রাবুমামা হেসে বললেন, আরে, আমি কী আজকের কথা বলছি নাকি তোদের? বলে চাদরের নীচে হাত হাত ঢুকিয়ে পকেট থেকে কী যেন মুখে ফেলে চিবুতে লাগলেন। এলাচ মনে হল। কে বলবে ইনিই বিখ্যাত ডাক্তার ইফতেখার উদ্দীন চৌধুরি? আমাদের রাবুমামা। রাবুমামার মাথায় কালো রঙের লেদারের একটা অদ্ভূত আকারের লম্বাটে টুপি। রাবুমামা যখন জাপান গিয়েছিলেন টুপিটা তখননিয়ে এসেছিলেন। এলাচ চিবোতে চিবোতে রাবুমামা বললেন, আমি বলছি নাইনটিন সিক্সটি ফাইভের কথা। তার মানে আজ থেকে এই ধর পয়তাল্লিশ বছর আগেকার ঘটনা। তখনও বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি বুঝলি। পাড়া গাঁ কী রকম নির্জন ছিল। কৃষিজমিতে স্যালো মেশিনেরও যান্ত্রিক শব্দও নেই। পাতার ওপর শিশির পড়ার শব্দও শোনা যেত সেসব দিনে!
মুনিয়া ছড়া/কবিতা লেখে। ও ছোট্টশ্বাস ফেলে বলল, তারপর কী হল মামা?
বৃদ্ধ ইবনে ইয়াসিন গজারিবনের ভিতর দিয়ে পুরনো একটা দু-মহলা দালানের সামনে এসে দাঁড়ালো। প্রাচীন আমলের বুরুজের মতন বেঢপসাইজের দালান। একতলা আর দোতলার বারান্দায় গ্রিল রয়েছে দেখলাম। দালানের চারপাশে বেশ ঘন গাছপালা। সামনে সিমেন্টের বড় একটি পরিস্কার মসৃন চাতাল। আশেপাশে অবশ্য ডালিম গাছ দেখলামনা। কোথায় ডালিম বাগান। বাড়ির পিছনে মনে হল।
চাতালে থই থই জ্যোস্না। আমি সাইকেল ধরে দাঁড়িয়ে আছি । আমার খিদে পেয়েছিল। এখন বিদায় নিয়ে চলে গেলেই হয়। রাজারহাট শহরে পৌঁছতে লাগবে মিনিট কুড়ি। আজ রাতে রহমত- এর মুগের ডালের খিচুড়ি আর হাঁসের মাংস রাঁধার কথা।
নীলু জিগ্যেস করে, রহমত কে মামা?
ওহ্, রহমত? রহমত ছিল আমার বাবুর্চি কাম কেয়ারটেকার। ঘরদোর ওই সামলাতো। বেশ রাঁধত ছেলেটি। তখনও বিয়েটিয়ে করিনি। অই রেঁধে-বেড়ে খাওয়াত। মুক্তিযুদ্ধের পর ছেলেটিকে আর দেখিনি রে। বড় ভালো ছেলে ছিল। বলে রাবুমামা চুপ করে রইলেন।
রবিনের তর সইছিল না। ও জিগ্যেস করে, তারপর কী হল মামা?
ওহ্, হ্যাঁ। আমি শিশুর কান্নার ট্যাঁ ট্যাঁ শব্দ শুনতে পেলাম। বৃদ্ধ হেসে বললেন, আমার ছোট মেয়েজান্নাত আরার ছেলে । গতকালই হয়েছে। আল্লাহর রহমতে আমার নাতীর শরীরস্বাস্থ্য ভালাই আছে। বলে ইবনে ইয়াসিন ওপাশে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। এই অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা তখনও বুঝিনি। আমি চারপাশে তাকালাম। তখনও আমি জানতাম না যে কুড়ি বছর পর ওই কান্নারত শিশুর সঙ্গে আমার আবার দেখা হবে। এনি ওয়ে। আমি তখনই দেখতে পেলাম …
কি দেখতে পেলে মামা?
ডালিম বাগান। চাঁদের আলোয় পরিস্কার দেখতে পেলাম চাতালজুড়ে বিশাল একটা ডালিম বাগান । ডালিম গাছে থরে থরে ডালিম ধরে আছে। আশ্চর্য! বাগানের ঠিক মাঝখানে একটা কুয়াশা মোড়ানো দীঘির জলে ধবধবে সাদা রঙের একটি রাজহাঁস ভেসে আছে।
আশ্চর্য! এত রাতে দীঘিতে রাজহাঁস কেন? হঠাৎই কুয়াশা সরে যেতেই দেখতে পেলাম … দীঘির ওপাশে শ্বেত পাথরের একটা প্রশস্ত সিঁড়ি ধাপে ধাপে উঠে গেছে মসজিদের একটি সুপরিসর প্রাঙ্গনে। মসজিদের দেয়ালে চিনি টিকরির কাজ। সোনালি রঙের মিনার ঘিরে অজস্র কবুতর উড়ছে।
এসো বাবা। ঘরের ভিতরে গিয়ে বসি। এইখানে বড় ঠান্ডা। ইবনে ইয়াসিনের কন্ঠস্বরে স্ববিৎ ফিরে পেলাম।
আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। শরীরজুড়ে কেমন যেন মৃদু একটা শিরশিরানি বোধ করছিলাম। কোনও মতে বললাম, ইয়ে চাচা, মানে … আমি তাহলে এখন যাই। বলে আমি আড়চোখে চাতালের দিকে তাকালাম। চাতালে কেবল কুয়াশায় আবছা চাঁদের আলো। একটু আগে দেখা ডালিম বাগান, দিঘী, রাজহাঁস ও মসজিদের দৃশ্য মিলিয়ে গেছে।
তখন ভুল দেখলাম না তো?
ইবনে ইয়াসিন বললেন, আরে, যাবে কেন বাবা । এত কষ্ট করে গরিবের বাড়ি এলে । একটু শরবত খাও, পানটান খাও।
না, না। কষ্ট কীসের। তাছাড়া আমি তো পান খাই না চাচা।
পান না খেলে। এসো, একটু বস। ইবনে ইয়াসিন অত্যন্ত আন্তরিক স্বরে বললেন।
পূর্ব বাংলার গ্রামের লোকজন এরকম আন্তরিকই হয়। একটু ক্ষণ বসেই যাই, নইলে কষ্ট বৃদ্ধ পাবেন। আমার তখন তরুণ বয়েস, বুঝলি। তোদের মতনই অত হিসেব করে চলতাম না। এনি ওয়ে। ইবনে ইয়াসিন একটু পর আমাকে একতলায় একটা বড় কামরায় নিয়ে গেলেন। এক পাশে বড় একটা টেবিল। টেবিলের ওপর একটা হ্যাজাকবাতি জ্বলেছিল । কামরায় খাটপালঙ্ক নেই। মেঝেতে নীল রঙেরপুরু মখমলের কার্পেট বিছানো । তার ওপর মোটাসোটা একটা জাজিম পাতা। জাজিমের ওপর একটি নরম তাকিয়া। কামরার সবুজ রঙের দেয়ালে মক্কা শরিফের ছবি। ছবির ওপরে গুলেনার।
রবিব জিগ্যেস করল, গুলেনার কি মামা?
গুলেনার হল ডালিম ফুল।
ওহ্ ।
উষ্ণ কামরায় কেমন মিষ্টি সুরভি ছড়িয়ে ছিল। আগরবাতিই মনে হল। হ্যাজাকের আলোয় দেয়ালে আমার ছায়া পড়েছে। তবে বৃদ্ধের ছায়া নেই! আমি অবাক হল না। আমি কোথায় এসেছি ততক্ষণে অবচেতন মনে টের ঠিকই পেয়ে গেছি।
বৃদ্ধ বললেন, বস, ডাক্তার । আরাম করে বস। কন্ঠস্বর অত্যন্ত আন্তরিক শোনালো।
আমি বসলাম।
আহা, জুতা খুলে পা তুলে জাজিমের ওপর আরাম করে বস। নাদিরা বিবির খানা তৈরি। নাদিরা বিবি হল জান্নাত আরার আম্মাজান। বলে ইবনে ইয়াসিন ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে গেলেন। বেড়িয়ে গেলেন না বলে অদৃশ্য হলেন বলাই ঠিক হবে।
আমি জুতা খুলতে- খুলতে ভাবলাম-খানা তৈরি মানে? আমি তো অবাক। এতরাতে কে রান্নাবান্না করবে? গ্রামের লোকজন তো সন্ধ্যের পরই খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ে করার কিছু থাকে না বলে। সেসব দিনে টিভিও ছিল না। জাজিমের ওপর বসলাম আরাম করে। বুঝলাম এরা আমাকে না-খাইয়েছাড়বে না। তখনকার দিনে মোবাইল ছিল না যে রহমত কে ফোন করে বলব … তুই খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়। আমার ফিরতে দেরি হবে।
হঠাৎ চেয়ে দেখি ঘরের মেঝের ওপর কে যেন দাঁড়িয়ে। বেশ লম্বা একটি বালক। বারো-তেরো বছরের অপরুপ চেহারা। আশ্চর্য! ও এ ঘরে কখন ঢুকল? বালকটির শরীর ধবধবে ফরসা।পেলব। চোখে যেন ‘ক্যাটস আই’ বসানো বুঝলি। আয়ত চোখের চারধারেসোনালি রঙের কাজল। বালকের পরনে ফিরোজা রঙের শেরওয়ানি আর ঘিয়ে রঙের চুরিদার পাজামা। বালকটিকে আমার কেমন যেন লাজুক মনে হল। বালকের হাতে একটি রূপার রেকাবি।রেকাবিতে একটি বড় কাঁচের গ্লাস।বালকটি গ্লাস তুলে আমার দিকে বাড়িয়ে দেয়। গ্লাসে লাল রঙের টলটলে ঠান্ডা তরল। গ্লাস নিতে নিতে আমি ভাবলাম-
এই অপরূপ ছেলেটি কে?
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।