যাচ্ছে। সে নিজেকে এই ভেবে সান্ত্বনা দিত যে এমন দিনও আসবে যেদিন তার সন্তানরা মাথা উঁচু করে চলবে এবং ভাববে তার পিতৃদেব আগাগোড়া একজন সৎ মানুষ ছিলেন। এ জন্য তারা গর্ভও বোধ করবে। তার বেতনে যে সারা মাসও চলত না, এই বিষয়টি তার কাছে একেবারেই মূল্যহীন। তার পরিবারের লোকেরা তো দেখত না সে কত বেতন পায়, না পায়; গত বিশ বছরে সে নতুন একটা স্যুটও বানাতে পারেনি। তার জুতা জোড়ার তলাও এমন ক্ষয়ে গেছে যে মাঝেমধ্যে মনে হয় রাস্তার গনগনে গরম আলকাতরা তলা ভেদ করে তার পায়ের চামড়া পুড়িয়ে দিচ্ছে। তার একমাত্র সান্ত্বনা যে সে তার সন্তানদের সব রকম দম বন্ধ করা পরিবেশ থেকে বাঁচিয়ে বড় করে তুলেছে।
চরিত্রের দৃঢ়তা নিয়ে তার একটা গর্ভ ছিল; একটানা কাজ করেছে, উচ্চ নৈতিক মনোবল ছিল তার বড় ভিত্তি, যদিও সে জানে নৈতিকতার এই ভিত্তিফিত্তির দাম বাজারের পেঁয়াজের দামের চেয়েও কম।
তার অপরাধবোধ ছিল দুটো। একটা দারিদ্র্য, অন্যটা সততা।
একজন গরিব মানুষের প্রয়োজন যুক্তি দিয়ে তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারা কিংবা গায়ের জোরে দখল করে নেওয়া। সে এই দুটোর যদি কোনোটাই করতে না পারে, তাহলে সে নিজেই দখল হয়ে যেতে পারে।
রামলাল এভাবেই দখল হয়ে গেল, যখন সে আর বেঁচে নেই।
আসলে সে ডাকাতির ব্যাপারটা জেনেছিল তার মৃত্যুর সামান্য কিছু আগে। আর খবরটা সে যখন জানতে পারে তখনই সে সিদ্ধান্ত নেয় দিনমানেই সে বিষয়টি জানিয়ে দেবে।
এভাবেই ব্যাপারটা ঘটে যায়।
এটার শুরুটা এভাবে : যখন গণপূর্ত বিভাগের কমিশনারের বিশাল, মনোরম, আকর্ষণীয় ও ক্ষমতাবান প্রাইভেট সেক্রেটারির টেবিলে তার বদলি হওয়ার নথিটি আসে, তখনই জানাজানি হয় তার সহকর্মীরা তাকে অভিনন্দন জানায়।
সে কিছুটা হতভম্ব হয়ে জানতে চায়, অভিনন্দন! কিন্তু কেন? এটা তেমন কোনো পদোন্নতি নয়। একজন কেরানি একটি জোয়ালে বাঁধা গরু ছাড়া আর কিছু নয়। আসলে জোয়ালটা তুমি বাইছো মাঠে, না গরুর গাড়িতে। পার্থক্য তেমন কিছুই নয়।
‘পার্থক্য? তোমরা পার্থক্যের কথা বলছ? ওহে বন্ধুরা আমার! তোমরা যদি কেউ এই জাদুর চেয়ারে একবার বসতে পারো, তখনই এর পার্থক্যটা বুঝতে পারবে। তোমার নতুন উপরওয়ালার ঘরে টনকে টন মালপানির লেনদেন হয়। ভক্তরা তখন দেবতার উদ্দেশ্যে ভক্তির ডালি সাজিয়ে আসে। তখন পুরোহিতও কিছু ভাগ পায়’-একজন অর্থপূর্ণ হাসি হেসে কথাটি বলে।
সবাই হাসে, কিন্তু রামপালের মুখ লাল হয়ে যায়। ভাবে সবাই বুঝি তার দিকে পাথরের নুড়ি ছুড়ে মারছে।
সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবে, ‘হায় ভগবান! এই নরক যন্ত্রণা থেকে তুমি আমার সম্মান ও সততা রক্ষা করো।’
এখন সে নতুন কর্তার সঙ্গে কাজ শুরু করে। তখনই কর্তা তাকে একটি তালিকা ধরিয়ে দিয়ে বলে, ‘এই তালিকার সবাই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি; এরা ফোন করলে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে লাইন দেবে; আর যদি সশরীরে আসে তাহলে সঙ্গে সঙ্গেই আমার ঘরে নিয়ে আসবে।’
বাকিটা নিজে বুঝতে সে কিছুটা সময় নেয়, ধীরে ধীরে, অভিজ্ঞতা দিয়ে। তাকে কর্তার মনোভাব বুঝতে হয় তার চোখের পাতার ওঠানামা দেখে, চোখের দৃষ্টিভঙ্গির চেহারা বুঝে। কর্তার বিভিন্ন মনোভাবের সঠিক অর্থটা বুঝে যথাযথভাবে কাজ করা তার চাকরির একটা অতি আবশ্যক অংশও।
তাকে অনেক সময় তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে হয় ওই মহাক্ষমতাবান শয়তান লোকটার ঘরে কাকে ঢুকতে দেবে বা দেবে না; বস যখন মিটিংয়ে ব্যস্ত থাকে তখন চা দেওয়া না-দেওয়া, তিনি ফ্রি থাকলেও সামান্য নেশাটেশা সরবরাহ করা, ভব্যতাহীন কিছু লোকের পাইপ টানা মেনে নিতে হয়। এর পরও তার ‘লাভজনক’ কোনো কাজের জন্য যদুমধুকেও কর্তার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দিতে হয়। তার খামোখা সময় নষ্ট করার সময় কোথায়?
প্রাইভেট সেক্রেটারির চেয়ারে বসে রামলাল বুঝতে পারে এই রহস্যময় জগৎটার বিধাতা হচ্ছে সর্বক্ষমতাধর অর্থ। যদি তারও রাজনৈতিক দলের উপরওয়ালা কেউ ফোন করে একটু সাহায্য চায়, তাহলেই বুঝতে হবে টাকা-পয়সার লেনদেন আগেই হয়ে গেছে।
রামলাল বুঝে গেছে চোরেরা তাকে ঘিরে ফেলেছে। তার মনে হয় সে যেন আলীবাবা। আসলেই তাই, তবে তাকে ঘিরে ফেলেছে চল্লিশজন নয়, চল্লিশ হাজার চোর।
চিন্তা করে দেখল রামলাল, সব কাউন্সিলর, রাজ্য সরকার ও সংসদের সব সদস্য, যারা নির্বাচনের সময় সহায়তা করেছে, তাদের সব সময়ই যত্নের সঙ্গে তোয়াজ করে যেতে হবে।
এসব মালই চোরের হাড্ডি।
সব সময়ই দেখা যায় বড় চোরদের পেছনে একদল ছোট চোর থাকে। এরা সেই রাশিয়ান বড় পুতুলের মতো, যার একটা খুললে আরেকটা বেরোয়; সেটা খুললে আরেকটা, তারপরে খুললে আরো এবং সবার শেষে সবচেয়ে ছোটটা। চোরের মধ্যে চোর।
আরব্য রজনীর চল্লিশ চোরকে আলীবাবা যেভাবে চেটেপুটে শেষ করেছিল, রামলালের পক্ষে তার কিছুই করা সম্ভব হলো না। যেদিন সে এই পদে যোগ দিতে আসে, সেদিনটাকে সে কেবল অভিশাপই দেয়। সে অনুভব করে এরা তার শুধু বারোটাই বাজাতে পারে। কারণ ভারতের আয়তনে সে একটা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিন্দু ছাড়া আর কিছুই নয়, সব দেশের উত্তরাধিকারের বিচারে তার সব কিছুই লোপাট হয়ে যেতে পারে।
এই চেয়ারে বসে মনে হয় তার তৃতীয় চক্ষু খুলে গেছে। যদিও এটাকে শিবের তৃতীয় চোখ বলা হয়। কিন্তু শিব যেমন তৃতীয় চোখের ক্রোধে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড পুড়িয়ে দিতে পারে, পচা-গলা পৃথিবীকে ধ্বংস করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে, রামলাল তার তিন নম্বর চোখ দিয়ে কিছুই করতে পারে না। শিব যেমন বিষপান করে নতুন চেতনা অর্জন করেছিল, সে ক্ষেত্রে সে কেবল ওই চোখেই শুধু দেখতে পায়।
তৃতীয় চোখ দিয়ে রামলাল দেখে কিভাবে বিনা ওষুধে লাখ লাখ লোক মারা যায়, শিশুরা কেন শিক্ষা পায় না, যুবাদের হাড়-মাংস ঘুণপোকার আক্রমণে ক্ষয়ে যাচ্ছে, যে বয়সটায় কাজ করার বয়স, তখনই দেখা যায় তাদের জন্য কোনো কাজ নেই; এমনই অবস্থা যে আলকাতরা দিয়ে সদ্য তৈরি করা রাস্তা বর্ষার প্রথম মৌসুমেই ধুয়েমুছে গেছে, রাস্তা খানাখন্দে চলাচলে ঝাঁকুনির চোখে জান শেষ। কিন্তু সব রাজনীতিবিদই নির্বাচনে কোটি কোটি টাকা খরচ করছে। সে জানে নির্বাচিত হওয়ার পর তার সব বেতনের কাছে রামলালের আয় তুচ্ছাতিতুচ্ছ। কিন্তু রামলাল এর বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারে না। পারার মধ্যে পারে শুধু ‘জি স্যার’, ‘ঠিক আছে স্যার’ বলতে।
তার করণীয় হচ্ছে, বড় কর্তার ডিকটেশন নেওয়া, চিঠি ও নোটগুলো টাইপ এবং টেলিফোন রিসিভ করা।
রামলালের চাকরির একমাত্র প্রমাণ হচ্ছে তার কাঁধের ব্যাজ।
‘রামলাল? কোন রামলাল?’
‘রামলাল! ওহ, যে ভাইরন প্রসাদের ছেলে।’
‘কোন হতভাগা ভাইরন প্রসাদ? এই দেশে লাখ লাখ রামলাল আর ভাইরন প্রসাদ তারপিন তেলের চেয়েও কম দামে বেচাবিক্রি হচ্ছে, গুদামে জমা আছে।’
‘আরে রামলাল হচ্ছে পাবলিক ওয়ার্কসের কমিশনারের একান্ত সচিব। চাকরি করে টাউন হলে।’
‘তাই বলো! ওই রামলাল!’-এই পরিচয়টাই তাকে আর দশজন থেকে আলাদা করেছে।
তার সন্তান তিনটি। তাদের প্রয়োজন খাদ্য, ওষুধ, স্কুলের বেতন, নোটবই আর বইয়ের জন্য টাকা। তারাই তো দেশের ভবিষ্যৎ। এটা বলা নিষ্প্রয়োজন যে তাদের যথেষ্ট পরিমাণ খাবার ছিল না, নতুন ক্লাসে যাওয়ার সময় কখনোই নতুন বইও ছিল না। তাদের পায়জামা ছেঁড়াই থাকত, বিশেষ করে পেছনের দিকে, আর জামার কলার? সব সময়ই ছেঁড়াফাটা।
রামলালের বৌয়ের হাতে যেন জাদু ছিল। বাচ্চাদের ওই সব ছেঁড়াফাটা জামাকাপড়ের অংশ এমনভাবে সেলাই করে দিত যে ধরাই যেত না। আর সেগুলো ম্যাজিকের মতো করত রামলালের বাতিল জামাকাপড়ের টুকরো দিয়ে। ঝুল বেশি থাকলে ছোট করে দিতে পারত, হাতার আকার ছেঁটেছুটে এমন করে দিত যেন জাদুবিদ্যা। কিন্তু সে কখনোই জামার কলার সেলাই করতে পারত না। ফলে ওই কলার রামলালের কলার থেকে তার বাচ্চাদের কলার পর্যন্ত ব্যবহৃত হতো।
দেশের দারিদ্র্য ও ক্ষুধার মতোই এই কলার চলত বংশপরম্পরায়; শোভা পেত দেশের ভবিষ্যৎ বংশধরদের গলায়।
শিক্ষকরা সব সময়ই তাদের বকাঝকা, গালমন্দ করত; বকত দেরি করে আসার জন্য, ঠিকমতো বাড়ির কাজ না করা, সময়মতো স্কুলের বেতন দিতে না পারা, আর অসভ্যতা ও বাঁদরামির জন্য।
আসলে রামলালের ক্লান্ত ভারাক্রন্ত কাঁধে ‘দেশের ভবিষ্যতের বোঝা’র ভার, সে জন্য ‘পৌরাণিক শিল্পীত মানচিত্র’-এর মতো কাঁধ ঝাঁকিয়ে ফেলেও দিতে পারত না। কিন্তু সে মানচিত্র প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বরই তো!
ঈশ্বর তো সবই করতে পারে! তারা ঘাড় ঝাঁকুনি দিতে পারে, পাহাড়-পর্বতকে হাতের তালুর ওপর তোলা কোনো ব্যাপারই নয়, মাখন চুরি করতে পারে এবং বিবাহযোগ্য ন্যাংটো মেয়েদের স্নান দেখতে পারে, বিবাহিতা মহিলাদের সঙ্গে জোর গলায় প্রেম-ভালোবাসার কথা বলা, যাদের ওপর প্রভুত্ব খাটাতে চায় তাদের কাছে গর্ভবতী স্ত্রীকেও পাঠানো, স্ত্রীর সতীত্ব প্রমাণের জন্য জ্বলন্ত অঙ্গারের ওপর দিয়ে হাঁটাতেও পারে, তারা সবই পারে, কারণ তারা প্রভু।
রামলাল তার কাঁধ থেকে এসব ঝেড়ে ফেলার কথা চিন্তাই করতে পারত না; যদি পারত তাহলে আসন্ন ভূমিকম্পের আঘাত পাথরের কণার মধ্যে চাপা পড়ে থাকত।
অতএব, রামলাল কাজ করে যেত নিঃশব্দে। নতুন নতুন যেসব অভিজ্ঞতা সে অর্জন করত সেগুলো বিষ গেলার মতো হজম করে ফেলত।
বৃষ্টির মৌসুম শুরু হয়েছে। গত দুদিন মুষলধারে বৃষ্টির তৃতীয় দিনে নতুন বানানো স্কুলের ছাদ ধসে পড়ল তাসের ঘরের মতো এবং সঙ্গে সঙ্গে সেখানেই মারা গেল চারটে শিশু। মারাত্মক আহত চারটে শিশুকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো।
যে কন্ট্রাক্টরকে স্কুল বানানোর দায়িত্ব দেওয়া হয় রামলাল তাকে চেনে। রামলালের মাধ্যমেই তার বস কন্ট্রাক্টরকে হাজার গজ আয়তনের একটা প্লট সম্পর্কে আভাস দিয়ে জানিয়েছিল একজন ভালো আর্কিটেক্ট দিতে। সবজান্তার মতো হাসি দিয়ে বলেছিল কন্ট্রাক্টর, ‘আর্কিটেক্ট কেন? আমিই তো ওটা বানিয়ে দিতে পারি। সাহেবকে এটা নিয়ে চিন্তা করতে বারণ করো। আমাকে শুধু দশটা স্কুল বিল্ডিং বানানোর কার্যাদেশটা পাইয়ে দাও। দিয়ে স্যারকে বলে রেখো তার চিরবিশ্বস্ত দাসানুদাস সব কাজ করে দেবে।’
রামলাল জানত এর মধ্যে একটা নোংরা খেলা আছে। তবে সে বিশ্বস্ততার সঙ্গেই তথ্যগুলো তার সাহেবকে বলেছিল।
রামলালের নিজেকে একজন দুষ্কর্মের সহযোগী মনে হয়।
কন্ট্রাক্টর তার কথা রেখেছে এবং ছয় কি সাত মাসের মধ্যে বাড়ির কাজ শেষ। একটা দেড়তলা বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি। মার্বেল আনা হয়েছে মাকরানা থেকে, বোম্বাই থেকে এসেছে টাইলস। সাহেবের বৌয়ের ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে এসেছে স্যানিটারি ফিটিংস, লাইট ও ঝাড়বাতি, ফ্যান এবং এয়ারকন্ডিশনার।
রামলালের ওপর কখনো কখনো মেমসাহেবকে নিয়ে মার্কেটে গিয়ে ইটালিয়ান ও জার্মান সরঞ্জামাদি কেনার নির্দেশ এসেছে। এসবের দাম শোধ করত কন্ট্রাক্টর।
বাড়ির কাজ শেষ হওয়ার পর দেখা গেল একটা অপরূপ সুন্দর ও মজবুত বাড়ি। এমন একটি বাড়িতে কর্তার তৃতীয় ও চতুর্থ বংশধরও বসবাস করতে পারবে।
স্কুল ভবন তৈরি হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যে ভেঙে পড়ল কি না তা নিয়ে এখন কে আর মাথা ঘামায়? যেসব শিশু ধ্বংসস্তূপের মধ্যে জীবন দিল তারা হিসাবের মধ্যেই এলো না। অমন বেহিসাবি মৃত্যু দেশে হাজারে হাজারে ঘটছে; প্রত্যেক দিন গাদায় গাদায় জন্মও তো নিচ্ছে।
যদি আমাকে জিজ্ঞেস করো, কে এই শিশুদের স্কুলে যেতে বলেছিল? কেন বলেছিল তাদের? তারা ফুটপাতে জুতা পালিশের কাজ করতে পারে, রাস্তার পাশে ‘ধাবা’র থালাবাসন ধুতে পারে, বাসাবাড়ির চাকরগিরি কিংবা কোনো কারখানার পেছনে ভাগাড়ে কাজ রয়েছে, কুলিগিরি করা যায়, রাস্তার মোড়ে খবরের কাগজ বিক্রির কাজও তো করা সম্ভব। হ্যাঁ, তারা যা খুশি তাই করতে পারে। কিসের পাল্লায় পড়ে তারা বই-খাতা নিয়ে স্কুলে যায়? তারা কি জানে না শুধু শোভা বাড়ানোর জন্য স্কুলটি বানানো হয়েছে, আর বর্ষা মৌসুমের প্রথম ধাক্কাতেই ওটা ধসে পড়বে?
খেপে গেছে রামলাল।
তার রাগ নিহত বাচ্চাগুলো ও বসের ওপর, কন্ট্রাক্টর এবং নিজের ওপরও।
বিকেলে বস মাখন মাখানো গলায় রামলালকে ডেকে বলল, এই বিল্ডিং বানানোর ব্যাপারে কন্ট্রাক্টরকে দেওয়া যত ফাইল আছে, সব নিয়ে সন্ধ্যায় আমার বাসায় আসবে।
সন্ধ্যার সময় বিল্ডিং বানানোর সংশ্লিষ্ট যত ফাইল, সব নিয়ে বসের বাসায় পৌঁছে দেখল ড্রয়িংরুমে বসের সঙ্গে কন্ট্রাক্টর ও তার ছেলে একসঙ্গে বসে মদ গিলছে।
বস বলল, রামলাল, ফাইলগুলো ওই টেবিলে রাখো, আর বিল্ডিং বানানোর ব্যাপারে ফাইলে যেখানে যেখানে উল্লেখ আছে, সেখানে কাগজ দিয়ে দিয়ে রাখো।
রামলাল শান্তভাবে যন্ত্রের মতো বসের নির্দেশ পালন করতে থাকে।
কন্ট্রাক্টর রামলালের কাজের গুরুত্ব বুঝতে পেরে একটা গ্লাসে মদ ঢেলে রামলালকে দেয়। রামলাল অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলল, আমি জীবনেও ও জিনিস চোখে দেখিনি। কিন্তু কন্ট্রাক্টর পীড়াপীড়ি করতে থাকে, আরে একটু খাও না! আমরা তোমাকে সম্মানিত করতে চাইছি। রামলাল, তোমাকে একটা চুমুক দিতেই হবে। তুমি যদি না দাও, আমরা কিন্তু সত্যি আহত হব।
নিঃশব্দে মিটিমিটি হাসছিল বস। শুধু তাই নয়, একটা নির্লিপ্ত ধৈর্য নিয়ে গোটা ঘটনাটা দেখছিল। এটা সে সচরাচর করে না।
রামলাল তার দিকে তাকায়; তাকিয়ে একবার কৃতজ্ঞ বোধ করে, সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিশোধের ইচ্ছাটা তীব্র হতেই গ্লাসের সবটুকু মদ এক চুমুকে গিলে ফেলে। শেষ করেই গ্লাসটা আবার এগিয়ে দেয়, কন্ট্রাক্টর আবার সেটি ভরে দিল।
দ্বিতীয় পেগটি শেষ করে সে গা ছাড়া দিয়ে পেছনে হেলান দিয়ে বসে। সে চোখ খুলে চায়, তাকায় চারপাশে। এই ঘরে সে বহুবার এসেছে, কিন্তু কখনো চোখ তুলে কথা বলতে পারেনি। এইবার জীবনের প্রথমবার চারদিকে চোখ মেলে দেখল, ঘরে রয়েছে টিভি, ভিডিও, পারস্যের কার্পেট, মনোরম ফুলদানিতে সাজানো ফুল, ডিনার সেট, বাদ্যযন্ত্রের সরঞ্জাম এবং আলো ঝলমল ঝাড়বাতি।
উঠে দাঁড়ায় রামলাল। হাঁটা দেয় বাইরে।
বাসায় ফেরার পথে সে নিজেকেই ধিক্কার দিতে দিতে বলে, ওহে বেজন্মা রামলাল! জীবনে কী করতে পারলে? অর্জনটাই বা কী তোমার? পরিবারের মুখে তো দুই পদের খাবারও তুলে দিতে পারোনি! কোনো সুখ দেওয়ার ক্ষমতা তোমার হয়নি। তুমি স্কুলের ওই হতভাগ্য শিশুদের স্কুল ভবন ধ্বংসের মৃত্যুর হাত থেকেও তো বাঁচাতে পারলে না!
রামলাল, তুমি, তুমি একটা মরা কুত্তার চেয়েও অধম। সে ছিল মাতাল এবং জীবন সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন। তার সারাটা রাত গেল নিজের সঙ্গেই বোঝাপড়া করতে করতে, কথা বলতে বলতে। সমগ্র বিশ্বের ওপর সে তখন মহাক্ষুব্ধ।
সকালে ঘুম থেকে উঠল রামলাল। শান্ত, সমাহিত রামলাল একটা নতুন ব্লেড বের করে দাড়ি কামায়, স্নান সারে, কাপড় পরে এবং অফিসে যায়।
ওপরে উঠতে থাকে রামলাল, উঠতেই থাকে; যতক্ষণ না সে ছাদে পৌঁছায়, উঠতে থাকে। সেখান থেকে সে নিচে ঝাঁপ দেয়।
গল্পের প্রথম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।