তিনি চলে যাবেন! মাসের শেষ দিন। আর ফিরে আসবেন না সে পরিচয়ে। যদিও কখনো আসেন, তখন নামের সঙ্গে উচ্চারিত হবে নতুন উপাধি, সাবেক কথাটি। তিন-তিনটি বছরের কত রাত পার করলাম একসঙ্গে এক রুমে আমরা। সেই মানুষটি কিনা আজ আমাকে ছেড়ে সত্যি সত্যি চলে যাবেন! কথাটা ভাবতেই আমার বুকের ভেতরটায় কেমন যেন এক আলোড়ন ওঠে। এক মৃদু যন্ত্রনার আভাস পাই কোথাও।
চলে যে তাকে যেতেই হবে। এটাই নিয়ম। এটাই বাস্তবতা। মেনে আমাকে নিতেই হবে। রাতে শুয়ে থেকে জীবনের কত গল্প করতাম অনবরত দুজন। সেই বাল্যকাল, কৈশোর কালের জমানো কত কথাই-না বিনিময় করতাম দুজন। এমনকি বর্তমান সময় সারা দিন ক্যাম্পাসে আড্ডা বা অন্য কোথায় কে কী করেছি, রুমে এসে শেয়ার না করা পর্যন্ত দুজনের কেউ খেতেই বসতাম না। শেয়ার করার মাঝেই যেন আলাদা একটা তৃপ্তি খুঁজে পেতাম দুজন।
বাসায় থেকে হোক আর অন্য কোথায় থেকে হোক, খাবার বা অন্য জিনিস নিয়ে এলে একে অপরকে দিয়ে খেতাম। কখনো হঠাৎ কাজের মাসি না থাকলে দুজনে মিলে নিজের হাতে ছানা ভাত রান্না করে খেতাম। নিজে রান্না করে খাওয়ার মাঝে কী যে মজা, তারা বুঝবে, যারা খেয়েছে।
বিভিন্ন কারণে অনেক সময় মন খারাপ হয়ে যেত আমার। তিনি আমাকে বুঝতে পারতেন। এমন হাসির কথা বলতেন, মুহূর্তের মধ্যেই মন ভালো হয়ে যেত আমার।
কখনো তার স্নানের সময় আমাকে বাথরুম ছেড়ে দিতেন। আমি যদি বলতাম, আমার প্রাইভেট আছে, হাতে সময় নেই তাড়াতাড়ি যেতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে আমাকে ছেড়ে দিতেন। কখন যদি অসুস্থ হয়ে পড়তাম, তাহলে তো কোনো কথা নেই, সঙ্গে সঙ্গে ওষুধ নিয়ে আসতেন। তিনি মাছ খুব কম খেতেন, ভাগের মাছটুকু আমাকে বেশি খাওয়াতেন। মাছের মাথা তো একেবারেই পছন্দ করতেন না।
আমি আবার মাছের মাথা খুব পছন্দ করতাম। মাছের মাথা খাওয়ার লোভে বাজারের গিয়ে বেছে বেছে মাছ কিনে নিয়ে আসতাম। করণ মেসের নিয়ম হলো যে বাজার করবে, সেই মাছের মাথা খাবে। আমাকে বলত, মাছের মাথা তো খায় বোকারা।
আমি অবাক হয়ে বলতাম, বোকারা মাছের মাথা খায়!
তিনি যুক্তি দিয়ে বলতেন, কারণ গ্রামে বর্ষাকালে নদীতে, খালে, বিলে ধিয়াল, দারকি পেতে মাছ ধরে। ধিয়াল, দারকি মধ্যে মাছ মাথা দিয়ে কত সুন্দর ভেতরের প্রবেশ করতে পারে কিন্তু আর বের হতে পারে না। তাহলে তারা বোকা না, বলো? আর যারা মাছের মাথা খায় তারাও বোকা।
আমি হাসতাম কথাটা শুনে। তবু আমি পেটুকের মতো মজা করে মাছের মাথা খেতাম।
তিনি কিছু সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিল। তাই মাঝে মধ্যে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেতেন। আমাকে নিয়ে যেত। কখনো প্রাইভেট বা পড়াশোনার চাপে যেতে পারতাম না। খাবার ব্যবস্থা থাকলে প্যাকেট নিয়ে আসত আমার জন্য।
ছাত্রজীবনে আর্থিক কষ্ট কমবেশি সবাই ভোগ করে। আমার আর্থিক অবস্থা বুঝতে পারতেন তিনি। আমাকে টিউশনির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন তিনি। কেন যে আমাকে এত বেশি ভালোবাসা, আমি বুঝতাম না। সরাসরি কখনো বলিনি। কেন আমাদের মধ্যে এত মিল ছিল। আমি একটু একটু বুঝতে পারতাম।
দ্বিতীয় মাসের প্রথম দিকের কথা। রুমে উঠে দেখি একটা বদ অভ্যাস আছে তার। সিগারেট খাওয়া। আমি অবশ্য ধূমপানের বিরুদ্ধে সব সময় কথা বলি, এখনো বলি। ভবিষ্যতেও বলব। প্রথম প্রথম কিছুই বলতাম না। আগে বোঝার চেষ্টা করতাম। কী করে তার মন জয় করা যায়। কী পছন্দ করে, কী ভালোবাসে। আমি সেগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করতাম। ধীরে ধীরে বুঝতে পারতাম, আমার আচার-ব্যবহারে কথাবার্তায় তিনি মুগ্ধ। কিছুটা হলেও তার মন জয় করতে পেরেছি। তিনি কিছুটা হলেও আমার প্রতি বিশ্বাস অর্জন করতে শুরু করেছেন। ভাবলাম, সুযোগ এখন কাজে লাগানো দরকার।
প্রতি রাতে দুজন একসঙ্গে খেতে বসলাম। ভাত নাড়াচাড়া করতে করতে তার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আমরা কেমন বিবেকবান সচেতন মানুষ। আমরা নিজেদের ভালোমন্দ নিয়ে ব্যস্ত থাকি। অন্যের ভালোমন্দ বুঝি না। গুরুত্ব দিই না। সব সময় নিজেদের স্বার্থ নিয়েই ব্যস্ত থাকতে চাই।’
আমার এই কয়েকটা বাক্যের মধ্যে কী যেন বোঝার চেষ্টা করলেন তিনি। আমার কথার উদ্দেশ্য বুঝতে পারেনি। আমাকে বলেই ফেলল।
‘কবি, আমাকে যদি কিছু বলো, তাহলে সরাসরি বলবে, কেমন? কারণ তুমি তো কবি। তোমার কবিতার ভাষা আমি বুঝি না।’ তিনি আমাকে কবি বলে ডাকেন। কারণ আমি লেখালেখি করি। তাই আমাকে কবি বলে ডাকে।
আমি হাসতে হাতে বললাম, ‘আপনাকে অনেক দিন হলো একটা কথা বলতে চাইছিলাম। কিন্তু সাহস পাচ্ছি না। যদি কিছু মনে করেন?’
‘কী বলবে বলো। ভয়ের কী আছে!’
আমি আবারও বললাম, ‘রাগ করবেন না তো?’
‘বলো তো!’
আমার সাহস বেড়ে গেল, তবু ভয়ে ভয়ে প্রয়োজনের ক্ষেত্রে সাহস করে বললাম, ‘আপনি সিগারেট খান, এর গন্ধ সহ্য করতে পারি না আমি। যদি বাইরে গিয়ে খেতেন, তাহলে পরোক্ষ ক্ষতির হাত থেকে বাঁচতাম।’
আমার কথা শোনামাত্র যেন আকাশ থেকে মাটিতে নয় যেন সে সমুদ্রে পড়ে গেল। চেহারা দেখে বুঝলাম। অনেক সময় চুপচাপ থাকল। ভাবলাম, আমাকে মার দেবে কি না আচ্ছা করে নাকি বকা দেবে! যে কথাটা আমি বলেছি! আমার মুখের দিকে তাকাল। তারপর বললেন, ‘বাদ দেব।’
আমি সুযোগ পেয়ে আরও জোরে বললাম, ‘আমরা মানুষ জাতি অন্যেরটা দেখে শিখি, এটা ঠিক কিন্তু কিছু খারাপ কাজ বা বদ অভ্যাসগুলো মনোযোগসহ গ্রহণ করি।’
আমাকে বললেন, ‘দ্যাখো, বন্ধুবান্ধব, বড় ভাই, এদের কাছে থেকেই শিখেছি।’
আমি সঙ্গে সঙ্গে ধীরে বললাম, আমি তো আপনাকে দেখে শিখতে পারতাম কিন্তু খারাপ থেকে সব সময় দূরে থাকি। এটা নিতান্ত নিজের ইচ্ছাশক্তি ও মনোবলের ওপর নির্ভর করে।
‘ঠিকই বলেছ, সঙ্গদোষে দোষী, তবে বাদ সত্যি দেব।’
আমি বললাম, কথা দিলেন তো।
মাথা ঝেঁকে বলল, ‘হ্যাঁ।’
দুজন ভাত খেতে শুরু করলাম…।
কিছু দিন পর সত্যি সত্যি তিনি সিগারেট খাওয়া বাদ দিলেন। এক দিন বললেন, ‘তোমার জন্য আজ আমি নেশামুক্ত।’তারপর থেকে তার কাছে খুব প্রিয় হয়ে গেলাম আমি।
সত্যি চলে যাবেন, আগের দিন বই-খাতা, লেপ-তোষক, বুক শেলফ, প্রয়োজনীয় জিনিস প্যাকেট করা হলো। পরদিন সকালের মেসের শেষ মিল খেলেন। রিকশা-ভ্যান ডাকা হলো। সব তোলা হলো রিকশা-ভ্যানে। মেসমেটদের কাছে থেকে একে একে বিদায় নিলেন তিনি।
অবশেষে আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করলেন। আমিও কেঁদে ফেললাম। কাঁদতে কাঁদতে শুভ ভাই বললেন, ‘আমার মতো তোমারও একদিন এই দিন আসবে। তখন তোমাকেও সব ছেড়ে যেতে হবে। প্রায়োজনের তাগিদে। এমনকি এই দুনিয়া থেকেও একদিন সব মায়া-মমতা ত্যাগ করে চলে যেতে হবে।’আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম, ‘যোগোযোগ থাকবে, মোবাইলে, ফেসবুকে। আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘অবশ্যই।’
রিকশায় উঠলেন শুভ ভাই। রিকশা চলছে। তাকিয়ে রইলাম রিকশার দিকে আমি।