে ঠাণ্ডা। এসব বাসায় মৃত্যু মানেই একটা বাড়তি খরচের বোঝা। এই অতিরিক্ত খরচের জন্য ধারদেনা করতে প্রতিবেশী বা বন্ধুদের বাড়িতে যাতায়াতে এতই ব্যস্ত থাকতে হয় যে একটু জিরোবে কিংবা দুদণ্ড আহাজারি করবে, সে সুযোগও হয় না।
তৃতীয় দিনে রামলালের দুর্নীতি, চার্জশিট ও সাময়িক বরখাস্তের খবর যখন কাগজে বেরোল, তখনো তার বউ কিছুই জানে না। খবরের কাগজ এমন একটা বিলাসিতা যে তার বউয়ের মতো মানুষের পক্ষে সেই খরচ বহন করা সম্ভব নয়। এই শ্রেণির মানুষ উড়ন্ত বা কার্নিশের ওপর বসে থাকা কাকদের মাধ্যমেই জানতে পারে। এই ‘উড়ন্ত সংবাদ’, যা কিনা সাধারণ গুজব নামেই পরিচিত। সাধারণত এসব খবরের যোগসূত্র থাকে প্রতিবেশী কোনো বাড়ির কোনো ঘটনার সঙ্গে। অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাই হচ্ছে প্রতিবেশীদের বাড়ির কোনো ছেলের সঙ্গে কোনো মেয়ের প্রেম-পিরিতি।
ধীরে ধীরে শহরের এসব ঘটনা একসময় মিইয়ে আসে, প্রধানত ডাকাতি বা খুন কিংবা আত্মহত্যা। আর জাতীয় পর্যায়ের কোনো ঘটনার ব্যাপারটা কানাকানি হতে হতে কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তির পর্যায়ে চলে যায়। ওই যে খবরটা, ইন্দিরা গান্ধীর ছোট ছেলেটা বিমান দুর্ঘটনায় মারা গেলে ইন্দিরা চিৎকার করে কাঁদেনইনি। আর বড় ছেলে রাজীব চালাতেন বিমান, এখন চালাচ্ছেন ভারত নামের একটি ঘুড়ি। কিন্তু কোনো সন্দেহ নেই, তিনি একজন সুদর্শন ও বুদ্ধিমান এবং তাঁর রয়েছে একজন সুন্দরী ইতালিয়ান স্ত্রী ইত্যাদি। তুমি যদি বাস্তবতার নিরিখে দেখো, তাহলে অন্যান্য খবর সাধারণ মানুষের মনে কোনো প্রতিক্রিয়াই সৃষ্টি করে না। গর্বাচেভ-রিগান চুক্তি এবং জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন অথবা পারমাণবিক চুক্তি, ওই স্পেনে কালোরা না লালেরা ক্ষমতায় এলো তাতে মানুষের কিচ্ছু এসে-যায় না।
যুগোস্লাভিয়া কিংবা কম্পুচিয়াতে কী ঘটছে না-ঘটছে, তাতে থোরাইকেয়ার সাধারণ মানুষের। এরা হচ্ছে তারা, যারা পায়ের ওপর পা তুলে শুয়ে-বসে দিন কাটায়। কারণ তাদের অবস্থান না ঘরকা না ঘাটকা।
রামলালের বউয়ের খোশগল্প করে বেড়ানোর সময় কোথায়! সে জানেও না দুনিয়ায় কী ঘটছে না-ঘটছে। সে গভীর ধর্মপরায়ণা মহিলা, কিন্তু ধর্মকর্ম করার মতো সময়ই তার জোটে না। তার বাড়িতে ছোট্ট একটা মাটির মূর্তি আছে। সে প্রতি সকালে তাকে প্রণাম করে এবং ছোট্ট প্রার্থনার মধ্যে তার পরিবারের মঙ্গলের আশাবাদের কথা জানায়।
ফুল আর ধূপ-ধুনোর এত দাম যে তাদের ভগবান রামলালের বাসায় এটা উপভোগই করতে পারে না।
কিন্তু জন্মাষ্টমীর মতো বিশেষ দিনে রামলাল দুধের আড়ত থেকে ফেরার পথে ফুলের পার্ক থেকে কিছু ফুল নিয়ে এসে দেবতাকে অর্ঘ্য দেয়। এই ফুল ও ধূপ-ধুনোর অর্ঘ্য দেবতার ‘শুভ জন্মদিন’-এর জন্য যথেষ্ট।
যদিও রামলালের স্ত্রী তার স্বামীকে নিয়ে খবরের কাগজে এত ঘটনা ছাপা হচ্ছে তার কিছুই সে জানে না। কিন্তু ইতিমধ্যেই বিষয়টি চারদিকে রটতে শুরু করেছে এবং রসাল ডালপালা ছড়াতে ছড়াতে প্রতিবেশীদের কান থেকে কানে চলে গেছে।
শেষতক রামলালের পরিবারে পৌঁছায় খবরটি। খবরটি যেন উড়ে এসে রামলালের বউ প্রেমার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
সে বুক চাপড়ে চিৎকার করে কেঁদে বলে, ‘এটা মিথ্যা। ডাহা মিথ্যা। শুধু আমিই জানি মাসের তিরিশটি দিন কিভাবে চলে। পাই পাই হিসাব করে হেঁসেলের চুলা জ্বালিয়ে রাখতে হয়। তার বেতনে মাসের বিশ দিনও যায় না। বাকি দশ দিন? ওই ধারদেনা। যে কেউ মুদির দোকানে গিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখতে পারে। তার কাছে আমাদের সব সময় দেনা থাকে। বউজি যদি ঘুষ নিত, আমি এখানে বসে আহাজারি করতাম না, আগামীকাল বাচ্চাদের মুখে কী তুলে দেব তা নিয়েও দাপাদাপি করতাম না।’
প্রতিবেশীরা রামলালের বউয়ের সব কথা শুনে সমবেদনাও প্রকাশ করে যার যার কাজে চলে গেল।
এসব লোক কড়াইয়ে তলানির মতো পড়ে থাকে, তারা মধ্যবিত্ত ও খুব স্বার্থপর। তাদের সারাক্ষণের চিন্তা বাড়ি আর চুলো।
রামলালের বউ সারা রাত ঘুমাতে পারে না। তার সারাক্ষণই মনে হয় সে জ্বলন্ত কয়লার ওপর শুয়ে আছে।
সহসা তার এলোমেলো চিন্তার মাঝে একটা কথা মনে হয়-‘বউজি’ একজন শান্ত মানুষ। সারাক্ষণ নিজের চিন্তায় ডুবে থাকে। পারতপক্ষে কোনো বিষয়ে কথা বলে না। হতে পারে তার জীবনে আরো একজন নারী ছিল, যার পেছনে সে বাড়তি আয়গুলো ঢেলেছে। তুমি কখনো এসব মানুষ চেনো না।
এবং এভাবেই এই সাধারণ মানুষটি, যে কিনা চোখে ঠুলি পরে ঘানির তেল বের করে যাচ্ছে। সে একজন সাধারণ কেরানি, মাত্র আড়াই রাতের মধ্যে সব মান-সম্মান হারিয়ে মরে গেল!
তার গোত্রে সে ছিল একটা ছাগল মার্কা লোক, যদিও এই গোত্রটি ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে …
গল্পের তৃতীয় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।