গল্পের ২য় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
একটি ছেলে ছিল।রূপে যেন রাজপুত্ত্বর। মা আদর করে নাম রেখেছিলেন রাজকুমার। ছেলেটি এই পনরো-ষোলো বছর বয়সেই বেশ জোয়ান হয়ে উঠেছে। লেখাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে তার বাবার কাছে শিখেছে ঘোড়ায় চড়া, তলোয়ার চালনা, তীর ধনুক লক্ষ্যভেদ, দ্বন্দ্বযুদ্ধ প্রভৃতি সব রকম রণকৌশল ও যুদ্ধবিদ্যা। কারণ, ছেলেটির বাবা ছিলেন এক রাজ্যের প্রধান সেনাপতি। দুঃসাহসী যোদ্ধা বলেও তার সুনাম ছিল। এ পর্যন্ত তিনি যতো যুদ্ধে গেছেন সবগুলিতেই জয়ী হয়ে রাজার হাত থেকে জয়মাল্য পেয়েছেন।
রাজা তাকে খুবই স্নেহ করতেন। বীর বলে শ্রদ্ধাও করতেন। অনেক সময় মন্ত্রীদের সঙ্গে পরামর্শ না করে তিনি তার এই প্রিয় সেনাপতির সঙ্গে পরামর্শ করে চলতেন। এর ফলে সেনাপতির প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে তারা ষড়যন্ত্র করে রাজ্য থেকে তাকে তাড়াবার চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু কিছুতেই সেনাপতির কোনো দোষ বার করতে না পেরে শেষে সেনাপতির বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার এক মিথ্যা অভিযোগ নিয়ে এলেন তারা।
রাজার কাছে সেনাপতির বিচার হ’ল। সেনাপতি বীরপুরুষ। সাদাসিধে সরল মানুষ। মন্ত্রীদের মতো অতো শতো কূটবুদ্ধি আর ঘোরপ্যাচ জানেন না। তিনি নির্ভীক। তিনি সত্যবাদী। কিন্তু হলে কি হবে ? মন্ত্রীরা গোপনে প্রচুর ঘুষ দিয়ে অনেক জাল মিথ্যা সাক্ষী হাজির করে রাজার কাছে প্রমাণ করে দিল যে, সেনাপতি রাজার রাজ্য ও সিংহাসন দখল করবার জন্য গোপনে শক্রদের সঙ্গে পরামর্শ করছিলেন।
এ ধরনের রাজনৈতিক অপরাধের জন্য সাধারণতঃ দোষীর প্রাণদণ্ডই হয়। কিন্তু রাজা তার এই বীর সেনাপতিকে খুবই ভালবাসতেন বলে তার প্রাণদণ্ড না দিয়ে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের দণ্ড দিয়ে রাজ্য থেকে নির্বাসিত করলেন।
সেনাপতি সংগ্রামসিংহ এই দণ্ডাদেশে মর্মাহত হয়ে সে রাজ্য পরিত্যাগ করে অনেক দূর দেশে চলে গেলেন, সঙ্গে গেলেন তার সুযোগ্য সহধর্মিণী, পুত্র রাজকুমার আর কন্যা ইন্দিরা।
অপরূপ সুন্দরী ও গুণবতী ছিলো তার এই কন্যা ইন্দিরা। রাজকুমারের চেয়ে মাত্র ছ’বছরের ছোট। কিন্তু বুদ্ধি-বিবেচনায় সে ছিলো দাদার চেয়েও অগ্রসর। যারাই দেখতো মেয়েটিকে, তারাই তাকে ভাল না বেসে থাকতে পারতো না।
নির্বাসন দণ্ডে দণ্ডিত সেনাপতি সংগ্রামসিংহ মনের দুঃখে দেশ ছেড়ে এই অনেক দূরে এক গ্রামে এসে চাষবাসের কাজে মন দিয়েছিলেন। মনে মনে তার নিজের উপরই ঘৃণা এসে গেল। বহু যুদ্ধে বহু লোকের প্রাণহানি করার অপরাধেই বোধহয় তার আজ এই কঠিন নিষ্ঠুর সাজা হ’ল। এই ভেবে তিনি যুদ্ধ করা ছেড়ে দিলেন।
ছেলে রাজকুমার ও মেমেয় ইন্দিরাকে নিয়ে তাঁর প্রতিব্রতা পত্নীও রাজ্য ছেড়ে স্বামীর অনুগামিনী হলেন। শ্রীরামচন্দ্রের বনবাসের সময় জনকদুহিতা সীতা যেমন রাজ্যসুখ তুচ্ছ করে দেবতুল্য পতির অনুগমন করেছিলেন, তেমনি তিনিও স্বামীর সঙ্গে দুঃখ বরণ করবার জন্য প্রস্তুত হয়েই দেশ ছেড়ে চলে এলেন।
নতুন দেশে এসে সুখে-দুঃখে তাদের দিন কেটে যাচ্ছিল এক রকম। কিন্তু মানুষের দুঃসময় যখন আসে তখন পর পর নানা অতর্কিত বিপদ ঘটে যায়। হঠাৎ একদিন ক্ষেতে চাষের কাজ করতে করতে অপাঘাতে সংগ্রামসিংহ ইহলোক ত্যাগ করলেন। পুত্র রাজকুমার ও কন্যা ইন্দিরাকে নিয়ে তাদের জননী শোকে-দুঃখে ও দুর্ভাবনায় অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়লেন।
পাড়া প্রতিবেশীরা অনেকেই এসে সান্তনা দিলেনঃ ভাবছো কেন মা ? এ-রকম অঘটন তো পৃথিবীতে অনেক ঘটে থাকে। ভগবান আছেন। তিনি তোমাদের রক্ষা করবেন। তুমি এমন অশান্ত হয়ে পড়লে ছেলে-মেয়ে দুটিকে সান্তনা দেবে কে? রাজকুমার চোখের জল মুছতে মুছতে বললো, মা, চুপ করো তুমি। আর কোঁদো না। আমি তো বড় হয়েছি। বাবা আমাকে নিজের হাতে সব বিদ্যা শিখিয়ে গেছেন। আমি তোমার দুঃখ দূর করবো। তোমাদের কোনো কষ্ট হবে না।
মেয়ে ইন্দিরা কাঁদতে কাঁদতে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বললো, মা, তুমি ভেবো না। সংসারের সব ভার আজ থেকে আমি নিজের হাতে তুলে নিলুম।