‘আমাদের পাড়া গাঁয়ে ছিল এক মামা
গান গেতো সারাদিন সা..সা..রে..রে..গামা’
নানাজানের কথা-‘গান শোনা পাপ’। মামা এ গোঁড়ামী বিশ্বাস করতেন না। তবে মামা আধ্যাত্মিক ঘরানার গান গাইতেন বেশি। মামা আমাদের প্রায় বলতেন,
‘যখন ডাকবে মামা…
গান শোনাবো
সা..সা..রে..রে..গা..মা’
মামার গায়ের রং ছিল মিশমিশে কালো। যাকে আমরা স্থানীয় ভাষায় বলতাম ‘ভূচারুংগা’। তো মামার আসল নাম চাপা পড়ে হয়ে গেল ‘ভূচরুংগা মামা’।
রাতের বেলা মামার শরীরটা অন্ধকারের সাথে মিলিয়ে যেত। এ জন্য ক’বার যে পথ চলতে গিয়ে মামার বিশাল দেহটার সাথে ধাক্কা খেয়ে আমরা গড়াগড়ি খেয়েছি, তার কোন ইয়ত্তা নেই। একবার মামা দাঁড়িয়ে ছিলেন চৌরাস্তার মোড়ে। আর আমরা মামাকে খুঁজে খুঁজে হয়রান। অমাবশ্যার তিথি ছিল সেই দিন। প্রচন্ড গরমও পড়েছিল। মামাকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছিলাম না। শেষে চৌরাস্তার মোড়ে গিয়ে দেখি, সেখানে দাঁড়িয়ে মামা বাতাস খাচ্ছেন। টর্চ লাইট ছিল আমাদের হাতে। আলো ফেলতেই দেখি মামার দুই পাশে তিন জন লোক হার্টফেল করে পড়ে আছে। ব্যাপারটা আমরা পড়ে বুঝতে পারলাম। মামার বিশাল দেহটার সাথে ধাক্কা খেয়ে তাদের এই বুড়াহাল হয়েছে। পরে তাদের তিনজনের গায়ে তিন বালতি পানি ঢেলে দিয়ে সংজ্ঞা ফিরিয়ে আনা হয়।
জ্ঞান ফিরে এলে তারা মামাকে দেখেই কাপড় নষ্ট করে ফেলেছিল। তারপর দিক-বিদিক হারিয়ে তারা যে কোথায় দৌঁড়ে পালালো, আর খুঁজেই পেলাম না।
একদিন আমি, সুজন, পাপ্পু, তানজিল, তাসলিমা আর সুরমা মামার কাছে গো ধরলাম মামা আমাদের গান শোনাতে হবে। মামা বললেন, ‘ঠিক আছে। তোমরা সবাই ছাদে যাও। আমি আসছি..’
আমরা ছাদে গেলাম। খানিক পরে মামা হারমোনিয়াম নিয়ে আসলেন। আমরা গোলাকার হয়ে বসে
পড়লাম। মাঝখানে বসে মামা গান ধরলেন-
‘সা..সা..রে..রে..গা..মা..
সা..সা..রে..রে..গা..মা..
একদিন চুরি হলো আমার পায়জামা…’
দু’তলা বাড়ির ছাদের নিচের শেষ রুমটাতে থাকতেন নানাজান। নানা নামাজ শেষ করে তসবিহ্ টিপছিলেন। গানের আওয়াজ কানে যেতেই উনার প্রেশার উঠা-নামা করতে লাগলো। আমরা আনমনে গান শুনছিলাম। হঠাৎ দেখলাম নানা ছাদের দরজা পেরিয়ে এদিকে আসছেন। দেখে সকলেরই গায়ের লোম ভয়ে খাড়া হয়ে গেল। কারণ-নানার হাতে ছিল ইয়া মোটা একটা লাঠি!
লাঠি দেখেই আমাদের জানে পানি নাই। নিমিষেই কলিজা শুকিয়ে গরু মার্কা ঢেউ টিন। দিক-বিদিক হারিয়ে আমরা যে যেভাবে পারলাম পালাবার চেষ্টা করলাম।
কেউ পানির পাইপ ধরে, কেউ টয়লেটের পাইপ ধরে, কেউ আবার ডাবগাছ ধরে নামার চেষ্টা করলাম। ডাবগাছ ধরে খুব দ্রুত নামতে গিয়ে আমি নিচে পড়ে গেলাম। হাঁটুতে আঘাত পেলাম। হাঁটুর কাপড় তুলে দেখি ছাল উঠে গেছে। সামান্য আঘাতেই আমার এ্যাম্বুলেন্সের কথা মনে পড়লো। ওদিকে তাকিয়ে দেখি সুরমা আর তাসলিমা একসাথে পানির পাইপ ধরে নামতে গিয়ে একজন আরেকজনের পিঠের উপর পড়ে গান ধরেছে-‘একি বাধঁনে বলো জড়ালে আমায়…মরি লজ্জায়…’
এদিকে তাদের চেয়ে বিপদজনক অবস্থা পাপ্পু, সুজন আর তানজিলের।
টয়লেটের পিভিসি পাইপ ধরে প্রথমে নেমেছিল পাপ্পু তারপর সুজন এরপর তানজিল। অর্থাৎ পাপ্পুর ঘাড়ে পড়েছিল সুজন, তার উপর তানজিল। এতে করে পাপ্পু বেচারার অবস্থা রীতিমত যারপর নাই কেরোসিন। পাপ্পুর দুই হাঁটুর-ই ছাল উঠে গিয়ে সফেদ অংশটা বেরিয়ে এসেছে। আমার মনে পড়েছিল এ্যাম্বুলেন্সের কথা ওর নাকি মনে পড়েছিল হাসপাতাল আর ডাক্তারের কথা।
এতসবের ভিতরেও আমরা ভুলে যাইনি মামার কথা। একে অন্যকে জিজ্ঞেস করলাম-‘মামা কোথায়? মামা…?’
মামা তার বিশাল দেহটা নিয়ে নামতেই পারেনি। উপর থেকে আওয়াজ আসছিলো- ঠাস্..ঠাস্..ঠুস্..ঠুস্..!
আমরা বুঝতে পারলাম মামাকে ধরে নানা অ্যায়সা পিটুনি পেটাচ্ছে! আমরা আরো থাকি? দিলাম ভোঁ দৌড়…
উহু..আহা..মাগো…! মা…! বাবাগো…আল্লারে…! ইত্যাদি শ্লোগান দিতে দিতে আর কোঁকাতে কোঁকাতে যে যার বাড়ি উদ্দেশ্যে দে ছুট।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।