আয়না

আমি এখন আর বাথরুমের আয়নায় নিজের চেহেরা দেখিনা। ভয় লাগে। মৃত্যুভয়। আমি বাথরুমের আয়নায় নিজের চেহেরা দেখতে গেলে ভয়ঙ্কর এক চেহেরা ভেসে উঠে। ফোঁসকা ফোঁসকা দাগ, বিভৎস মুখমন্ডল, অগ্নিস্ফুলিঙ্গের ন্যায় চোখ। মাঝে মাঝে ভয়ে আৎকে উঠি কিন্তু, নিজের চেহেরা দেখে কি কেউ আৎকে উঠে ?

পুরনো ঘর। থাকার মত অল্প মূল্যে এমন ঘর পাওয়া দুঃস্কর। কোনরকমে মানিয়ে চলছি। উঁচু পাঁচিল ঘেরা বাড়ি। সামনে বিশাল বারান্দা। দখিণা বাতাসে মন-প্রাণ ছুঁয়ে যায়। ঘরটা কিভাবে পেয়েছি, সে কথায় আসি।

রাত দেড়টা, ঘর খুঁজে চলছি শহর থেকে শহরান্তরে। ঘর পাওয়া বর্তমান বাজারে দুঃস্কর। শেষমেষ ক্লান্ত হয়ে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে এসে একটু শান্ত হয়ে নিচ্ছিলাম। পুরো স্টেশন খাঁ খাঁ করছে। শেষ ট্রেনটা বোধহয় চলে গেছে। হঠাৎ এক বৃদ্ধলোককে হন্তদন্ত হয়ে ছুঁটতে দেখলাম,
‘দাদা, হয়েছেটা কি ?’
“আমার ছেলে আর ছেলের বউ আসছে ”
‘শেষ ট্রেনটা যে চলে গেছে, দাদা’
“আজকেও….আজকেও পারলাম না। আমাকে তোমরা মুক্তি দাও”- লোকটা ঠুকড়ে কেঁদে উঠলো। লোকটার কান্না দেখে খুব আফসোস হল। আহ বেচারা ! কত আশা নিয়ে এসেছিল।

লোকটাকে নিয়ে তখনও আমি চিন্তায় ব্যাতিব্যাস্ত। লোকটার জ্বলজ্বল করা চোখ আমার চিন্তায় ছেদ টানলো। কিছুটা ভড়কে গেলাম। লোকটা তার চক চক করা চোখ নিয়ে বলল,পেয়েছি …আমি পেয়েছি ।
‘কি পেয়েছেন , দাদা’
“তুমি …হ্যা তুমি কি আমার বাড়িতে কয়েকটাদিন থাকতে পারবে। এই ধর মাসখানেক”
‘মাসখানেক…? দাদা, আমার একটা ঘরের প্রয়োজন ছিল থাকার জন্য। আমি আপনার ঘরে একমাসের ভাড়াটিয়া হয়ে থাকতে চাই। কত দিতে হবে বলুন …?’

লোকটা কিছুক্ষণ বির বির করে কি যেন ভাবলো, তারপর মুখ তুলে তাঁকালো। দেড় হাজার টাকা লাগবে।
মাত্র দেড় হাজার টাকা ! খুশিতে আমার চিৎপটাং অবস্থা। নতুন ঘর পাওয়ায় পার্টি করার চিন্তা সব ম্লান করে দেয়। বৃদ্ধলোকটার সামনে নিজের চাঁপা আনন্দটাকে আরো চেপে মনটাকে কিছুটা শান্ত রাখার চেষ্টা করি। লোকটা আমার সামনে একগোঁছা চাবি রাখে। সোনালী কালচে হলদে লাল, অনেকটা ডিপ ব্রাউন রঙয়ের। বাড়িটাও আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। লাল-হলুদ বাড়ি। বিশাল জায়গাজুড়ে অবস্থিত ওটা। স্টেশনের ঠিক পিছন দিকটায়। পাঁচিল ডিঙ্গিয়ে একদম বাড়ির ভেতর চলে আসি। চাকুরির বেতন পেলে দেড় হাজার টাকা বৃদ্ধলোকের বলে যাওয়া একটা ঠিকানায় পাঠিয়ে দিয়ে আসি। ল্যাটা চুঁকে গেল। এরপর, বৃদ্ধালোকটার আর খবর নেয়া হয় নি। দিব্যি কেটে যাচ্ছিল সময়টা।

বাসার ভেতরটা যথেষ্ট গোঁছানো। ঝিমঝাম পরিবেশ, খুব মনে ধরে আমার। শুধু একটাই সমস্যা, ঘরে কোন বাথরুম নেই। প্রত্যেকটা সিলগালা করে রাখা। এমনকি, ঘরে ড্রেসিং টেবিল থাকা সত্ত্বেও ঘরে কোন আয়না নেই। আয়না কিনে আনতেও প্রায়সময় মনে ধাকেনা। নিজের চেহেরা আর চুল প্রায়ই অগোছালো থাকায় বসের ঝাঁড়ি খেতে হয়। চুল-দাড়িও অহেতুক দিনে দিনে বেড়ে যাচ্ছে। অবশেষে, প্রথমে দক্ষিণ দিকের বাথরুমের দরজা খুললাম। ভেতরে লাল গালিচা বিছানো। টয়লেট-ই মনে হয়না যেন আস্ত এক বিছানা। ছোট্ট ছোট্ট দু’টো ক্লজিট। আয়নাসহ প্রয়োজনী সবই বাথরুমে পাওয়া গেল। হাফ ছেড়ে বাঁচলাম!

মাঝরাতে হঠাৎ সেদিন গোঙ্গানির আওয়াজ পেয়ে ঘুম থেকে উঠে বসলাম। কে যেন প্রচন্ড ব্যাথায় গোঙ্গাচ্ছে। এই বাড়িতে গত বিশদিন যাবৎ তো আমি একাই আছি। দ্বিতীয় কোন ব্যাক্তির থাকার কোন কথাই নেই। যদিও কোথাও থেকে থাকে তবে, ওটা কে ?

মানুষের মন যথেষ্ট কৌতূহল প্রণেদিত। শব্দটার উৎস খোঁজার জন্য শব্দের পিছু নিলাম। শব্দটা বাথরুম থেকে আসছে। এমন সময় ট্রেনের হুইসেলে আমার পিলে চমকে উঠার মত অবস্থা। গত কুড়িদিন যাবৎ এ বাড়ি নিয়ে অবশ্য হাজারো বাক্যালাপ শুনেছি। বিশ্বাস করিনি। তেনারা নাকি এখানে আছেন,আমি বিশ্বাস করি না। বাথরুমে ঢুকলাম। কিছু ইঁদুড়ের দৌড়াদৌড়ি আর কিচকিচানি শব্দ। মুখে একটু পানি দেওয়ার খুব প্রয়োজন। আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। ওপাশেও আমার মত একজন। এমনটাই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু, এই আমির সাথে ঐ আমির একটুও মিল নেই। অন্যপাশের আমি কোন নড়াচড়া করেনা, স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার টলটলা চোখে সাগরসম রহস্যতায় বন্দী। আমি চমকে উঠলাম, তার এমন নীরবতা দেখে। হঠাৎ, পেছনে কারো অস্তিত্ব অনুভব করলাম কিন্তু তার পূর্বমুহূর্তেই আয়নার ওপাশের চেহেরা পরিবর্তন হতে শুরু করলো। আমি আমাকে একটাসময় আয়নার ভেতরে আবিষ্কার করলাম। আমি নড়াচড়া করতে পারছিনা। অন্য প্রান্তের মানুষের মুখায়বটা দেখতে পাচ্ছি।

ঝট করে স্বপ্নটা ভেঙে গেল। ঘেমে নেয়ে উঠেছি। দরদর করে ঘাম ঝরছে। মুখে একটু পানির ছিঁটা দেওয়া দরকার। এমন সসময় কারো গোঙ্গানির স্পষ্ট শব্দ শুনতে পেলাম। আমি জানি,আয়নার সামনে দাঁড়ালে এখন আমাকে আয়নার ভেতরে চলে যেতে হবে। ও ঠিক আমাকে আয়নার ভেতর আটকে রেখে বাইরে বেড়িয়ে আসবে……

 

গল্পটি পাঠিয়েছেন মোঃ জাহিদুল ইসলাম। খুলশী, চট্টগ্রাম থেকে।

দুঃখিত!