আমি শাহাজাদা [৩য় অংশ]

ইবনে ইয়াসিন বললেন, আমার মেজো ছেলে গাউস। এ তার ছোট ছেলে। এর নাম ইরফান। সালাম দাও ইরফান, ডাক্তার সাহেবকে সালাম দাও।
ইরফান আমাকে সালাম দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল! আমি অবাক হলাম। তখন দীঘিতে রাজহাঁস ভাসছিল, সোনালি মিনারের মসজিদ দেখলাম। কিছুই বুঝতে পারছি না। সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।
ইবনে ইয়াসিন বললেন, একটু শরবত খাও বাবা।
আমি আল্লাহর নাম নিয়ে শরবতে চুমুক দিলাম। অপূর্ব স্বাদ। কী বলব। ডালিমের শরবত। এমন টেস্টি শরবত আমি এর আগে খাইনি। পরবর্তী জীবনে কত দেশে গিয়েছি, অমন টেস্টি লিকুইড আর খাইনি। এনি ওয়ে। চেয়ে দেখি ইবনে ইয়াসিন আমার সামনে একটা কাঁচের বাটি রাখল। তাতে পানি। পানি গরম মনে হল। পানিতে গোলাপের কয়েকটি পাপড়ি ভাসছিল। তার মৃদু সুরভি ছড়িয়েছে।
পরের মুহুর্তে ইবনে ইয়াসিনের হাতে একটি বড় চিনামাটির বাটি দেখতে পেলাম। বাটিতে পোলাও। ধোঁওয়া উঠছে। বৃদ্ধের পিছনে আরও পাঁচ-ছ জন অপরুপ চেহারার লম্বা আর ফরসা বালক দাঁড়িয়ে। বালকদের সবার পরনে বেগুনি শেরওয়ানি আর ঘিরে রঙের চুরিদার পাজামা। চোখের চারপাশে সোনালি রঙের কাজল। প্রত্যেকর হাতেই একটা করে বড় প্লেট বা বাটি। একজনএকটা খালি প্লেট আমার সামনে রাখল। আরেকজনের প্লেটে দুটি আস্ত মুরগির রোস্ট তো আরেক জনের বাটিতে রেজালা; খাসীর রেজালা বলে মনে হল। আরেকজনের বাটিতে মাংসের ভুনা; গরুর মাংস বলে মনে হল। একজনের প্লেটে টিকিয়া, একজনের প্লেটে সালাদ। আমি কিছু বলার আগেই বালকগুলি জাজিমের ওপরপ্লেট আর বাটিগুলি রেখে অদৃশ্য হয়ে গেল।
ইবনে ইয়াসিন বললেন, খাও বাবা খাও। বিসমিল্লা কর। যা পার আল্লাহ্র নামে খেতে শুরু কর। তোমার বাবা খিদে পেয়েছে।
আমার যে খিদে পেয়েছে তা বৃদ্ধ জানল কি করে। আন্দাজ করেছেন। কিন্তু আমি খাব কী-কে এসব রাঁধল?এই বাড়িতে কি কোনও অনুষ্ঠান ছিল? গতকালই ইবনে ইয়াসিনের ছোট মেয়ে জান্নাত আরা মা হয়েছে বললেন। কিন্তু বালকগুলিই- বা কে? ওরা গেলই বা কোথায়? ওরা কি বৃদ্ধের নাতি?
খাও বাবা, খাও। খাবার ঠান্ডা হয়েযায়।
আমার আর সন্দেহ নেই যে এরা সবাই জিন। তবে খারাপ জিন বলে মনে হল না। কেমন নিজেদের পরিচয় দিচ্ছেন। ভয় দেখানোর চেস্টা করছেন না। মনে হয় না এরা আমার তেমন ক্ষতি-টতি করবে। তবে জিনেদের খাওয়া কি ঠিক হবে? না খেয়েও তো উপায় নেই। আল্লাহ ভরসা। আমি গরম পানিতে হাত ধুয়ে প্লেট টেনে নিলাম। ইবনে ইয়াসিন প্লেটের ওপর পোলাও তুলে দিয়ে আস্ত একটা মুরগির রোস্ট তুলে দিলেন। বলে রাবুমামা তাঁর স্বভাব অনুযায়ী চুপ করে রইলেন।
মুনিয়া জিগ্যেস করে, জিনদের রান্না খেলে তুমি মামা?
হ্যাঁ। খেলাম।
রান্না কেমন হয়েছিল মামা?
তোফা। আর কী বলব। অমন অপূর্ব রান্না আর আমি এত বয়েসেও খাইনি। সেদিন রাতে আমার যে কী হল- এমন খিদে পেয়েছিল আমাকে আস্ত ভেড়ার রোস্ট দিলেও খেয়ে সাবার করে ফেলতাম। মনে হয় ডালিমের শরবতটা ছিল ক্ষুধা বর্ধক অ্যাপিটাইজার। ওহ্ হ্যাঁ। শেষে মিষ্টিও খেতে দিল। আমি আবার ওই বয়েসে মিষ্টির ভীষণ পোকা ছিলাম।মিষ্টির সাইজ দেখে আমি তো থ। ইয়াবড় বড় কালোজাম। একেকটা টেনিস বলের সমান। আর স্বাদের কথা আর কীবলব। প্লেট ভরতি পোলাও, মুরগির রোস্ট, টিকিয়া, খাসীর রেজালা, গরুর মাংসের ভুনা, সালাদ সব খেয়েশেষ করে ফেলেছি দেখে আমার ভারি তাক লেগে গিয়েছিল।
আমার খাওয়া শেষ হলে পর ইবনে ইয়াসিন জিগ্যেস করলেন, রান্না কেমন হয়েছে বাবা?
আমি সুপারি চিবুতে চিবুতে বললাম, তোফা চাচা তোফা।
ইবনে ইয়াসিন খুশি হয়ে বললেন, সবাই নাদিরা বিবির রান্নার প্রশংসা করে। আমার প্রথম ঘরের বিবি শামসি বেগম জবরদস্ত মশলাদার দুম্বার বিরিয়ানি রাঁধতে পারতেন। বলে ইবনে ইয়াসিনঅদৃশ্য হলেন।
আমি আর অবাক হব কী। বরং চারধারে যা ঘটছে তা উপভোগই করছি। শামসি বেগম-এর জবরদস্ত মশলাদার দুম্বার বিরিয়ানি খেতে পারলাম না বলে আমার খানিকটা আফসোসই হচ্ছিল।
একটু পর ইবনে ইয়াসিন ফিরে এলেন। কোলে রঙিন বুটিদার কাপড়ে জড়ানো একটা পুঁটুলি। ট্যাঁ ট্যাঁ করে শব্দ হচ্ছে। বুঝলাম এক দিন বয়েসি নবজাতক নাতীকে নিয়ে এসেছেন। ইবনে ইয়াসিন বললেন, আমার মেয়ে জান্নাত আরার ইচ্ছা আপনি ওর ছেলের একটা নাম দিবেন।
আমি? আমি অবাক হয়ে বললাম। আমার কেমন ঘুম ঘুম লাগছিল। আসলে জম্পেশ খাওয়া হয়েছে তো।
হ্যাঁ। আপনি। বলে অদ্ভূত কায়দায়হাঁটু গেড়ে আমার সামনে বসে আমাকে নাতীর মুখ দেখালেন ইবনে ইয়াসিন। শিশুর মুখ দেখে আমি চমকে উঠলাম। গাঢ় নীল রঙের ছোট্ট মুখ। আশ্চর্য! শিশু বয়েসে এদের রং নীল হয়? কাঁধ অবধি সোনালি চুল। কবুতরের ডিমের সমান অক্ষিগোলক। তবে চোখের মনি কাকেরডিমের মতন নীলচে। চোখের চারপাশেসোনালি রঙের কাজল। বলে রাবুমামাচুপ করে রইলেন ।
নীলু জিগ্যেস করল, বাচ্চার নাম তুমি কী রাখলে মামা?
শাহাজাদা।
শাহাজাদা?
হ্যাঁ। শাহাজাদা।ওই নামটাই কেন যেন মনে এল।
তারপর ? রবিন জিগ্যেস করে।
তারপর আর কী। নাতীকে নিয়ে ইবনে ইয়াসিন অদৃশ্য হলেন। ততক্ষণে আমার বেশ ঘুম পাচ্ছিল। কখন যে জাজিমের ওপরই ঢলে পড়েছিলাম। সকালবেলায় ঘুম ভেঙে দেখি রাজারহাটে আমার পরিচিত ঘরের বিছানায় শুয়ে আছি। ঘরে গাওয়া ঘিয়ের গন্ধ ম ম করছে। রহমত রান্নাঘরে পরোটা ভাজছে। আমি চেঁচিয়ে রহমতকে ডাকলাম । রান্নাঘর থেকে এসে রহমত বলল, জ্বী ছার, বলেন।
এখুনি তুই নীচে গিয়ে একবার দেখ তো। আমার সাইকেলটা আছে কিনা।
একটু পর রহমত ফিরে এসে বলল, জ্বী,ছার। সাইকেল ঠিক আছে।
আমি নিশ্চিন্ত হয়ে পাশ ফিরে চোখ বুজলাম।
তারপর?
তারপর? তারপর কুড়ি বছর কেটে গেছে। রাজারহাট থেকে শ্যামগঞ্জ গিয়ে বছর কয়েক প্র্যাকটিস করলাম। তারপর এই কুসুমপুরে এলাম। জায়গা-জমি কিনলাম। এই বাড়িটা করলাম। এক তলায় চেম্বার।আল্লাহর রহমতে হাত যশ ভালোই। তো,নাইনটিন এইট্টি ফাইভের কথা। একদিন সকালবেলায় নীচতলার চেম্বারে বসে আছি। রোগীর তেমন প্রেশার ছিল না। লম্বা এক তরুণ চেম্বারে ঢুকল। সঙ্গে সঙ্গে আতরের গন্ধ পেলাম। কেমন পরিচিত গন্ধ। আমার ভুরু কুঁচকে উঠল। তরুণের বয়স কুড়ি /একুশ বছর হবে। কী অপরুপ মুখ! ফরসা পেলব শরীর। চোখের চারধারে সোনালি রঙের কাজল। পরনে বেগুনি রঙের শেরওয়ানি আর ঘিয়ে রঙের চুরিদার পাজামা। হাতে কী যেন। ভালো করে চেয়ে দেখলাম মিষ্টির হাঁড়ি।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!