আবীসিনিয় কিশোরী বারাকাহ

ঠিক কত বছর বয়সে দাস হিসেবে বিক্রির জন্য আবীসিনিয়া থেকে মক্কায় আনা হয়েছিল তাকে তা আমাদের জানা নেই। জানা নেই কে তার মা, কে তার বাবা, বা কি তার বংশ পরিচয়। সেই সময় তার মত অনেককেই বিভিন্ন জায়গা থকে ধরে আনা হত দাস দাসী হিসেবে মক্কার বাজারে বিক্রির জন্য। আর নিষ্ঠুর মনিবদের কাছে বিক্রি হত যারা তাদের জন্য অপেক্ষা করত নির্মম অত্যাচার আর অমানবিক আচরণ। তবে সবার ক্ষেত্রেই যে এমনটা হত তা কিন্তু নয়; এদের মাঝে অনেক সৌভাগ্যবানও ছিল, যাদের মনিবেরা ছিল অনেক ভাল আর দয়াবান।

 

আবীসিনিয় কিশোরী বারাকাহ ছিল সেই সৌভাগ্যবানদের একজন। কারণ তার মনিব ছিল আব্দুল মুতালিবের ছেলে আব্দুল্লাহ্‌। যিনি ছিলেন মক্কার সুদর্শন আর দয়াবান যুবকদের একজন। বারাকাহ ছিল আব্দুল্লাহ্‌র গৃহে একমাত্র কাজের লোক যে কিনা আমিনার সাথে আব্দুল্লাহ‌র বিয়ের পর তাদের পারিবারিক কাজে সাহায্য সহযোগিতা করত।

 

বারাকাহর ভাষ্যমতে, বিয়ের দুই সপ্তাহ হতে না হতেই পিতা আব্দুল মুতালিবের নির্দেশ অনুযায়ী ব্যবসার কাজে সিরিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হতে হয়েছিল সদ্যবিবাহিত আব্দুল্লাহকে। ব্যাপারটাতে নববধূ আমিনা খুব হতাশ হয়ে বললঃ

 

“কি আশ্চর্য! ক আশ্চর্য! হাতের মেহেন্দির রঙ পর্যন্ত (মুছে) যায়নি এখনো আমার, এই অবস্থায় একজন নববধূকে একা রেখে তার স্বামী সিরিয়া যায় কি করে??”

 

আব্দুল্লাহ্‌র এই প্রস্থান ছিল আমিনার জন্য খুবই হৃদয়বিদারক। আর সেই কষ্টে বধূ আমিনা সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছিল। বারাকাহ বললঃ “তিনি চলে যাওয়ার পর আমি যখন দেখলাম তাঁর স্ত্রী বেহুঁশ হয়ে পরে আছে, ভয়ে আর কষ্টে আমি যখন অনেক জোরে চিৎকার দিয়ে উঠলাম, তখন তিনি চোখ খুললেন হঠাৎ আর তার চোখ দিয়ে অনবরত অশ্রু ঝরছিল তখন। কান্না চেপে তিনি বললেনঃ “আমাকে একটু বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আস বারাকাহ।”

 

“এর পর সেই কষ্টে অনেকদিন শয্যাশায়ী ছিলেন আমিনা। তার পর থেকে কারো সাথেই কথা বলতেন না তিনি আর। এমন কি সেসময় তার শ্বশুর বৃদ্ধ আব্দুল মুতালিব ছাড়া তাকে আর যারা দেখতে আসতেন তাদের দিকে তাকাতেন পর্যন্ত না। ‘ আব্দুল্লাহ সিরিয়া যাবার দুইমাস পর আমিনা এক ভোরে ডাকলেন আমাকে হঠাৎ। তাকে বেশ উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল সেই সময়।

 

তিনি বল্লেনঃ “বারাকাহ, আমি না অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখেছি আজ।”

 

“নিশ্চয় ভাল কিছু, তাই না ?” জিজ্ঞাস করলাম আমি।

 

তিনি বললেন, “আমি দেখলাম আমার তলপেট থেকে আশ্চর্য একটা আলো বের হয়ে মক্কার আশেপাশের সমস্ত পাহাড়, পর্বত, উপত্যকা সবকিছুই আলোকিত করে দিল হঠাৎ।”

 

“আপনি কি সন্তান-সম্ভবা?” আমি জিজ্ঞাস করলাম।

 

তিনি বললেন, “হ্যাঁ, কিন্তু অন্য সন্তান-সম্ভাবা মহিলাদের মত কোন ব্যথা, কষ্ট বা অসুস্থতা অনুভব করছিনা আমি”।

 

আমি বললাম, “নিশ্চয় আপনি এমন একটা সন্তান জন্ম দিবেন যে সবার জন্য কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসবে”।

 

যতদিন আব্দুল্লাহ দূরে ছিল, আমিনা বেশ বিষণ্ণ ও বিষাদগ্রস্ত হয়ে ছিল। তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বারাকাহ প্রায়সময় তার পাশে থেকে বিভিন্ন গালগল্প করতেন এবং বিভিন্ন কথাবার্তা বলে তাকে হাসিখুশি উৎফুল্ল রাখার চেষ্টা করতেন সবসময়। কিন্তু তিনি আরও বেশি বিষণ্ণ হয়ে পড়েছিলেন যখন একদিন শ্বশুর আব্দুল মুতালিব এসে বললেন, তাদের সবাইকে ঘর ছেড়ে পাহাড়ে আশ্রয় নিতে হবে, কারণ ইয়েমেনের তৎকালীন শাসক আব্রাহাহ তার শক্তিশালী দলবল নিয়ে মক্কা আক্রমণ করতে আসছিল। তখন আমিনা তাকে বললেন, তিনি এতই দুর্বল আর বিষণ্ণ যে তার পক্ষে ঘর ছেড়ে পাহাড়ে আশ্রয় নেওয়া সম্ভব না। আমিনা আরও বললেন যে আব্রাহাহ কখনোই মক্কায় প্রবেশ করতে পারবে না আর পবিত্র কাবা গৃহ ধ্বংস করতে পারবেনা। কেননা, স্বয়ং আল্লাহ্‌ ওটাকে রক্ষা করবেন। কথাটা শুনে শ্বশুর আব্দুল মুতালিব বেশ রাগান্বিত হয়ে পরলেন; কিন্তু পুত্রবধূ আমিনাকে বেশ নির্ভীক দেখাচ্ছিল এব্যাপারে। তার চোখে মুখে বিন্দুমাত্র ভয়ের লক্ষণ পরিলক্ষিত হচ্ছিল না। আর আমিনার কথাই সত্যি হয়েছিল শেষ পর্যন্ত। আমিনার কথামত মক্কায় প্রবেশের পূর্বেই আব্রাহাহ তার হস্তী-বাহিনীসহ পরাজিত আর ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।

 

দিন রাত চব্বিশ ঘণ্টা বারাকাহ আমিনার পাশে থাকত। তার ভাষ্যমতে, “ আমি তার পায়ের কাছে ঘুমাতাম আর তার ঘুমের মাঝে স্বামীর জন্য তার বিলাপ আর কান্না শুনতে পেতাম নিয়মিত। মাঝে মাঝে তার কান্নার শব্দে আমার ঘুম পর্যন্ত ভেঙ্গে যেত, তখন আমি বিছানা থেকে উঠে তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করতাম”।

 

ইতিমধ্যে সিরিয়া যাওয়া বণিকদের অনেকেই ফিরে এসেছে এবং তাদের পরিবার-পরিজন তাদের আনন্দের সহিত অভ্যর্থনা দিল। কিন্তু আব্দুল্লাহর কোন খবর জানা গেল না। বারাকাহগোপনে আব্দুল্লাহর খবর নেওয়ার জন্য আব্দুল মুতালিবের বাসায় গেল, কিন্তু কোন খবর পেল না। শুনলে কষ্ট পাবে ভেবে বারাকাহ আমিনাকে খবরটা জানাল না। ইতিমধ্যে সিরিয়া যাত্রী বণিকদের সবাই ফিরে এলো, শুধু মাত্র আব্দুল্লাহ ছাড়া!

 

পরে ইয়াত্রিব থেকে যখন আব্দুলাহ’র মৃত্যুর খবর আসল বারাকাহ তখন আব্দুল মুতালিবের ঘরেই ছিল। বারাকাহ বললঃ “মক্কার সবচাইতে সুদর্শন যুবক, কুরাইশদের গর্ব আব্দুল্লাহ, যার ফেরার জন্য এত অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিলাম আমরা সবাই, সেই আব্দুল্লাহ ফিরবে না কখনোই আর। খবরটা শুনা মাত্রই জোরে একটা চিৎকার দিলাম আমি আর চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে আমিনার কাছে ছুটে গেলাম আমি।

 

দুঃসংবাদটা শোনামাত্রই অজ্ঞান হয়ে গেল আমিনা। এই জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে তার পাশেই ছিলাম আমি। আমিনার ঘরে আমি ছাড়া আর কেউই ছিল না তখন। এইভাবে আসমান জমিন আলোকিত করে মুহাম্মদ (সঃ) এর জন্ম পর্যন্ত দিবারাত্রি সর্বক্ষণ আমিনার সেবায় নিয়োজিত ছিলাম আমি”। মুহাম্মদ (সঃ) যখন জন্মগ্রহণ করেছিল বারাকাহ সর্বপ্রথম তাকে কোলে তুলে নিয়েছিল। তারপর দাদা আব্দুল মুতালিব এসে ক্বাবায় নিয়ে গেল তাকে, সেখানে সমগ্র মক্কাবাসী উৎসবের মাধ্যমে বরন করে নিলো তাকে। এরপর মুহাম্মদ(সঃ) কে যখন সুস্বাস্থ্যকর উত্তম পরিবেশে লালনপালনের জন্য হালিমার সাথে ‘বাদিয়াতে’ (মরুভূমি) পাঠানো হয়েছিল বেশ কয়েক বছরের জন্য। তখনও বারাকাহ আমিনার সাথে থেকে তাকে সাহায্য সহযোগিতা করত। পাঁচ বছর বয়সে মুহাম্মদ(সঃ) কে যখন মক্কায় ফিরিয়ে আনা হল তখন মা আমিনা ও বারাকাহ তাকে পরম আনন্দে গ্রহণ করে নিলো। আর মুহাম্মদ(সঃ) এর বয়স যখন ছয় তখন মা আমিনা তার স্বামীর কবর যিয়ারতের মনস্থির করল। শ্বশুর আব্দুল মুতালিব আর বারাকাহ দুজনেই তাকে নিরুৎসাহিত করতে চাইল এব্যাপারে। কিন্তু কোনভাবেই নিরুৎসাহিত করা গেল না আমিনাকে। সুতরাং একদিন সকালে বড় একটি উটে চড়ে সিরিয়া-গামী মরুযাত্রীদের সাথে আমিনা বারাকাহ ও শিশু মুহাম্মদ (সঃ) কে সাথে নিয়ে ইয়াত্রিবের উদ্দ্যশ্যে রওনা দিল। ব্যাপারটা জানলে শিশু মুহাম্মদ(সঃ) মানসিকভাবে ভেঙ্গে পরতে পারে তাই তারা যে তার বাবার কবর যিয়ারত করতে যাচ্ছিল সেটা মুহাম্মদ(সঃ) কে জানানো হয়নি তখন”।

 

তাদের কাফেলাতি বেশ দ্রুতই আগাচ্ছিল। বারাকাহ আমিনাকে অন্ততপক্ষে তার সন্তানের স্বার্থে হলেও শান্ত থাকতে বলছিল বারবার। আর এদিকে শিশু মুহাম্মদ(সঃ) যাত্রার প্রায় পুরো সময় জুড়েই বারাকার গলা জড়িয়ে কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়েছিল।

 

ইয়াত্রিব পৌছাতে প্রায় দশদিনের মত লেগেছিল তাদের। প্রতিদিন আব্দুল্লাহর কবরে যাবার সময় আমিনা শিশু মুহাম্মদ(সঃ) কে তার বানু নাজ্জার গোত্রীয় ভাইদের কাছে রেখে যেতেন। এভাবে প্রায় কয়েক সপ্তাহ যাবত প্রতিদিন আমিনা আব্দুল্লাহর কবরে যেতেন। এসময় আমিনা আরও বেশি শোকার্ত হয়ে পড়েছিল।

 

এরপর মক্কা ফেরার পথে আমিনা মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়ল হঠাৎ। মক্কা আর ইয়াত্রিবের মাঝামাঝি আল-আবওয়া নামক একটা জায়গায় যাত্রা-বিরতি করতে বাধ্য হল তারা। আমিনার অবস্থা আরও বেশি খারাপ হতে লাগল। এক অমাবস্যার রাতে, তার জ্বর মারাত্মক রকম বেড়ে গেল। এমন সময় আমিনা বারাকাহকে কাছে ডেকে কান্না-বিজড়িত কণ্ঠে কানে কানে বললেনঃ “বারাকাহ, আমি তো আর বেশিক্ষণ বাঁচব না। আমি আমার সন্তান মুহাম্মদ (সঃ) কে তোমার দায়িত্বে দিয়ে গেলাম। পেটে থাকা অবস্থায় বাবাকে হারিয়েছে সে। আর এখন তার চোখের সামনেই তার মাকে হারাতে যাচ্ছে সে। তার মা হয়েই থেকো তুমি, বারাকাহ। কখনোই ছেড়ে যেওনা তাকে তুমি”।

 

“কথাটা শোনামাত্র হৃদয় ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেল আমার, কান্না আর ধরে রাখতে পারলাম না আমি। আমার কান্না দেখে শিশু মুহাম্মদ(সঃ)ও কাঁদা শুরু করল। কাঁদতে কাঁদতে তার মায়ের বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল সে; জড়িয়ে ধরল তাকে গলায়। আমিনা শেষবারের মত আর্তনাদ করে উঠল একবার। তারপর আর কোন সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না তার… সারাজীবনের জন্যই নীরব হয়ে গেল সে”।

 

বারাকার কান্না থামল না আর। কাঁদতেই থাকল সে অঝোর ধারায়। ধূধূ মরুর বুকে নিজ হাতেই কবর খুঁড়ল সে। আর নিজ হাতেই প্রিয় আমিনাকে দাফন করল সে। বারাকার চোখের জলে ভিজল আমিনার কবর। মা-বাবা হারানো এতিম শিশু মুহাম্মদ(সঃ) কে নিয়ে দাফন শেষে মক্কায় তার দাদা আব্দুল মুতালিবের কাছে ফিরল সে। শিশু মুহাম্মদ (সঃ) কে দেখাশুনা করবার জন্য সেও তাদের সাথে থেকে গেল। এর দুই বছর পর দাদা আব্দুল মুতালিবও যখন মারা গেল তখন সে চাচা আবু তালিবের বাসায় শিশু মুহাম্মদ(সঃ) দেখাশুনা করতে লাগল। এভাবে মুহাম্মদ(সঃ) বড় হওয়া এবং খাদিজার সাথে তার বিয়ে পর্যন্ত আমাদের প্রিয় নবীর সেবায় নিয়োজিত ছিলেন বারাকাহ।

 

খাদিজার সাথে বিয়ের পর মুহাম্মদ(সঃ) একদিন বারাকাহকে ডেকে বললেন, “ইয়া উম্মাহ! ( বারাকাহকে তিনি ‘মা’ বলেই সম্বোধন করতেন সবসময়) এখন তো বিবাহিত আমি, আর বিয়েই করেননি আপনি এখনো…কেউ যদি এখন বিয়ে করতে চায় আপনাকে…?” বারাকাহ মুহাম্মদ(সঃ) এর দিকে এক পলক তাকাল আর বলল, “তোমাকে ছেড়ে কখনোই যাবনা আমি। মা কি তার ছেলেকে ছেড়ে যেতে পারে কখনো?” মুহাম্মদ(সঃ) মৃদু হাসলেন আর বারাকাহর কপালে চুমু খেলেন। আর স্ত্রী খাদিজার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ দেখ, এটাই হল বারাকাহ। আমার নিজের মায়ের পরে ইনিই আমার মা, আমার পরিবার”।

 

তখন খাদিজা বলল, “বারাকাহ, আপনি আপনার যৌবন বিসর্জন দিয়েছেন আপনার প্রিয় মুহাম্মদ(সঃ) এর জন্য। সে আপনার প্রতি তার দায়িত্ব সম্পাদন করতে চাচ্ছে। তাই আমার আর আপনার প্রিয় মুহাম্মদ(সঃ) এর স্বার্থে বৃদ্ধ হয়ে যাবার আগেই এই বিয়েতে রাজি হয়ে যান আপনি”।

 

বারাকাহ বলল, “কে আমাকে বিয়ে করবে, খাদিজা?” “ ওই যে… ইয়াত্রিবের খাযরায গোত্রের উবাইদ ঈবনে যায়েদ আমাদের কাছে এসেছিল আপনার বিয়ের ব্যাপারে। দয়া করে না বলবেন না ”।

 

বারাকাহ রাজি হয়ে গেল। বিয়ের পর উবাইদ ঈবনে যায়েদের সাথে ইয়াত্রিব চলে গেল সে। সেখানে তাদের সন্তান ও হয়েছিল একটি। যার নাম ছিল আইমান। এরপর থেকে লোকে তাকে ‘উম্মে আইমান’ অর্থাৎ আইমানের মা বলেই ডাকত।

 

তার বিয়ে অবশ্য বেশিদিন ঠেকেনি। হঠাৎ স্বামী মারা গেল তার। আবার সে মক্কায় ফিরে এলো, তার ‘ছেলে’ মুহাম্মদ (সঃ) এর কাছে। তখন মুহাম্মদ(সঃ) ও খাদিজার সাথে আলী বিন আবু তালিব, খাদিজার প্রথম স্বামীর কন্যা হিন্দ, আর যায়েদ বিন হারিথাহও থাকত।

 

যায়েদ ছিল আরবের কাল্‌ব গোত্রের লোক। যাকে তার ছেলেবেলায় মক্কায় দাস হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল। তখন খাদিজার ভাইপো কিনে নিয়েছিল তাকে খাদিজার সেবা করার জন্য। খাদিজার গৃহে যায়েদ মুহাম্মদ(সঃ) এর সংস্পর্শে আসার পর তার সেবায় নিয়োজিত করল নিজেকে সে। তাদের দুজনের সম্পর্ক ছিল বাবা-ছেলের মতই। সম্পর্কটা এতই সুন্দর ছিল যে যায়েদের বাবা যখন তার ছেলে খোঁজে মক্কায় আসল একদিন তখন মুহাম্মদ(সঃ) যায়েদকে বললেন, তুমি স্বাধীন, ইচ্ছা হলে আমার সাথে থাকতে পার তুমি অথবা তোমার বাবার সাথে চলে যেতে পার। তখন যায়েদ তার বাবাকে বললঃ

 

“উনাকে [মুহাম্মদ(সঃ) কে] ছেড়ে কখনোই যাবনা আমি। একজন বাবা তার সন্তানকে আদর করেন যেভাবে তার চেয়েও বেশি আদর করেছেন তিনি আমাকে। তিনি এত ভালবাসতেন আমাকে যে একদিনের জন্যও মনে হয়নি আমার যে আমি তার চাকর। তিনি হল সৃষ্টির সেরা মানব। তাকে ছেড়ে কি করে আমি আপনার সাথে যাব?…তাকে ছেড়ে কখনোই যাব না আমি!”

 

মুহাম্মদ(সঃ) পরে প্রকাশ্যে মুক্ত ঘোষণা করেছিলেন যায়েদকে। কিন্তু তারপরও যায়েদ উনাকে ছেড়ে যায়নি। বরং তার সাথে থেকে তার সেবায় আরও বেশি মনোনিবেশ করেছিল সে।

 

পরে মুহাম্মদ(সঃ) যখন নবুয়ত প্রাপ্ত হলেন, তাতে প্রথম বিশ্বাস স্থাপনকারীদের মধ্যে যায়েদ এবং বারাকাহ ছিল অন্যতম। প্রথম মুসলিম হিসেবে কুরাইশদের অমানুষিক নির্যাতনও সহ্য করতে হয়েছিল তাদের।

 

নবী করিম(সঃ) এর ইসলাম প্রচারের মিশনে তাদের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। সেসময় ইসলামের বিরুদ্ধে মুশরিকদের ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনা সম্পর্কে গোপনে তথ্য সংগ্রহের জন্য নিজেদের জীবন পর্যন্ত বাজি রেখেছিল তারা।

 

এক রাতে মুশরিকরা যখন আল-আরকাম [যে গৃহে নবী করিম(সঃ) তার সাহাবীদের ইসলামের শিক্ষা দিতেন] যাবার পথ অবরোধ করে বসল, বারাকাহ সেই অবরোধের মধ্যেই তার জীবন বাজি রেখে খাদিজার পাঠানো গোপন বার্তা নিয়ে আল-আরকামে নবী(সঃ) এর কাছে এসে হাজির হয়েছিলেন। যখন তিনি মুহাম্মদ(সঃ) এর কাছে এসে খবরটা জানালেন, তখন নবী করিম(সঃ) মৃদু হেসে বললেনঃ

 

“আপনি অনেক ভাগ্যবতী, উম্মে আইমান। নিঃসন্দেহে জান্নাতের অধিবাসী হবেন আপনি”। উম্মে আইমান সেখান থেকে চলে যাবার পর নবী করিম(সঃ) তার সাহাবীদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমাদের মাঝে কেউ যদি জান্নাতি কোন মহিলাকে বিয়ে করবার ইচ্ছা পোষণ কর তবে তার উচিত উম্মে আইমানকে বিয়ে করা”।

 

এই কথা শুনার পর সব সাহাবীরাই নীরব হয়ে গেলেন হঠাৎ। কোন সাড়া পাওয়া গেল না কারো কাছ থেকে। কেননা উম্মে আইমান না ছিলেন সুন্দরী না ছিলেন আকর্ষণীয়। বয়স ইতিমধ্যেই পঞ্চাশের কাছাকাছি হয়ে গেছে তার, দেখতেও বৃদ্ধ বৃদ্ধ লাগত তাকে। কিন্তু যায়েদ ইবনে হারিথাহ এগিয়ে এসে বললঃ

 

“হে আল্লাহ্‌র নবী, আমিই বিয়ে করব উম্মে আইমান কে। আল্লাহ্‌র কসম, সুন্দরী রূপবতী মহিলাদের চাইতে তিনিই উত্তম”।

 

এরপর যথারীতি বিয়ে হয়ে গেল তাদের দুজনের। একটা সন্তানও জন্ম নিয়েছিল তাদের সংসারে। তার নাম ছিল ঊসামা। উসামাকে নিজের সন্তানের মতই ভালবাসতেন নবী করিম(সঃ)। তিনি প্রায়সময়ই খেলাধুলা করতেন তার সাথে,আদর করতেন তাকে চুমু দিয়ে আর খাইয়ে দিতেন তাকে নিজ হাতে। একারণে মুসলিমরা ‘প্রিয় নবীর প্রিয় সন্তান’ হিসেবেই জানত তাকে। অল্প বয়স থেকেই উসামা নিজেকে ইসলামের খেদমতে নিয়োজিত করেন। পরে নবী করিম(সঃ) ইসলামের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব অর্পণ করেন তার উপর।

 

পরে নবী করিম(সঃ) যখন ইয়াত্রিবে (মদীনায়) হিজরত করলেন তখন তিনি উম্মে আইমান কে রেখে গিয়েছিলেন মক্কায় তার ঘরের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ দেখাশুনা করবার জন্য। পরবর্তীতে উম্মে আইমান একা একায় ‘পুত্র’ মুহাম্মদ(সঃ) এর কাছে মদীনায় গিয়ে হাজির হয়েছিলেন। উঁচু পর্বত আর উত্তপ্ত বালি আর মরুঝড় পাড়ি দিয়ে এই কঠিন দীর্ঘ পথ অতিক্রমের কাজটি একা পায়ে হেটেই সম্পন্ন করেছিলেন তিনি। শেষপর্যন্ত মদীনায় যখন পৌঁছালেন তিনি তখন তার মুখমণ্ডল ও শরীর ছিল ধুলো আবৃত, ফোসকা পড়ে পা গিয়েছিল ছিঁড়ে আর ফুলে। এত কিছুর পরও তার সেই কঠিন যাত্রাটিকে একমাত্র সম্ভব করে তুলেছিল ‘পুত্র’ মুহাম্মদ(সঃ) এর প্রতি তার অপরিসীম মমতা ও ভালবাসা।

 

হঠাৎ তাকে দেখতে পেয়ে বিস্ময়ে নবী করীম(সঃ) বললেন , “ইয়া উম্মে আইমান! ইয়া উম্মি! ( ও উম্মে আইমান! ও আমার মা!) নিঃসন্দেহে আপনি জান্নাতবাসী”। তারপর পরম মমতায় তার চোখ মুখে নিজের কোমলখানা হাত বুলিয়ে, পা টিপে দিয়ে, কাঁদে দুহাত রেখে আদর করে দিলেন তাকে তিনি।

 

উম্মে আইমান মদীনায় গিয়েও ইসলামের সেবায় পরিপূর্ণভাবে সমর্পণ করেন নিজেকে তিনি। উহুদের যুদ্ধে তৃষ্ণার্তদের মাঝে পানি বিতরণ করেন তিনি এবং আহত সৈনিকদের সেবা শুশ্রূষা করেন। খাইবার ও হুনাইনের মত বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অভিযানেও নবী করিম(সঃ) এর পাশে ছিলেন তিনি।

 

রসূল (সঃ) এর প্রিয় সাহাবী বারাকাহর পুত্র আইমান হিজরি অষ্টম বর্ষে হুনাইনের যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন। তার স্বামী যায়েদও মুতাহ’র যুদ্ধে শহীদ হন। ইতিমধ্যে বারাকাহর বয়স সত্তরের কাছাকাছি হয়ে গিয়েছিল। বার্ধক্যের কারণে বেশীরভাগ সময় ঘরে বসেই কাটাতে হত তার। আবু বকর আর উমর কে সাথে নিয়ে নবী করিম(সঃ) প্রায়সময় তাকে দেখতে যেতেন এবং জিজ্ঞাস করতেন, “ইয়া উম্মি! (ও আমার মা!) কেমন আছেন আপনি?” প্রত্যুত্তরে তিনি বলতেন, “ হে আল্লাহ্‌র নবী, ইসলাম যতক্ষণ ভাল, আমিও ভাল ততক্ষণ”।

 

নবী করিম(সঃ) এর ইন্তেকালের পর প্রায়সময়ই কাঁদতে দেখা যেত বারাকাহকে। তাকে যখন একবার জিজ্ঞাস করা হয়েছিল, “কেন কাঁদছেন এত আপনি?” তিনি বলেছিলেন, “আল্লাহর কসম, নবী(সঃ) যে ইন্তেকাল করবেন তা আমি জানতাম, কিন্তু আমি একারণে কাঁদি যে তার মৃত্যুর পর আমাদের প্রতি আল্লাহ্‌র ওহী নাযিল হবেনা কখনোই আর”।

 

বারাকাহই হল একমাত্র ব্যক্তি/ মহিলা যে কিনা মুহাম্মদ(সঃ) এর জন্ম থেকে শুরু করে ইন্তেকাল পর্যন্ত পাশে ছিলেন তার। মুহাম্মদ(সঃ) এর পরিবারের প্রতি নিঃস্বার্থ ভালবাসা ও শ্রম দিয়ে গেছেন সারাজীবন তিনি। নিয়োজিত ছিলেন প্রিয় নবী মুহাম্মদ(সঃ) এর সেবায়। সর্বোপরি ইসলামের ক্রান্তি-লগ্নে, ইসলামের আবির্ভাবের সময়ে ইসলামের প্রতি তার অবদান ছিল অনস্বীকার্য। পরবর্তীতে হযরত উসমানের খিলাফতের সময় মৃত্যুবরণ করেন তিনি।

 

যদিও কিনা তার বংশ পরিচয় নিয়ে নিশ্চিত হতে পারিনি আজও আমরা, সে যে জান্নাতের অধিবাসী হবে সে ব্যাপারে পুরাপুরি নিশ্চিত আজ আমরা। আল্লাহ্‌ এভাবেই সৎকাজের প্রতিদান দেন!!

 

ধৈর্য সহকারে পড়ার জন্য ধন্যবাদ। জাযাকাল্লাহু খাইরান

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!