আর্কাইভ রুম ৩ (Misk Al Maruf)

  1. ঢাকার ন্যাশনাল লাইব্রেরি নিয়ে আমাদের সবারই একটা পরিচিত ছবি আছে।
    দিব্যি আলো, বইয়ের গন্ধ, সাইলেন্ট হল আর বাইরে সারাদিন শিক্ষার্থী গবেষকের ভিড়।
    কিন্তু খুব কম মানুষ জানে এই লাইব্রেরির ভিতরে এমন একটি জায়গা আছে যেটা খুব প্রচার পায় না… বরং ইচ্ছে করেই ভুলিয়ে রাখা হয়।

আমি প্রথম শুনেছিলাম “আর্কাইভ রুম ৩” এর কথা একজন সাবেক লাইব্রেরি স্টাফ নাসির উদ্দিন এর মুখে।
তিনি ১৯৯৬ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত লাইব্রেরিতে ছিলেন।
তার কথার টোন আমাকে অস্বস্তি দিয়েছিল দেখেই বোঝা যাচ্ছিল তিনি এমন কোনো স্মৃতি মনে করছেন যেগুলো তিনি ভুলতে চাইলেও পারেন না।

আমরা লাইব্রেরির নিচতলার পুরনো করিডোরে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম।
একরকম আধো অন্ধকার জায়গা দেয়ালে পুরনো পোস্টার, “জাতীয় পত্রিকা সংগ্রহ বিভাগ” লেখা।
সেখানে দাঁড়িয়েই তিনি আমাকে বলেছিলেন,

“ভাই… রুম–৩ নিয়ে আমরা বেশি কথা বলি না। যেদিন বুঝলেন, সেদিন থেকে আপনি নিজেও এড়িয়ে চলবেন।”

আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম।
এরপর তিনি খুব ধীরে, ভয় মেশানো স্বরে, তার দেখা শোনা সব কথা বললেন।

নাসির উদ্দিন বলেন ১৯৯৮ সালের জানুয়ারিতে রুম ৩ “অফিশিয়ালি” সিলগালা হয়।
রুমটা মূলত পুরনো পত্রিকা হাতে লেখা ডায়রি, সরকারি রিপোর্ট, rare বই এসবের আর্কাইভ ছিল।
প্রায় ২০০ বছরের কালেকশন।

কিন্তু ৯৮ সালের এক গভীর রাতে লাইব্রেরির নৈশপ্রহরী মাসুদ রুম ৩-এর সামনে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়।
তার চোখ খোলা মুখ থরথর করছে।
একদম যেন ভয় দেখে জমে যাওয়া মানুষ।

তার জ্ঞান ফেরার পর সে শুধু একটা কথাই বলেছিল,

“রুমের ভেতর কেউ বই উল্টাচ্ছিল…”

এই কথার পরদিন সকালেই রুম ৩-এর তালায় মোটা ইস্পাত বসানো হয়।
ইউনিটটাকে “অস্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ” ঘোষণা করা হয়।
যারা কাজ করত সবাইকে অন্য সেকশনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

এত বছরেও রুম ৩ আবার খোলা হয়নি।

কিন্তু আসল ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটেছিল ২০১১ সালে যেটা নাসির নিজ চোখে দেখেছেন।

ঘটনা: ডিসেম্বর, ২০১১, রাত ১০টা ৪৭ মিনিট

সেদিন লাইব্রেরিতে বিশেষ ইনভেন্টরি চলছিল তাই সব স্টাফই দেরি করে কাজ করছিল।
নাসিরের দায়িত্ব ছিল পুরনো জার্নাল লিস্ট চেক করা তার রুম ছিল করিডোরের ঠিক পাশেই।

১০টা ৪৭ এর দিকে হঠাৎ করিডোরে একটি অদ্ভুত শব্দ শোনা যায়।

খড়খড়…
চট করে পাতা উল্টানোর শব্দ।
একটা নয়, একাধিক পাতা।

তিনি প্রথমে ভেবেছিলেন কেউ হয়তো কোথাও বই দেখছে।
কিন্তু লাইব্রেরির ঐ সেকশন তখন পুরোই খালি।
সবাই উপরের তলায়।

নাসির বলেন:

“পাতা উল্টানোর শব্দটা ছিল খুব পুরনো, শুকনো কাগজের মতো।
এবং সবচেয়ে ভয়ংকর শব্দটা রুম–৩ এর ভেতর থেকে আসছিল।”

তিনি ধীরে ধীরে করিডোর দিয়ে রুম ৩ এর দিকে হাঁটতে থাকেন।
তার পায়ের নিচে হালকা শব্দ।

আমি তখন মনে মনে অনুভব করতে পারছিলাম, যেন আমিও তার সঙ্গে হাঁটছি।
করিডোরের সেই হালকা স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ…
দেয়ালে ঝুলে থাকা ধুলোমাখা নোটিস বোর্ড… সব আলো যেন একটু হলুদ হয়ে এসেছে।

রুম ৩ এর কাছে এসে তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন।

দরজাটা এখনো একই রকম শক্ত মোটা স্টিলের লক।
কিন্তু দরজার নিচ থেকে হালকা ঠান্ডা বাতাস বের হচ্ছিল।
যেন ভেতরে কেউ আছে।

সবচেয়ে ভয় লাগল যা
সেই পাতার শব্দ একদম হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়।

এক মুহূর্তের জন্য যেন সবকিছু থেমে যায়।
করিডোরের বাতাসও থমকে থাকে।

তারপর…

দরজার ভেতর থেকে শোনা যায়
একটা খুব ধীর শব্দ, টক… টক… টক…
যেন কেউ নখ দিয়ে দরজার কাঠ খুঁটছে।

নাসির শ্বাস আটকে ফেলেন।
তার কানে তখন শুধুই সেই শব্দ ধীর, ছন্দহীন অদ্ভুত।

তিনি ভয় পেয়ে দৌড়ে ওপরের তলায় চলে যান।
পরদিন ঘটনা অথরিটিকে বললেও সবাই বিষয়টাকে “গল্প” ভেবেছে।

কিন্তু সত্যিকারের প্রমাণ এসেছে ২০১২ সালের সিসিটিভি ফুটেজে।

হ্যাঁ লাইব্রেরির এক পুরনো কন্ট্রোল রুমে রুম–৩ এর করিডোরের একটা ক্যামেরা ছিল।
২০১২ সালের জুন মাসের এক রাতে প্রায় ১টা ১২ মিনিটে ফুটেজে দেখা যায়,

করিডোর পুরো ফাঁকা।
কেউ নেই।

কিন্তু ক্যামেরার ডান পাশে, রুম ৩ এর ঠিক সামনে একটা অদ্ভুত ছায়া।
মানুষের মত আবার না-ও হতে পারে।
ছায়াটা হঠাৎ করে দরজার দিকে ঝুঁকে পড়ে যেন দরজার ফাঁক দিয়ে কিছু দেখছে।

৫–৬ সেকেন্ড পরে ছায়াটা মিলিয়ে যায়।
কোনো শব্দ নেই, কোনো মানবদেহিক নড়াচড়া নেই কেবল মিলিয়ে যাওয়া।

আরো ভয়ংকর হলো
ভিডিওর ঠিক ২ মিনিট পর গার্ড এসে করিডোরে ঢোকে।
সে বারবার চারপাশে তাকায়, কিন্তু কিছু দেখে না।

ফুটেজটা কিছুদিন পরে “সংরক্ষণ” এর নাম করে সরিয়ে ফেলা হয়।

২০১৩, নাসির উদ্দিনের শেষ রাত

এটা তার জীবনের সবচেয়ে অদ্ভুত অভিজ্ঞতা।

সেদিন ছিল গরমের রাত।
রাত ৯টার দিকে তিনি নিচতলা দিয়ে যাচ্ছিলেন।
সব রুম বন্ধ, করিডোর নিস্তব্ধ।

হঠাৎ তিনি দেখলেন
রুম–৩ এর দরজার নিচ দিয়ে খুব হালকা আলো বের হচ্ছে।
ম্লান হলদেটে ঠিক সেই আলো যেমন পুরনো ল্যাম্পে হয়।

রুম ৩-এ কোনো বিদ্যুৎ সংযোগ নেই।
দরজাটা সিল করা।

তার বুক ধড়ফড় করতে থাকে।
তিনি কয়েক ধাপ কাছে যান।

এবার শোনা গেল,

খসখস…
কারো হাঁটার ছোট ছোট চিহ্ন।

তিনি সোজা তাকিয়ে দেখলেন,

দরজার নিচের ফাঁক দিয়ে কারো পায়ের ছায়া,
ধীরে ধীরে এদিক–ওদিক হাঁটছে।

একটা পা…
তারপর আরেকটা…
নীরবে, ধীর।

যেন কেউ পুরনো লাইব্রেরির ধুলোমাখা বই সাজাতে সাজাতে হাঁটছে।

তাকে দেখে হঠাৎ ছায়াটা থেমে যায়।

নাসির ওই মুহূর্তে বুঝলেন
যে-ই হোক, সেটা তার উপস্থিতি বুঝে গেছে।

এক সেকেন্ড পর বাতাস ভারী হয়ে গেল।
এমন ঠান্ডা লাগল যেন পুরো রুমের ভিতর থেকে শীত প্রবাহিত হচ্ছে।

তিনি পেছন ফিরে দৌড়ে সোজা গার্ড রুমে চলে যান।
সেই রাতের পর তিনি ওই সেকশনে আর একা যাননি।

২০১৪, রুমের ভেতর থেকে পাওয়া ‘সাম্প্রতিক লেখা’

রুম ৩ বন্ধ থাকার পর অনেক বছর পরে একদিন আর্কাইভ রুমগুলোর ধুলো ঝাড়ার জন্য প্রশাসন ভেতরে একটি টেকনিক্যাল টিম পাঠায়।
তারা দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে।

রুম–৩ এ ঢুকে তারা যা পায়, সব বই ১৯৩০–১৯৭০ সালের।
হাতে লেখা ডায়েরিগুলো ১৯৫০ সালের।

কিন্তু সেই ডায়েরিগুলোর একটি পাতায় দেখা যায়—

একটা তাজা হাতের লেখায় তিনটি শব্দ,
“আমি এখনো আছি।”

কালিটা শুকনো হয়নি।
স্পষ্ট, একদম নতুন।

স্টাফরা বলেছিল কেউ হয়তো প্র্যাঙ্ক করেছে।
কিন্তু ভেতরে ঢোকার আগে দরজার লক কাটা হয়নি, সিল ভাঙেনি।
সিসিটিভি চেকেও কেউ ঢোকার প্রমাণ নেই।

রিপোর্টটা পরে “অফিসিয়ালি” হারিয়ে যায়।
রুম ৩ আবার লোহার তালায় বন্ধ করে দেওয়া হয়।

২০২৪-এ আমি গিয়েছিলাম। লাইব্রেরির সেই করিডোর এখনো একই রকম নিস্তব্ধ।
দরজাটাও একইভাবে দাঁড়িয়ে।

এক বর্তমান স্টাফ আমাকে পাশ থেকে বললেন,

“ভাই, রাতে এইদিকে যাই না। মাঝে মাঝে ভেতর থেকে পাতার শব্দ আসে… আর কখনও মনে হয় কেউ দাঁড়িয়ে আছে।”

স্টাফরা ফিসফিস করে বলে, কেউ লুকিয়ে রুমের দিকে তাকিয়ে থাকে, কিন্তু কেউ সত্যিই দেখেনি।

আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
“রুমটা খুলে দেখেন না?”

তিনি খুব আস্তে হেসে বললেন,

“খুললে যে কি দেখি…
আর দেখলে যে ফিরতে পারব কি না কে জানে!”

তারপর তিনি ফিসফিস করে যোগ করলেন,

““কিছু জায়গা আছে, যেগুলো রাতের জন্য বন্ধ থাকাই উত্তম।”

কিন্তু ন্যাশনাল লাইব্রেরির স্টাফরা আজও রুম ৩ এর সামনে দিয়ে দ্রুত হেঁটে যায়।
কেউ দাঁড়ায় না, কেউ কান পেতে শোনে না।

কারণ তারা জানে
কাগজের পাতার শব্দ কখনো কখনো
মানুষের হাত থেকে আসে না।

আপনার এলাকায় এমন কিছু দেখেছেন?

কমেন্টে লিখুন আর পোস্টটা শেয়ার করে অন্যদেরও

জানতে দিন।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!