আমি শাহাজাদা [১ম অংশ]

ভালো করে গায়ে চাদর জড়িয়ে রাবুমামা বললেন, বুঝলি, সে অনেক বছর আগের কথা। সে সময় আমি একবার এক অতিপ্রাকৃত ঘটনার মুখোমুখি হয়েছিলাম। আজ পর্যন্ত আমি সেই অতিপ্রাকৃত ঘটনার কোনও গ্রহনযোগ্য ব্যাখ্যা দিতে পারিনি। বলে রাবুমামা চুপ করে রইলেন। মুখ তুলে একবার আকাশের দিকে তাকালেন। আকাশে উথাল-পাথাল জ্যোস্নার মাঠে পরিপূর্ণ একখানি চাঁদ। নভেম্বর মাস; এই সময়ই গ্রামাঞ্চচলের দিকে শীত বেশ জেঁকে বসে। রাত দশটার মতো বাজে। রাবুমামার সামনে রবিন, নীলু আর মুনিয়া চাদরমুড়ি দিয়ে বসে। আজ রাতের খাওয়টা বেশ জম্পেশ হয়েছে। হাঁসের মাংস আর মুগের ডালের খিচুড়ি খেয়ে রাবুমামার গল্প শুনতে ছাদে এসে বসেছে ওরা।
রাবুমামা বললেন, তখন আমি সবে ডাক্তারি পাস করে রাজারহাট শহরেপ্র্যাকটিস শুরু করেছি। একবার। মরনাপন্ন এক রোগী দেখতে দূর্গাপুর গিয়েছিলাম; ফিরতে ফিরতে বেশ লেটই হয়ে গিয়েছিল। সাইকেলে বেশ দ্রুতই প্যাডেল মারছি। রাত তখন- এই ধর ন’টা কি দশটা, সেসব দিনে গ্রামেগঞ্জে, বুঝলি, যাকে বলে একেবারে গভীর নিশুতি। এবড়োখেবড়ো পিচ রাস্তার দু’পাশে গজারি গাছ। চারধারে কুয়াশা আর জ্যোস্নার আলো । হর্ন বাজিয়ে বাতাসে পোড়া ডিজেলের গন্ধ ছড়িয়ে আমার পাশ দিয়ে একটি ট্রাক দ্রুতগতিতে চলে যায়। এর পরপরই ‘ধপ’ করে একটা ভোঁতা শব্দ শুনতে পেলাম। চেয়ে দেখি রাস্তারপাশে কে একজন উলটে পড়ে আছে।
ট্রাকটা লোকটাকে ধাক্কা দিয়েছে মনে হল। আমার বুকটা ধক করে উঠল। বলে রাবুমামা চুপ করে রইলেন। গল্প বলতে বলতে রাবুমামা হঠাৎ করে চুপ করে যান। এটিই ওনার বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
ওরা উশখুশ করে। নির্জন রাত। দূরে ঝিলাই নদীর ওপর গাঢ় কুয়াশার সামিয়ানা। ওই ঝিলাই নদীচরে ওরা কাল পিকনিক করতে যাবে। ওরা আজই ঢাকা থেকে এসেছে শীতের পিঠা, খেজুরের রস, ঝিলাই নদীর চরে পিকনিক আর রাবুমামার গল্পেরটানে। কত যে অদ্ভূত-অদ্ভূত সব জিন-পরির গল্প জানেন রাবুমামা। তা রাবুমামা আজও গল্প বেশ জমিয়ে তুলেছেন।
রবিন শীত একেবারেই সহ্য করতে পারে না। ওর মাথায় একটা নীল রঙেরউলের মাঙ্কি টুপি। এখন অবশ্যি চাঁদের আলোয় টুপিটা কালচে দেখাচ্ছে। ও জিজ্ঞেস করে, তারপর কি হল মামা?
বলছি। আমি রাস্তার পাশে সাইকেল থামিয়ে নামতেই কড়া আতরের গন্ধ পেলাম। একজন লম্বা মতন বৃদ্ধ রাস্তায় পড়ে আছেন। ষাটের মতন বয়স। পরনে কালো রঙের শেরওয়ানি আর সাদা রঙের চুরিদার পাজামা। মাথায় রঙিন কিস্তি টুপি। বৃদ্ধের গায়ের রং ধবধবে ফরসা। বেশ সম্ভ্রান্ত চেহারা। দরবেশদের মতন লম্বা পাকা দাড়ি। পাকা জোড়া ভুরু, খাড়া নাক। চোখ দুটি আকিক পাথরের তৈরি যেন। আঙুলেও আকিক পাথরের আংটি। শীতেরহাত থেকে বাঁচতে আমার পরনে সোয়েটার, গলায় মাফলার। অথচ শীতের রাতে বৃদ্ধের গায়ে কোনও শীতের পোশাক নেই দেখে খানিকটা অবাকই হলাম। বৃদ্ধকে দ্রুত পরীক্ষা করে দেখলাম। কী ফর্সা হাত আর পা। চাঁদের আলোয় নীল শিরাও চোখে পড়ল। খানদানি বংশের কেউ হবে। বৃদ্ধের শরীর অত্যন্ত হালকা বলে মনে হল। তবে তেমন গুরুতর আঘাত পাননি বলেই মনে হল।
আশ্চর্য! তখন ‘ধপ’ করে ভোঁতা শব্দ হল। শব্দটা তাহলে কীসের?
আপনি ব্যথা পাননি তো চাচা? আমি জিগ্যেস করলাম।
না বাবা, আমি তেমন ব্যথা পাইন। বৃদ্ধের কন্ঠস্বর ভারি মধুর। যাকে বলে জলদ গম্ভীর।
আপনি কি দাঁড়াতে পারবেন চাচা? আমি নরম সুরে জিগ্যেস করলাম।
পারব বাবা। বৃদ্ধ বললেন। আতরের গন্ধটা ততক্ষণে আরও গাঢ় হয়ে উঠেছে। আমি বৃদ্ধকে ধরে দাঁড় করাতে- করাতে বিরক্ত হয়ে বললাম, রাতের বেলা এরা এত বেপরোয়া ভাবে ট্রাক চালায়।
বৃদ্ধ মাথা নেড়ে বললেন, থাক বাবা। আমি এখন বাড়ি যেতে পারব। তুমিও এখন বাড়ি যাও । তোমার অনেকদেরি হয়ে গেল।
আমি বললাম, না, না। আমার তেমন দেরি হয়নি। চাচা, আপনার বাড়ি কি কাছেই?
হ্যাঁ বাবা, কাছেই। এই গজারিবনের ভিতরে একটা ডালিম বাগান আছে। সেখানে।
ডালিম বাগান নামটা এর আগে আমি কখনও শুনিনি। আসলে আমি মাস দুয়েক হল রাজারহাটে এসেছি । ভালো করে এদিকটা এখনও চেনাজানা হয়নি । আমি বললাম, আপনি একা যেতে পারবেন তো চাচা?
পারব বাবা।
আমি কি আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দেব?
তুমি যাবে আমার বাড়ি?
আপনি বললে নিশ্চয় যাব। কেন যাব না। এতবড় দূর্ঘটনা থেকে বেঁচে গেলেন।
তোমার আবার দেরি হবে না তো বাবা?
না, না। দেরি হবে কেন। আমি রাজারহাট শহরেই থাকি। তাছাড়া আমি একজন ডাক্তার । আমার একটা দায়িত্ব আছে না?
আমার কথা শুনে বৃদ্ধের মুখচোখ কেমন উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি বললেন, তাহলে আমার সঙ্গে এসো । বলে বৃদ্ধ হাঁটতে লাগলেন। আমিও তার পাশে সাইকেলটা ঠেলতে ঠেলতে হাঁটতে লাগলাম ।
বাঁ পাশে গজারিবন। তারই ভিতর দিয়ে সরু পথ। বনটাকে কেন যে গজারিবন বলা হয়- সেটি আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। কেননা গজারিবনে গজারি গাছই কম। বরং সংখ্যায় জারুল ও অর্জুনগাছই বেশি চোখে পড়ল। সে যাই হোক। বনেরমধ্যে দুধসাদা চাঁদের আলো বিছানো । পায়ের নীচে অজস্র শুকনো পাতা। পাতার ওপর মচমচ পায়ের শব্দ হয়। ঠান্ডা বাতাসে আতরের গন্ধ পেলাম। গন্ধটা এবার আরও অনেক ঘন। হঠাৎই আমার মনে হল আমাদের সঙ্গে আরও কারা যেন হাঁটছে, অথচ আমি তাদের দেখতে পাচ্চি না। মনের ভুল? আমি চারপাশে তাকালাম। কাউকে দেখতে পেলাম না। তবে শুকনো পাতার ওপর স্পষ্ট অনেক লোকের পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম।
হাঁটতে-হাঁটতে বৃদ্ধ তাঁর পরিচয় দিলেন। বৃদ্ধের নাম ইবনে ইয়াসিন। ফলের ব্যবসা করেন । ডালিম বাগান আছে বললেন; বৃদ্ধের তিন ছেলে। গুলজার, গাউস আর গাজী।আর এক মেয়ে । ছেলেরা আখরোখ, কিশমিশ আর আতরের ব্যবসা করে। সুলতানগঞ্জে
(জায়গাটা রাজারহাট থেকে দশ মাইল) নাকি তাদের মোকাম আছে । মেয়েই সবচে ছোট, মেয়ের নাম জান্নাত আরা । গত বছরই নাকি জান্নাত আরার বিয়ে দিয়েছেন বৃদ্ধ। আদরের কন্যা। বাপের বাড়িতেই নাকি থাকে। জামাইয়ের নাম শেখ আন্দালিব। সেও সুলতানগঞ্জে নাশপাতি আর পেস্তার ব্যবসা করে।
ইবনে ইয়াসিনকে আমার ভারি সহজ, সরল আর অমায়িক মনে হল। আমি রাজারহাটের আশেপাশে গাঁয়ে রোগী দেখে বেড়াই। তাছাড়া আমি গাঁয়ের ছেলে। আমি জানি ইস্ট পাকিস্তানের গ্রামের মানুষ এমন সহজ, সরল আর অমায়িক হয়।
নীলু জিজ্ঞেস করে, ইস্ট পাকিস্তান মনে? ওর প্রশ্ন শুনে মনে হল ও অবাকই হয়েছে।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!