আমাদের ক্লাস ক্যাপ্টেন —- তানজিল রিমন

সবচেয়ে পাকা আমটি পাড়তে গিয়েই সমস্যাটি হল। যা ভেবেছিলাম তাই। কী দরকার ছিল বাজি ধরার। কত আম তো হাতের কাছেই আছে। শুধু শুধু জেদ ধরে বাজিতে জিততে গিয়েই এমনটা হল। গাছের চিকন ডালে পা দিতেই মড়াৎ করে একটা শব্দ হল। তারপর যা হওয়ার তাই। ডিগবাজি খেতে খেতে গাছের ওপর থেকে একদম নিচে মাটিতে পড়ে গেল রাতু। ধপাস করে শব্দ কানে আসার আগেই আমরা গাছ থেকে নামতে থাকি। ততক্ষণে ‘বাবাগো মাগো’ বলে- কান ফাটানো চিৎকার শুরু করেছে। শাহেদ নিচেই ছিল। আমরা তিনজন নেমেই দৌড়ে রাতুর কাছে যাই। রাতু উঠে দাঁড়াতেই পারছে না। শুধু একটানা চিৎকার করে যাচ্ছে। আর বাম পায়ের দিকে তার চোখ। পা নাড়াতেও পারছে না। মনে হয় পায়ে ঘাপলা হয়ে গেছে! গাল বেয়ে চোখের পানি ঝরছে টলটল করে। শাহেদও কেঁদে দিয়েছে। আমরা কী করব বুঝতে পারছি না। হাসপাতালে নিতে হবে রাতুকে। চারজনে ধরাধরি করে ওকে বাগান থেকে রাস্তার দিকে যাই। অন্য সময় একাই পারি একজন তুলে দৌড়াতে কিংবা হাঁটতে। আর এখন চারজনেও ওকে নিয়ে দৌড়াতে পারছি না। রাতুর কান্নাকাটি থামছে না। সাথে সাথে শাহেদটাও নাক টানছে। তার গালেও চোখের পানি গড়াগড়ি খাচ্ছে। রাস্তায় একটা রিকশাও নেই। মেজাজটা আরও খারাপ হয়ে গেল। রাস্তায় সারাদিন কত রিকশা থাকে। এখন একটাও নেই। রিকশাভ্যানও দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ পেছন দিক থেকেই রিকশার বেল বেজে উঠল। সাদেক চাচা তার রিকশাভ্যান নিয়ে হাজির। আজ বাড়িতেই ছিলেন। রাতুর চেঁচামেচিতেই তিনি রিকশাভ্যান নিয়ে চলে এসেছেন। রাতুদের বাগানের পাশেই সাদেক চাচার ঘরটা। একটা ছাপড়া ঘরে থাকেন। রাতুদের বাগানটাও দেখাশুনা করেন। রিকশাভ্যান চালিয়ে যা পান, তাই দিয়ে সংসার চলে।
শ্রীবরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। জরুরি কক্ষের ভেতরে রাতু শুয়ে আছে। ডাক্তার না থাকায় এখানকার একজন সহকারী ওর পায়ে সেভলন লাগাতে শুরু করল। কোথাও কোথাও কেটে গেছে। রক্তের ছিটেফোটা দেখা যাচ্ছে। মনে হয় বাম পায়ে ভালো চোট পেয়েছে। আমরা তিনজন পাশেই দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের সবার মুখই ভোতা হয়ে আছে। কারো মুখে কোনো শব্দ নেই। সাদেক চাচাও আছেন। শাহেদটা জরুরি কক্ষে ঢুকেনি। সব কিছুতেই ও খুব ভয় পায়। ভয়ে কাটাছেড়া পর্যন্ত দেখতে পারে না। আবার তাকে যদি ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়, আগে থেকেই চোখ বন্ধ করে থাকে। আর ধরতেই সে কী চিৎকার। শাহেদ বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। একটু পরে দেখি সুজন আর ফালুও আমার পাশে থেকে সরে গেল।
সরকারি হাসপাতালের জরুরি কক্ষ বলতে তেমন কিছু না। ছোট্ট একটা কক্ষে একটা টেবিল, তিনটা চেয়ার রাখা। একটা আলমারি আর রোগীকে বসা কিংবা শোয়ানোর জন্য দুইটা লোহার বিছানা। তাতে আবার তোষক-টোশক কিছু নেই। তা শুধু কোনো রকম ইঞ্জেকশন দেওয়া কিংবা ছোটখাটো সেলাই করার জন্য। সরকারি হাসপাতাল বলেই এই অবস্থা। বিকেল হয়েছে তো কী হয়েছে। জরুরি বিভাগে একজন ডাক্তার থাকবে না এটা কেমন কথা। যে কোনো মুহূর্তে তো রোগী আসতে পারে। না থাকুক, রোগী আসলে তো তাকে খবর দেওয়া দরকার। রাতুর কান্না কিছুটা কমেছে।
এমন সময় চশমা নাকে একজন ঢুকল। সহকারীটা স্যার স্যার করতে লাগল। ইনিই তাহলে ডাক্তার। তিনি রাতুর পা-টা নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলেন। সাদেক চাচা রাতুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। শাহেদ, সুজন ও ফালু কই গেল দেখার জন্য রাতুকে ‘আসছি’ বলে বের হলাম।
শাহেদটা এখনও নাক টানছে। টানবেই তো। এমনিতেই যে ভীতু, তার উপর আজকের ঘটনাটা তার জন্য ঘটল।
‘আমার জন্যই রাতুর এই অবস্থা’ -কাঁদতে কাঁদতে বলল শাহেদ।
‘এখন ভ্যাঁ ভ্যাঁ করছিস কেন? কাজের বেলায় তো একশ’ হাত দূরে থাকিস। অকাজের বেলায় আবার উস্তাদ’ -ফালু গড়গড় করে কথাগুলো বলল।
‘চুপ কর। সব দোষ এখন শাহেদের, না? রাতুকে না করার পরও সে গাছের আগায় চড়তে গেল কেন? বললেই চড়তে হবে নাকি?’ -সুজন বলল।
আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না। আমার চোখও ছলছল করছে। রাতুর আববুকে একটা খবর দেওয়া দরকার। কিন্তু কীভাবে এই খবরটা যে দেই। ‘এই তোরা চুপ কর। এটা কি ঝগড়া করার সময়। আঙ্কেলকে একটা খবর দেওয়া দরকার।’ আমি বললাম। ওদিকে কী হয়েছে দেখার জন্য জরুরি কক্ষে অনেক লোকজন ভিড় করেছে। একটা পিচ্চিকে নিয়ে একজন বাবা এলেন। পিচ্চিটা নাকি কেরোসিন খেয়েছে। ডাক্তার শুনে তাকে শেরপুর জেলা হাসপাতালে রেফার্ড করে দিলেন। এখানে ওয়াশ করার জন্য তেমন কিছু নাই। রোগীকে নিয়ে যেভাবে আসলেন ঠিক সেভাবেই চলে গেলেন তিনি।
এমন সময় সাদেক চাচা আমাদের ডাকলেন। জরুরি কক্ষে ঢুকতেই ডাক্তার আঙ্কেল বললেন- ‘তোমাদের গার্জিয়ান কোথায়? সম্ভবত ওর একটা পা ভেঙে গেছে। এক্সরে করলে বুঝা যাবে।’
বলে কী লোকটা! রাতুর পা ভেঙে গেছে। ভাবতেই পারছি না। এবার শাহেদ ভালোভাবেই কেঁদে ফেলেছে। চোখের পানি আর কোনো বাধা মানছে না আমাদেরও। রাতুর আববুকে খবর দেওয়ার মতো আমাদের মাঝে একজনই আছে, সুজন। আঙ্কেলকে দেখলেই কেমন জানি আমাদের মাঝে ভয় কাজ করে।
‘তুই একটু আঙ্কেলকে খবর দে, আমরা এখানেই থাকি।’-আমার কথায় সুজন দেরি না করে রওনা দিল। দুই মিনিট পরেই আবার সে ফিরে আসল। তার পেছনেই ঢুকলেন আঙ্কেল। নিশ্চয়ই কারো কাছে খবর পেয়েছেন। এসেই রাতুর মাথায় হাত বুলিয়ে ডাক্তারের সাথে কথা বলতে থাকলেন।
রাতু এখন চুপচাপ শুয়ে আছে। কান্না থামলেও চোখে পানি টলটল করছে। কেমন জানি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। আমরা নানা কথা বলে রাতুকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছি। যদিও আমরা এখনো স্বাভাবিক হতে পারিনি। কিছুক্ষণ পর শাহেদ রাতুর হাত ধরে বলল- ‘রাতু, আমাকে তুই মাফ কর।’
রাতু চুপচাপ। কোনো কথা বলছে না। সুজন চোখের ইশারায় শাহেদকে কথা বলতে মানা করল। এমন সময় আন্টি আসলেন। একে একে আসলেন আরও অনেকে।
সন্ধ্যার আজান হচ্ছে। রাতুকে এখন বাইরের একটা ক্লিনিকে নেওয়া হবে। হাসপাতালের এক্সরে নষ্ট। পায়ে এক্সরে করতে হবে। আঙ্কেল আমাদের বাসায় যেতে বললেন। আঙ্কেল বেশ গম্ভীর। তার সামনে আমরা সাধারণত যাই না। দেখলেই দূর থেকে কেটে পড়ি। কেমন যেন তাকে দেখলেই ভয় করে। এছাড়া তার ধমক যে খেয়েছে, সে জানে! আমাদের বাসায় যেতে একদম ইচ্ছে করছে না। তারপরেও আমরা রাতুর কাছে বিদায় নিয়ে রওনা দিলাম।
হাসপাতালের গেইটে একটা মসজিদ রয়েছে। আমরা সাধারণত নামাজ পড়ি না। শুধু শুক্রবারে নামাজ পড়ি। তিন শুক্রবার নামাজ না পড়লে নাকি অন্তরে পাথর লাগিয়ে দেওয়া হয়। তবে আজকে মাগরিবের নামাজ পড়লাম। ফালু হাফ প্যান্ট পড়েছে। তাই সে নামাজ পড়ল না। আর শাহেদ না যাওয়ার জন্য কাচুমাচু করতে লাগল। ও নাকি হিসু করে পানি নেয় নাই। তাই নামাজ পড়তে যাবে না। কী আর করার। আমি আর সুজন অজু করে মসজিদে ঢুকলাম। নামাজ পড়ে রাতুর জন্য দোয়া করলাম।

আমরা পাঁচজন। রাতু, আমি, শাহেদ, সুজন ও ফালু। একই ক্লাসে পড়ি। এক সাথেই খেলি। গলায় গলায় ভাব। রোল যথাক্রমে এক, দুই, তিন, ছয় ও সতেরো। প্রথম তিন জনের মাঝে পড়াশোনা নিয়ে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলে। মানে কার রোল এক হয় তা নিয়ে। কারণ যার রোল এক, সে থাকে ক্লাসের ক্যাপ্টেন। আর এই ক্যাপ্টেন্সীটা কেড়ে নিতেই পড়াশোনার লড়াই চলে। ক্লাস ক্যাপ্টেন হলে স্কুলে বেশ দাপটের সাথে চলাফেরা করা যায়।
আমাদের মাঝে সুজনের একটু বেশি সাহস। শুধু সাহসই না, শক্তিও অনেক। অথচ তার শরীর হালকা-পাতলা, রোগা-রোগা। মনে হয়, কালবোশেখী ঝড়ের কবলে পড়লে বাতাস তাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। হয়তো নিতেও পারে কিন্তু তার সাথে মারামারিতে পেরে ওঠবে এমন দ্বিতীয়টি আমাদের ক্লাসে আর কেউ নেই। দশ জনের বিপরীতে সুজন একাই যথেষ্ট। বাপরে কী শক্তি গায়ে! পড়াশোনায় মোটামুটি।
শাহেদ একটু ভীতু টাইপের। একটু না প্রচন্ড ভীতু সে। আমরা যখন কোনো অ্যাডভেঞ্চার কাজে বের হই! তখন আগে ভাগেই এটা সেটা বলে কেটে পড়তে চায়। সন্ধ্যার পরে তাকে কেউই কোনোদিন কোথাও একা থাকতে দেখেনি। এমন কী তাদের বাড়ির উঠোনেও না। আবার ওর চোখেও সমস্যা রয়েছে। চশমা না পড়লে সে কাছের জিনিস নাকি দেখতে পায় না। কিন্তু দূরের জিনিস দেখতে পায়। আবার একটু ঘুমকাতুরেও বটে। সন্ধ্যে না হতেই ঘুম। এত ঘুমালেও পড়াশোনাটা ঠিক মতোই করে।
আর ফালু ঠিক উল্টো শাহেদের থেকে। সারাদিন এই সেই করে ঘুরে বেড়ায়। শুধু আমাদের গ্রামই না, আশপাশের কয়েক গ্রামের সবাই প্রায় তাকে চেনে। টো টো করে ঘুরে বেড়ানো ছাড়া যেন তার আর কোনো কাজ নেই। তবে তাদের একটা ছোট মুদি দোকান আছে। যেখানে তার বাবার সাথে মাঝে মাঝে বসতে হয়। ফালু দুষ্টুমিতে ক্লাস নয়, পুরো স্কুলের সেরা। তবে প্রয়োজনের সময় সে এতটাই ভদ্র ছেলে হয়ে যায়। দেখে কেউ ভাবতেই পারবে না যে, ফালু নামের এই ছেলেটা এত দুষ্টু হতে পারে। পড়াশোনায় দিন দিন খারাপ করছে।
রাতু খুব মেধাবী। ক্লাসের এক নম্বর রোল এবং ক্যাপ্টেন্সীটা তার দখলে। কেউই ছিনিয়ে নিতে পারেনি গত চার বছরে। সব সময়ই ক্লাসের প্রথম স্থান অধিকার সে করবেই। আমিও কম চেষ্টা করিনি। কিন্তু ফলাফলে তাকে পিছনে ফেলতে পারিনি। গেল বছর মাত্র ছয় নম্বর বেশি পেয়ে সে তার জায়গায় রইল। অর্থাৎ তার রোল এক এক-ই রইল আর আমারটা দুই। রাতু খুব পড়াশোনাও করে। তবে তার মতো এত পড়াশোনার ধৈর্য আমার নেই। এত পড়তেও আমার ভাল্লাগে না। অবশ্য সবাই তো আর এক রকম নয়। এই হলাম আমরা পাঁচবন্ধু। পাঁচ জনের বৈশিষ্ট্যগুলো আলাদা আলাদা হলেও মনের দিক থেকে কিংবা চিন্তার দিক থেকে সবাই এক। হঠাৎ রাতুর পা ভেঙে যাওয়ায় আমার কোনো কিছু আর ভালো লাগছে না। পড়ার টেবিলে বসে কিছুতেই গল্পের বইয়ে মন বসাতে পারছি না। নিশ্চয়ই শাহেদ, ফালু, সুজন কেউই কোনো কাজে মন বসাতে পারছে না।
রাতু গাছ থেকে ডাল ভেঙে পড়ত না। কিন্তু এই ভীতু শাহেদ কখনও গাছে চড়ে না। পড়ে যাওয়ার ভয়ে নিচেই দাঁড়িয়ে থাকে। আজ হঠাৎ আমাদের সাথে গাছে ওঠেছে। তবুও একদম গাছের নিচের ডালে বসে আছে। রাতু তখন বলল- ‘কিরে আজ দেখি তোর খুব সাহস বেড়েছে। হঠাৎ গাছে ওঠলি যে!’
‘তাতো বটেই। আমার সাহসটা মাটি থেকে বেড়ে আজ দশ ফুট ওপরে ওঠেছে। কিন্তু তোদের তো ওঠেনি। বরং কালকের থেকে একটু নিচে নেমেছে।’ রাতু কালকে যে ডালে ওঠেছিল, ঐ ডাল দেখিয়ে জবাব দেয় শাহেদ।
শাহেদের যুক্তি শুনে আমাদের মুখ ফেটে হাসি বের হল। রাতু হাসতে হাসতে বলল, ‘তো কী করলে আজ সাহস বাড়বে শুনি?’
গাছের একটা পাকা টুকটুকে লাল আম দেখিয়ে শাহেদ বলল, ‘ঐ যে আমটা দেখছিস, আমটা যদি পাড়তে পারিস, তাহলে বুঝব তোর সাহস বেড়েছে।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে। দাঁড়া পেরে দিচ্ছি।’ রাতু বলেই গাছের ওপরে ওঠতে লাগল।
আমরা তো অবাক। বলে কী! ঐ মগডালে কেউ ওঠবে নাকি। ডালটা এত চিকন, ফালুর ছোট ভাইটা যে এখনও জন্মপোষাক পড়ে থাকে তার ওজনেও মড়াৎ করে ভেঙে পড়বে। ফাজলামির তো সীমা থাকা দরকার।
‘খবরদার রাতু, তুই আর ওপরে ওঠবি না।’ -আমার আগেই ফালু চেচিয়ে উঠল।
‘তোর কী মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি। ঐ মগডালে কেউ ওঠবে?’ -আমিও নিষেধ করলাম।
সুজনও না করল। কিন্তু রাতু কারো কথা না শুনে গাছের উপরের দিকে উঠতে লাগল। তখন শাহেদও মানা করল, ‘আমি তো এমনি এমনি বললাম। তোকে কি সত্যি সত্যি ওঠতে বলেছি নাকি?’
কিন্তু কে শোনে কার কথা। এতক্ষণে রাতু আরও উপরে উঠে গেছে। এবং আমের কাছাকাছি গিয়ে নিচের চিকন ডালে যেই না পা রেখেছে। ব্যস, চোখের পলকেই রাতু মাটিতে পড়ে গেল। আমরা শুধু ‘ধপাস’ শব্দ আর চিৎকার শোনলাম।

সকালবেলায় হাঁটতে বের হয়েছি। শনিবার স্কুল বন্ধ ছিল। আর শুক্রবার তো সপ্তাহিক ছুটির দিন। ছোট ভাইকে নানার বাড়ি রেখে আসতে হয়েছে। দুই দিন কারো সাথে দেখাই হয়নি। হঠাৎ দেখি ফালু উল্টো দিক থেকে হেঁটে আসছে। সে নিশ্চয়ই আমার আগে ঘুম থেকে উঠেছে।
কী রে রাহু, কই উধাও হইছিলি?’ ফালু বলল।
নানার বাড়ি গেছিলাম। কেমন আছিস? -আমি প্রশ্ন করলাম।
এই তো ভালো আছি। – উত্তর দিল ফালু।
চল রাতুদের বাড়িতে যাই।’-আমি বললাম।
হু, যাওয়া যায়।’- ফালুর উত্তর।
আচ্ছা এক কাজ করলে কেমন হয়? রাতুদের বাড়ি তো স্কুলের পাশেই। তাই একেবারে রেডি হয়ে স্কুলে যাওয়ার আগে গেলেই তো হবে। একটু আগেই বের হব না হয়। তাহলে দুটোই হবে। এখন গেলে তো আবার বাসায় এসে বই-খাতা নিয়ে স্কুলে যেতে হবে।’ -আমি বললাম।
আমি আজ স্কুলে যাব না।’ -ফালু সোজাসাপ্টা বলে ফেলল।
কেন, স্কুলে যাবি না কেন?’ -আমি জানতে চাইলাম।
আজকে তো ইংরেজি স্যারের ক্লাস আছে, পড়া শিখি নাই। তুই যা। আমি পরে রাতুকে গিয়ে দেখে আসব।’ – বলেই ফালু আমার আগে আগে চলে যেতে লাগল।
ফালু দাঁড়া। পড়া না শিখলে কি স্কুলে যাওয়া যাবে না? পড়া না শিখলেও নিয়মিত স্কুলে যাওয়া দরকার।’ -আমি ফালুকে ডাক দিয়ে বললাম।
কিন্তু আজ গেলে তো খবর আছে। স্যার আমাকে আলটিমেটাম দিয়েছে পড়া শিখার। না শিখে গেলে আজ বেতগুলো ঠিকই ভাঙবে।’ -ফালু কাচুমাচু করে বলল আমাকে।
আচ্ছা শোন, তুই বই-খাতা নিয়ে আসিস। যাবি কি যাবি না সেটা পরে দেখা যাবে।’ – আমি বললাম।
ঠিক আছে।’ -ফালু বলে উঠল চিৎকার করে। ততক্ষণে সে বেশ দূরে চলে গেছে। আমাদের বাড়ি থেকে তাদের বাড়ি বেশি দূরে নয়। আমিও দ্রুত পা চালালাম।
সকাল আটটা বাজতে আরও পঁচিশ মিনিট বাকি। ক্লাস শুরু হবে দশটায়। আজ অনেক সকালে স্কুলের দিকে যাচ্ছি। এতো সকালে কখনই স্কুলে যাওয়া হয়নি। অবশ্য আজকেও তো স্কুলে যাচ্ছি না। আমরা তো যাচ্ছি রাতুদের বাড়ি। ওখান থেকে দশটার আগে আগে স্কুলে চলে যাবো। ওদের বাড়ি থেকে বের হলেই স্কুলের মাঠ। আমরা সবাই চুপচাপ হাঁটছি।
এখন কী হবে রে?’ – সুজন প্রশ্ন করল।
কী হবে মানে?’ -ফালু না জানার ভান করল।
আমিও ভেবেছি, আমাদের পরিকল্পনার এখন কী হবে?’ -শাহেদ বলল।
কী আর হবে, পরীকে কল্পনা না করে এখন থেকে স্বপ্ন দেখবি।’ – ফালু ঝটপট উত্তর দিয়ে একপাশে সরে গেল। অন্যসময় ফালুর এই কথায় আমরা সবাই হেসে ফেলতাম। কিন্তু এখন কেউ হাসতে পারলাম না। ফালু সব কিছুকে স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারলেও আমরা পারি না। রাতুর অবস্থার জন্যও আমরাই দায়ী। আমাদের মনে মনে একটা কাজ করার কথা ছিল। এজন্য নিজেরা কিছু কিছু করে টাকা জমিয়েছি। আমরা পাঁচজন ছাড়া কাজটির কথা কেউ জানে না। প্রথম সাময়িক পরীক্ষার পরেই কাজটা শুরু করার কথা। পরীক্ষা শেষ হতে না হতেই রাতু ঠ্যাং ভেঙে ঘরে শুয়ে আছে। আমাদের সাথে থাকতে পারবে না বলে আমি আপাতত চিন্তা মাথা থেকে বাদ দিয়েছি।
‘সবসময় ফাজলামো করবি না। একটা মেরে একদম নাক ভেঙে দিব।’ -সুজন ফালুকে হুমকি দিল।
‘দাঁড়া সুজন, নাকে মারিস না। নাক ভাঙলে নিশ্বাস নিব কেমন করে। আমি আবার তোর মতো কাক নিশ্বাস নিতে পারি না।’ -ফালু উত্তর দিল।
সুজন এবার সত্যি সত্যি মারতে গেল। কিন্তু ফালু ততক্ষণে পেছনের দিকে দৌড়াতে শুরু করেছে। ফালুর মতে, কাকের যখন সর্দি লেগে নাকের ছিদ্র বন্ধ হয়ে যায় তখন নাকি কাক হাঁ করে মুখ দিয়ে নিশ্বাস নেয়। ভালো ছাত্র না হলেও ফালুর এই যুক্তিকে খারাপ বলা যায় না। তবে ছাত্র হিসেবে এক্কেবারে খারাপও না। মাঝে মধ্যেই ক্লাস পরীক্ষায় সবার চেয়ে বেশি নম্বর পেয়ে যায়। আর উপস্থিত বক্তৃতায় তার সাথে পেরে উঠতে পারি না আমরা কেউ।
‘এখন তো রাতুর অবস্থা ভালো না। তাই ওর সাথে পরামর্শ করে সব করা যাবে।’ -আমি বললাম।
‘তাছাড়া সামনে আমাদের গ্রীষ্মের ছুটি হবে তখনও কাজটা করা যাবে।’ – শাহেদ মুখ খুলল।
হঠাৎ রাতুর আববুকে দেখে আমরা সবাই সুন্দরভাবে হাঁটতে লাগলাম। কারণ এতক্ষণ কেউ আগে, কেউ পরে হাঁটছিলাম। কেউ রাস্তার এই পাশে, আরেকজন ওই পাশে। জোরে, চেঁচিয়ে কথা বলছিলাম। ফালু তো দৌড়ে একবার সামনে, আরেকবার পেছনে যাচ্ছে।
আসসালামু আলাইকুম।’ -আমি সালাম দিলাম।
ওয়ালাইকুম আস সালাম।’ -আঙ্কেল সালামের জবাব দিয়ে জানতে চাইলেন, এত সকালে আমরা কোথায় যাচ্ছি। জানতে চাওয়াটা স্বাভাবিক। স্কুল শুরু হতে আরও ঘণ্টা দুয়েকের বেশি সময় বাকি। অথচ সবার হাতে বই খাতা। সুজনই কথা বলল – ‘রাতুকে দেখতে যাচ্ছি আঙ্কেল।’ আমাদের মাঝে যখন কেউ কথা বলতে না পারে তখন সুজন কথা বলে। এটা সুজনের একটা ভালো গুণ। আঙ্কেল মনে হয় কোথাও যাচ্ছেন তাড়াতাড়ি। তাই আর কথা হল না। অবশ্য ওনার সাথে আমাদের কথা খুব কমই হয়। কম বলতে আমরা তার সামনেই আসি না।
আমি লক্ষ্য করছি- কাল থেকে আঙ্কেল একটু পরিবর্তন হয়ে গেছেন। ওনার সামনে আমরা ভুলেও পড়তাম না। দূর থেকেই কেটে পড়তাম। যদিও সামনে পড়ে যেতাম, সালাম দিলে কেমন করে তাকিয়ে থাকত। ভয় লেগে যেত আমাদের। অথচ আজ এমন ভাবে সালাম নিলেন, অনেক মাওলানারাও এভাবে সালামের জবাব দেয় না। আঙ্কেল সবসময় কেমন যেন গম্ভীর হয়ে থাকেন। তিনি এখানকার কলেজের অধ্যাপক। সবাই খুব সম্মান করে চলে। এই বয়সেও তিনি প্রচুর বই পড়েন। ক্লাসে পড়ানোর বই না। সব বিখ্যাত লেখকদের সাহিত্য পড়েন তিনি। একদিন তো ফালু রাতুকে বলছিল- ‘তোর বাবার মাথায় দেখি কিছুই নাই, না হলে কেউ এত পড়া পড়ে নাকি! সারাদিন শুধু বই আর বই। আচ্ছা তোর আববা যদি কোন স্কুলে পড়ে?’ আমরা কেউ কেউ হাসলেও ফালুর এই কথা কানে তুলেনি রাতু। কারণ ফালু সারাদিন সব ফালতু প্যাঁচাল পাড়ে। একদিন রাতুকে ডাকতে এসে ঘড়ি ধরে তিন ঘণ্টা বসে বসে ঞবহংব শিখতে হয়েছিল। দুনিয়ার সবচেয়ে কঠিন বিষয়টি অবশ্য সেদিন আমাদের কিছুটা শেখা হয়েছে। সেদিন হঠাৎ করেই ফালু চেঁচাতে লাগল পেট ধরে। তার নাকি পেটে ব্যথা করছে। আমরা তো ভয় পেয়ে গেলাম। কিন্তু আঙ্কেলের ভয়ে কেউ নড়তেই পারলাম না। আঙ্কেল ফালুকে ঘরে গিয়ে শুয়ে থাকতে বললেন। ঘরে শুয়ে শুয়ে ফালু নাকি সেদিন একটা বিশাল গোয়েন্দা কাহিনী পড়ে শেষ করেছে। আসলে সেদিন ওর পেটে ব্যথা না ছাই হয়েছিল। পড়তে হবে এই ভয়ে অভিনয় করেছিল। এতে সে শুধু পড়া শেখা থেকেই রেহাই পায়নি। আন্টির হাতের শরবত, এই-সেই খেয়েছিল। আমাদের ঞবহংব শেখার কথাটা মনে পড়লেই ও হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খায়। তবে যাই হোক, ওর উপস্থিত বুদ্ধির কাছে আমরা সবাই হার মেনে যাই। এরপর ফালু আরও কয়েকবার গিয়েছিল রাতুদের বাসায়। যখন আঙ্কেল বাসায় থাকত না তখন। গোয়েন্দা কাহিনীর কোনো বই আনতে। কিন্তু ওর ভাগ্যই খারাপ। আঙ্কেল সব বই আলমারির ভেতরে তালা দিয়ে রাখেন। ফালুর অবশ্য আরেকটা লাভ হয়েছে- আন্টির হাতের পিঠা আর নাড়ু খেয়ে এসেছে। আন্টির এই একটা ভালো গুণ। বাসায় গেলে কোনো কিছু না খাইয়ে আসতেই দিবেন না। আরেকদিন আমরা সবাই বসে চা খাচ্ছি আর কথা বলছি। এমন সময় বাইরে আঙ্কেলের কণ্ঠ। শাহেদটা একটু বেশি ভীতু। ও ভয়ে তাড়াতাড়ি চা খেতে গিয়ে জিহবা পুড়ে ফেলেছিল। মানে ঐ গরম চা দ্রুত খেতে গেলে যা হয় তাই আর কি। কয়েকদিন শাহেদ ঝাল কিছু খেতে পারেনি। আমরা দেখিয়ে দেখিয়ে ঝালমুড়ি আরও ঝাল করে খেতাম! এখন তো শাহেদ চা খাওয়াই বাদ দিয়েছে।
ফালুর মাঝেও পরিবর্তন এসেছে। ও সবসময় এমন সব কথা বলত, না হেসে থাকতে পারি না। কথায় কথায় হাসাতে পারে সে। কিন্তু কাল থেকেই ফাজলামোর মাত্রাটা কম দেখা যাচ্ছে। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকার মতো ছেলে নয় ফালু। বেশি লাফালাফি করে। যদিও সবার সাথে ফাজলামো করে না। অন্যদের সামনে তো এক্কেবারে ভদ্র ছেলে হয়ে যায় যে, দশ গ্রামেও এমন ছেলে আর পাওয়া যাবে না! কিন্তু আমাদের সাথে সারাদিন মজা করে। বেশি লাফালাফি করার জন্যই ওর নাম হয়েছে ফালু। ফালাফালি (লাফালাফি) থেকে ফালু। আসলে ওর নাম হল ফারুক। কিন্তু স্কুলের স্যারেরা ছাড়া আর কেউ তার এই নাম জানে না। কাল থেকে ফালু অন্য দিনের তুলনায় বেশ চুপচাপ। তারপরেও আমাদের মন খারাপ বলে হাসানোর চেষ্টা যে করছে না, তা নয়। কিন্তু তা আগের তুলনায় ষোলআনার পনের আনাই বাকি। অবশ্য ওর মনটাও খারাপ।
আমরা চুপিচুপি রাতুদের বাসায় ঢুকি। জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখি- রাতু বই পড়ছে।
‘শালা মানুষ না পায়জামা, ঠ্যাং ভেঙে গেছে তারপরেও বই পড়ছে।’ – ফালু একটু জোরেই বলল। রাতু আমাদের দিকে তাকাতেই আমরা সরে গেলাম এবং ঘরে ঢুকে পড়লাম।
‘কিরে এখন কেমন লাগছে?’ -আমার আগেই সুজন জিজ্ঞাসা করল।
‘ভালো, তোরা কেমন আছিস?’ -রাতু জবাব দিল।
আমরা সবাই রাতুকে ঘিরে বসে আছি। ‘তুই এই অবস্থায়ও বই পড়ছিস’- ফালু বলল।
‘তো শুয়ে শুয়ে কী করব?’- রাতুও প্রশ্ন করে।
‘কেন, তোদের ঘরে কত বই। গোয়েন্দা কাহিনী, কিশোর উপন্যাস, গল্প এসব পড়তে পারস না।’ -আলমারির বইগুলো দেখিয়ে বলে ফালু।
‘আববু পিটিয়ে পিঠের ছাল তুলে ফেলবে।’ রাতু বলল।
নানান বিষয় নিয়ে আমাদের কথা-বার্তা চলতে থাকে। এর মধ্যে বিস্কুট, সেমাই খাওয়া হয়ে গেছে। এখন আবার আন্টি এসে চানাচুর আর মুড়ি দিয়ে গেল।
‘আচ্ছা রাহু তুই কী কিছু ভেবেছিস, আমরা যে কাজটা করতে চেয়েছিলাম সেটার ব্যাপারে।’ -রাতুই প্রথম বলল।
‘ভেবেছি, কিন্তু তুই ছাড়া কাজটা করতে আমরা রাজি না। তুই সুস্থ হয়ে নে তারপর করা যাবে।’ -আমি উত্তর দিলাম।
‘কাজটা তো পরেও করা যাবে। তোকে মিস করে এটা করা সম্ভব না।’ -শাহেদ ওর চশমাটা ঠিক করে বলল।
‘তুইও তো যেতে পারবি না। ঘরে বসে বসে আঙুল চুষবি আর আফসোস করবি। তারচেয়ে পরে করলেই ভালো হয়। তোকে আঙুলও চুষতে হবে না আর আফসোসও করতে হবে না।’ -ফালুর মুখে যেন খই ফুটল।
‘তাহলে তো আবার পরিকল্পনা করতে হবে। নতুন করে এগুতে হবে।’ -রাতু বলল।
‘কোনো সমস্যা নেই। নতুন করেই আমরা কাজটি শুরু করব।’ -আমি জবাব দিলাম।
আমরা একটা কাজ হাতে নিয়েছিলাম। সব পরিকল্পনা করা শেষ। শুধু কাজ শুরু করাটাই বাকি ছিল। সবাইকে এখনই ব্যাপারটা বলা যাবে না। বললে বড়রা মানে আমাদের অভিভাবকরা করতে দিবেন না। পড়াশোনা বাদ দিয়ে এসব করাটা কেউ ভালো চোখে দেখবেন না। হয়তো রাতুকে ওর আববু কোনোদিন বিকেল বেলায়ও বাইরে বের হতে দিবেন না। শুধু রাতু নয়। আমাদের সবাইকেই তখন স্কুল ছাড়া আর কোথাও যেতে দিবেন না। কারণ বড়রা আমাদের ছোট মনে করে। ঠিক আছে, আমরা ছোট এটা মানছি। কিন্তু আমাদের যে কাজগুলো আছে তাও তো তারা করতে দেয় না -ছোট বলে। কত কাজ আছে বড়রা ইচ্ছে করলেই করতে পারে। এলাকার কত সমস্যা ইচ্ছে করলেই সমাধান করতে পারে। কিন্তু করে না। অথচ আমরা যেসব করতে পারব। তাও করতে দেবে না। তবে আমরা বড় হলে ঠিকই কাজগুলো করব। ছোটদের করার মতো কাজ করতে দিব। ছোটদের ছোট বলে বলে ভালো কোনো কাজ থেকে দূরে সরিয়ে রাখব না। এই সেদিন এক স্যার ক্লাসে বললেন, ‘তোরা এখনো অনেক ছোট। একা একা বাইরে বের হবি না। ……….এই সেই যেন এক বক্তৃতা দিয়ে ফেললেন।’
‘স্যার আমরা কি এখনো ফিডার খাই, নাকি কারো কোলে উঠে ইয়ে করে দেই যে, আমরা অনেক ছোট।’ -ফালু বলেই ফেলল। স্যারটা আমাদের বাংলা স্যার বলে কথা। তাই কিছু বললেন না। অবশ্য অন্য কোনো স্যার হলে এটা বলার চিন্তাও করত না ফালু। আচ্ছা আমরা যদি ছোট হই। তাহলে ফালুর ছোট ভাইয়ের মতো যারা প্যান্টেই ইয়ে করে দেয় তাহলে তাদের কি বলা হবে? যাক ছোট প্রসঙ্গ নিয়ে বেশি কথা বলব না। কারণ আমরা সবার চোখেই ছোট। কিন্তু আমাদের পরিকল্পনা ছিল অনেক বড়। কাজটা করতে পারলে বড়রা হয়তো কিছুটা আমাদের বড় মনে করতেও পারেন।
কখন যে দশটা পার হয়ে গেছে খেয়ালই করিনি। আন্টি এসে দেখেন আমরা আড্ডায় ডুবে আছি। আন্টি সেখান থেকে আমাদের তুললেন! স্কুলে যাওয়ার কথা মনে করিয়ে দিলেন। আমরা স্কুলের উদ্দেশ্যে রওনা দেই। ওদের বাড়ি আর স্কুলের সীমানা এক। স্কুল ঘর আর ওদের ঘরের মাঝে একটা মাঠ আছে। যেখানে আমরা বিকেলে ক্রিকেট খেলি। ফালুকে আমার পাশে বসিয়ে ইংরেজি স্যারের পড়া লেখার সময় দেখানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে স্কুলে যেতে রাজি করাই।

ক্লাসে ঢুকেই দেখি প্রথম বেঞ্চটা দখল হয়ে গেছে। বেশ বড় বড় বেঞ্চ। দুইটা সারির একটায় আমরা পাঁচজন বসি। আমাদের জন্য বেঞ্চটা যেন নির্ধারিত। আমরা কেউ না আসলে তাহলেই কেবল অন্যরা বসে। ক্লাস ক্যাপ্টেনের একটা ভাব আছে না! সে তার বন্ধুদের নিয়ে এই বেঞ্চটায় বসে। আর হলো আমাদের ক্লাসে কিন্তু কোনো মেয়ে নেই। না, এটা বালক উচ্চ বিদ্যালয় না। এখানে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত ছেলেমেয়ে এক সাথেই ক্লাস হয়। এরপরের শ্রেণিগুলোতে ছেলেমেয়েদের জন্য আলাদা আলাদা শাখা। দ্বিতীয় বেঞ্চে একজন বসেছে। এটাতেই আমি, সুজন, শাহেদ আর ফালু বসে পড়লাম। প্রথম বেঞ্চে বসেছে একটা অপরিচিত ছেলে। তার পাশে বসেছে শাকিল আর মামুন। শাকিল ছেলেটা ভীষণ রকমের পাজি। মিথ্যা কথাও বলে যেমন, বিপদেও পড়ে তেমন। এটা-সেটা বানিয়ে বানিয়ে বলে বন্ধুদের মাঝে শত্রুতা বাড়ানোর চেষ্টা করে। ক্লাসের বেশিরভাগ ছেলেই তাকে দেখতে পারে না। দেখতে পারবে কীভাবে, খেলতে গেলেই মারামারি করে। অপরিচিত ছেলেটা হয়তো নতুন এসেছে। কয়দিন টিকবে কে জানে? গত বছর আমাদের ক্লাসেই দু’জন নতুন ছাত্র ভর্তি হয়েছিল। ভর্তি হয়েছিল মানে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট নিয়ে আসা আর কি। কিন্তু একে একে বছর না ঘুরতেই আবার চলে গেছে। এদের মধ্যে একজনের বাবা ছিল কলেজের শিক্ষক, আরেকজন শিক্ষা অফিসার। সবাই জেলা শহরে কিংবা তারচেয়েও বড় শহরে থাকতে চায়। গ্রামে থাকলে নাকি তাদের ছেলেমেয়েরা ভালো হবে না। খারাপ ছেলেদের সাথে মিশে নষ্ট হয়ে যাবে। গ্রামে পড়াশুনার পরিবেশ নেই ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু তারা হয়তো জানে না, গ্রামে থাকুক আর শহরেই থাকুক। খারাপদের সাথে মিশলে তো খারাপ হবেই। গ্রামে কি কোনো ভালো ছেলে নেই? আমরা তো সবাই ভালো। এই দিক থেকে অবশ্য রাতুর আববুকে আমাদের অনেক ভালো লাগে। উনি সাত বছর থেকে এই এলাকায় আছেন। আঙ্কেলের মতে- ‘ওরা আসলে শিক্ষিত মূর্খ! যত বড় অফিসারই হোক না কেন, তাদের বাইরের ধারণা কম। পৃথিবীর সব বিখ্যাত মানুষগুলো গ্রামেই বড় হয়েছেন। গ্রামে যদি পড়ার পরিবেশ না থাকে তাহলে তৈরি করে নিতে হবে। ভয়ে লেজ গুটিয়ে পালালে কি চলবে।’ তিনি মনে করেন শহরের থেকে গ্রামেই ভালো আছেন। প্রতিদিন পাখির ডাকে ঘুম ভাঙে। নির্মল বাতাস গায়ে মাখা যায়। শহরের সব ঘিঞ্জি পরিবেশ। দালান-কোঠা, গাড়ি- ঘোড়া, দূষিত বাতাসে কি সুস্থভাবে বাঁচা যায়? খাবার-দাবার সব কিছুতেই ভেজাল। একদিন তো তিনি বলেই ফেললেন, ‘শহরে বসবাসরত বেশিরভাগ মানুষেও ভেজাল আছে!’ আর খারাপ ছেলের কথা, তাও গ্রামের থেকে শহরে বেশি। তবে গ্রামে একটা সমস্যাও আছে- ভালো শিক্ষকের অভাব। আঙ্কেল একটি বারের জন্যও গ্রাম ছেড়ে শহরে যাওয়ার কথা চিন্তা করেননি। আঙ্কেল নাকি এখানেই ভালো আছেন। এর আগে একবার ঢাকার সবচেয়ে নামকরা কলেজে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। কিন্তু তিনি যাননি।
নতুন ছেলেটাই নাকি ওই বেঞ্চে প্রথম বসেছে। তারপর শাকিল নিশ্চয়ই মামুনকে নিয়ে গিয়ে বসেছে। আসলে আমাদের ক্লাসের বেশির ভাগই পড়া না শিখে আসায় প্রথম বেঞ্চটায় বসতে চায় না। আর ফালু তো আমাদের সাথে বসে, দেখে দেখে লেখার জন্য। নতুন ছেলেটার সাথে পরিচিত হওয়া দরকার।
শাকিল আবার তার মাথায় এটা সেটা বলে উল্টাপাল্টা কিছু ঢুকালো কি না কে জানে। এমন সময় বাংলা স্যার ঢুকলেন। রোল ডাকা শেষ করেই স্যার বললেন- ‘তোমাদের ক্লাসে একজন নতুন ছাত্র ভর্তি হয়েছে। সবাই কি তার সাথে কথা বলেছ। পরিচয় জেনেছ। ওর নাম হচ্ছে তনয়। এই যে তনয় একটু উঠে দাঁড়াও।’ তনয় উঠতে এক সেকেন্ডও দেরি করল না। হয়তো এমন একটা সুযোগের অপেক্ষার জন্যই বসে ছিল। নিজে থেকে আর পরিচিত হতে হচ্ছে না। স্যারই পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। তনয়ের মুখটা হাসি হাসি। মনে হয় স্যারের ব্যবহারেই খুশি হয়েছে। স্যারের কি কেরামতি, এক নিমিষেই সবার সামনে তাকে পরিচয় করিয়ে দিল। যা এতক্ষণে ও পারেনি। স্যার রাতুর পা ভাঙার খবরটা আগেই জেনেছেন। শুধু স্যার নয় অল্প সময়ের মধ্যেই সবাই জেনে গেছে। ভালো ছেলে বলে কথা!
‘আমাদের স্কুলে তনয়কে অভিনন্দন। আর তনয় নতুন আসায় আজ তোমাদের কিছু পড়াব না। তোমাদের সাথে গল্প করব। তনয়ের কথা শুনব। তোমরা কে কি করছ, বড় হয়ে কে কি হতে চাও বলবে।’ -স্যার বললেন।
আমরা সবাই খুশিতে নড়েচড়ে বসলাম। সবচেয়ে বেশি খুশি মনে হল ফালুকে। মনে হয় সে বাংলা স্যারের পড়াটাও শিখে আসেনি। খুশিতে সে ওর সামনে বসা শাকিলের মাথায় টোকা দিল সবার অজান্তেই। শাকিল এদিক ওদিক তাকিয়ে আগের মতোই বসে রইল। ফালু আবারও তার মাথায় টোকা দিল। এবার শাকিল পেছনে তাকাল। কিন্তু কাকে ধরবে সে? তার পেছনে বসা ফালু তো একেবারে স্যারের কথার ভেতরে ঢুকে গেছে। ফালুকে সন্দেহ হলেও বলার সাহস পেল না। বেশ কিছুক্ষণ আড়চোখে তাকাচ্ছিল। আমি আর সুজন খুব কষ্ট করে হাসি চেপে রাখলাম। সবাই স্যারের কথায় মনোযোগ দিলাম। এবার ফালু শাকিলের মাথায় খোঁচা দিতেই সে তনয়কে সন্দেহ করল। কেননা তনয় পেছনের টেবিলে হেলান দিয়ে স্যারের কথা শুনছিল আর তখনই একটু নড়েচড়ে বসছিল। ভাবল- এই ছেলে তো ফালুর চেয়েও ভীষণ দুষ্টু। তাই দেরি না করে শাকিল দাঁড়িয়ে বলল- ‘স্যার তনয় আমার মাথায় বার বার খোঁচা দিচ্ছে।’ আমাদের তো মুখ ফেটে হাসি বের হতে চাচ্ছে। কিন্তু হাসতে পারছি না। তনয় এতটাই ভড়কে গেল যে, নিশ্চয়ই সে চিন্তা করেনি এরকম পরিস্থিতিতে পড়বে। পেছনে যারা বসেছে তাদের কেউ কেউ দেখলেও সে তো আর দেখেনি কে এই কাজ করেছে। ফালু তো একদম চুপচাপ স্যারের কথা শুনছে। স্যার কী করবেন মনে হয় বুঝতে পারলেন না। ‘কী স্কুলে এসেই শুরু হয়ে গেছে?’ স্যার তনয়ের উদ্দেশ্যে বললেন।
‘স্যার আমি এ কাজ করিনি। পেছন থেকে কেউ করেছে।’ তনয় উত্তর দিল।
এবার স্যার বুঝতে পারলেন কে এই কাজ করতে পারে। স্যার ফালুকে দাঁড়াতে বলতেই ফালু বলল- ‘স্যার আপনি পড়া ধরবেন না এবং নতুন একজন বন্ধু পেলাম শুনে খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করল। হাতটা যেই একটু নড়ল অমনি ওর মাথায় লাগল।’ এরপর আর আমরা হাসি ধরে রাখতে পারলাম না। স্যারও হেসে ফেললেন আমাদের সাথে। কেবল শাকিল ফোঁসতে লাগল। স্যার চলে যাওয়ার পর আমরা তনয়কে ঘিরে বসলাম। একে একে সবার সাথে নাম বিনিময় হলো। ওর মা এই স্কুলেই বদলি হয়ে এসেছেন। তবে তিনি আমাদের পড়াবেন না। নবম ও দশম শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগে পড়াবেন। তনয়ের কপালে কেটে যাওয়ার দাগ দেখে বললাম- কীসের দাগ এটা।
‘পিচ্চি থাকতে যুদ্ধ করতে গিয়ে আহত হয়েছিলাম। তলোয়ারের আঘাতে ফেটে গিয়েছিল।’ তনয় খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলল।
বলে কি ছেলেটা! নিশ্চয়ই মাথায় সমস্যা আছে না হলে কেউ এমন কথা বলে। কোনোদিন না। তনয়ের কথায় কেউ কেউ হাসল। বেশ তো ফাজিল ছেলেটা। এসেই ফাজলামো করেছে। পরে অবশ্য তনয় জানাল- যুদ্ধ যুদ্ধ খেলতে গিয়ে এই অবস্থা হয়েছিল। আরও মজার মজার কথা বলে মাতিয়ে তুলল ক্লাসটা। তনয়কে সবার ভালো লেগে গেল। শাকিলটা এক কোনায় চুপচাপ বসে আছে। তনয় দুইবার ডাকল কিন্তু ও না শোনার ভান করে বসে থাকল। আমরা গল্পে গল্পে মজে আছি। এমন সময় বস্তা স্যার এসে হাজির। আমাদের গোল হয়ে বসে হাসাহাসি করাটা মনে হয় তার কাছে ভালো লাগল না। এসেই একটা ধমক দিয়ে সোজা হয়ে বসতে বললেন। বস্তা স্যার না হয়ে অন্য কোনো স্যার হলে ফালু এতক্ষণে নিশ্চয়ই দাঁড়িয়ে বলত- স্যার সোজা হয়ে কখনও বসা যায়? কেউ যদি সোজা হয় তাহলে সে বসবে কীভাবে? সোজা হয়ে দাঁড়ানো যায়, শোয়া যায়। কিন্তু বস্তা স্যার বলে কথা। সব জায়গায় সব ধরনের কথা বলা ঠিক না -এটা ফালু ভালো করেই জানে। আর বস্তা স্যারকে বললে পিঠের উপর কয়টা বস্তা পড়বে কে জানে? স্যারের নামটা এই জন্যই বস্তা স্যার। কথা নাই বার্তা নাই, কোনো কিছু হলেই ধাম করে পিঠে হাত পড়ত। শব্দ হতো সে কী! শব্দের চেয়ে মারের চোটটা আরও বেশি। তাই স্কুলে স্যারকে সবাই বস্তা স্যার নামেই ডাকে। এখন তো ছাত্ররা স্যারের অন্য নামটা ভুলেই গেছে। ক্লাসে স্যার ঢুকায় আমরা চুপচাপ স্যারের কথা শুনতে থাকি।

আমাদের স্কুলের মাঠটা বেশ বড়। এটিই আমাদের খেলার মাঠ। স্কুল ছুটির পরে আমরা সাধারণত কেউ বাসায় যাই না। তখন আমরা খেলাধুলায় ব্যস্ত। তবে রাতুকে দৌড়াতে হয়। অন্তত বাসায় গিয়ে দেখা করে আসতে হবে। এটা ওর আববু নিয়ম করে দিয়েছে। আমাদের আর কারো বাসায় এই নিয়ম নেই। অবশ্য রাতুদের বাড়ি তো মাঠের পাশেই। একপ্রান্তে স্কুল অন্য প্রান্তে ওদের বাড়ি। এক দৌড়ে যায়, এক দৌড়ে আসে। বেশিক্ষণ লাগে না। স্কুল ছুটির পর আজও আমরা খেলতে ব্যস্ত। তনয়ও আমাদের সাথে যোগ দিয়েছে। মজার একটা বিষয় হল- তনয় ক্রিকেট কিংবা ফুটবল ছাড়া আর কোনো খেলা খেলতে পারে না। তাই সে ক্রিকেট আর ফুটবল বাদে আরও যে খেলাগুলো আছে সেগুলো সম্পর্কে জানতে চাইছে। শহুরে পোলাপান তো আর অন্যসব খেলা খেলে নাই কোনোদিন! আমরা খুব মজা পাচ্ছি। তনয়ও মজা পাচ্ছে।
আমরা প্রতিদিনই একটা করে খেলা খেলি। আজ গোল্লাছুট তো কাল কানামাছি। এভাবে বউছি, ডাংগুলি, নোনতা বলরে, ইচিং বিচিং চিচিং চা, এক তালি ভাই বল্টু, সাত চারা, লুকোচুরি, কুমির কুমির, বম্বাস্টিং, এক্কাদোক্কা খেলা খেলতে থাকি। তনয় প্রথম দুই একবার দেখেই শিখে ফেলছে এবং খেলছে।
একদিন সবাই মিলে লুকোচুরি খেলছি। ফালু লুকিয়ে আছে। সুজন কোনোভাবেই তাকে খুঁজে বের করতে পারছে না। সুজন হার মানলেও ফালু বের হচ্ছে না। সন্ধ্যায় সবাই একটা ঘুড়ির পেছনে ছুটতে ছুটতে ফালুদের বাড়ির পাশে এসে পড়ি। দেখি ফালু বসে বসে আইসক্রীম খাচ্ছে। তাকে দেখেই তো সুজন তেড়ে গেল মারতে। কোনো রকম ছাড়া পেয়ে ফালু বলল- ‘আচ্ছা বল দেখি তোকে যদি বারবার পাখম ভাই মিসকল দেয়। তুই কি কল ব্যাক না করে পারবি।’
ফালু কী বলল আমরা কিছুই বুঝলাম না। পরে সেই বুঝাল- পাখম ভাই মিসকল দিচ্ছে মানে, টয়লেটে যেতে হবে। আর মোতালেব ভাই হচ্ছে হিসুর চাপ। পাখম আর মোতালেব নাকি বড়-ছোট দুই ভাই। সরাসরি এসব না বলে সে এখন থেকে পাখম ভাই আর মোতালেব ভাই বলছে। এটা তার আবিষ্কার। এক সময় এটা বলতে সবাই নাকি সাচ্ছন্দ্য বোধ করবে। আমরা না হেসে পারি না। তাহলে ফালুকে পাখম ভাই মিসকল দেওয়ায় কলব্যাক করতে বাড়িতে দৌড়িয়েছে!
সব শুনে তো তনয় হাসতে হাসতে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। প্রায় প্রতিদিনই একটা আড্ডা হয়ে যায় রাতুদের বাসায়। পুরো ছয় মাস তাকে বিশ্রাম নিতে হবে। পায়ে প্লাস্টার করা হয়েছে, এটাই খোলা হবে তিন মাস পর। সারাদিন বাসায় শুয়ে থাকা ছাড়া রাতুর কোনো কাজ নেই। তাই আমরা গিয়ে আড্ডা জমানোর চেষ্টা করি।
আজ খেলাটা তেমন জমল না। হঠাৎ প্রচন্ড বাতাস বইতে শুরু করল। পুরো আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেছে। মনে হচ্ছে বৈশাখের প্রথম ঝড়টা বুঝি আজই হবে। সেই কবে বৈশাখ শুরু হয়েছে, অথচ ঝড়বৃষ্টির কোনো খবরই নেই। আমরা স্কুলের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। বৃষ্টি নামতেও দেরি হলো না। ফালু দৌড়ে গেল আমগাছের তলায়। বৃষ্টির মধ্যেই। স্কুলের আমগাছটায় খুব একটা আম ধরেনি। মোট চারটা আম নিয়ে ফালু ফিরল। ততক্ষণে ও ভিজে একাকার। বাতাস কমে গেলেও এখন বৃষ্টি পড়ছে।
‘চল রাতুদের আম বাগানে যাই। অনেক আম পড়ছে।’ -ফালু প্রস্তাব রাখল। ‘সেখান থেকে পরে রাতুদের বাসায় যাব।’
তনয় রাজি হচ্ছে না কিছুতেই। বৃষ্টিতে ভেজা তার নাকি নিষেধ রয়েছে। তবে সে যে বৃষ্টিতে ভিজতে চাচ্ছে এটা বোঝা যাচ্ছে। ফালু হঠাৎ পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে বৃষ্টিতে নামিয়ে দিল আমাদের।
‘কিন্তু বইয়ের কী হবে?’ -শাহেদ প্রশ্ন করল।
সুজন তখন একটা বড় দেখে কলাপাতা এনে শাহেদের হাতে ধরিয়ে দিল। বলল- তুই বইগুলোকে বাঁচিয়ে আমাদের পিছু পিছু যাবি। তোর তো আবার ভিজতে মানা আছে।’
শাহেদ কোনো কথা বলল না। তবে কলাপাতা নিতেও রাজি হলো না। আমরা জোর করেই ওর হাতে ধরিয়ে দিব। তখন তনয় ওর স্কুল ব্যাগে আমাদের সবার বই ঢুকালো। বলল- ‘এটা ওয়াটার প্রুফ। বৃষ্টিতেও ভেতরে পানি ঢুকতে পারবে না।’ তাহলে তো আর কারো ভিজতে মানা থাকল না। এতক্ষণে শাহেদের মুখের কালো কালো রাখা ভাবটা কেটে গেল।
স্কুলের মাঠ পার হওয়ার আগেই হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন চিৎকার করল। শাহেদ কিছুটা চমকে উঠল। কেউ পিছলে পড়ল নাকি। না কেউ পিছলে পড়েনি। পেছন ফিরে দেখি, ঝিনুক এসেছে। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে স্কুল থেকে বাড়ি যাচ্ছে। ওদের স্কুলে ছুটির পরে কোচিং করতে হয়। এটা বাধ্যতামূলক। কোচিং না করলেও টাকা দিতে হবে। আজব নিয়ম-কানুন। অবশ্য আমাদের স্কুলে এমনটা নেই। এমন নিয়ম চালু করতে চেয়েছিল কিন্তু পরে আর করেনি। কোচিং শেষ করে যেই না বাইরে বের হয়েছে তখনই বৃষ্টি। তাই ভিজতে ভিজতে রওনা দিচ্ছে। সাথে আরও অনেকে ছিল। ওরা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। ঝিনুক আমাদের দেখেই দৌড়ে এসেছে। বলতে বলতে যেন হাঁপিয়ে উঠল ঝিনুক।
পিচ্চি বেলার বন্ধু বলে কথা। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত সবাই একই স্কুলে ছিলাম। পরে ঝিনুক গার্লস স্কুলে ভর্তি হয়েছে। সে সাথে নিয়ে এসেছে অনেক আম। স্কুল থেকে আসার পথে যেসব গাছ থেকে পড়েছে, তারই কিছু কাড়াকাড়ি করে এনেছে। ঝিনুক আর তনয়ের মাঝে পরিচয় হয়ে গেল বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতেই। ঝিনুকের আনা আম এর মধ্যে ফালু সবার হাতেই সাফাই করে ফেলেছে। ঝিনুক রাতুর কথা জিজ্ঞেস করল। শুনে তার মন কিছুটা খারাপ হয়ে গেল। আমরা আম কুড়াতে না গিয়ে সোজা রাতুদের বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। বৃষ্টিও কমে গেছে। ঝিরঝির করে একটু একটু ঝরছে।
আমরা চুপি চুপি রাতুর ঘরে ঢুকে পড়লাম। রাতুর পাশেই আন্টি বসে আছেন। আমাদের দেখে সে কী রাগ! এই বৃষ্টিতে ভিজে এলাম কেন? ভেজা কাপড়ে কতক্ষণ থাকব? যদি কোনো অসুখ হয়। এই জাতীয় আর কী। আমাদের কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা একটাই আঙ্কেল দেখতে না পেলেই হলো! তনয়ের সাথে আন্টি এবং রাতুর কথা হলো।
‘কিরে কাল পা ভেঙেছে অথচ আমি খবর পেলাম না?’ -রাতুর চুল টেনে বলল ঝিনুক।
‘কীভাবে খবর দেই? পা ভালো থাকলে তো?’ – রাতু হাসি মুখে জবাব দেয়।
‘পা ভালো থাকলে তো’ – ঝিনুক ভেংচি কাটে।
আন্টি এসে ঝিনুকের হাতে গামছা এগিয়ে দিলেন মাথা মোছার জন্য। সাথে রাতুর একগাদা শার্ট-গেঞ্জি। ‘মাথা মুছে এগুলো পরে নাও। ভেজা কাপড়ে থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবে।’
‘আন্টি সন্ধ্যা হয়ে গেছে তো। আমরা বেশিক্ষণ থাকব না।’ -ঝিনুক মাথা মুছতে মুছতে বলল। তার সাথে সাথে আমরাও সুর মেলালাম।
‘কী যে বলো, আজ বাসায় তোমাদের নতুন বন্ধুকে এনেছ, আরেকজন এসেছে ছয়মাস পর। এমনি এমনি কী আর যাওয়া যায়।’ -আন্টি ঝিনুকের মাথায় হাত রেখে বললেন। মাথার উপর বৈদ্যুতিক পাখা চলছে। গায়ের শার্ট কিছুটা শুকিয়ে এসেছে প্রায়।
‘আন্টি, তাহলে কিছু একটা হয়ে যাক’ – সুজন বলল আন্টিকে। আন্টি মুচকি হেসে টেবিল ফ্যানটা অন করে অন্য ঘরে চলে গেলেন। আমাদের আড্ডা চলতে থাকল। আসলেই অনেক দিন পর আমরা মানে ঝিনুক সহ একসাথে হয়েছি। আড্ডায় যোগ হয়েছে পিয়াজু আর বাদাম দিয়ে মাখা ঝালমুড়ি।

অনেকদিন হয়ে গেল রাতুর স্কুলে আসা বন্ধ। যদিও এখন সে একা একা কিছুটা হাঁটতে পারে কিন্তু স্কুলে আসে না। বিকেলে আমাদের সাথে খেলতেও আসে না। আমরাই গিয়ে দেখে আসি। সেটা এক দিক থেকে ভালোই। রাতুদের বাসায় ঘন ঘন যাওয়া মানেই মজাদার কিছু একটা পেটে যাওয়া। শুধু আঙ্কেলের চোখটা একটু ফাঁকি দিতে হয়। মানে আঙ্কেল যখন বাসার বাইরে থাকেন তখন যাওয়াটাই উত্তম।
শাহেদ এসে খবর দিল আগামীকাল থেকে রাতু স্কুলে আসবে। আমরা একসাথে হুররে বলে চিৎকার করে উঠলাম। এদিকে বস্তা স্যার মানে ইংরেজি স্যার সপ্তাহখানেক হলো ঢাকায় গিয়েছেন স্কুলের একটা কাজে। বস্তা স্যার না থাকায় কারো উপর আর বস্তা পড়ছে না। তাই পুরো স্কুলে একটা উৎসব উৎসব ভাব। এই সময় ফালুর সবচেয়ে বেশি খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু বেশ কয়েকদিন থেকেই ও স্কুলে আসছে না। বিকেলে খেলতেও আসে না। আমাদের কারো সাথে দেখাও হয়নি। সুজন জানাল, কাল বিকেলে ফালু তার আববার সাথে দোকানে বসেছিল। ওদের একটা কাঁচামালের দোকান আছে। স্কুলের বিজ্ঞান স্যার অনেক ভালো। কখনও কাউকে বকাঝকা দেন না। কিন্তু গত সপ্তাহে ফালু পড়া না শিখে আসায় তাকে ক্লাসের বাইরে বারান্দায় হাঁটুতে ভর দিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। আমাদের স্কুলের কোনো বাউন্ডারি নেই। সীমানা প্রাচীর না থাকায় রাস্তা থেকে সবই দেখা যায়। যেদিন ওকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছে, রাস্তা থেকে সবাই দেখেছে ফালুকে। আজ চার দিনের বেশি হলো ওর সাথে আমাদের দেখা নেই। রাতে ফালুর কথা বেশ ভাবলাম। সকালে উঠেই আববুর সাথে নামাজে গেলাম। নামাজ শেষ করে আমি ফালুদের বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকি। ফালু ঘরে নেই। আন্টি জানাল, ‘এখানেই তো ছিল। কই যে গেল।’ আমি ফালুর ঘরে গেলাম। ফালুর পড়ার জন্য কোনো টেবিল নেই। বিছানার একপাশে তার বই-খাতা গুছিয়ে রাখা। কিন্তু গণিত আর ইংরেজি ছাড়া ক্লাস সেভেনের কোনো বই আমি দেখলাম না। জানালা দিয়ে দেখি- বাড়ির পেছনের কাঁঠাল গাছটার নিচে ফালু বসে আছে। আমি ঘর থেকে বের হয়ে ওর কাছে গেলাম। আমাকে দেখেই দাঁড়াল, ‘কী রে তুই?’ আমি ওকে নিয়ে বসে পড়লাম। বললাম, ‘স্কুলে যাস না ক্যান?’
আমি আর স্কুলে যামু না’ – ফালু উত্তর দিল।
স্কুলে যাবি না মানে?’ -আমি অবাক হয়ে যাই ওর কথা শুনে। ফালু কোনো কথা বলছে না। ‘ক্যান যাবি না? স্কুলে না গেলে কী করবি তুই? আর তুই ছাড়া কি আমাদের কারো ভালো লাগে? পড়াশুনা না করলে কী করবি তুই?’
ফালু কোনো কথা বলছে না। ‘তোদের সাথে দেখা না হলে আমারো খারাপ লাগে। কিন্তু আমার পড়াশুনা আর ভাল্লাগে না। প্রতিদিন কোনো না কোনো স্যারের বকা শুনতে হয়, বন্ধুদের মাঝে লজ্জা পেতে কার ভালো লাগে? তাই চিন্তা করছি, আববার সাথে দোকানে বসব।’ ফালুর কথা শুনে বেশ খারাপ লাগল আমার। যখন ক্লাস থ্রি থেকে ফোরে উঠি বন্ধুদের অনেকেই আর স্কুলে ভর্তি হয় নাই। থ্রি পর্যন্ত আমি অন্য স্কুলে ছিলাম। সেই স্কুলে থ্রি পর্যন্ত পড়াশুনা হত। যারা ফোরে ভর্তি হয়নি, এদের সবাই এখন কোনো না কোনো কাজ করছে। কিন্তু এতে কী কোনো লাভ হয়েছে। সারাজীবন কষ্ট করে মরতে হবে। ফালুদের জমিজমা কিছু নেই। এই বাড়িটা ছাড়া ওদের একটা কাঁচামালের দোকান আছে। এটা থেকে যা আয় হয়, তাই দিয়ে কষ্ট করে চারজনের সংসার চলে।
তুই ক্লাসের পড়া শিখস না ক্যান? শিখলেই তো আর কোনো ঝামেলা হয় না।’ -আমার কথার কোনো উত্তর দেয় না ফালু। অন্য দিকে আনমনা হয়ে তাকিয়ে আছে। ‘পড়াশুনা একটু ভালোভাবে করলেই তো হয়। না হলে শুধু শুধু আঙ্কেলের টাকা নষ্ট হচ্ছে না। কিছু দিন আগে স্কুল ড্রেস বানাতে হয়েছে, সেজন্য কী টাকা লাগেনি। কত কষ্ট করে আঙ্কেল টাকাটা দেয়, একবার চিন্তা কর। আর তুই পড়া না শিখে সারাদিন ঘুরে বেড়াস।’
‘সেই জন্যই তো চিন্তা করছি, আর টাকা নষ্ট করব না। আববার সাথে দোকানে বসব। তাহলে আববারও সহযোগিতা হবে।’ -ফালু অন্য দিকে তাকিয়েই উত্তর দেয়।
‘দ্যাখ, এটা কোনো সমাধান হইল না। দোকানে তো আর বাড়তি লোকের দরকার নাই। তাহলে দোকানে বসে তুই কী করবি? আচ্ছা বুঝলাম দোকানে বসে আঙ্কেলকে তুই হেল্প করবি। কিন্তু পড়াশুনা বাদ দিবি ক্যান? পড়াশুনা করেও তো দোকানে বসা যায়।’ -আমি বললাম। ‘পড়া শিখে স্কুলে গেলে কারো বাপের ক্ষমতা আছে নাকি, তোকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখবে?’
‘আমার আর পড়ার কোনো ইচ্ছে নাই।’ -ফালুর কথাতেই বুঝা যায় এটা ওর মনের কথা নয়।
‘কিন্তু পড়াশুনা বাদ দিলে তুই বড় হয়ে কী হবি। আঙ্কেলের মতো দোকানের মালিক হবি এইতো। বড় কোনো ব্যবসাও করতে পারবি না। সারা জীবন কষ্ট করে যেতে হবে। সবাই তোকে ঠকাবে, তুই বুঝতেও পারবি না। আন্টি আঙ্কেলকে কষ্ট করতে হবে। এজন্য ভালোভাবে পড়াশুনা করে বড় কোনো চাকরি করতে হবে।’ -আমি কথা বলছি ফালুর দিকে তাকিয়ে। ও কোনো কথা বলছে না। ওর ঠোঁট দুটি কেমন কাঁপছে যেন। চোখের কোনায় পানি টলমল করছে।
তুই কি সব বই কিনেছিস।’ – এখনো ফালু অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। আমার দিকে তাকাতে বলতেই টুপ করে গাল বেয়ে পানি পড়ল। আমি ওর হাত ধরলাম। ‘কীরে কাঁদছিস ক্যান?’ -না ও কোনো উত্তর দিচ্ছে না। শুধু একটু বলল- ‘আমার আর পড়তে ইচ্ছে করে না।’ অনেক বসে থেকে একসময় আমি চলে আসলাম। যতটুকু জানলাম- ওদের দোকানের অবস্থা খুব একটা ভালো না। যা আয় হয়, তা দিয়ে সংসারই চলে না। কিছুদিন আগে ধার করে স্কুল ড্রেস বানিয়ে দিয়েছে। দুইটা বই ছাড়া আর কোনো বই কেনা হয়নি এখনও। যেখানে ঠিক মতো খাওয়াই হয় না, সেখানে বই কেনার প্রশ্নই আসে না। তাইতো বলি- প্রাইমারি স্কুলে তো ও মোটামুটি ভালো ছাত্রই ছিল। নিয়মিত পড়াশুনা করত। এখন সে পড়বেই বা কীভাবে? বই থাকলে তো? হাই স্কুলে তো আর সরকারিভাবে বই দেয় না।
বাসায় যাচ্ছি আর ভাবছি- এই বয়সেই ফালুর কত কষ্ট। ওর মাঝে এত কষ্ট আমরা কখনও বুঝতেই পারিনি। জানতেও চেষ্টা করিনি কোনোদিন। একবেলা খেতে দেরি হলে, পুরো বাড়ি মাথায় তুলে ফেলি আর ফালু প্রায়ই না খেয়ে থাকে। না খেয়েই স্কুলে যায়। তাইতো ওকে কখনও স্কুলে টিফিন বিরতির সময় খুঁজে পাওয়া যায়নি। লজ্জায় হয়তো কারো সামনে থাকতো না। সবাই তো টিফিন নিয়ে আসত। যাই হোক আমার মাথায় কোনো কিছু ঢুকছে না। বাড়ি এসে আম্মুকে সব বললাম। ওর কথা যখন আম্মুকে বলি, আমার চোখ পানিকে আটকে রাখতে পারেনি। আম্মু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আম্মুকে বললাম, কিছু একটা ব্যবস্থা করার জন্য। গোসল করে খেয়ে দেয়ে স্কুলে যাওয়ার সময় আম্মু মনে করিয়ে দিলেন, শাওন ভাইয়ার কথা। বললেন – ‘তোকে তো সব নতুন বই কিনে দেওয়া হয়েছে এবার। ক্লাস সিক্সে শাওনের কাছ থেকে বই এনেছিলি। সেভেনের গুলোও হয় তো আছে। বিকেলে একবার খোঁজ নিস।’ আম্মুর কথা শুনে আমার মুখে যেন একটু হাসি ফুটল। শাওন ভাইয়ার কাছে বই পাওয়া যেতে পারে। এবার তিনি এসএসসি পরীক্ষা দিবেন। বছর বছর উপরের ক্লাসে উঠলেও নিচের ক্লাসের বইগুলো শাওন ভাইয়া কখনও বিক্রি করেন না। রেখে দেন নিজের কাছে।
ক্লাসে আজ কোনোভাবেই মন বসছে না। ভাবছি- সুজন, শাহেদ, রাতু, তনয়কে কি বিষয়টা বলা উচিত হবে। কী মনে করে ওদের আর বললাম না। স্কুল ছুটি হলে আমার একটু কাজ আছে এই বলে চলে আসি। একদিন একটু না খেললেই বা কী।
রাস্তায়ই শাওন ভাইয়ার সাথে দেখা। কোচিং থেকে ফিরছিল। ভাইয়ার কাছে জানতে চাইলাম, ক্লাস সেভেনের বইগুলো আছে কী না।
‘আছে হয় তো। কোনো বই-ই তো আর ফেলে দেওয়া হয় নাই। চলো দেখি যাই।’ -ভাইয়া উত্তর দিলেন।
বাসায় যেতেই ফুফু একটু ঝাড়ি দিলেন। বাসায় কেন আসি না? দিন দিন বড় হচ্ছি আর সবাইকে ভুলে যাচ্ছি ইত্যাদি ইত্যাদি।
পুরাতন পত্রিকা আর বই-টই রাখার জন্য আলাদা একটা কক্ষ আছে বাসায়। শাওন ভাইয়া আর আমি ঢুকলাম সেই কক্ষে। খোঁজাখুঁজি করে সেভেনের বাংলা বইটা ছাড়া সব বই-ই পাওয়া গেল। ময়লায় ঘোলাটে হয়ে গেছে। ঝেড়েটেড়ে পরিষ্কার করে ভাইয়া বইগুলো বেঁধে দিলেন।
‘কী ব্যাপার, ক্লাসের ছয় মাস চলছে এতদিনে বই কেন?’ -ফুফু জানতে চাইলেন।
আমি পুরো ঘটনাটা খুলে বললাম। শাওন ভাইয়া আমাকে বাহবা দিলেন। ফুফুও দোয়া করলেন। আমি বইগুলো নিয়েই ফালুর কাছে রওনা দিলাম। ফালু বাড়িতে নেই। আমি বইগুলো ওর অন্য বইয়ের পাশে রাখলাম। এরপর গেলাম ওদের দোকানে। আমাকে দেখেই ও দোকান থেকে নেমে আসে। তারপর কথা বলতে বলতে ওদের বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকি। ‘দেখ, পৃথিবীর যত বিখ্যাত ব্যক্তি আছে, তাদের সবাই অনেক কষ্ট করেছেন। আমি তোর জন্য এক সেট বই সংগ্রহ করেছি। একটা বই শুধু বাদ আছে। এটাও ম্যানেজ হয়ে যাবে। তুই ভালোভাবে পড়াশুনা কর।’ খুব বেশি কিছু বলতে পারলাম না আমি। কেমন যেন খারাপ লাগছিল। ঘরে এসে বই দেখে ফালু আমাকে জড়িয়ে ধরল। সে কথা দিল – নিয়মিত পড়া শিখে স্কুলে যাবে। পরের দিনই আববুর জন্য নতুন একটা বাংলা বইয়ের ব্যবস্থাও হয়ে গেল।
গত এক সপ্তাহে ফালু একটা ক্লাসও মিস দেয়নি। আরও বড় বিষয়, কোনো পড়া না শিখে সে আসেনি। ক্লাসের সবাই অবাক হলেও আমার খুব ভালো লাগে।

ছয়মাস কীভাবে কেটে গেল কিছুই বুঝলাম না। এরমধ্যে দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা হয়ে গেছে। স্কুলের সবই আবার সেই আগের মতো চলছে। রাতু এখন পুরোপুরি সুস্থ। সামনে বার্ষিক পরীক্ষা। পড়াশোনা নিয়ে সবাই খুবই ব্যস্ত। প্রচন্ড শীত পড়েছে। সারাদিন সূর্যের দেখা পাওয়া যায় না। দিনের বেলায় পর্যন্তত প্রচুর কুয়াশায় ঢাকা থাকে চারপাশ। পাহাড়ি এলাকার কাছে বলেই এত কুয়াশা। স্কুল ছুটির পর বিকেলে লুকোচুরি খেলছি সবাই। একপর্যায়ে চোর হয়েছি আমি। সবাইকে একে একে খুঁজে বের করলেও শাহেদকে খুঁজে পেলাম না। ‘আমি হার মেনেছি’ চিৎকার করে বললেও ও বের হয়ে আসল না। আমরা হন্যে হয়ে খুঁজছি। এদিকে সন্ধ্যাও ঘনিয়ে আসছে। শাহেদের কোনো দেখা নেই। একজন বলল একটু আগে শাহেদ ওদের বাড়ির দিকে গিয়েছে। আমরা ওর বাড়িতে গিয়েও খুঁজলাম। কিন্তু সেখানেও পেলাম না। আমরা ভাবলাম- হয়তো অন্য কোথাও গেছে আবার চলে আসবে। মাগরিবের আযান হওয়ায় আমরা সবাই বাড়ি চলে গেলাম।
রাত আটটা। রাতের খাওয়া শেষ করে দাঁত ব্রাশ করছি। প্রচন্ড কুয়াশা পড়ছে। শীতের কাপড়ে মাথা থেকে একদম পা পর্যন্ত ঢাকা। এমন সময় ফালুকে সঙ্গে করে শাহেদের আম্মু আসলেন। শাহেদ নাকি এখনও বাড়ি যায়নি। আমি শুনে তো অবাক। শাহেদ তাহলে কোথায় গেল! যে সন্ধ্যার পর ভুলেও একা বাইরে বের হয় না, সে এই রাতেও বাড়ি ফিরেনি। এমন তো কোনো দিন হয়নি। আম্মুকে বলে আন্টি আর ফালুর সাথে আমিও বের হই, শাহেদকে খুঁজতে। আশেপাশে পরিচিত সবার বাড়িতেই খোঁজ নেওয়া হল। কেউ শাহেদকে দেখেনি। আন্টি এবার কান্নাকাটি করতে শুরু করলেন। আমি, ফালু, সুজন, রাতু, তনয় সবাই এক জায়গায়। আর বড়রা এক জায়গায়। সবার কথা একটাই- শাহেদ কোনোদিন সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরে না। সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিরে। তাহলে গেল কোথায়? আমাদের আম্মুরা আন্টিকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। কিন্তু এতে কি মায়ের মন শান্ত হয়? আদরের ধন বলে কথা। বড়রা বাইরে বের হয়েছেন শাহেদের খোঁজে। বাজারে গেছেন কেউ কেউ। দুইজন গেল মাইকিং করতে। শাহেদ সাঁতার জানে না। ওদের বাড়ির পেছনে একটা পুকুর রয়েছে। সারা বছর এটাতে পানি থাকে। অনেকে সন্দেহ করছেন হয়তো পুকুরে পড়ে গেছে কি না। কয়েকজন পুকুরের দিকে এগিয়ে গেল। আমরা কী করব কিছু বুঝতে পারছি না। আমাদেরও কান্না পাচ্ছে। বড়রা উঠোনে কত ধরনের কথা বলছে- এটা নিশ্চয়ই ছেলেধরাদের কাজ। আজ দুপুর থেকে রনি নামে তিন বছরের এক পিচ্চিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এই নিয়ে চারটা ছেলে তিন দিনে উধাও হয়ে গেল। পুলিশও কোনো কিছু করতে পারছে না। এবার শাহেদও যদি ছেলেধরাদের কবলে পড়ে তাহলে কি হবে তার। আমরাই বা তাকে ছাড়া খেলব কিভাবে। আর আমাদের এত সুন্দর একটা টিম। ছেলেধরার কথা শুনে আন্টি আরও ভেঙ্গে পড়ছেন। পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছে।
কয়েকদিন থেকেই ছেলেধরাদের কথা শোনা যাচ্ছে। এই ছোট্ট গ্রামেই যদি কয়েকদিনের ব্যবধানে চারটা ছেলে হারায়। এমন হতে থাকলে তো আমাদেরও কবে ধরে নিয়ে যায়। আমরা আর বসে থাকতে পারলাম না। আমরাও বেরিয়ে পড়লাম। শাহেদ গেল কই? আমরা বাজারের দিকে যেতে থাকলাম। রাতু বলল- ‘এক মুর্হূতের জন্যও কেউ আলাদা হব না। সবাইকে একসাথে থাকতে হবে।’
কেউ একজন মাইকিং করছে। স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে ‘একটি হারানো বিজ্ঞপ্তি। আজ বিকেলে উত্তরপাড়া থেকে একটি ছেলে হারানো গিয়েছে। ছেলেটির নাম শাহেদ। তার গায়ের রং ফর্সা, চোখে চশমা রয়েছে। চশমা ছাড়া সন্ধ্যার পর ছেলেটা চোখে দেখতে পারে না। পরনে ছিল কালো রঙের ফুলপ্যান্ট আর ঘি রঙের সোয়েটার। কোনো সহৃদয়বান ব্যক্তি যদি ছেলেটির খোঁজ পান তাহলে………।’
আচ্ছা এটা কী রকম ব্যাপার বলতো? -সুজন বলল।
একসাথে সবাই খেললাম। আর হঠাৎ করেই উধাও হয়ে গেল।- রাতু বলল।
ছেলেধরার কবলে পড়েনি তো আবার।- আমারও সন্দেহ লাগল।
আমাদের ভালো করে খোঁজা দরকার। কেননা ছেলেধরার কবলে পড়লেও মনে হয় বেশি দূরে যেতে পারেনি তারা।- তনয় বলল।
দেখলি না আমরা এদিকে আসার সময় সবাই কত করে সতর্ক করে দিল। -ফালু এবার বের করল তার কথা।
আরে এখন দশটা একসাথে আসলেও নাক ভেঙে হাত পা বেঁধে রাখব না। -সুজন উত্তর দেয়।
এ কথা ঠিক যে সুজন একার সাথে আর দশজন পারবে না। বড়রাও না!
তুই থাকতে আমাদের ভয় কী।- আমি বললাম।
কুয়াশা বাড়তে শুরু করেছে। কুয়াশা নয়, যেন ঝিরঝিরি বৃষ্টি পড়ছে! চারদিকে অন্ধকার। শীতে আমাদের হাত পা কাঁপছে। ঘড়ির কাটা নয়টার ঘরে ছুঁইছুঁই। শীতের কারণে বাজারে লোকজন এমনিতেই কম। দোকানও তেমন একটা খোলা নেই। কেবল চায়ের দোকানগুলোতে দুই একজন গল্প করছে আর চা খাচ্ছে। এদের গল্পের বিষয় হচ্ছে ছেলেধরা। গত কয়েকদিনে চারটা ছেলে উধাও হয়ে গেছে। কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আজ আবার শাহেদ উধাও হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই ছেলেধরার চিন্তাটা মাথায় চলে আসে। আজ দুপুরে রনি নামের এক পিচ্চি হারিয়ে গেছে। কেবল কথা বলতে শিখেছে রনি। বাড়ির উঠোনে বল খেলছিল কয়েকজন। বলটি সড়কের দিকে গেলে বলটি আনতে বাড়ি থেকে বের হয় রনি। এরপরই আর কোনো খবর নেই। নেই তো নেই। কোথাও খোঁজে পাওয়া যায়নি। বড়দের মুখে শুনেছি- ছেলেধরারা নাকি ছোটদের ধরে নিয়ে গিয়ে বিদেশে পাচার করে দেয়। বিনিময়ে প্রচুর টাকা পায় তারা। বিদেশে ছোটদের দিয়ে বিভিন্ন কাজ করানো হয়। যাদের ছেলেমেয়ে নেই, তাদের কাছে অনেক টাকায় বিক্রি করে দেয়। আবার তাদের কিডনি, চোখের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন অঙ্গ নিয়ে অন্যদের শরীরে স্থাপন করে। এজন্যে লাখ লাখ টাকা পায়। হায়রে মানুষ। টাকার জন্য আরেকজনের মায়ের বুক কীভাবে খালি করে। কত খারাপ হলে এরা এসব কাজ করতে পারে। ওরা কী পারবে নিজেদের সন্তানকে পাচার করতে। নিশ্চয়ই পারবে না। দুই বছর আগে ঠিক এই সময়েই আমাদের ঘরের বাইরে বের হওয়া বন্ধ ছিল। বড়রা স্কুলে নিয়ে যেত আবার নিয়ে আসত। এবারও তাই হবে নাকি। তাহলে ছেলেধরাদের কবলেই পড়ল শাহেদ! আমি একটু ভয়ই পেয়ে যাই। তবে সুজন সাথে থাকায় সে ভয়টুকু কেটে যায়। হঠাৎ দূরে আবছা আবছা কাউকে চোখে পড়ে। যে হাতড়ে হাতড়ে এদিকেই এগিয়ে আসছে এবং হোঁচট খেয়ে দু’বার পড়েই গেল।
ঐ তো শাহেদ। -আমি সুজনকে দেখালাম।
আমাদের মুখে হাসি ফুটে উঠল। হয়তো চশমা হারিয়ে ফেলেছে। তাই পথ চিনতে পারছে না। দিনের বেলায় চশমা ছাড়া দেখতে পায় না। রাতের বেলায় দেখবে কেমনে। এতদূর থেকে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। আমরা দৌড়ে কাছে গেলাম। কিন্তু আমাদের মুখটা আবার আগের মতো হয়ে গেল। এ আমাদের শাহেদ না। পাশের গ্রামের একজন অন্ধ ব্যক্তি। তিনি এভাবেই চলাফেরা করেন।
আমরা বাজার এবং এর আশেপাশে ঘুরলাম। সন্দেহজনক কিছু পাওয়া যায় কি না। কিন্তু কোনো কিছু না পেয়ে বাড়ির দিকেই ফিরছি। লোকজন, রিকশা তেমন একটা নেই। শীতের পরিমাণটা বেড়েই চলছে। আমাদের মাথার চুল ভিজে যায় যায় অবস্থা।
আচ্ছা শাহেদকে আবার পরী ধরে নিয়ে যায়নি তো! -ফালুর কথা শুনে মেজাজ আমাদের গরম হয়ে গেল। কিন্তু মেজাজ গরম করলে তো চলবে না।
দেখ এখন ফাজলামো করার সময় না। -রাতু ফালুর উদ্দেশ্যে বলল।
ফালু তুই আর একটা কথা বলবি তো খবর আছে। -সুজনের মেজাজ গরম হয়েছে, ওর কথায় বুঝা যায়।
বারে কতজনের মুখেই তো শুনি, সুন্দর ছেলেদের পরীরা নিয়ে যায় ওদের রাজ্যে। অবশ্য পরী নিয়ে গেলে চিন্তা নাই, আবার তো ফিরে আসবেই। -ফালুর কথায় সুজন এবার ওকে ধরে পিঠে একটা বসিয়ে দিল।
এমন সময় ‘আমি আম্মুর কাছে যামু’ ‘আম্মুর কাছে যামু’ চিকন একটা কণ্ঠ ভেসে এল। ওদিকে তাকালে তেমন কিছু চোখে পড়ল না। কুয়াশায় কিছু দেখা যাচ্ছে না। শুধু সাদা আর সাদা। একটু দূরেই আবছা আবছা কী যেন দেখা যাচ্ছে। মানুষের ছায়া বলেই মনে হলো। বড় মানুষের ছায়া কিন্তু কথা ভেসে আসল তো পিচ্চি কারো।
ফালু আস্তে আস্তে সামনে এগিয়ে গেল। আমরা রাস্তার একপাশেই দাঁড়িয়ে থাকলাম। মিনিট কয়েক পরেই ফালু এসে জানাল, একটা লোক রনিকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সম্ভবত কোনো রিক্সা খুঁজছে। কিংবা কারো জন্য অপেক্ষা করছে। রনি তো কান্নাকাটি করছে আম্মুর কাছে যাবে বলে। ‘আমি নিশ্চিত এই রনি। দক্ষিণপাড়া থেকে যে ছেলেটা হারিয়ে গেছে, সে। হাবিবের ছোট ভাই। নিশ্চয়ই ছেলেধরা। এই লোককে কোনোদিন দেখিনি। একটা মহিলাও আছে সাথে। আমার দেখা কখনও ভুল হতে পারে না।’ আমাদের সন্দেহটা এবার পরিষ্কার হয়ে যায়। লোকটি একটু একটু করে হেঁটে এদিকেই আসছে। আমরা চুপচাপ, কোনো কথা বলছি না।
ঘরে বসে থাকার ছেলে ফালু না। সারাদিন টইটই করে ঘুরে বেড়ায়। এলাকার এমন কেউ নেই তাকে না চেনে। কিংবা সে চেনে না। এছাড়া ফালুদের মুদির দোকান রয়েছে। মাঝে মাঝেই ও দোকানে বসে। এজন্যও অনেকের সাথেই ওর পরিচয় হয়। এতক্ষণে লোকটি আমাদের কাছে চলে এসেছে। কিন্তু হাঁটছে অনেক ধীরে ধীরে। মনে হয় রিকশা খুঁজছে। আর আস্তে হাঁটার কারণটা মনে হয়, বাজারের কাছাকাছি তো কেউ আবার দেখে ফেলে এই ভয়ে হয়তো। আমরা সড়ক থেকে নিচের ক্ষেতে নেমে পড়ি। ঠিক তখনই একটা ট্রাক সামনে দিয়ে চলে গেল। ট্রাকের লাইটের আলোয় ফালু এবার নিশ্চিত হল- এই দক্ষিণপাড়ার রনি। সে চিৎকার করতে যাবে এমন সময় রাতু ওর মুখ চেপে ধরল। আমাদের সামনে দিয়েই লোকটি হেঁটে যাচ্ছে। পেছন পেছন আরেকজন মহিলা হাঁটছে। রনি একটু পরপরই বলছে, ‘আমি আম্মুর কাছে যামু’। লোকটি বলছে, ‘হ্যাঁ বাবু তোমার আম্মুর কাছেই নিয়ে যাব।’
হঠাৎ একটি রিকশা আসছে দেখে লোকটি দাঁড়াল। রিকশায় উঠেই বলল- খামারপাড়া চলেন। রনি কান্নাকাটি করছে শুনে রিকশাঅলা বলল- ‘ওর মাও কই।’
ওই তো আসছে। -লোকটি দেখিয়ে দিল পেছনে থাকা মহিলাটিকে।
রিকশাঅলা এবার রিকশা চালাতে শুরু করলেন।
‘দেখছস, শালায় কত চালাক।’ -রাতু বলল।
বুদ্ধি আছে মাথায়। – তনয় বলল।
আমি সুজনকে বললাম- শোন, তুই এক কাজ কর। আস্তে আস্তে উপরে উঠে যা এবং রিকশাঅলাকে বলে লোকটিকে আটকে রাখ। পালাতে চাইলে জাপটে ধরবি। আমরাও আসছি।
কিন্তু আগেই কোনো চিৎকার করবি না। তাহলে আবার অন্ধকারে পালিয়ে যেতে পারে। -ফালু বলল।
রিক্সা বেশ কিছুটা এগিয়ে গেছে। আমরা সবাই সড়কের উপরে। সুজনকে বাধা দিয়ে তনয় বলল- আরে দাঁড়া, এখন এদের ধরলে তো অন্যরা পালিয়ে যেতে পারে। তখন আমরা হয়তো শাহেদকে পাব না। তাই ওদের ঘাঁটি যেখানে, সেখানে যেতে হবে।’
কিন্তু রিক্সা তো চলে যাচ্ছে। একটা বুদ্ধি পেয়েছি। তোরা আয় আমি রিক্সার পেছনে পেছনে যাচ্ছি। তোরা দেখ আলাদা রিক্সা পাস কি না।- সুজন বলেই দৌড় দিয়ে রিক্সার পেছনে গিয়ে বসে পড়ল। স্কুল থেকে আসার পথে এরকম কত রিক্সার পেছনে উঠেছি। রিক্সাঅলা টেরই পায়নি।
আমরাও হাঁটছি দ্রুত। কিন্তু কোনো রিকশাও আসছে না। বাজারের কাছে আসতেই একটা রিক্সা পেলাম। কিন্তু রিক্সাঅলা যেতে রাজি হচ্ছে না। রাত হয়েছে তাই সে বাড়ির দিকে যাচ্ছে। অনেক বলে কয়ে রাজি করাই। তিনজন উঠে পড়ি। একটু তাড়াতাড়ি খামারপাড়ার দিকে যেতে বললাম রিক্সাঅলাকে। বাজার থেকে বেশ খানিকটা দূরে খামারপাড়া। কিছুদূর যাওয়ার পরই রিক্সার নিচে যে বাতি থাকে তা একটু একটু দেখতে পেলাম আমরা। এবার আস্তে চালাতে বললাম রিক্সাঅলাকে। বাজারের পর হাইস্কুল, তারপর উপজেলা পরিষদ ছাড়িয়ে মেইন রাস্তা থেকে অন্য রাস্তা দিয়ে খামারপাড়ায় ঢুকে গেছে রিক্সা। সামনের রিক্সাটা যেখানে থামল, সেখানে পুরনো একটা ভাঙা বাড়ি রয়েছে। এখানে কেউ থাকে না বলেই শুনেছি। অনেক পুরনো এই দালান-বাড়ির পেছনে বিশাল এলাকা জুড়ে বেশ ঘন গাছপালা। এত ঘন যে, দিনের বেলায় ঘুটঘুটে অন্ধকার থাকে। সন্ধ্যার পর কেউ এদিক দিয়ে চলাচল করে না। এই জঙ্গল আর পুরনো বাড়িটাকে নিয়ে নানান কেচ্ছা কাহিনী শোনা যায়। কত গল্প যে শুনেছি তার হিসেব নেই। সবই রূপকথার গল্পের মতো। এখানে ভুত থাকে! কেউ একা একা এসেছে তো খবর আছে। জীবন নিয়ে আর ফিরতে পারবে না। কিছু না কিছু দেখে ভয় পাবেই, যদি বাড়ি পৌঁছতে পারে তাহলে পরদিন থেকেই আবার জ্বর এসে যাবে। বাড়িটার বিপরীত দিকে মানে রাস্তার অন্য পাশে বিশাল এক বটগাছ রয়েছে। এই বটগাছকে নিয়েও কত কাহিনী। রাতের বেলায় কখনও এদিকে আসি আমরা কেউ। আসার প্রয়োজনই হয়নি। একদিন দিনের বেলায় এখানে টিয়া পাখির বাচ্চা পাড়তে এসেছিলাম। একদম নিশ্চুপ এলাকা। গায়ে লোমগুলো দাঁড়িয়ে যায়। গা ছমছম করে উঠে।
সামনের রিকশা থেকে বেশ দূরেই আমরা নেমে পড়লাম। রিকশাঅলাকে বিদায় করে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। ভাবছি, এখন শাহেদ থাকলে তো ভয়েই মারা যেত! ঠান্ডার মাত্রা এবার আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। হঠাৎ কে যেন এদিকে আসছে জঙ্গলের দিক থেকে। ছায়ার মতো কি একটা আসছে দেখে আমাদের ভয়টা আরও বেড়ে যায়। ফালু পড়ে থাকা একটা বাঁশ তুলে নেয়, ‘আরে ভয়ের কিছু নেই’। ভুত-পেত্নীতে ফালুর কোনো বিশ্বাস নেই। আমাদেরও নেই। তারপরও ভয় লাগছে। শুনেছি- বড়রাই এখানে এসে কত বিপদে পড়েছে। হাতি, ঘোড়া, নতুন বউ কতকিছু দেখেছে। ছায়াটি আরও কাছে আসাতে আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় এটি ভুত নয়, সুজন। সে রিক্সা থেকে নেমে কিছুক্ষণ ঘাপটি মেরে বসেছিল। কি হচ্ছে দেখেই ছুটে এসেছে। সুজন এসে যা বলল তা হচ্ছে- এরা পাচারকারী দলের সদস্য, তা নিশ্চিত। রিক্সায় তেমন কোনো কথা বলেনি। মনে হয় রিক্সাওয়ালার সন্দেহ হতে পারে এজন্যই কথা কম বলেছে। তবে আস্তে আস্তে যতটুকু বলেছে, তাতে বোঝা গেছে এরা শিশু পাচারকারী। বেশ কয়েকজনকে তারা ধরে এনেছে।
কিন্তু এই জঙ্গলের মধ্যে কেন?’ আমি জিজ্ঞাসা করি।
এখানে কেউ আসে না। নিরাপদ জায়গা হিসেবে তারা এটা বেছে নিয়েছে মনে হয়।’ -রাতু বেশ বিজ্ঞের মতো কথাগুলো বলল।
ওরা ভেতরে ঢুকে পড়েছে। আমাদেরও ঢুকতে হবে। দেরি করলে আবার খুঁজে পেতে কষ্ট হবে। -সুজন বলল।
তাড়াতাড়ি চল তাহলে – তনয় আর ফালুও সুর মেলাল সুজনের কথায়।

এই জায়গাটা তুলনামূলকভাবে বেশি ঠান্ডা। এমনিতেই একটা ভয় কাজ করছে। তবে পাচারকারী একটা দলকে আমরা ধরতে যাচ্ছি, একটা বড় রহস্য উদঘাটনে যাচ্ছি -এই কারণে ভয়-ঠান্ডা অনুভব আবার অনেকটাই কমে গেছে। নেই বললেই চলে। সুজন আগে আগে আমরা তার পেছনে। চারপাশে অন্ধকার। আমরা রীতিমতো হাতড়ে হাতড়ে এগুতে লাগলাম। খুব সাবধানে পা ফেলছি। আমরা ভাঙা বাড়িটায় ঢুকে পড়লাম। পাশাপাশি অনেকগুলো কক্ষ। পুরনো এই বাড়িটার ইটগুলো অনেক জায়গায় খসে পড়েছে। ভেতরে ময়লা-বালু পায়ে আটকাল। হাঁটতে গিয়ে মাকড়শার জাল মুখে এসে পড়ল। অন্ধকারে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু এই কক্ষ থেকে দুই পাশের দুটো কক্ষে যাওয়া যায়। ভেতর দিকে যাওয়ার জন্য একটাই দরজা। তাতে তালা লাগানো। হঠাৎ আমার পাশে একটু আলো জ্বেলে উঠল। চমকে গিয়ে দেখি- রাতুর হাতে টর্চ লাইট। কিন্তু টর্চটা এত ছোট যে, আলো নেই বললেই চলে। নাই মামার থেকে কানা মামা ভালো! তাই এটা দিয়েই আমরা কোনো রকম কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। আশেপাশে কেউ আছে বলে মনে হচ্ছে না। তিনটি কক্ষই নোংরা হয়ে আছে। তবে মাঝেরটায় দিয়ে যে কেউ যাতায়াত করে, তা কিছুটা বোঝা যায়। যাওয়া আসার জন্য দরজা বরাবর যেন ছোট রাস্তাই হয়ে গেছে। কিন্তু দরজায় ঢাউস একটা তালা লাগানো। এবার ফালু আবিষ্কার করল- একটা ভাঙা জানালা, যার লোহার শিকগুলো ভেঙে গেছে অনেক আগেই। কিন্তু এটা দিয়ে ভেতরে যাওয়ার মতো সাহস হচ্ছে না। ভেতরটা অনেক নিচু মনে হচ্ছে। আবার অন্ধকারটা আরও বেশি। প্রথমে সুজনই নামল। ওরে বাবা! তার মাথার চেয়েও উঁচুতে জানালাটা। একে একে আমরা সবাই নামলাম। এটাও একটা কক্ষ। কিন্তু এর ভেতরে কোনো জানালা নেই। দরজাটাও বাইরে থেকে আটকানো। এবার আরেক বিপদে পড়লাম। এত নিচু হওয়ায় জানালা দিয়ে আর বের হওয়ায় সম্ভব নয়।
সুজন দরজা ধরে ধাক্কাতে লাগল। রাতু সুজনকে টেনে ধরল ‘আরে এখন কোনো শব্দ হলে তো টের পেয়ে যাবে।’ কী করা যায় চিন্তায় পড়ে যাই। ঠিক তখনই কারো কথা ভেসে আসে কানে। দরজা খোলার শব্দ হল। আমরা একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে যাই। দরজা খুলে দুইজন লোক ঢুকে পড়ে। আবার দরজার সামান্য একটু ভাঙা জায়গা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে দরজায় তালা দিয়ে দিল। ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল। সড়ক থেকে ঘরের দিকে তাকালে যেন কেউ বুঝতে না পারে যে, ঘরে কেউ যাতায়াত করে। এজন্যই বাইরে সব সময় তালা দেওয়া থাকে। ঠিক একইভাবে ভেতর থেকে পেছনের দরজার ভাঙা অংশ দিয়ে হাত দিয়ে দরজা খোলে বাইরে বের হয়ে গেল মুহূর্তেই। দেখতে দেখতে অন্ধকারে মিশে গেল। এবার আমরা নিশ্চিত হলাম যে, এরা এখানেই রয়েছে এবং ওদের ঘাঁটিটা এখানেই গড়েছে।
এখন কী করা যায়?’ রাতু ফিসফিস করে বলল। নিঝুম রাতে কোথাও কোনো শব্দ নেই। আস্তে কথা বললেও মনে হচ্ছে জোরে বলছি।
কিছু করার নেই। জানালা দিয়ে আগে বাইরে বের হতে হবে।’ ফালু আমাদের উদ্ধার করল।
কিন্তু ঘরের মেঝে জানালা থেকে বেশ নিচুতে। জানালায় উঠতে সুজন আমাদের সাহায্য করল। বলা যায় কোলে তুলেই জানালায় উঠাল আমাদের। তারপর সে নিজেও বের হয়ে এল।
আমরা জঙ্গলের ভেতরে ঢুকছি গাছপালার ফাঁক গলে। গাছের গায়ে লেগে থাকা শিশিরে আমাদের কাপড় প্রায় ভিজে গেছে। আর হাত-পায়ে একটু লাগলেই আঁচ করা যায় কতটা ঠান্ডা হতে পারে শিশির। ‘বাপরে কী ঠান্ডা!’ বলল তনয়। নিশ্চয়ই এত শীতের পাল্লায় কখনও পড়েনি সে।
‘শীতের মধ্যে গরম লাগবে নাকি?’ ফালু উত্তর দিল।
আমরা অন্ধকারে এগিয়ে যাচ্ছি সাবধানে। অবশ্য এখানটায় কুয়াশা বাইরে থেকে একটু কম। বিশাল বিশাল গাছ আর তার ডালপালা। এ জন্যই মনে হয় কুয়াশা কম। তারপরেও অন্ধকারে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। আমরা যাচ্ছি তো যাচ্ছি। মনের ভেতর অন্যরকম উত্তেজনা কাজ করছে। বেশ কিছু দূর গিয়ে আমরা একটা দেওয়ালের সাথে ধাক্কা খাই। বুঝতে পারি, আমরা অন্ধকারে জঙ্গলের অন্যপ্রান্তে চলে এসেছি। এই প্রান্তে বেশ কিছু বাড়ি ঘর আছে। অনেকেই থাকে। গাছপালাও কিছুটা কম। এটা নিশ্চয় ঝিনুকদের বাড়ি। আমরা ওদের বাড়ির দেওয়াল ধরে এগুতে থাকি। ওদের বাড়ির সামনের রাস্তাটা চলে গেছে মেইন রাস্তায়। খুব বেশি দূরে নয়। রাস্তার ঐ পাশে পুরোটাই আবাসিক এলাকা। কিছুদূর এগিয়ে আমরা আবার জঙ্গলের ভেতরে যেতে থাকি। বেশ কিছুক্ষণ হাঁটতেই ফালুর সজাগ দৃষ্টি আমাদের থামিয়ে দিল ‘ঐ দেখ কিসের একটা আলো দেখা যাচ্ছে।’ ফালুর কথায় আমরা ওর আঙুল বরাবর তাকাই। ডিবডিব করে হালকা একটা আলো ভাসছে। হঠাৎ আবার আলোটা নেই হয়ে যায়। আমরা সাবধানে এগুতে থাকি আলোটা কোথায় হারাল? আর একটু আসতেই আবার আলোটা দেখা গেল। এবং খুব সামনেই। একটা ঘর। বাঁশের বেড়া দিয়ে তৈরি ঘরটায় বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলছে। বেড়ার ফাঁক দিয়ে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে- ভেতরে দুইজন মহিলা আর তিনজন পুরুষ রাতের খাবার খাচ্ছে।
‘পোলাপাইন নিয়া এক জায়গায় বেশিদিন থাকা ঠিক না।’ -মুখে ভাত পুরেই গোঁফঅলা লোকটা বলল।
‘তাতো ঠিক কিন্তু কাদের, বস আসা ছাড়া তো এদের নেওয়া সম্ভব নয়।’ -গাট্টাগাট্টা নেতা গোছের মহিলাটি উত্তর দিল। বোঝা গেল গোঁফঅলা লোকটার নাম কাদের। ‘আপা বসরে কন কালকেই আইতে, কারণ যদি কেউ টের পায় তাইলে খবর আছে।’ আরেকটি কণ্ঠস্বর শোনা গেল।
‘আল্লাহরে, আমার সাথে আয়!’ ফালু কানে কানে বলেই টানতে লাগল। ওর পিছু পিছু যাই। পাশেই আরেকটা ঘর। ফালু জানাল, ভেতরে ন্যাদান্যাদা সব বাচ্চা। আমরা যখন কথা শুনছিলাম তখন সে দেখে এসেছে। দেখে আমাদেরও চক্ষু চড়ক গাছ। কারো চোখ ঠিক জায়গায় নেই, কপালে উঠে গেছে! ঘরের ভেতরে শুধু রনিই নয় আরও চারটি বাচ্চা ঘুমাচ্ছে। এসব বাচ্চা দিয়ে এরা করবে কী? মানুষ কতটা খারাপ হলে এই কাজ করতে পারে। কিন্তু কোথাও শাহেদকে দেখতে পেলাম না। অন্য কোথাও লুকিয়ে রেখেছে মনে হয়।
শাহেদকে তো দেখছি না।’ সুজন বলল।
দেখছিস না, এরা সব পিচ্চি। মনে হয় বড়গুলারে অন্য জায়গায় লুকায়ে রাখছে।’ আমি বললাম।
শোন, আমাদের এখন খুব সাবধানে কাজ করতে হবে। কোনোভাবেই ওদের বুঝতে দেওয়া যাবে না।’ রাতু আমাদের আস্তে আস্তে জানাল। আমরা আবার আগের ঘরটার কাছে এসে কান খাড়া করলাম।
‘সাতটা তো জোগাড় করার কথা।’ -নেতা গোছের মহিলাটি বলল।
‘আপা, মনে হয় আর পারা যাইব না। পুরা এলাকায় তোলপাড় হইয়্যা গেছে।’ -কাদের বলল।
‘আজকেও মাইকিং করতে শুনলাম। পরে আবার ধরা খাইতে হইব।’ -বলল শাড়ি পড়া মহিলাটি।
কিন্তু বস্ যদি রাইগ্যা যায়।’ -নেতা নেতা ভাবের মহিলাটি উত্তর দিল।
এমন সময় তার মোবাইলটি বেজে উঠল।
‘হ্যালো, স্থালেমালেকুম বস। কেমন আছেন?’
আমাদের কোনো সমস্যা হয় নাই। তবে এখানে বেশিদিন থাকা ঠিক হচ্ছে না।
এলাকার অবস্থা খুব খারাপ। অপরিচিত কাউকে দেখলেই সন্দেহ শুরু করে।
না স্যার, পাঁচটা বাচ্চা জোগাড় হয়েছে।
আপনি যদি একটু তাড়াতাড়ি করেন।
তাইলে আজকেই চলে আসেন। খালি খালি রিস্ক বাড়াইয়া লাভ নাই।
ওকে স্যার।
আমরা শুধু একজনের কথাই শুনলাম। অপর প্রান্তের কথা কিছুই শোনা গেল না। তবে এতটুকু বোঝা গেল যে, আজকেই এদের নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাবে। ওদের বস আসছেন। তার মানে যা করার খুব দ্রুত করতে হবে।
‘আব্দুল যা বসের জন্য খাবার রেডি কর। বসের আসতে বেশিক্ষণ লাগবে না।’ নেতাগোছের মহিলাটির কণ্ঠ আবারও ভেসে এল।
বাজারে যেতে হবে খাবার আনতে।’ আব্দুল উত্তর দিল।
তাড়াতাড়ি যা, হোটেল আবার বন্ধ হয়ে যাবে।’ নেতাগোছের মহিলার কণ্ঠস্বর।
আব্দুল ঘর থেকে বের হয়ে গেল। অন্যরা আবার নানান কথায় ডুবে গেল। মাঝে মাঝে হাসির শব্দ ভেসে আসছে।
যাও একটু আলো ছিল। এবার তাও শেষ। বিদ্যুৎ চলে গেল। নিমিষেই সবকিছুই যেন কুচকুচে কালো হয়ে গেল। শয়তানগুলো অনেক দিন থেকেই আছে বলে মনে হয়। কিছুদিন পর পর লোক পরিবর্তন হয়ে আসে। কিডন্যাপ করে তারপর অন্য এলাকায় চলে যায়। সড়কের সাথে যে ঘরে আমরা ঢুকেছিলাম ঘর থেকে এই ঘর দুটো বেশ দূরে। আবার এখান থেকে ঝিনুকদের বাড়িও দূরে। চারপাশে ঘন জঙ্গল। এখানে নাকি ভূত থাকে। দুষ্টু ভূতগুলো আজকে হাতি, কালকে ঘোড়া, পরশু বউ হয়ে কারো কারো সামনে আসে। অবশ্য সবার সামনে আসে না। গভীর রাতে যারা সড়ক দিয়ে গেছে তাদের সামনেই নাকি বেশি আসে। কিংবা ঝিনুকদের বাসায় কেউ বেড়াতে এসে রাতের বেলায় উঠোনে বের হলেই নাকি দেখেছে অনেকে। তবে আজকে আমাদের মাঝে কোনো ভয়ই নেই। এতক্ষণ তো এসব কথা মনেই ছিল না। এখন অবশ্য একটু একটু ভয় লাগছে। আবার এসব কথা যে পুরোটাই মিথ্যা, সেটাও প্রমাণ হতে চলেছে। আমরা তো কতক্ষণ যাবৎ জঙ্গলের ভেতরে আছি। কই ভূতের পুতও তো দেখলাম না। আর যদি ভূত থাকতই, তাহলে ওরা নিশ্চয়ই এখানে আস্ত্বানা তৈরি করত না।
আমরা ঘরগুলো থেকে একটু সরে এসেছি। কী করা যায়-তাই ভাবছি। ‘আমাদের যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে।’ রাতু বলল।
‘এদের ধরতে না পারলে আমরা বাচ্চাদের তো উদ্ধার করতে পারবই না। শাহেদকেও পাব না।’ বলল ফালু।
‘আস্তে কথা বল।’ আমি ফিসফিসিয়ে বললাম।
‘পুলিশকে খবর দিতে হবে।’ সুজন বলল।
‘কিন্তু এই রাতের বেলায় আমরা কেউ গেলে কি পুলিশ আমাদের কথা বিশ্বাস করবে। উল্টো থানায় আটকে রাখবে। বাসায় খবর দিবে।’ -তনয় বলল।
তাহলে তো ভালোই হবে। বড়রা আসলে নিশ্চয়ই আমাদের কথা বিশ্বাস করবে এবং তখন পুলিশও আসবে।’ সুজন বলল।
তোর মাথা হবে। ততক্ষণে সবকটা চম্পট দেবে।’ আমি বললাম।
তারচেয়ে থানায় না গিয়ে বাসায় গিয়েই আগে খবরটা দিতে হবে। বড়দের সাথে নিয়ে থানায় গেলে সময় বেশি নষ্ট হবে না।’ তনয় বলল। কিন্তু বাসায় কে যাবে? একা একা যেতে হবে ভেবে ভয়টা সবার মধ্যেই যেন ঢুকে গেল।
‘আমি যাই।’ সুজন বলল।
‘না, তুই যাস না। বরং আমি যাই। তোর গায়ে অনেক শক্তি, কেউ বিপদে পড়লে তুই উদ্ধার করতে পারবি। তুই থাক আমি যাই।- বললাম আমি।
ঠিকই তো, এখানে তো পাচঁজন। ওরা আরো বেশিও থাকতে পারে।’ ফালু বলল।
আর হ্যাঁ, এখন আমাদের জোটবদ্ধ থাকতে হবে। আর একা একা কিছু করা যাবে না। মাথায় কিছু আসলে সবার সাথে পরামর্শ করতে হবে।’ রাতু বলল। ‘খুবই সাবধান থাকতে হবে। কোনোভাবেই ভুল করা যাবে না।’
এমন সময় চিৎকার ভেসে এল ‘ঐ ক্যাডা কথা কয় রে?’ আমরা হকচকিয়ে গেলাম। কথা বলতে বলতে কখন যে জোরে কথা বলতে শুরু করেছি। খেয়ালই করিনি।
ওইখানে কে?’ আবারো শোনা গেল। এবং হারিক্যান হাতে এদিকে এগিয়ে আসতে লাগল। আমরা তাড়াতাড়ি ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে পড়লাম। ফালু গাছের উপরে উঠে গেল। সুজন উঠল আরেক গাছে। আমি, তনয় আর রাতু নিচে ঝোঁপের পাশে চুপটি করে বসে পড়লাম। ঠিক যেখানে দাঁড়িয়ে কথা বলেছি, সে জায়গায় কাদের আর শাড়ি পড়া মহিলাটি এসে দাঁড়াল। হারিক্যান হাতে তারা এদিক-ওদিকে তাকাচ্ছে। ‘হাসি, তুই শুনছস না এখানে কেউ কথা কইতাছিল।’ কাদের বলল মহিলাটির উদ্দেশ্যে।
হ, শুনলামই তো।’ উত্তর দিল হাসি নামের মেয়েটি। যেমন নাম তেমন তার চেহারা। কেউ নাম জেনে চেহারা দেখলে না হেসে পারবে না।
গেল কই তাইলে।’ কাদের বলল।
হারিক্যান হাতে তারা আমাদের খুঁজতে লাগল। এমন সময় ধপ করে হারিক্যান নিভে গেল। হঠাৎ হারিক্যান নিভে যাওয়ায় মনে হয় ভয়ই পেয়ে গেল।
কিসের পানি পড়ল রে?’ কাদের প্রশ্ন করল হাসিকে।
পানির আবার কেমুন একটা গন্ধ গন্ধ।’ হাসি উত্তর দিল।
উপরে তাকাতেই ওয়াক ওয়াক করে উঠল কাদের ‘কি পঁচা গন্ধরে। আর ঠান্ডায় গরম পানি পড়ে কোন থ্যাইক্যা।’ চোখে মুখে পানি পড়েছে এবার। হঠাৎ গাছের ডাল থেকে হিঁ হিঁ করে হাসির শব্দ শোনা গেল ‘আঁমারেঁ চিঁনলিঁ নাঁরে কাঁদেইরাঁ?’ নাকি সুরে বলল ফালু। পানির বিষয়টা এবার পরিষ্কার হয়ে গেল আমাদের কাছে। গাছ থেকে নিশ্চয়ই ফালু হিসু করে দিয়েছে। হাসি নামের মেয়েটা ভয়ে কাদেরকে জড়িয়ে ধরেছে।
‘কে কে…?’ কাদেরও একটু ভয় পেয়ে যায়। তার নিজের নামই বা জানল কি করে।
‘কঁত uঁদন ধঁরে এঁই জাঁয়গাঁয় অাঁমি অাঁছি, অাঁর তুঁই অাঁমারেঁ চিঁনলি নাঁ। আঁজকে ভাঁলো কঁইর‌্যা চিঁনায়ে দিঁমু।’ ফালু আবার নাকি সুরে বলল।
‘ভু-উ-উ-উ-ত’ বলে একটা চিৎকার দিয়েই হাসি নামের মহিলাটি অজ্ঞান হয়ে গেল। কাদেরও কাঁপতে লাগল।
‘কঁতদিঁন ধঁরে মাঁনুষ টাঁনুষ কিঁছু খাঁইনাঁ।’ আমিও নাকি সুরে যোগ করলাম। এবার কাদের ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। এমন সময় নেতাগোছের মহিলা আর আরও একজন আসতে লাগল টর্চ হাতে। রাতু টর্চকে লক্ষ্য করে একটা ঢিল ছুড়ল। লাইটের সামনের অংশে লেগে ভেঙে গেল।
‘ঐ ঢিল মারল কেরে? কী রে কাদের কার সাথে কথা কস? স্বপন দেখ তো কে?’ নেতাগোছের মহিলাটি জিজ্ঞেস করল।
‘তোঁর বাঁপ। তোঁর বাঁপের সাঁথে কঁথা কঁয়।’ নাকি সুরে যোগ দিল সুজনও।
তোঁদের বাঁপকেঁও তোঁরা চিঁনিস নাঁ।’ রাতুও যোগ দিল।
‘তোঁদের তোঁ দেঁখি পঁয়দা করাঁই ভুঁল হঁইছে।’ ফালু নাকি সুরে বলেই আরও জোরে জোরে হিহি করে হাসতে লাগল।
নেতা নেতা ভাবটা মনে হয় চলেই গেছে। ভয়ে সে কথা বলছে না। কাদের বলল ‘আমারে মাফ কইর‌্যা দেন। আমার কোনো দোষ নাই।’
অাঁজকে তোঁদের সঁব কয়ঁটার ঘাঁড় মঁটকাঁবো।’ তনয়ের এই কথায় আরও ভয় পেল তারা। কেননা কয়েক জায়গা থেকে কথা ভেসে আসছে বার বার। একবার গাছের নিচে আবার গাছের উপরে, আরেক গাছ থেকে কথা আসছে। আবার হাসির শব্দ আর কথা দুটোই একসাথে হচ্ছে। ভূত ছাড়া আর কার পক্ষেই বা এটা সম্ভব! কাদেরের দৌড়ানোর শক্তি আরও আগেই শেষ হয়েছে। ওরা দৌড়ে ঘরের দিকে যাবে ঠিক সে সময়ই সুজন গাছ থেকে লাফ দিয়ে নিচে নামল। একদম কাদেরের ঘাড়ে। ‘বাবাগো’ বলে কাদের চিৎকার দিয়ে উঠল। নেতাগোছের মহিলা ও স্বপন দৌড় দিল ঘরের দিকে। ততক্ষণে সুজন কাদেরকে চেপে ধরে আছে। আমি, তনয় আর রাতু ধরেছি স্বপনকে। গায়ে কী শক্তি! আমাদের অনেক কষ্ট হচ্ছে ওকে আটকাতে। আর নেতাগোছের মহিলাটি ঘরের ভেতর ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। হাসি নামের মেয়েটা তো জ্ঞান হারিয়ে পড়েই আছে। আশেপাশে কিছু খুঁজে পাওয়া যায় কি না- চোখ রাখছি। চারপাশে অন্ধকার হলেও আমাদের চোখে কিছুটা সয়ে এসেছে তা। ফালু কোথা থেকে একটা দড়ি এনে স্বপনের হাত বাঁধতে লাগল। কিন্তু খুব ছোট দড়ি (রশি) হওয়ায় দুইজনের হাত দুইটা বাঁধা গেল শুধু। এর মধ্যে হাসি নামের মেয়েটা জ্ঞান ফিরেই চিৎকার করতে লাগল। কিন্তু ফালু তাকেও বাঁধতে শুরু করেছে। এ কী! ফালুর প্যান্ট গেল কোথায়? ওর পরনে তো ফুলপ্যান্ট ছিল। সেদিকে ওর কোনো নজরই নেই। কাছে যেতেই পরিষ্কার হয় বিষয়টা। বাঁধার মতো কোনো কিছু না পেয়ে ফালু ওর নিজের প্যান্ট খুলে ফেলেছে! সেই প্যান্ট দিয়েই হাসিকে বেঁধে ফেলেছে। অবশ্য ওর পরনে যে কিছুই নেই তা নয়। কিন্তু এই শীতের মধ্যে তা কষ্টসাধ্য। হাফপ্যান্ট পরনে থাকলেও তাকে দেখে বুঝার কোনো উপায় নেই যে, তার শীত লাগছে। ফালু বলল, ‘আরে কিছু পরনে থাকলেই কি আর না থাকলেই কি। আন্ধারে তো কেউ কিছু খুঁজে দেখতে যাবে না।’ ওর কান্ড দেখে হাসতে হাসতে মরার মতো অবস্থা।
হঠাৎ রাতুর পেছনে কাউকে দেখতে পায়। রাতুর মাথায় কেউ কিছু একটা ধরে আছে। আরও একজন দাঁড়িয়ে। মহিলা কণ্ঠ হুংকার ছাড়ল, ‘সব একদম চুপচাপ। একটু নড়লেই গুলি করে দিব।’ পাশের জনের হাতে থাকা চার্জার বাতি জ্বালাতেই সব পরিষ্কার হয়ে গেল। রাতুর মাথায় ছোট একটা পিস্তল ধরে দাঁড়িয়ে হুংকার ছেড়েছে সেই নেতাগোছের মহিলাটি। আর পাশে আব্দুল চার্জার হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
‘আব্দুল ওদের হাত খুলে দে। আর সব কয়টারে বাইন্ধা ফেল।’ নেতাগোছের মহিলাটি বলল।
আমরা কী করব বুঝতে পারছি না। সুজন একটু এগিয়ে গিয়েও গেল না। রাতুর মাথায় পিস্তল ধরে রাখা। যদি গুলি করে দেয়। মুহূর্তেই ওরা আমাদের হাত বেঁধে ফেলল। কাদের আমাদের কিল-ঘুষি দিতে লাগল ইচ্ছেমতো। মনে হয় আমাদের মেরে পেশাব খাওয়ার জ্বালা মিটিয়েছে কাদের। পুরো চিত্রটা উল্টে গেল। শীত কাকে বলে, কত প্রকার, কী কী সবই উদাহরণসহ ব্যাখ্যা বুঝতে পারছি অনায়াসে। একে তো শীত তার ওপর আবার ধরা পড়ে গেছি।

‘তোদের সাহস তো কম না। এই লায়লার কথা শুনলে পুলিশ আসার সাহস পায় না। আর নাক ধরে চাপ দিলে দুধ বের হবে তোরা কিনা আইসছ আমার সাথে চিটিংবাজি করতে।’ একটানা বলল নেতাগোছের মহিলাটি। ‘যাক ভালোই হইছে। এখন বুঝবি, কত ধানে কত চাল।’ ঘরের ভেতর আমাদের ধরে আনা হয়েছে। একটা থামের সাথে গোল করে সবার হাত বেঁধে রাখা। কেউ কারো মুখ দেখতে পারছি না। চার্জার বাতি জ্বলছে টেবিলের উপর। পুরোনো একটি চেয়ারে বসে গম্ভীর মুখে কথা বলছে লায়লা নামের নেতাগোছের মহিলাটি, ‘এরা খবর পেল কীভাবে? আর এত রাতে এখানে আসার সাহসই হল কীভাবে?’
‘এই তোরা কয়জন আইছস? সাথে আরো কেউ আছে নাকি?’ -আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন। আমরা কেউ কোনো কথা বলছি না। কথা আসলে মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না।
ঘড়িতে কয়টা বাজে আল্লাহ-ই জানে। আমাদের সবার হাতই বাঁধা। ঘড়ি দেখতে পারছি না। এমন সময় লায়লার ফোন বেজে উঠল। ফোন হাতে নিয়েই খুশিতে বলল- ‘বস্ আপনে আসছেন নাকি? ওকে বস্। একটু অপেক্ষা করেন।’ ফোন রেখেই কাদের ডাকলেন, ‘তুই আর স্বপন মিলে বস্কে নিয়ে আয়। বস্ রাস্তায় আছে।’ কাদের আর স্বপন ঘরের বাইরে চলে গেল।
আমরা কী করব বুঝতে পারছি না। এখানে চিৎকার করলে কী কোনো লাভ হবে। মনে হয় না। তারচেয়ে বরং চুপচাপ থাকাই ভালো। একটু পরেই ঘরে কাদের আর স্বপন ছাড়া আরও তিনজন প্রবেশ করল। একজন একদম সাহেব সেজে এসেছে। কোট-টাই পরা ভদ্রলোকটি আমাদের দেখেই যেন আঁতকে উঠলেন। লায়লা ব্যস্ত হয়ে পড়ল, ‘বস্ বসেন, বসেন। হাসি যা চায়ের ব্যবস্থা কর।’ এরই মধ্যে বিদ্যুৎ চলে এসেছে। সব কয়টার চেহারা খুব ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে। আমাদের সম্পর্কে জানতে চাইলেন কোট-টাই পরা লোকটা- ‘এরা কারা লায়লা?’
লায়লা তার বস্কে সব খুলে বলল। শুনে তার বস্ বলল ‘ভালোই হয়েছে। এক ঢিলে দুই পাখি। গাড়ি তো আছেই। এদেরকেও সাথে নিয়ে যাব।’
লোকটার কথা শুনে লায়লা নামের ডাইনির মুখে হাসি ফুটে উঠল! হাসি অন্যদের মুখেও। আমাদের শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেছে। বলে কী লোকটা! শাহেদকে খুঁজতে এসে আমরাও পাচারকারীদের হাতে ধরা পড়লাম। আমরাও পাচার হয়ে যাব অন্যদেশে। ভাবতেই গা শিরশির করতে লাগল। ওরা কথা বলতে বলতে পাশের ঘরে চলে গেল। যে ঘরে বাচ্চাগুলোকে রাখা হয়েছে।
এখন কি হবে আমাদের।’ -ফিসফিস করে বললাম আমি।
আল্লাহকে ডাক। বিপদে তিনি আমাদের রক্ষা করবেনই। -রাতু উত্তর দিল।
সুজন কোনো কথা বলছে না। চারপাশে কোথাও কোনো শব্দ নেই। বাইরে যতক্ষণ ছিলাম শীত লাগেনি। উত্তেজনায় শীত আর শীত ছিল না। কিন্তু এখন ঘরের মধ্যে থেকেও বুঝতে পারছি- শীত কী জিনিস! তার সাথে আবার ভয় এসে যোগ হয়েছে। শীতে দাঁতে দাঁত আঘাত করছে।
এতক্ষণে বিদ্যুৎ চলে এসেছে। দুই পা-অলা শয়তানগুলো আবার ঘরে ঢুকল। মুখে ওদের হাসি লেগেই আছে। স্বপন সবাইকে চা-নাস্তা দিল। ওরা হাসছে আর চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে।
এমন সময় বাইরে কে যেন দৌড়ে গেল। আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম দরজা দিয়ে। চিন্তায় মাথায় সমস্যা হতে শুরু করল কী না আল্লাহই জানে। ও আল্লাহ তুমি আমাদের এই বিপদ থেকে রক্ষা করো। – মনে মনে খুব করে বলছি।
লায়লা, কাদের, স্বপন আর কোট টাই পরা লোকের সাথে আসা অন্য দুইজনকে তাড়াতাড়ি বাচ্চাগুলোকে গাড়িতে তুলতে বলল। ওদের উঠানো শেষ হলে আমাদের চারজন বাইরে বের হয়ে গেল। ঠিক তখনই আবার চারজন ঘরে ঢুকল। সাথে ঢুকল পুলিশ! একজন নয়, বেশ কয়েকজন।
‘কোনো চালাকির চেষ্টা নয়। পুলিশ ঘর দুটোকে ঘিরে ফেলেছে।’ -পুলিশের মাঝখানে একজন বললেন।
পুলিশ বিষয়টা জানল কীভাবে? পুলিশের পেছনে পেছনে ঘরে ঢুকল ঝিনুক আর তার আববু। আমাদের চক্ষু ছানাবড়া। ঝিনুকই বা জানল কি করে? তবে যাই হোক আমরা যেন প্রাণ ফিরে পেলাম। আল্লাহ তাহলে আমার ডাক শুনতে পেয়েছিলেন! দুই জন পুলিশ আর ঝিনুক আমাদের মুক্ত করল। এই শীতে কতক্ষণ যাবৎ মাটিতে বসে আছি। শরীরটা এতক্ষণ কাঁপছিল। এখন একটু যেন শীত কম লাগছে!
‘কিরে তুই জানলি কীভাবে?’ -ফালু জিজ্ঞাসা করল ঝিনুককে।
আমার কাছে জাদু আছে।’ – বেশ ভাব নিয়েই উত্তর দিল সে।
শয়তানগুলোর চেহারা হয়েছে দেখার মতো। সব কয়টার হাতেই হ্যান্ডকাপ লাগানো হয়েছে। সবগুলোকে বাইরে গাড়িতে উঠানো হলো। ন্যাদা ন্যাদা বাচ্চাগুলোকেও। এদের দেখে সবাই এক্কেবারে হতবাক হয়ে গেছে। যদিও বাচ্চাগুলোকে পর্যাপ্ত শীতের কাপড় দেওয়া হয়েছিল। তবে অবাক করা বিষয় হলো- একটা বাচ্চাকেও কাঁদতে দেখা যায়নি।
শ্রীবরদী থানায় সবাইকে একটা লকারে আটকে রাখা হয়েছে। আমরা ওসি আঙ্কেলের রুমে বসে আছি। তিনি শাহেদের কথা শুনে পাচারকারীদের শাসালেন। কিন্তু ওরা সবাই অস্বীকার করল। তারা জানাল- বাচ্চাকাচ্চাদেরই সাধারণত তারা কিডন্যাপ করে থাকে। বড়দের করে না।
ঝিনুকের আববু ওসির সাথে কথা বলছেন। সবার বাসায় খবর দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বাচ্চাগুলো উদ্ধারের একটা ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে। যাদের বাচ্চা হারিয়েছে, তাদেরকে থানায় যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে।
শাহেদ না জানি কোথায় আছে? শাহেদের কথা শুনে ঝিনুক জানতে চাইল কী হয়েছে? রাতু খুলে বলল পুরো ঘটনা। শাহেদের কথা শুনে ঝিনুকের মনটা খারাপ হয়ে গেল।
এবার তোর কথা বলত। কীভাবে খবর পেলি?’ -ফালু জানতে চায় ঝিনুকের কাছে।
‘তোরা তো বিশ্বাস করতে চাইবি না। খুব মজার কাহিনী।’ ঝিনুক বলতে লাগল। ‘তোরা তো জানিস, ভূত প্রেতে আমার কোনো বিশ্বাস নেই। কতজন কত কিছু দেখেছে। কিন্তু আমি দেখার চেষ্টা করেও দেখতে পাইনি। আমাদের বাড়িতেই কেউ বেড়াতে এলে রাতের বেলায় কিছু না কিছু দেখেই ভয় পেত। কেউ হাতি দেখেছে, কেউ ঘোড়া, কারো সামনে আবার ধবধবে সাদা রঙের শাড়ি পরা বউ কত কিছু। আর আমার কত উৎসাহ এদের দেখার ব্যাপারে। কিন্তু কপাল আমার কোনো কিছুই কোনোদিন চোখে পড়ল না। আমাকে দেখে যেন সব ভয়ে দূরে দূরে থাকে। একদিন হয়েছে কী? মাঝ রাতে ঘুম থেকে উঠেছি পানি খেতে। ঘুম ভাঙার পরপরই কেমন একটা ফরফর শব্দ হচ্ছিল। চাঁদের আলোয় বাইরেটা বেশ পরিষ্কার। জানালা দিয়ে বাইরে কিছু দেখতে পেলাম। হঠাৎ মোরগের ডাক ভেসে আসল। এবার আমার চোখ গেল- কামিনী ফুলের গাছটার উপর। সাদা কি যেন একটা দেখা যাচ্ছে। গাছের উপরের অংশ পুরোটাই সাদা। সেখান থেকেই ফরফর ফরফর কেমন একটা শব্দ আসছিল। সাথে মোরগের ডাক। কিন্তু মোরগের ডাক এমন শোনা যাচ্ছে কেন? বাইরে প্রচুর বাতাস বইছে। আমি একটু ভড়কে গেলাম। আজ বুঝি আমাকে ভূত ধরেই বসল। কিন্তু আমি পিছু হটার কেউ নই। আববুকে ডেকে তুললাম। তারপর চার্জার লাইট নিয়ে গিয়ে দেখি, কামিনী গাছের উপর একটা সাদা পলিথিন। বাতাসে হয়তো কোথাও থেকে উড়ে এসেছে। পলিথিনের শব্দটাই এমন বিশ্রী লাগছিল। আর কামিনী গাছে আমাদের একটা মোরগ থাকত। সেটা ভয়েই ডাকাডাকি শুরু করেছিল। এরপর তো ভূত আমাকে দেখলে ভয়েই পালায়।’
ধুর তোর কাছে এই কাহিনী শুনতে চাইছি। আজকের কথা বল। বেশি বকবক করিস।’ – ফালু কিছুটা চটে যায় ঝিনুকের উপর।
আরে বলছি তো।’ -ঝিনুক উত্তর দেয়। ‘আজ রাতেও পানি আনতে গেছি। হঠাৎ দেওয়ালের পাশে ফিসফিস কথার আওয়াজ আসে আমার কানে। আমার নামটাও শুনতে পেলাম। পেয়ারা গাছে উঠে দেখি- চারটা ছায়া কথা বলছে আর সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। চারটা ছায়ার কণ্ঠ খুব পরিচিত মনে হতে থাকে। আমি কোনো দেরি না করে সোজা দেওয়াল টপকে এই পাশে নেমে পড়ি। কাছাকাছি যেতেই নিশ্চিত হই- ভুত না ঘোড়ার ডিম। ততক্ষণে আমি তোদের চিনে ফেলেছি। কিন্তু তোরা যাচ্ছিস কোথায় দেখার জন্য পিছু পিছু যেতে থাকি। দেওয়াল থেকে নামতে গিয়ে এই দেখ কয়েক জায়গায় ব্যথাও পেয়েছি।’ হাতের কনুই আর পা দেখিয়ে বলল ঝিনুক।
একটুও ভয় পেলি না? -ফালু জানতে চাইল।
আমি কী তোর মতো ভীতু নাকি? -ঝিনুক ভেংচি কাটে।
ভীতু হলে কী আর এত রাতে ভূতের জঙ্গলে গিয়ে দাঁত কিলিয়ে হাসতাম।’ – ফালু বেশ চটে যায়। ওর কথায় কান না দিয়ে ঝিনুক বলতে থাকে- ‘আমি যদি তোদের সাথে আগেই কথা বলতাম, তাহলে তো খবরই ছিল। এতক্ষণ কোথায় থাকতাম সবাই চিন্তা কর। এরপর তোদের পিছু পিছু আমি শয়তানগুলোর আখড়ায় পৌঁছাই। তোদের কান্ডকারখানা সব দেখছিলাম চুপটি করে। তোর ইয়ে করে দিয়ে হারিকেন নেভানোর বুদ্ধিটা কিন্তু দারুণ। আমার যা হাসি পাচ্ছিল।’ -ফালুকে বলল।
ফালু যেন এবার একটু লজ্জা পেল। এছাড়াও ফালু এক পর্যায়ে প্যান্ট খুলে ফেলেছিল। লজ্জা তো পাওয়ারই কথা।
‘এরপর তোদের সবাইকে যখন ধরল। তখন বেশ ভয় পেয়ে গেলাম। কি করব বুঝতে পারছিলাম না। আল্লাহ বাঁচাইছে যে, আমাকে কেউ দেখে নাই। আমি এক দৌড়ে বাসায় যাই। আববু তখনও ঘুমায়নি। আমি কই গেলাম, সেই টেনশনে ছিল। আমাকে দেখে একটু ধমকই দিল। কিন্তু সব শোনার পর, আমাকে নিয়ে থানায় গেলেন। তারপর তো সব দেখলিই।’ -ঝিনুক বলল।
আসলেই ঝিনুকের সাহস দেখে অবাক হতে হয়। এমন সাহসী মেয়ে খুব কমই আছে। থানায় অনেক মানুষ এসে ভিড় করেছে। কিডন্যাপারদের গ্রেপ্তারের খবর ছড়িয়ে পড়েছে মুহূর্তেই। ক্যামেরা হাতে বেশ কয়েকজন ঢুকল ওসির কক্ষে। এরা নিশ্চয়ই সাংবাদিক। কিডন্যাপারদের ছবি তুলল। উদ্ধার হওয়া বাচ্চাগুলোর ছবি তুলল। আমাদেরও বাদ দেয়নি। আমাদের একটা গ্রুপ ছবি নিল। আমাদের সবার সাথে কথা বলল। পুরো কাহিনী শুনে তারাও হতবাক। শাহেদকে এখনও উদ্ধার করা যায়নি এটাও জানিয়ে দিলাম সাংবাদিকদের। এমন সময় আমাদের সবার আববুরা এসে পড়েছেন। সবার মুখেই আতঙ্কের ছাপ। শাহেদের সাথে সাথে আমরাও হারিয়ে গেলাম কি না? একি শাহেদও এসেছে! আমরা একটু দৌড়েই গেলাম শাহেদের কাছে। ‘কি রে তুই নাকি হারিয়ে গেছিস?’ -ঝিনুক জানতে চায় শাহেদের কাছে।
সবাইকে ঝিনুকের আববু ও ওসি আঙ্কেল সব ঘটনা খুলে বললেন এবং আমাদের বাহবা দিলেন। এদিকে রাতুর আববু শাহেদকে কোথায় পাওয়া গেল বললেন। আমরা যখন শাহেদকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান, তখন শাহেদ ওদের পুরাতন ঘর থেকেই বের হয়ে এলো। ভূত দেখার মতো সবাই চমকে উঠে। উল্টো সেই জানতে চায়- বাড়ির সবাই কান্নাকাটি করছে কেন? কী হয়েছে? সে কিছুই বুঝতে পারেনি। শাহেদ কোথায় ছিল তাহলে? আসলে যা হয়েছে -বিকেলে লুকোচুরি খেলার সময় ঘরের মাচায় গিয়ে লুকায়। মাচায় রাখা পুরাতন কাপড়ের উপর শুয়ে শুয়ে একটা বই পড়ছিল। এরপর কখন যে ঘুমিয়ে গেছে বলতেই পারে না। যখন ঘুম ভাঙ্গে তখন রাত দশটা পার হয়ে গেছে। সারা এলাকা তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে তাকে নিয়ে। তার জন্য আর সবার ঘুম হারাম, আর সে আরামে ঘুমিয়েছিল।
শাহেদের কান্ড শুনে আমরা কাঁদব না হাসব বুঝতে পারছিলাম না। ফালু হেসেই ফেলল। সাথে সাথে আমরাও।
‘এরপর দেখি যে হারিয়েছে, তাকে পাওয়া গেছে কিন্তু আর সবাই উধাও! আবার আরেক চিন্তায় পড়ে গেলাম।’ – বললেন রাতুর আববু।
সাংবাদিকেরা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব শুনছিল। যাওয়ার সময় এটাও বলে গেল- হয়তো কাল নিউজ পত্রিকায় আসবে না, পরশু আসবে। কেননা এখন অনেক রাত হয়ে গেছে, আর পত্রিকাও ছাপা হয়ে গেছে। ‘আমাদের ছবি ছাপা হবে তো?’ ফালু প্রশ্ন করল একজনকে।
হবে মানে, অবশ্যই হবে।’ -উৎফুল্ল এক সাংবাদিক ভাইয়া জবাব দিলেন।
তোমরা যে কাজ করেছ, তা তো গোয়েন্দারাও করতে পারে না।’ -আরেকজন বললেন।
এত রাতেও থানায় ভিড় বাড়ছেই। বিশেষ করে যাদের বাচ্চা হারিয়ে তারা তো আসছেনই। এছাড়াও অনেকেই হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন।
সবাই পত্রিকার এজেন্টের দোকানে এসে হাজির। আজ আমাদের খবরও ছবি ছাপা হওয়ার কথা। বাসায় পত্রিকা দিলেও আমরা আগেই চলে এসেছি। সববাই। কিন্তু সময় যেন যাচ্ছেই না। পত্রিকা আর আসে না। অবশ্য আমরা সকালেই খবর পেয়ে গেছি যে, আমাদের ছবিসহ খবর ছাপা হয়েছে। রাতুর মামা ঢাকায় পড়াশুনা করে। সকালে তিনিই রাতুর আববুকে ফোন দিয়ে জানিয়েছেন। খবরটা পেয়ে আরো বেশি কৌতূহল পেয়ে বসেছে আমাদের। কখন দেখব নিজের চোখে। আমাদের এখানে পত্রিকা ১১/১২টার আগে আসে না। তবে আজ শুক্রবার হওয়ায় আমরা আসতে পেরেছি, অন্য দিন হলে তো স্কুলে থাকতে হত। এরই মধ্যে পত্রিকা এসে গেছে। প্রায় সব পত্রিকাতেই সংবাদ এসেছে। বেশির ভাগ পত্রিকাতেই প্রথম অথবা শেষ পাতায় বক্স করে ছবিসহ ছাপা হয়েছে সংবাদ। শুধু আমাদের ছবিই নয়, পাচারকারী ও ন্যাদান্যাদা বাচ্চাগুলোর ছবিও কোনো কোনো পত্রিকায় এসেছে। আমাদের খুশির যেন আর অন্ত নাই। সে কী আমাদের লাফালাফি। তবে অ্যাডভেঞ্চার গল্পের মতো করেই লিখেছে কেউ কেউ। পড়ার সময় মনে হচ্ছে যেন, কোনো অ্যাডভেঞ্চার গল্প পড়ছি।

আমাদের স্কুলে আজ বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল দিবে। স্কুলের মাঠে মঞ্চ করা হয়েছে। মঞ্চের সামনে অভিভাবক ও আমরা বসে আছি। রাতুর রোল যে এক আবারও হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। বাকিগুলোও অপরিবর্তিত থাকবে। তবে তনয় আর ফালুও এর মাঝে কারো জায়গাটা হয়তো দখল করে নিতে পারে। ঠিক বুঝতে পারছি না। এবার পরীক্ষা আমারও ভালো হয়েছে। রাতুর জায়গায় যেতে পারব কী না কে জানে। ও ঠ্যাং ভেঙে শুয়ে থাকলে কী হবে, সারাদিনই পড়েছে। বরং আগের থেকে ওই ছয়মাস আরও বেশি পড়ার সুযোগ পেয়েছে। তাই ভয়টা আমার আছেই। ক্যাপ্টেন্সীটা আবারো ওর ভাগ্যেই থাকছে। সবার বুকের ভেতরেই দুরুদুরু করছে। পুরো জেলায় আমাদের স্কুলেই ক্লাস ক্যাপ্টেনদের ব্যাজ পড়ানো হয়। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি জেলা প্রশাসক ক্লাস ক্যাপ্টেনদের একটা ব্যাজ পড়িয়ে দেন। যা অন্য কোনো স্কুলে দেওয়া হয় না। তাই ক্লাস ক্যাপ্টেন হতে আমাদের মাঝে বেশ প্রতিযোগিতা চলে!
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথিসহ সবাই উপস্থিত হয়েছেন। প্রধান শিক্ষক স্যার রোল সাত থেকে এক ক্রমান্বয়ে ঘোষণা দিতে শুরু করলেন। সাত এর পর যাদের রোল, তাদের রোল নোটিশ বোর্ডে টানিয়ে দেওয়া হবে অনুষ্ঠান শেষে।
ক্লাস সিক্সের ফলাফল শেষে শুরু হলো ক্লাস সেভেনের।
প্রথম নামটাই মামুন। তার মানে মামুন এগারো থেকে সাতে চলে এসেছে।
এরপর সুজনের নাম। আগে যা ছিল এখনও তাই।
পাঁচ হয়েছে শাহেদের। ডাববা খেয়েছে এবার। তিন থেকে পাঁচে। ফালুটার কি হলো? আশা করেছিলাম সাতের ভেতরে থাকবে। কিন্তু এখন তো দেখি নেই। ফালুর কথা মনে হতেই মনটা খারাপ হলো। এক পাশে বসে আছে চুপচাপ। তবে মন খারাপের কোনো রেশ তার মাঝে নেই। বরাবরের মতোই।
তনয়ের হলো চার। তনয় বেশ খুশি। শহরের স্কুলে নাকি ওর রোল ছিল দশ। এখন তো অনেক এগিয়ে। এতেই সে খুশিতে গদগদ!
এরপর আমার যার নাম বলা হলো শুনে মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল। দুই থেকে পিছিয়ে আমার রোলটা হয়েছে তিন। ক্যাপ্টেন্সীটা আবারও ল্যাংড়ার কাছেই রয়ে গেল তাহলে। মনে মনে ভাবতে থাকি। পড়াশোনা তো ঠিক মতো করি-ই নাই। তিন হয়েছে এটাই তো বেশি! রাতুকে বেশ উৎফুল্ল দেখাচ্ছে।
কিন্তু এই হাসি হাসি মুখটা আর বেশিক্ষণ থাকল না। কারণ আমার পরের নামটাই যে রাতুর। তার মানে এবার ক্যাপ্টেন্সীটা হাত ছাড়া ওর। রাতুর মুখটা কেমন ভোতা হয়ে গেল।
ঠিক তখনই যে নামটা ঘোষণা হলো আমি চমকে উঠলাম। অনেক অনেক বেশি মার্ক পেয়ে এবার প্রথম স্থান অধিকার করেছে ফালু। আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। ফালু আমার দিকে বেশ কয়েকবার তাকাল। আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। এতক্ষণ খারাপ লাগলেও এখন বেশ ভালো লাগছে। ফালুর এই আনন্দের যে আমিও একজন। খুশিতে আমি দু’চোখে ঝাপসা দেখতে পাচ্ছি। চোখের পাতা ফেলতেই টুপ করে ঝরে পড়ল পানি।

ক্লাস এইটের নতুন কাস শুরু হয়েছে। একদিন স্কুলে ওসি আঙ্কেল এসে উপস্থিত। আমাদের খুঁজে বেড়াচ্ছেন। তিনি আমাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষককে নিয়ে আমাদের ক্লাসে আসলেন। আমরা কিছু বুঝতেছি না।
ঘটনা হলো- ওসি আঙ্কেল আমাদের পরিকল্পনার কথাটা কীভাবে যেন জেনে গেছেন। আর তাই বাজারের উত্তর পাশের শফিক চাচার পরিত্যক্ত ঘরটি আমাদের জন্য ব্যবস্থা করেছেন। আমরা এই ঘরটি এখন ব্যবহার করতে পারব। কোনো ভাড়া বা কিছু দিতে হবে না। আমাদের সবার মুখে হাসি ফুটে উঠল। আমরা তাকে অসংখ্য ধন্যবাদ দিলাম। তিনি আমাদের মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলেন।
বিকেলে গিয়ে দেখি- ঘরটা পরিষ্কার করা হয়েছে। নতুন দুইটা চেয়ার, দুইটা বেঞ্চ ও একটা টেবিল আনা হয়েছে। আর সব করেছেন ওসি আঙ্কেল। আমাদের পরিকল্পনাটা তাহলে বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে। কত দিন থেকে আমরা এটা চিন্তা করে রাখছিলাম। কিন্তু বড়দের কাছে বলার সাহস পাচ্ছিলাম না, ঝাড়ি খাওয়ার ভয়ে। কিন্তু ওসি আঙ্কেল কিভাবে জানলেন- সেটা বুঝতে পারছি না। তবে তিনি জানায় কাজটা অনেক সহজ হয়ে গেছে। না হলে অনেক কঠিন হয়ে যেত আমাদের জন্য। নিশ্চিত সবার বাড়ি থেকে সোজা না করে দিত এই রকম পন্ডিতি না করতে!
পরের দিন উদ্বোধন হলো আমাদের পাঠাগারটি। প্রায় পঞ্চাশটি বই নিয়ে যাত্রা শুরু হলো বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার কার্যক্রমের। বই পড়ার অভ্যাস করতেই এই পাঠাগারটির পরিকল্পনা ছিল আমাদের। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ওসি আঙ্কেল জানালেন, আমাদের পরিকল্পনাটা তার কাছে ফাঁস করে দিয়েছে আমাদের নতুন ক্লাস ক্যাপ্টেন।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!