আমার অতীত নেই… ভবিষ্যৎও নেই কোনোখানে

কোনো একদিন কোথাও থেকে ফিরছিলাম। কবে যেন। দিন ভুলে গেছি। তবে, ফিরছিলাম কি? কোথায় ফিরি? ফিরে কি আসি আসলে? ফিরে আসা কি কখনো বাধ্যতামূলক হয়? বরং ইচ্ছাকৃত হবার কথা। ভেবে নিলাম আমি ফিরি না। মানুষ কোথায় তাহলে ফেরে – যারা ফেরে? কোনো পদার্থের পার্থিব টানে ফিরতে থাকে তারা? নাকি সত্যিকারেই তাদের এই ফিরে যাওয়া কোনো অপদার্থ কিছুর প্রতি অপার্থিব টানে? ইচ্ছে করে। আগ্রহ ভরে তারা ফেরে? আমি কেন ফিরি না কোথাও? মাঝে মাঝে মনে হয় বেশি প্রশ্ন করে ফেলছি। একেকটা ‘কেন’র ওপর নতুন করে চড়াও হয়ে বলতে ইচ্ছা করে – আমি এতো কেন কেন করি কেন! আচ্ছা, সে যাক। প্রশ্নদের ওপর চড়াও হয়ে ফের প্রশ্ন করা আপাততঃ বন্ধ করি। চলে যাই কোথাও না কোথাও ফিরে যাওয়াতে। অথবা না-ফিরে যাওয়াতে। আমি তো ফিরি না কিছুতে। শুধু যাই। যেতে থাকি। ফেরা প্রসঙ্গেও আবার যাই-ই বরং।
সেদিন ঘোর বিকেলবেলা। ঘোর বলতে আঁধার বোঝাচ্ছি না অবশ্য। মানে, সে এক সম্পূর্ণ অর্থে বিকেল। দুপুর নয়। সন্ধ্যাও নয়। কিংবা নয় প্রায়-সন্ধ্যাও। বরং দুপুরের ঠিক শেষ অংশের কোণা থেকে যে মুহূর্ত। দুপুরের আঁচলের একেবারে শেষ সূতোটা ধরে বা ছেড়ে যার শুরু। আর শুরু হতে হতে পরিণত হওয়া এক বিকেল। তেমনি ঘোর এক বিকেলে একইরকম ঘোরতর একা আমি। কোথাও থেকে কোথাও চলেছি। রিকশাঅলা সদর রাস্তা, সদরের উদরের রাস্তা, গলি ও তস্য গলি করে চলেছে কোথাও। তার আর আমার গন্তব্য একই। তবে তার বেছে নেয়া পথ আমার পরিচিত নয়। তবু, গন্তব্যে পৌঁছাবার ভার ছেড়ে দিয়েছি তার ওপরেই। পথ বেছে নেবারও। সে সেই দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত থাকুক নিজের মতোন। আমি শুধু তার বেছে নেয়া পথেদের চারপাশের দৃশ্যে ডুবে যেতে ব্যস্ত। নিজের মতোন।
একেকটা দৃশ্যে কতোকিছু থাকে। মানুষ আর পাখি। বিশ্রামরত শ্রান্ত কুকুর। গুরুত্বপূর্ণ ভাবনায় মৌনী কাক। বিকেলের গা ঘেঁষে হঠাৎ উড়ে যাওয়া কবুতরের ঝাঁক। পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া, ছুটে যাওয়া অবয়ব। মুখেরা। মুখরা। বা নিশ্চুপ। দাগ কেটে যায় কিছু। স্পর্শও করে না কিছু। কতো কতো পদার্থ। আর অপদার্থ। রাস্তা আর বাঁক। টুং টাং। শব্দ, গন্ধ, রঙ। কতো কণ্ঠের কথকতা মিলেমিশে তৈরি অদ্ভুত গুঞ্জন। বিভিন্ন চেহারার ভিন্ন ভিন্ন ভাবের প্রকাশ ফুটে ওঠা। অথবা একেবারেই ভাবলেশহীন। সেই না-ফুটে ওঠার আড়ালেও রয়ে যায় হয়তো কতো অজানা গল্প বা ভাব। অপ্রকাশিত। সমস্ত রঙে আর গন্ধে, প্রকাশের আর অপ্রকাশের মেলামেশার সুঁইয়ের খোঁচায় সুতোর বুননে তৈরি হতে থাকে দৃশ্যেরা। মুহূর্তে মুহূর্তে। বিস্ময়ে দেখি। বিস্ফারিত নেত্রেও কি? তবে বিস্ফোরিত হয় না কিছুই তাতে। চেহারার ক্যানভাসে বিস্ময়দের অপ্রকাশিত রেখে দেখে যেতে থাকি শুধু। যতোটুকু পারা যায়। এক মুহূর্তের দৃষ্টির সীমায় যতোটুকু ধরে রাখা সম্ভব।
একেকটা দৃশ্য থেকে মনের কোণে যা দাগ কাটে বা যা দাগ কাটে না তাদেরও কোনো সীমা থাকে না। কখন যে কী দাগ কেটে যায় কেউ কি বলতে পারে? কিংবা কে দাগ কাটে? কোন সুর হঠাৎ বৃষ্টির মতো স্মৃতির পশলা ঝরিয়ে দেয়। কোন গন্ধে এক নিমেষে চলে যাওয়া যায় সম্পূর্ণ অন্য এক নিমেষের কাছে। যেন টাইম মেশিন। বৈজ্ঞানিক কোনো সূত্রে যাকে ধরে বেঁধে রাখা যায় না। যার কোনো নির্দিষ্ট সুইচ নেই। হঠাৎ হয়ে যেতে পারো যে কোনো কোথাও স্থানান্তর। স্মৃতির প্রকান্ড ক্যানভাসের যে কারো কাছে। মনের ক্যানভাসটাও ভীষণ। প্রকান্ড। বা অদ্ভুত। একেক সময় একেক রঙ তাকে টানে। কোন সুর পায়ের ছাপ রেখে যাবে চিরতরে তার কাছে? কোন চকিতে ভেসে যাওয়া টুকরো সুতো তার গায়ে নিজের কথা বুনে রেখে যাবে জন্মান্তরের জন্যে – কে বলতে পারে? সেদিনের ছুটে যাওয়া দৃশ্যেদের মধ্যে ডুবে যেতে যেতে আর ভেসে যেতে যেতে হঠাৎ দাগ রেখে যাওয়া তার কথাই-বা কে বলতে পারতো?
সেই যে গাছটা। মসজিদের সামনের ছোট্ট ঘেরা জায়গাতে হয়তো একটুখানি যত্নে আর অনেকখানি অবহেলায় বেড়ে ওঠা এক গাছ। গাছটা গুঁড়ি থেকে সোজা ওঠে নি। একবার ডানে, তারপর বাঁয়ে অপ্রস্তুত বাঁক। কিছুদূর এগিয়ে ফের মন ঠিক করে ডানে ফেরা। উদ্দেশ্যহীনভাবে বেড়ে ওঠা গাছ। গাছেদেরও কি উদ্দেশ্য থাকে কোনো? বড় হবো; পাতা, ফুল, ফল দেবো; তারপর একদা খুব অগোচরে মরে যাবো। ছোটবেলায় তাদেরও কি মন্ত্র দেয়া হয় কানে –
“বড় হও, দীর্ঘ হও,
শুধু বেড়ে ওঠো, শুধু বেড়ে!”
বাঁকাত্যাড়া সেই গাছটার মতো নিজেকেও বেশ উদ্দেশ্যহীন মনে হয়। বাঁকা এবং ত্যাড়াও বটে। যদিও আমাকে নিয়ে ছুটে চলা রিকশাটার গন্তব্য বেঁধে দেয়া। আপাতঃদৃষ্টিতে তাই আমার উদ্দেশ্য আছে বৈকি! তবু, আপাতঃর দৃষ্টি এড়িয়ে, দৃশ্যমানের আড়ালের অদৃশ্যকে সামনে আনতে গেলেই দৃষ্টিগোচর হয় ভেতরের কতো গল্প। যে গল্পে আমার উদ্দেশ্য বিধেয় আর বেঁধে দেয়া নেই। একবার ডানে মোড় নিচ্ছি। আবার বাঁয়ে বাঁক। ফের মোচড় খাচ্ছি। কোথায় যাচ্ছি? কিংবা যাচ্ছিই না। তবে তা-ই বা খারাপ কী? প্রায় সবাইকে দেখি খুব তাড়াহুড়ো করে কোথায় যেন যায়। কিংবা হয়তো ফেরে। তাদের বড় তাড়া। দীর্ঘ পদক্ষেপে নির্দিষ্ট গন্তব্য থাকবার প্রমাণ সুস্পষ্ট। দ্য ওয়াক উইথ আ পারপাস! গন্তব্য থাকলে তো পৌঁছানোর তাড়া থাকবেই। সে তো অকারণ নয়। তারা ফিরে যেতে চায়। ত্বরা করে। আমি যে ফিরি না কোথাও। ত্বরাও করি না তাই।
আমার কোনো কারণ নেই। গন্তব্য বা তাড়াও। নেই। আমি দিব্যি রিকশাটাকে বলতে পারি আস্তে চালাও। কিংবা ফুটপাতে আরো দু’দন্ড বসে থাকতে পারি। মানুষ দেখতে পারি। শুধু মানুষ কেন – গাছ, পাখি কিংবা ম্যানহোলের ঢাকনাহীন গর্তের দিকেও তাকিয়ে থাকতে পারি বেশ। ইচ্ছে করলে পাশের টং থেকে আরো এক কাপ চা খেতে পারি। দুই কাপও। তাড়া ছাড়া। পাশে টং নেই? আমি ধীরপায়ে হেঁটে হেঁটে চষে বেড়াতে পারি তার খোঁজে। এক কাপ চায়ের জন্যে। কিংবা দুই কাপ।
রিকশায় থাকলেও ক্ষতি নেই। অকারণ জ্যামে পড়লে বার বার ঘড়ি দেখার প্রয়োজন নেই যেমন। বরং কানে হেডফোনে গুঁজে দিয়ে নির্বিকার মেঘহীন বা তারাহীন আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবতে পারি, এমনো দিনে তারে বলা যায়..! যদিও সেই ‘দিন’, সেই ‘তারে’ বা সেই ‘বলার মতো কথা’ – কিছুই আমার নেই। তবু ভাবতে কী দোষ? আমার তো তাড়া নেই। আমি ভাবতে পারি যে কোনো কথা। যে কারো। কিছুই করার প্রয়োজন যে নেই। কারণ নেই। ইচ্ছেমতো তাই ভাবতে থাকতে পারি।
ইচ্ছেমতো ভাবলেশহীন হেঁটে যেতে পারি যে কোনো দিকে। ডানে মোড় নিয়ে আবার বাঁয়ে বাঁক নিয়ে ফের মোচড় খেতে পারি কোথাও। আমার উদ্দেশ্য নেই। গন্তব্যও নেই কোনোখানে।
কখনো অনেকখানি থমকে যাই। আমি থামি। সাথে চিন্তা। ভাবনারা। চেতনা। রা? আমার সাথে আমার সময়ও থমকায়। তার ছায়া। দীর্ঘতর। হতে থাকে। দীর্ঘ থেকে। আর চারপাশে সবকিছু বড় দ্রুত চলে যায়। টেনে দেয়া গানের মতো। ছবির মতো। মাঝখানে আমি। সাথে অনেক অনেক বাক্স। আর প্যাঁটরা। আর বোঝা। সেইসব প্রকান্ড স্মৃতিদের। সেইসব আপাতঃদৃষ্টিদের। সেইসব দৃশ্যমান দৃশ্যদের। সবকিছু নিয়ে দ্রুত বয়ে যাওয়া গতিদের মাঝখানে থেমে যাওয়া আমি। বসে থাকি। দেখতে থাকি। শুধুই দেখে যাওয়া। হঠাৎ কখনো ইচ্ছে হয় খুব তাড়া থাকুক। ছক থাকুক। প্রতি মুহূর্তে ঘড়ির কাঁটা আমার পিছে তাড়া করুক। ভ্রু কুঁচকে। বকতে বকতে। ঝাড়ু হাতে, কি লাঠি। টিক টিক। কিন্তু তারাও নিঃশব্দ বড়। তাদেরও পদচারণা সন্তর্পণে। বড় বেশি সাবধানে। আমাকে তাড়া না দিয়েই তারা ছুটতে থাকে। আমি একা বসে থাকি। বসে থাকি। চেয়ে থাকি। চাইতে থাকি। আমার কোথাও কোনো তাড়া নেই।
চেয়ে থাকা আর চাইতে থাকার মধ্য দিয়ে রিকশাটাও ছুটে চলে। না-ফেরার গন্তব্যে। আমার স্মৃতিদের ভীষণ ক্যানভাসে আরেকটা সুতো যোগ হয়। বাঁকা আর ত্যাড়া। গাছের মতো। আমার মতো। উদ্দেশ্যহীন। তাড়াহীন। শুধু, স্মৃতিহীন নয়।
“আমার অতীত নেই
ভবিষ্যতও নেই কোনোখানে।”
আমার উদ্দেশ্য নেই
গন্তব্যও নেই কোনোখানে …।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!